Tuesday, February 28, 2012

মধুসূদন, মাতৃভূমি ও মাতৃভাষা

মধুসূদন, মাতৃভূমি ও মাতৃভাষা

মধুসূদন, মাতৃভূমি ও মাতৃভাষা


ফজলুল হক সৈকত

বাংলা সাহিত্যের প্রথম সফল আধুনিক কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত (জন্ম : ২৫ জানুয়ারি ১৮২৪; মৃত্যু : ২৯ জুন ১৮৭৩)। কবিতার বিষয় ও শৈলীতে তিনি বৈপ্লবিক পরিবর্তন সূচনাকারী। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য ধারণার ভারতীয় সংস্করণ, দেশমাতার প্রতি অমিত ভালোবাসা, মহাকাব্য রচনা, অমিত্রাক্ষর ছন্দ সৃষ্টি ও তার যথার্থ প্রয়োগ, সনেট রচনা, পত্রকাব্য রচনা প্রভৃতি বিষয়ে তাঁর চিন্তার প্রতিফলন এবং সৃজন-প্রয়াস বাংলা সাহিত্যভাণ্ডারকে দান করেছে অভূতপূর্ব মর্যাদা ও সৌন্দর্য। এছাড়া বাংলা সাহিত্যে প্রথম সফল ঐতিহাসিক ও ট্র্যাজেডি নাটক এবং প্রথম মঞ্চসফল নাটক রচনার জন্যও তিনি সবিশেষ পরিচিত। তাঁর মেঘনাদবধ কাব্য বাংলা সাহিত্যের প্রথম এবং এক অর্থে একমাত্র মহাকাব্যের মর্যাদায় আসীন; বাংলা ভাষায় সনেট সৃষ্টি ও পরিচর্যায় এখনও পর্যন্ত মধুসূদন অবিকল্প ব্যক্তিত্ব! পত্রকাব্য রচনায়ও তিনি দেখিয়েছেন পথপ্রদর্শকের প্রণোদনা।

মধুসূদনের জন্ম বাংলার ইতিহাসের এক যুগসন্ধিক্ষণে। উনিশ শতকের শুরুতে এ ভূখণ্ডে ঘটে নানান পরিবর্তন; বাংলার নবজাগরণের সে এক বিরাট শুভসময়! ইউরোপ-আমেরিকার শিক্ষা-সভ্যতা-সংস্কৃতি-ধর্ম-দর্শন-মানবতা-ইতিহাস প্রভৃতির প্রভাব ভারতবাসীর জীবনে সামগ্রিকভাবে আমূল পরিবর্তনের আবহাওয়া প্রবাহিত করল। আত্মমুক্তির আবাহন আর সংস্কারমুক্তির চিন্তা তখন ভারতকে আন্দোলিত করেছিল। মধুসূদন সে জলবাতাসে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন; সেসব প্রবণতা আত্মস্থ করেছিলেন বেশ দ্রুত। এছাড়া উনিশশতকি দেশপ্রেম আর স্বাধীনতা স্পৃহাও তাঁকে আকৃষ্ট করেছিল প্রবলভাবে।

ইউরোপের প্রতি মাইকেল মদুসূদন দত্তের প্রবল এবং আপাত অস্বাভাবিক ঝোঁক পরিলক্ষিত হয়েছে; তিনি যে-কোনো উপায়ে এশিয়া পরিত্যাগ করার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছিলেন। অবশ্য তাঁর এ মানসিক অবস্থার পেছনে ক্রিয়াশীল ছিল সাহিত্যশিল্প চর্চায় ইউরোপের সামাজিক-রাষ্ট্রীয় অনুকূল আবহাওয়া। ইংরেজি ভাষাদক্ষতা ছিল মাইকেলের বিশেষ যোগ্যতা। অল্পবয়সে, কলেজে পড়ার সময়ে এ বৈশিষ্ট্যের কারণে তিনি পরিচিত ও পণ্ডিতজনদের মনোযোগ আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছিলেন। কলকালা বেলগাছিয়া নাট্যশালার জন্য রামনারায়ণ তর্করত্নর রত্নবতী নাটকটি ইংরেজিতে অনুবাদ করে তিনি সবিশেষ প্রশংসা কুড়িয়েছিলেন। অনেকে মনে করেন, বিশেষত ইংল্যান্ডপ্রীতির কারণেই কবি মধুসূদন ধর্মান্তরিত হয়ে খ্রিস্টানধর্মে দীক্ষা নিয়েছিলেন; বিয়েও করেছিলেন খ্রিস্টান নারীকে। ধর্ম পরিবর্তন করে তিনি নামের আগে মাইকেল শব্দটি যুক্ত করেন। আসলে ভারতের গণ্ডি পেরিয়ে সারা পৃথিবীর শিল্পভুবনে নিজেকে হাজির করা এবং খ্যাতি অর্জনের নেশা আচ্ছন্ন করে ফেলেছিল এই বাঙালি নাট্যকার-কবি শ্রী মধুসূদন দত্তকে। তিনি গ্রিক, ল্যাটিন, হিব্রু, সংস্কৃত, তেলেগু, ফরাসি, জার্মান, ইতালীয় ভাষাও শিখেছিলেন এবং পাশ্চাত্য চিরায়ত সাহিত্য অধ্যয়ন করেছিলেন। মধুসূদনের যখন জন্ম, তখন ভারতে সরকারি কাজকর্মের ভাষা ছিলো ফারসি। ১৮৩৫ খিস্টাব্দ থেকে আদালত এবং সরকারি কাজকর্মের ভাষা হিসেবে চালু হয় ইংরেজি। তখন স্বাভাবিকভাবেই ইংরেজি শেখার চাহিদা বাড়তে লাগলো! এই সহজ সত্যটি, মধুসূদনের সাহিত্যপাঠের সময়, আমাদের মনে রাখা প্রয়োজন।

তাঁর রচিত সাহিত্য: নাটক : শর্মিষ্ঠা, পদ্মাবতী, একেই কি বলে সভ্যতা, বুড় শালিকের ঘাড়ে রোঁ, মায়াকানন; কাব্যনাট্য : রিজিয়া (অসমাপ্ত) মহাকাব্য: মেঘনাদবধ কাব্য; কবিতাগ্রন্থ : তিলোত্তমাসম্ভব কাব্য, ব্রজাঙ্গনা, বীরাঙ্গনা, চতুর্দশপদী কবিতাবলী। এছাড়া তিনি ইংরেজিতে গ্রন্থ রচনা করেছেন। মাদ্রাজে থাকাকালে একটি পত্রিকাও সম্পাদনা করেছেন তিনি। তাঁর প্রথম কাব্য ক্যাপটিভ লেডি; গ্রন্থটি বাজারসাফল্য বা পাঠকপ্রিয়তা পায়নি।

১৮৪২ সালে বিলেতের পত্রিকায় প্রকাশের জন্য কবিতা পাঠানোর আগেই কলকাতার পত্রিকায় তাঁর কবিতা ছাপা হয়েছিল; অবশ্য সেগুলোতে বায়রন-শেলি-ওয়ার্ডসওয়ার্থ-রিচার্ডসন-কিটসের প্রভাবে রোমান্টিক ভাবধারাই প্রকাশ পেয়েছিল; পাশ্চাত্যপ্রেম আর নীলনয়না নারীর প্রতি আকর্ষণই ছিল তাঁর তখনকার সৃজন-কল্পনার মূল ভিত্তি!

১৮৪৬ সালের পর, মাদ্রাজে থাকাকালে (একটি বিদ্যালয়ের সহকারী প্রধান শিক্ষক হিসেবে চাকরিসূত্রে; অবশ্য ওই বিদ্যাপীঠে কোনো প্রধান শিক্ষক ছিলেন না এবং পদও ছিল মাত্র একটি) প্রচণ্ড পরিশ্রম করেছেন বিভিন্ন ভাষা ও সাহিত্য অধ্যয়নে।

বাংলাকে উপেক্ষা করে সে সময় তিনি ইংরেজিতে সাহিত্যচর্চার যে প্রয়াস চালিয়েছিলেন, তা যে পরবর্তীকালে ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে- সে কথা তিনি এবং তাঁর পাঠক আজ ভালোভাবেই অবগত! ইংল্যান্ড যাবার পথে তাঁর স্বপ্নের দেশের কাছাকাছি পৌঁছে যাবার আবেগময় অনুভূতির কথা আমরা জানতে পারি বন্ধু গৌরদাসকে লেখা চিঠি থেকে। কবি লিখছেন: “হে আমার প্রিয় ও পুরনো বন্ধু। আমি সীলোন নামক একটা জাহাজে চলেছি। এখন তোমাকে কয়েক ছত্র লিখব বুঝলে বৎস!... এ মুহূর্তে আমি ভেসে যাচ্ছি বিখ্যাত সেই ভূমধ্যসাগরের মাঝ দিয়ে, এখান থেকে উত্তর আফ্রিকার পর্বতাকীর্ণ উপকূল দেখা যায়। গতকাল ছিলাম মলটায়, গত রোববারে আলেকজান্দ্রিয়ায়। আর মাত্র কয়েকদিনের ভেতরেই ইংল্যান্ডে পৌঁছে যাব আশা করি। আজ থেকে বাইশ দিন আগে আমি কলকাতায় ছিলাম। বেশ দ্রুতগতিতেই আমরা চলেছি কী বল? কিন্তু এ ভ্রমণের একটা দুঃখজনক বিষয়ও রয়েছে। সব জানতে পারবে, ধৈর্য ধারণ কর ধৈর্য, বন্ধু।”

মধুসূদন বাংলায় সনেট লেখার আগে ইংরেজিতে আঠারোটি সনেট রচনা করেছেন। তিনি অবশ্য ভার্সাই থেকে গৌরদাসকে লেখা এক চিঠিতে সনেট রচনায় পেত্রার্ককে অনুসরণ করবেন বলে জানিয়েছিলেন। ১৮৬৫ সালে লেখা একটি চিঠির কিছু অংশ তুলে ধরছি :
‌‌‌‌I have been lately reading petrarca- the Italian poet, and scribbling some sennets after his manner. There is one addressed to this very river [কপোতাক্ষ নদ]... I hope to come out what you all think of this new style of poetry.

১৮৬০ খ্রিস্টাব্দে কবি মধুসূদন বন্ধু রাজনারায়ণ বসুকে একটি চিঠিতে জানিয়েছিলেন যে, তিনি বাংলা ভাষায় সনেট রচনা আরম্ভ করেছেন এবং কবি-মাতৃভাষা নামে একটি সনেট লেখার কাজ সমাপ্ত করেছেন। পরবর্তীকালে ওই সনেটটি বঙ্গভাষা নামে তাঁর “চতুর্দশপদী কবিতাবলী” গ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত হয়। বঙ্গভাষা বাংলা সাহিত্যের প্রথম সনেট। কবিতাটির বিষয়ভাবনা এবং পরিবেশনশৈলী মার্জিত-পরিশীলিত ও সংহত। ভুলের জন্য মনোবেদনা এবং ধারাপরিবর্তন করে সিদ্ধি অর্জনের পরিতৃপ্তি কবিতাটির মূল কথা! চতুর্দশপদী কবিতা লিখতে গিয়ে মধুসূদন ইতালির কবি জগৎখ্যাত সনেট-রচয়িতা পেত্রার্ক এবং ইংরেজ কবি মিল্টনের কলাকৃতি বিশেষভাবে অনুসরণ করেছেন। বঙ্গভাষা কবিতার শুরুতে লেখকের মানসিক বেদনাবোধ আর আত্ম-উপলব্ধির বিবরণ সাজানো হয়েছে এভাবে :
হে বঙ্গ, ভাণ্ডারে তব বিবিধ রতন;-
তা সবে, (অবোধ আমি!) অবহেলা করি,
পর-ধন-লোভে মত্ত, করিণু ভ্রমণ
পরদেশে, ভিক্ষাবৃত্তি কুক্ষণে আচরি।
কাটাইনু বহু দিন সুখ পরিহরি!
অনিদ্রায়, অনাহারে সঁপি কায়, মনঃ,
মজিনু বিফল তপে অবরণ্যে বরি;-
কেলিনু শৈবালে, ভুলি কমল-কানন! [বঙ্গভাষা]

কবি বঙ্গ বলতে বাংলা ভাষাকে বুঝিয়েছেন; তিনি বুঝতে পেরেছিলেন বাংলা ভাষায় রচিত সাহিত্য-ভাণ্ডার অত্যন্ত বৈচিত্র্যময় এবং উৎকর্ষমণ্ডিত। তবে তিনি নির্বোধের মতো অন্যের ভাষা-সাহিত্য আয়ত্ত করার এবং তার অনুকরণে সৃজনচর্চার আকাঙ্ক্ষা মনে পোষণ করেছিলেন। একবার বলেছিলেন : It is the language of fishermen, unless you import largely from Sanskrit । আর তখন থেকেই তাঁকে আঁকড়ে ধরে ইংরেজিপ্রীতি; এই যে পরের চিন্তাভাণ্ডরের মোহে আকৃষ্ট হবার প্রবণতা- একে তিনি পরের ধনের প্রতি লোভমত্ততা বলে অভিহিত করেছেন! নিজের ভাষা বাংলাকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করার শৈল্পিক প্রকাশ তিনিই প্রথম প্রদর্শন করেছিলেন; আজও আমরা হয়তো অনেকেই মাতৃভাষাকে যর্থার্থ মর্যাদা দেই না, কিন্তু তা তেমনভাবে অর্থাৎ দালিলিকভাবে ব্যক্ত করার প্রবণতা খুব কম লোকেরই রয়েছে! কিন্তু মধুসূদন সে কাজটি করেছেন নিঃসঙ্কোচে এবং তাঁর জন্য নিজেকে নির্বোধও ভেবেছেন বিনা দ্বিধায়! এই বৈশিষ্ট্যটি তাঁর সারল্যকে, মহত্ত্বকে প্রকাশ করে। কবিতাটিতে খুব স্পষ্টত কবির ব্যক্তিজীবনের প্রভাব পড়েছে। কবি মধুসূদন সাহিত্যসাধনার সূচনাই করেছিলেন ইংরেজি ভাষায়; পরে সে পথ পরিবর্তন করে বাংলা ভাষা মাধ্যমে শিল্পচর্চায় মনোনিবেশ করেন। এক সময় তিনি অনুধাবন করেছেন, অন্যের ভাষায় সাহিত্যসাধনা করা কিংবা কল্পনারাজি বিকাশের পথ অন্বেষণ করা এক ধরনের ভিক্ষাবৃত্তিমাত্র! মাতৃভাষার মাহাত্ম্যকে অবহেলা করার অপরাধে নিজেকে অপরাধী মেনেছেন তিনি; অনুশোচনায় কাতরও হয়েছেন! তিনি বুঝতে সক্ষম হয়েছিলেন যে, মাতৃভাষা ভিন্ন অন্য ভাষায় চিন্তার প্রকাশ ও বিকাশ দুরুহও বটে; এবং সে অভিপ্রায় অনভিপ্রেত, অশুভ এবং অগ্রহণযোগ্য! একে তিনি অভিহিত করেছেন অবরেণ্য বলে। বিভিন্ন ভাষায় দখল অর্জনকারী এই সাহিত্যিক এই সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পেরেছিলেন, মাতৃভাষার চেয়ে বড়ো কিছু হতে পারে না।

মাতৃভাষায় শিল্পসাধনার প্রেরণাদাত্রীকে কবি মধুসূদন কূললক্ষ্মী বলে বিবেচনা করেছেন; তাঁর ধারণা শিল্পী-সাহিত্যিকরা ওই অধিষ্ঠাত্রী দেবীর নির্দেশে বা অনুকম্পায় অথবা স্বপ্নাদেশবলে সৃজনশীল প্রতিভার প্রকাশ ঘটাতে সক্ষম হন। তাঁর ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম হয়নি বলেই কবির বিশ্বাস! বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস এবং ঐতিহ্য যে ভাবসম্পদ এবং স্মরণীয় ব্যক্তিত্বে সমৃদ্ধ, তা মধুকবির বুঝতে অসুবিধা হয়নি; রত্নরাজিতে পরিপূর্ণ বাংলাভাষার অমর সব কীর্তি এবং অসাধারণ সব প্রতিভার কথা মনে করেছেন- চর্চাপদ-শ্রীকৃষ্ণকীর্তনকাব্য-মঙ্গলকাব্য-মহাভারত-রামায়ণ-মেঘদূত-গীতগোবিন্দ আর এসবের রচয়িতারা তো আমাদের বাংলা ভাষারই অমূল্য সম্পদ!
স্বপ্নে তব কুললক্ষ্মী কয়ে দিলা পরে,-
“ওরে বাছা, মাতৃকোষে রতনের রাজি,
এ ভিখারী-দশা তবে কেন তোর আজি?
যা ফিরি, অজ্ঞান তুই, যা রে ফিরি ঘরে।”
পালিলাম আজ্ঞা সুখে; পাইলাম কালে
মাতৃভাষা-রূপ খনি পূর্ণ মণিজালে॥ [বঙ্গভাষা]

মধুসূদনের কোনো কোনো পাঠক-সমালোচক এমন ধারণা পোষণ করেন যে, মধুকবিকে তাঁর সমূহ আবেগ-উপলব্ধিসহ ধরতে চাইলে অবশ্যই সনেটকে অবলম্বন করতে হবে। তাঁদের চিন্তায় মাইকেলের কবিতা-নির্মাণকৌশল, জগৎ-জীবন সম্বন্ধে তাঁর অনুভব, বাংলাদেশের [তৎকালীন ভারতবর্ষ] প্রকৃতির মনোরম শোভা, এ মাটির সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের বিস্তৃত চেতনা, তাঁর সৃষ্টির বিষয়-বৈচিত্র্য, গীতিসুষমা এবং আত্মভাবনিষ্ঠা- এ সবকিছুর সরল সাক্ষাৎ মিলবে কবির এসব কবিতায়। প্রকৃত অর্থে সনেটকে তিনি কেবল মানবিক প্রেম বা দেশপ্রেমের বিবরণভূমি না বানিয়ে বহুভাবসম্পদের বিচরণত্রে হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন!

মাইকেল তাঁর কাব্যপ্রেরণায় অনুভব করেছেন পূর্বসূরি বাল্মিকী-কাশিরাম-কালিদাসের চেতনা আর ভারতীয় পুরাণের অনুপ্রেরণা; তাঁর ভাবনায় কবি যেন আনন্দ-আসরে কোনো বন্দি, যে কিনা শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছে পূর্বপুরুষ কিংবা পূর্বমহিলার যাবতীয় অর্জনের গৌরব! আর তাই হয়তো তিনি ভিনদেশী কবিতাকানন থেকে উপকরণ ও কৌশল ধার করে আপন সংস্কৃতির আলোয়ে সাজাতে সক্ষম হয়েছেন অভিনব কবিতামালা। কবিতা রচনা আর কাব্যের স্বাদ আস্বাদনে চিত্তের প্রসন্নতাকে গুরুত্বপূর্ণ বলে মেনেছেন কবি মধুসূদন। তিনি কল্পনাপ্রবণতাকেও মান্য করেছেন। যেমন লিখছেন : “কমলে কামিনী আমি হেরিনু স্বপনে/কালিদহে।” সুখ-দুঃখের সম্মিলনে কবিতার ক্যানভাস নির্মাণের পক্ষপাতী ছিলেন তিনি। “কি দুখে, হে পাখি, তুমি শাখার উপরে/বসি, বউ কথা কও, কও এ কাননে?”

অন্যত্র লিখেছেন:
কে না জানে কবি-কুল প্রেম-দাস ভবে,
কুসুমের দাস যথা মারুত, সুন্দরি,
ভাল যে বাসিব আমি, এ বিষয়ে তবে
এ বৃথা সংশয় কেন? [চতুর্দশপদী কবিতা : ১৪]

কবির কাজ হচ্ছে শব্দের সাথে শব্দের জোড়া দিয়ে অনিন্দ্য শোভা সৃষ্টি করা; পার্থিব সংসার-সাগরে সোনার কিরণ ছড়ানোও সম্ভবত কবিতার একটি দায়িত্ব- অন্তত মাইকেল এমনটি ভাবতে কৃপণতা বোধ করেন না। তাঁর কল্পনায় কবি এমন এক ব্যক্তি:
আনন্দ, আক্ষেপ, ক্রোধ, যার আজ্ঞা মানে
অরণ্যে কুসুম ফোটে যার ইচ্ছা বলে :
নন্দন-কানন হতে যে সুজন আনে
পারিজাত কুসুমের রম্য পরিমলে :
মরুভূমে- তুষ্ট হবে যাহার ধেয়ানে
বহে জলবতী নদী মৃদু কলকলে! [চতুর্দশপদী কবিতা : ১৬- কবি]

শিল্পের চর্চায় মধুসূদন মানেন “কবিতা-অমৃত-রসে”। দেশমাতা-পরিচিত ভুবন আর ফেলে-আসা দিনের-পথের রেখাকে কবিতায় আঁকতে ভালোবাসেন তিনি। শৈশব-কৈশোরের স্মৃতিবিজড়িত নদীর প্রতি মাইকেলের বিশেষ আকর্ষণের খবর আমরা পাই তাঁর কপোতাক্ষ নদ কবিতায়। তাঁর জন্মস্থান বাংলাদেশ আজ যখন নদীর বাঁচা-না-বাঁচা জটিলতায় আক্রান্ত, তখন তাঁর নদীর প্রতি মমতার কথা আমাদেরকে নতুন করে চিন্তার দরোজায় পৌঁছে দেয়। বর্তমানে একদিকে প্রতিবেশী ভারতের [অবশ্য মধুসূদনের সমকালে ভারত ছিল অখণ্ড; দেশবিভাগের ধারণাও ছিল কলাপনাতীত] ফারাক্কা বাঁধের মরণকামড় এবং টিপাইমুখ বাঁধের অমিত পরিকল্পনা, অন্যদিকে চীনের পানিবিষয়ক পররাষ্ট্রকৌশল বাংলাদেশের পানিস্থিতি এবং পানিপ্রবাহের জন্য মারাত্মক হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। নদীর জন্য মাইকেলের আকুলতা বাংলা সাহিত্যে একরকম প্রবাদ হয়ে উঠেছে। আজ কেবল মনে হতে পারে, তবে কি মধুসূদনের ভাবনার অতলে অনাগত দিনের নদীর কান্না লুকিয়ে ছিল; তিনি কি টের পেয়েছিলেন তাঁর দেশের নদীর ভবিষ্যৎ অসহায়তা। প্রবাসজীবনের যাতনা আর দেশমাতাকে ভালোবাসার অনন্য উদাহরণ তাঁর কপোতাক্ষ নদ কবিতাটি। কবি জানাচ্ছেন:
সতত, হে নদ, তুমি পড় মোর মনে।
সতত তোমার কথা ভাবি এ বিরলে;
সতত (যেমতি লোক নিশার স্বপনে
শোনে মায়া-যন্ত্রধ্বনি) তব কলকলে [কপোতাক্ষ নদ]
নদীর-শৈশবের প্রিয় বিচরণক্ষেত্রের দৃষ্টিসীমার বাইরে অবস্থান করে কবি স্মৃতির নরম রুমালের স্পর্শ পেতে চাইছেন; যেন কান পাতলে শুনতে পাচ্ছেন সেই চেনা কলকল ধ্বনি। পৃথিবীর বহুদেশের বহু নদ-নদী-সমুদ্র-মহ্সাগর পার করে জীবনের পরিভ্রমণকালে ক্লান্ত কবি অনুভব করছেন দেশের সেই ছোট্ট নদীটির জন্য মনোযন্ত্রণা; তার কাছে ফিরে যাবার জন্য কেমন যেন এক অবোধ্য তাড়না।

মাইকেল মধুসূদনের কাব্যভাবনায় আমরা দেখি দেশমাতার প্রতি অমিত শ্রদ্ধার বহির্প্রকাশ। তিনি বারবার তাঁর সেই আকুলতা ব্যক্ত করেছেন কবিতার কথামালায়। যেমন লিখেছেন :
আর কি হে হবে দেখা?- যত দিন যাবে,
প্রজারূপে রাজরূপ সাগরেরে দিতে
বারি-রূপ কর তুমি; এ মিনতি, গাবে
বঙ্গজ-জনের কানে, সখে, সখা-রীতে
নাম তার, এ প্রবাসে মজি প্রেম-ভাবে
লইছে যে তব নাম বঙ্গের সঙ্গীতে! [কপোতাক্ষ নদ]

জল-নদী-নদীতীর আর কূলের পারিপার্শ্বিকতায় মাইকেলের আকর্ষণ আমরা টের পাই তাঁর কাব্যভাবনার বিচিত্র অলিগলিতে; ধর্ম-আরাধনা অথবা সমকালীন সমাজ-সংকটের আড়ালে তিনি জলের বিচরণ-আনন্দে আচ্ছন্ন থেকেছেন চিন্তা আর স্বপ্নের দোলনাদোলায়! নদীর মমতায় মানুষের পরমার্থভাবনার সমন্বয়-অন্বেষাও আমরা পাঠ করি তাঁর কবিতাকথায়। কবি লিখছেন:
এ মন্দির-বৃন্দ হেথা কে নির্ন্মিল কবে?
কোন্ জন? কোন্ কালে? জিজ্ঞাসিব কারে?
কহ মোরে কহ তুমি কল কল রবে,
ভুলে যদি, কলোলিনি, না থাক লো তারে।
[নদী-তীরে প্রাচীন দ্বাদশ শিব-মন্দির]

“বৃথা ভাব, প্রবাহিণি, দেক ভাবি মনে।” কিংবা “হায়, গত, যথা বিম্ব তব চল জলে!” অথবা “রে দুরন্ত, নিরন্তর যেমত সাগরে/চলে জল, জীব-কুলে চালাস্ সে মত।” প্রভৃতি কথারাজিতে পাঠক বোধকরি সেই মধুকবিকে পেতে পারেন, যিনি কপোতাক্ষ নদের জন্য আকুলতায় নিমগ্ন হয়েছিলেন।

ভাষার প্রতি মধুসূদনের মমত্ববোধের আরেকটি নিদর্শন তাঁর “ভাষা” শীর্ষক কবিতা। ভাষাকে রূপময় মায়ের অধিক রূপবতী কন্যা হিসেবে বিবেচনা করে তিনি যে অভিনব চিন্তার প্রকাশ ঘটালেন, তা নিশ্চয়ই বাংলা কাব্যপরিসরে নতুনতর সংযোজন। বাঁশির সুরের মোহময়তা বা সময়ের সৌন্দর্যের লাভ-ক্ষতির বিবেচনার বাইরে ভাষার অপরূপতা কবিকে মুগ্ধ করেছিল, তা আমাদের বুঝতে অসুবিধা হয় না; ভাষার আলোক যেন তাঁর চোখে দেশমাতার আকাশে শোভমান চাঁদের লাবণ্য! তাঁর অভিমত- মূঢ় “সে, পণ্ডিতগণে তাহে নাহি গণি,
কহে যে, রূপসী তুমি নহ, লো সুন্দরি
ভাষা!- শত ধিক্ তারে!” [ভাষা]

দেশমাতা আর নিজভাষার প্রতি মাইকেলের শ্রদ্ধা আর ভালোবাসার পরিচয় পাওয়া যাবে তার বিভিন্ন কবিতায়। তাঁর স্বাজাত্যবোধক অনুভূতি ইতালীয় কবি ফিলিকেইয়ার কণ্ঠের সাথে মিলিয়ে দেখলে এমনটা দাঁড়ায় : “কুক্ষণে তোরে লো, হায়, ইতালি! ইতালি!/এ দুঃখ-জনক রূপ দিয়াছেন বিধি।” “ভারত-ভূমি” কবিতাটির শেষ দুটি পঙক্তি উদ্ধৃত হলো :
“কার শাপে তোর তরে, ওলো অভাগিনি,
চন্দন হইল বিষ; সুধা তিত অতি?”
প্রবাস-অসুবিধা থেকে মুক্তির জন্য মাইকেলের যে কান্না, তা বোধকরি আজও শেষ হয়নি; বাংলাদেশের বাইরে যেসব বাঙালি জীবিকার জন্য, জাগতিক সাফল্য অর্জনের জন্য অবস্থান করছেন, [কিংবা কে জানে হয়তো অন্য কোনো মোহে আটকে আছেন প্রবাসের আঠালো জড়তায়!] তারাও আজ ভেতরে ভেতরে কাঁদছেন কবির মধুসূদনের মতো! কতক খবর আমরা কাগজের পাতায় পাই আর অনেকটাই থাকে অপ্রকাশ! এমনকি পৃথিবীর যে কোনো দেশের যে কোনো প্রবাসীর জন্যও হয়তো এসব কান্নার আওয়াজ সত্য, তাও হয়তো অনুভব করা যায়!

আলোচনা শেষ করবার আগে একবার দেখে নিতে পারি মধুসূদনের ভ্রান্তিমোচনের প্রান্তিক আরতি:
“শৈশবে, অবোধ আমি! ডাকিলা যৌবনে;
(যদিও অধম পুত্র, মা কি ভুলে তারে?)
এবে- ইন্দ্রপ্রস্থ ছাড়ি যাই দূর বনে!
এই বর, হে বরদে, মাগি শেষ বারে,-
জ্যোতির্ম্ময় কর বঙ্গ- ভারত-রতনে!” [সমাপ্তে]

প্রতিভা আর কর্মপ্রেরণার সাথে মাইকেলের উচ্চাভিলাষী চিন্তাধারা নিঃসন্দেহে আমাদের জন্য এক বড়ো পাওয়া। বিভিন্ন ভাষার সাহিত্য পাঠ করে সে সবের ঐশ্বর্য দিয়ে সাজাবেন বাংলা কবিতাকে- এমন একটা ধারণা তিলি লালন করতে শুরু করেছিলেন শিল্পচর্চা আরম্ভের অল্পকাল পর থেকেই। বাংলা সাহিত্য উন্নততর করা আর এর সামর্থ্য বৃদ্ধি করার প্রতি তিনি ছিলেন অত্যন্ত যত্নশীল।

Wednesday, February 22, 2012

এথেন্সের পথ ধরে এবার লন্ডন— ২০১২


এথেন্সের পথ ধরে এবার লন্ডন— ২০১২

সৌমেন রায়

দেখতে দেখতে আবারও একটি বছর হাজির। ওলিম্পিকের বছর। লন্ডন ওলিম্পিক — ২০১২। চলতি বছরের ২৭শে জুলাই থেকে শুরু হয়ে শেষ হবে ১২ই আগস্ট। স্বভাবতই ওলিম্পিকের ৩০তম সংস্করণটি ঘিরে সদাই ব্যস্ত লন্ডন ওলিম্পিক আয়োজক সংস্থা।


খ্রিষ্টপূর্ব ৭৭৬ অব্দে গ্রিসে বসেছিল প্রথম ওলিম্পিকের আসর। তবে আধুনিক ওলিম্পিক শুরু হয় ১৮৯৬ সালে। আধুনিক ওলিম্পিকের জনক পিয়ের দ্য কুর্বাতিনের আন্তরিক প্রচেষ্টার স্বার্থক রূপ পেয়েছিল ওই গ্রিসেই। সেই সঙ্গে শুরু হয় ওলিম্পিক ইতিহাসের নতুন অধ্যায়। এর পর একে একে ২৯টি ওলিম্পিকের আসর বসে‍‌ছে। সেসবকে ঘিরে রয়েছে কতই না স্মৃতি।


গ্রিসের এথেন্সে বসেছিল প্রথম আধুনিক ওলিম্পিকের আসর। সেবার ১৪টি দেশ প্রতিযো‍‌গিতায় অংশ নিয়েছিল। ১০ দিনের ওই আসরে ২৪১ জন প্রতিযোগী ৪৩টি ইভেন্টে অংশ নিয়েছিলেন। পদক তালিকায় শীর্ষে ছিল যুক্তরাষ্ট্র। ১১টি সোনা জিতেছিল যুক্তরাষ্ট্রের ক্রীড়াবিদরা। আয়োজক দেশ গ্রিসের ঝুলিতে ছিল ১০টি সোনা ১৭টি রুপো ও ১৯টি ব্রোঞ্জ পদক। দারুণভাবে নজর কেড়েছিলেন গ্রিসের ম্যারাথন রানার স্পিরিডন লুই। স্পিরিডন ছিলেন একজন জলবাহক। সোনার পদক জেতার পর জাতীয় বীরের সম্মান পেয়েছিলেন লুই। প্রথম ওলিম্পিকের ১০৮ বছর বাদে ২০০৪ সালে গ্রিস আবার ওলিম্পিকের দায়িত্ব পায়। সেবার অংশগ্রহণকারী দেশের সংখ্যা দাঁড়ায় ২০২তে।


১৯০০ সালে প্যারিস ওলিম্পিক থেকে মহিলা ক্রীড়াবিদরা অংশ নেন। সেবার ১৯ জন মহিলা প্রতিনিধি অংশ নিয়েছিলেন। তারা তিনটি ইভেন্টে অংশ নেন। ১০ জন গলফ ৬ জন টেনিস এবং ৩ জন ক্রোকুইস্ট নামে এক ধরনের ইভেন্টে অংশ নিয়েছিলেন।


১৯১৬, ’৪০ এবং ’৪৪ সালে বিশ্বযুদ্ধের জন্য ওলিম্পিকের কোন আসর বসেনি। ১৯০৮ সালে লন্ডন ওলিম্পিকে ম্যারাথন দৌড়কে ঘিরে ঘটেছিল এক অভিনব ঘটনা। ব্রিটিশ রাজ-পরিবারের অনুরোধে ম্যারাথন দৌড় শুরু হয়েছিল ‘উইন্ডসর’ ক্যাসেল থেকে। শেষ হয় ওলিম্পিক স্টেডিয়ামে। রাজ-পরিবারের ছেলেমেয়েরা যাতে এই দৌড় দেখার সাক্ষী থাকতে পারেন, সেজন্যই এমন অনুরোধ। ক্যাসেল থেকে স্টেডিয়ামের দূরত্ব ২৬ মাইল ৩৮৫ গজ। পরবর্তীকালে ১৯২৪ প্যারিস ওলিম্পিক থেকে ওই দূরত্বকে ওলিম্পিক ম্যারাথনের দূরত্বের পরিমাপ ধরা হয়ে আসছে। ওলিম্পিকে অংশগ্রহণকারী ক্রীড়াবিদ থেকে আরম্ভ করে ওলিম্পিকের সঙ্গে যুক্ত প্রত্যেকের কাছেই ওলিম্পিক পতাকা অতি পবিত্র। ওলিম্পিকের জনক কুর্বাতিনের মস্তিষ্কপ্রসূত এই পতাকা মৈত্রী ও সম্প্রীতির প্রতীক। সাদা রঙের পতাকার মাঝে রয়েছে ৫ রঙের ৫টি রিং। নীল, হলুদ, কালো, সবুজ এবং লাল রঙের পাঁচটি রিং পাঁচ মহাদেশের পরিচয় বহন করছে। নীল রঙের রিংটি ইউরোপ মহাদেশের জন্য। হলুদ রঙটি এশিয়ার প্রতিনিধি। কালো রিং আফ্রিকা মহাদেশের। সবুজ — অস্ট্রেলিয়া ও ওশিয়ানিয়ার। লাল রঙের রিং বহন করছে আমেরিকা মহাদেশের জন্য। শুধু তাই নয়, বিশ্বের প্রত্যেকটি দেশের জাতীয় পতাকার কমপক্ষে কোন একটি রঙ রয়েছে ওই পাঁচ রঙের তালিকায়। পতাকার রিংগুলি একে অপরের সঙ্গে যুক্ত থেকে মহাদেশগুলির মধ্যে বন্ধুত্বের সহাবস্থানের বার্তা বহন করছে। ওলিম্পিক কখনোই কোন দেশের নামে হয় না। আয়োজনকারী দেশের কোন শহরের নামে হয়। যেমন ২০০৮-এর বেজিং ওলিম্পিক বা ২০১২ লন্ডন ওলিম্পিক। প্রত্যেক ওলিম্পিকেই আয়োজনকারী শহরের মে‌য়র ওলিম্পিক পতাক তুলে দেন পরবর্তী আয়োজনকারী শহরের মেয়রের হাতে।


আধুনিক ওলিম্পিককে ঘিরে এরকম আরো কতই না ঘটনা-কাহিনী রয়েছে স্মৃতিপটে। সে সব না হয় আরেকদিন।