Sunday, October 28, 2012

আজ সারাদিন


10:33pm Sep 26

আজ সারাদিন
– শহীদ কাদরী
বাতাস আমাকে লম্বা হাত বাড়িয়ে
চুলের ঝুঁটি ধরে ঘুরে বেড়িয়েছে, আজ সারাদিন।
কয়েকটা লতাপাতা নিয়ে
বিদঘুটে বাতাস,
হাতকড়া পরিয়ে দিয়েছে আমাকে,
লাল পাগড়ি-পরা পুলিশের মত কৃষ্ণচূড়া হেঁকে বললো :
‘তুমি বন্দী’ !
আজ সকাল থেকে একজোড়া শালিক গোয়েন্দার মতো ঘুরছে
যেন এভিনিউ পার হ’য়ে নির্জন সড়কে পা রাখলেই
আমাকে গ্রেপ্তার ক’রে নিয়ে যাবে ঠিক !

‘তুমি অপরাধী’
-এই কথা ঢাক-ঢোল পিটিয়ে যেন
ব’লে গেল বজ্রসহ এক পশলা হঠাৎ বৃষ্টিপাত-
‘তুমি অপরাধী’-
মানুষের মুখের আদলে গড়া একটি গোলাপের কাছে।’

বৃষ্টিভেজা একটি কালো কাক
একটি কম্পমান আধ-ভাঙা ডালের ওপর থেকে
কিছুটা কাতর আর কিছুটা কর্কশ গলায়,
আবার ব’লে উঠলো: তুমি অপরাধী!

আজ সারাদিন বাতাস,বৃষ্টি আর শালিক-
আমাকে ধাওয়া করে বেড়ালো
এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত পর্যন্ত।
তোমার বাড়ির কিন্নরকন্ঠ নদী অবধি আমি গেলাম,
কিন্তু সেখানে ঘাটের উপর
একটি প্রাচীন বুড়ি।
সোনার ছাই দিয়ে ঘটি-বাটিহ মেজে চলেছে আপন মনে।
একটা সাংঘাতিক সূক্ষ ধ্বনি শুয়ে আছে পিরিচে,পেয়ালায়।
ঐ বাজনা শুনতে নেই
ঐ বাজনা নৌকার পাল খুলে নেয়
ঐ বাজনা ষ্টীমারকে ডাঙার ওপর
আছড়ে ফ্যালে;
ঐ বাজনা গ্রাস করে প্রেম,
স্মৃতি, শস্য, শয্যা, ও গৃহ।

তোমার বাড়ির কিন্নরকন্ঠ
নদী অবধি আমি গিয়েছিলাম।
কিন্তু হাতভর্তি শালিকের পালক
আর চুলের মধ্যে এলোপাথারি বৃষ্টির ছাঁট নিয়ে
উল্টোপাল্টা পা ফেলে
তোমার দরজা পর্যন্ত যেতে ইচ্ছে হল না।

ঐ শালিকের ভেতর উনুনের আভা,মশলার ঘ্রাণ।
তোমার চিবুক,রুটি আর লালচে চুলের গন্ধ,
ঐ বৃষ্টির ফোঁটার
মধ্যে পাতা আছে তোমার
বারান্দার চেয়ারগুলো
তাহলে তোমার কাছে গিয়ে আর কি হবে!

আজ একজোড়া শালিক
গোয়েন্দা পুলিশের মতো,
বাতাস একটা বুনো একরোখা মোষের মতো
আমাকে ধাওয়া করে বেড়ালো এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত পর্যন্ত।
আমি অনেকদিন পর একজন
হা-ঘরে উদ্বাস্তু হ’য়ে
চরকির মতো গোটা শহর
ঘুরে বেড়ালাম।

সৌজন্যেঃ- সঞ্জ​য় বিশ্বাস​

ইচ্ছে চুরি

        ইচ্ছে চুরি 

যাচ্ছে যে দিন মজায় মজায়
আসবেনা আর ফিরে ,
হারানো সব দিনের মূল্য
বুঝবি ধীরে ধীরে....!!
পাবিনা আর আড্ডাবাজি
গান গাওয়ার এই দিন ,
কাজের চাপে মাথার উপর
বাজবে দুঃখের বীণ...!!
পারবিনা আর করতে চুরি
ডাব লিচু আর আম ,
ধরা খেয়ে নিবিনা আর
আল্লাহ খোদার নাম...!!
আসবিনা আর খেলার মাঠে
সকাল কিংবা সাঁঝে ,
থাকবি তখন ব্যস্ত সবাই
নিজেদেরই কাজে...!!
ঘুরবিনা আর নাটাই হাতে
উড়বেনা তোর ঘুড়ি ,
অজান্তে তোর হবে সকল
ইচ্ছেগুলো চুরি....!!
পারবিনা আর কাটতে সাতার
পুকুর কিংবা খালে ,
আটকে যাবি জীবনেরই
কঠিন বেড়াজালে....!!
তাই মজা যত করবি রে
তুই কর ইচ্ছেমতন ,
হারাবি বয়স, হবে মজার
যবনিকা পতন ......!!


সৌজন্যেঃ- সঞ্জ​য় বিশ্বাস​

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়-এর প্রতি আমাদের শ্রদ্ধাঞ্জলি


 || সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়-এর প্রতি আমাদের শ্রদ্ধাঞ্জলি || 

যদি নির্বাসন দাও, আমি ওষ্ঠে অঙ্গুরী ছোঁয়াবো
আমি বিষপান করে মরে যাবো ।
বিষন্ন আলোয় এই বাংলাদেশ
নদীর শিয়রে ঝুঁকে পড়া মেঘ
প্রান্তরে দিগন্ত নির্নিমেষ-
এ আমারই সাড়ে তিন হাত ভূম
যদি নির্বাসন দাও, আমি ওষ্ঠে অঙ্গুরী ছোঁয়াবো
আমি বিষপান করে মরে যাবো ।
ধানক্ষেতে চাপ চাপ রক্ত
এইখানে ঝরেছিল মানুষের ঘাম
এখনো স্নানের আগে কেউ কেউ করে থাকে নদীকে প্রণাম
এখনো নদীর বুকে
মোচার খোলায় ঘুরে
লুঠেরা, ফেরারী ।
শহরে বন্দরে এত অগ্নি-বৃষ্টি
বৃষ্টিতে চিক্কণ তবু এক একটি অপরূপ ভোর,
বাজারে ক্রুরতা, গ্রামে রণহিংসা
বাতাবি লেবুর গাছে জোনাকির ঝিকমিক খেলা
বিশাল প্রাসাদে বসে কাপুরুষতার মেলা
বুলেট ও বিস্পোরণ
শঠ তঞ্চকের এত ছদ্মবেশ
রাত্রির শিশিরে কাঁপে ঘাস ফুল–
এ আমারই সাড়ে তিন হাত ভূমি
যদি নির্বাসন দাও, আমি ওষ্ঠে অঙ্গুরী ছোঁয়াবো
আমি বিষপান করে মরে যাবো ।

কুয়াশার মধ্যে এক শিশু যায় ভোরের ইস্কুলে
নিথর দীঘির পারে বসে আছে বক
আমি কি ভুলেছি সব
স্মৃতি, তুমি এত প্রতারক ?
আমি কি দেখিনি কোন মন্থর বিকেলে
শিমুল তুলার ওড়াওড়ি ?
মোষের ঘাড়ের মতো পরিশ্রমী মানুষের পাশে
শিউলি ফুলের মতো বালিকার হাসি
নিইনি কি খেজুর রসের ঘ্রাণ
শুনিনি কি দুপুরে চিলের
তীক্ষ্ণ স্বর ?
বিষন্ন আলোয় এই বাংলাদেশ…
এ আমারই সাড়ে তিন হাত ভূমি
যদি নির্বাসন দাও, আমি ওষ্ঠে অঙ্গুরী ছোঁয়াবো
আমি বিষপান করে মরে যাবো… ।


___ সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়


সৌজন্যেঃ- সঞ্জ​য় বিশ্বাস​

কেউ কথা রাখেনি

 আমরা কেউ ভালো নেই, আপনার প্র​য়াণে গভীরভাবে শোকাহত​, মর্মাহত​ | 


কেউ কথা রাখেনি
-সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
কেউ কথা রাখেনি,
তেত্রিশ বছর কাটলো
কেউ কথা রাখেনি
ছেলেবেলায় এক বোষ্টুমি তার
আগমনী গান হঠাত্ থামিয়ে বলেছিলো

শুক্লা দ্বাদশীর দিন অন্তরাটুকু শুনিয়ে যাবে,
তারপর কত চন্দ্রভুক অমবস্যা এসে
চলে গেল, কিন্তু সেই বোষ্টুমি আর এলো না
পঁচিশ বছর প্রতীক্ষায় আছি ।

মামাবাড়ির মাঝি নাদের আলী বলেছিল,
বড় হও দাদাঠাকুর তোমাকে আমি
তিন প্রহরের বিল দেখাতে নিয়ে যাবো
সেখানে পদ্মফুলের মাথায় সাপ
আর ভ্রমর খেলা করে !
নাদের আলি, আমি আর কত বড় হবো ?
আমার মাথা এই ঘরের ছাদ
ফুঁরে আকাশ স্পর্শ করলে
তারপর তুমি আমায় তিন
প্রহরের বিল দেখাবে ?

একটাও রয়্যাল গুলি কিনতে পারিনি কখনো
লাঠি-লজেন্স দেখিয়ে দেখিয়ে চুষেছে
লস্কর বাড়ির ছেলেরা
ভিখারীর মতন চৌধুরীদের
গেটে দাঁড়িয়ে দেখেছি ভেতরে রাস উত্সব​
অবিরল রঙ্গের ধারার মধ্যে সুবর্ণ কঙ্কণ পড়া
ফর্সা রমণীরা কতরকম আমোদে হেসেছে
আমার দিকে তারা ফিরেও চায়নি !

বাবা আমার কাঁধ ছুঁয়ে বলেছিলেন,দেখিস,
একদিন আমরাও...
বাবা এখন অন্ধ, আমাদের দেখা হয়নি কিছুই
সেই রয়্যাল গুলি,
সেই লাঠি-লজেন্স,
সেই রাস উত্সব​
আমায় কেউ ফিরিয়ে দেবে না !

বুকের মধ্যে সুগন্ধি রুমাল রেখে বরুণা বলেছিল,
যেদিন আমায় সত্যিকারের ভালবাসবে
সেদিন আমার বুকেও এরকম আতরের গন্ধ হবে !
ভালবাসার জন্য আমি হাতের মুঠোয় প্রাণ নিয়েছি
দুরন্ত ষাঁড়ের চোখে বেঁধেছি লাল কাপড়
বিশ্ব সংসার তন্ন তন্ন করে
খুঁজে এনেছি ১০৮ নীলপদ্ম

তবু কথা রাখেনি বরুণা,
এখন তার বুকে শুধুই মাংসের গন্ধ
এখনো সে যে কোন নারী !


সৌজন্যেঃ- সঞ্জ​য় বিশ্বাস​

Saturday, October 27, 2012

দ্বিশত জন্মবর্ষে স্মরণ নবজাগরণ পর্বের এক জ্যোতিষ্ক রেভারেন্ড কৃষ্ণমোহন


কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায় (রামতনু লাহিড়ী ও তত্কালীন​ বঙ্গসমাজ’ গ্রন্থে প্রকাশিত)

                  

দ্বিশত জন্মবর্ষে স্মরণ
নবজাগরণ পর্বের এক জ্যোতিষ্ক রেভারেন্ড কৃষ্ণমোহন

সুকান্ত মুখোপাধ্যায়

রেভারেন্ড কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন ডিরোজিওর প্রিয় ছাত্র ও সেকালের ‘ইয়ং বেঙ্গল’ দলের একজন প্রধান সক্রিয় সদস্য। হিন্দু কলেজের প্রাক্তন এই ছাত্র মূলত ডিরোজিওর প্রভাবে কিশোর বয়স থেকেই প্রতিবাদী হিসাবে গড়ে উঠেছিলেন এবং আজীবন প্রতিবাদী চরিত্রেরই মানুষ ছিলেন ও হিন্দু ধর্মের যাবতীয় কৃসংস্কার ও গোঁড়ামির বিরুদ্ধে তাঁর ক্ষুরধার লেখনী ও বাগ্মীতা তাঁকে সে যুগে এক বিশিষ্ট মানুষরূপে চিহ্নিত করেছিল। এছাড়াও ডিরোজিওর সান্নিধ্যে এসে তাঁর জীবনের আর একটি দিক উন্মুক্ত হয় যেটি হলো জানবার ইচ্ছা বা জ্ঞানতৃষ্ণা। ‘‘দ্য রোজিও কদাচ বলেননি, তুমি নাস্তিক হও, উচ্ছৃঙ্খল হও। বরং বলেছেন তুমি জিজ্ঞাসু হও। উচ্চ নৈতিক আদর্শের উপর জীবনের প্রয়োজনবোধকে স্থাপন কর...।’’ ডিরোজিওর এই কথাগুলি তিনি তাঁর লেখায় লিখেছিলেন এবং সারা জীবন এই আদর্শকেই জীবনের পাথেয় করেছিলেন। তিনি একদিকে যেমন পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে উঠেছিলেন তেমনি নিজের চেষ্টায় ইংরেজি ছাড়াও হিন্দি, সংস্কৃত, ওড়িয়া, ফারসি, উর্দু, ল্যাটিন, গ্রিক ও হিব্রু প্রভৃতি দশটি ভাষা আয়ত্ত করেছিলেন, যদিও মাতৃভাষা বাংলাকে কখনও অবজ্ঞা করেননি এবং তিনিই প্রথম বাঙালি খ্রিস্টান ধর্মযাজক যিনি আজীবন বাংলা ভাষায় ধর্মোপদেশ দিতেন। গোঁড়া ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মে তাঁর খ্রিস্টান হওয়া নিয়ে সে যুগে তুমুল আলোড়ন উঠেছিল।

কৃষ্ণমোহনের জন্ম হয়েছিল ২৪শে মে ১৮১৩ সালে মামার বাড়িতে, উত্তর কলকাতার ঝামাপুকুরের বেচু চ্যাটার্জি স্ট্রিটের নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণ পরিবারে। মাতামহ রামজয় বিদ্যাভূষণ ছিলেন গোঁড়া ব্রাহ্মণ, জোড়াসাঁকোর জাঁদরেল জমিদার শান্তিরাম সিংহের সভাপণ্ডিত। কৃষ্ণমোহনের বাবা জীবনকৃষ্ণের আদিবাড়ি ছিল বর্তমান দক্ষিণ ২৪ পরগনার বারুইপুরের কাছে নবগ্রামে। রামজয় বিদ্যাভূষণের মেয়ে শ্রীমতি দেবীকে বিয়ে করে জীবনকৃষ্ণ কিছুদিন শ্বশুরবা‍‌ড়িতে থাকার পর কাছেই গুরুপ্রসাদ চৌধুরী লেনে বাড়ি করে উঠে যান। ভুবনমোহন, কৃষ্ণমোহন ও কালীচরণ তাঁর তিন ছেলে। কৃষ্ণমোহনের প্রাথমিক শিক্ষা বর্তমান ঠনঠনিয়া কালীবাড়ির কাছে ডেভিড হেয়ার সাহেবের ‘ক্যালকাটা স্কুল সোসাইটি’র এক ছোট্ট স্কুলে। এটি এখন আর নেই। ১৮২৪ সালে তিনি হিন্দু কলেজে ভর্তি হন এবং ১ নভেম্বর ১৮২৯-এ কলেজ থেকে পাশ করে হেয়ার সাহেবের স্কুলেই শিক্ষকতা শুরু করেন। হাওড়ার শিবপুরের রাধারমণ চট্টোপাধ্যায়ের কন্যা বিন্দুবাসিনীর সঙ্গে ১৮২৯-এ তাঁর বিয়ে হয়।

হিন্দু কলেজে পড়ার সময় থেকেই ডিরোজিওর সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতা জন্মায় এবং ডিরোজিওর বাড়িতে যাতায়াত শুরু হয়। স্কটিশ মিশনারী আলেকজান্ডার ডাফ ১৮৩০-এ কলকাতায় এলেন, কিছুদিন পরে এলেন ইংল্যান্ডের ওল্ড মিশন চার্চের যাজক আর্চডিকন ডিয়ালট্রি। দু’জনের সঙ্গেই কৃষ্ণমোহনের ঘনিষ্ঠতা গড়ে ওঠে এবং তিনি পাশ্চাত্য শিক্ষার সুফলের দিকটি সম্পর্কে আগ্রহী হয়ে ওঠেন।

মাত্র ১৮ বছর বয়সে ১৭ই মে ১৮৩১ সালে কৃষ্ণমোহন প্রকাশ করেন ‘নব্যদল’-এর মুখপত্র সাপ্তাহিক পত্রিকা “The Inquirer” যার লক্ষ্য ছিল তাঁর ভাষায় “Having thus launched our back under the denomination of Enquires we set sail in quest of truth and happiness.”। জে নটরাজনের লেখা ‘History of Indian Jou

alism’ গ্রন্থে ১৮৩১ সালে সরকারী অনুমোদন প্রাপ্ত ১২টি পত্রিকার তালিকায় ‘দ্য এনকোয়ারার’-এর উল্লেখ পাওয়া যায়। সেই সময় ‘দ্য এনকোয়ারার’ পত্রিকার গ্রাহক সংখ্যা ছিল ২০০। প্রথম সংখ্যা প্রকাশের পরই তত্কালীন পত্রিকা ‘সম্বাদ কৌমুদী’ এই উদ্যোগকে সাধুবাদ জানিয়ে ‍‌লিখেছিল ‘‘গত ১৭ই মে অবধি ইনকোয়েরের নাম ইংলন্ডীয় ভাষায় সম্বাদপত্র এতদ্দেশীয়-সু-শিক্ষিত অল্প বয়স্কদের দ্বারা প্রকাশারম্ভ হইয়াছে, তন্মধ্যে শ্রীযুক্ত কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায় প্রধান সম্পাদক হন ত
ত্পত্রের ভূমিকার শেষভাগ অবলোকনে আমরা বোধ করিলাম যে পত্রের প্রথমভাগের লিখিত সম্পাদকের স্বীয় উক্তি ব্যতীত প্রায় সমুদয় তত্প​ত্রস্থিত বক্তৃতা এতদ্দেশীয় হিন্দু বালকদের দ্বারা রচিত হইয়াছে এবং রচরেকদের বয়ঃক্রমে চতুর্দ্দশ বা পঞ্চদশ বত্সরের ঊর্ধ্বে নহে ইহাতে আমরা অবশ্যই আহ্লাদিত হইলাম এবং তাহাদের এতাবত্ অল্প বয়সে যে এরূপ বিদ্যা জন্মিয়াছে ইহাতে বিশেষ অনুরাগ করিলাম’’। রক্ষণশীল হিন্দু সমাজ কিন্তু ‘দ্য এনকোয়ারার’-কে ভালো চোখে নেয়নি কারণ হিন্দুধর্মের যাবতীয় কু-প্রথার ওপর লেখা ছাপা হত এই পত্রিকায়। অন্যান্য পত্র পত্রিকায় সম্পাদক ও লেখককুলের প্রতি বিদ্বেষ ও গালিবর্ষণ শুরু হলো অচিরেই। অবশ্য পত্রিকাটি বেশিদিন চলেনি, ১৮৩৫-এর ১৮ই জুন পর্যন্ত চলেছিল কিন্তু ওই ক’বছরেই সতীদাহ নিবারণ, বহুবিবাহ, পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রচার ও প্রসার বিষয়ে অনেকগুলি গুরুত্বপূর্ণ লেখা প্রকাশিত হয়েছিল ওই পত্রিকায়। বহুবিবাহ প্রথা নিয়ে কৃষ্ণমোহন নিজে এক প্রবন্ধ লিখেছিলেন।সেখানে লেখা ছিল “That marriage is looked upon as traffic by the cool in Brahmins, is an evil, the existence of which can not denied. Many, many poor creatures have suffered keenly from this, and if we but consider the enormity of the crime, we cannot entertain any doubts about the course we, as members of society should pursue with respect to persons that recklessly marry a number of wives without fixing their affections on any.”

১৮৩১ সালের ২৩শে আগস্ট কৃষ্ণমোহনের অনুপস্থিতিতে তাঁর মামার বাড়িতে কয়েকজন বন্ধু রুটি ও গো-মাংস খেয়ে উচ্ছিষ্ট মাংসের হাড় প্রতিবেশীর বাড়িতে ফেলে দিয়ে ‘ঐ গো-হাড়, গো-হাড়’ বলে চিৎকার করতে থাকেন। সন্ধ্যেবেলা কৃষ্ণমোহন ঘরে ফিরে দেখেন বাড়িতে তুমুল গণ্ডগোল, গোটা পাড়া ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছে, দাদু রামজয় বিদ্যাভূষণও ক্ষিপ্ত। বন্ধুদের এই দুষ্কর্মের কারণে কৃষ্ণমোহন তাঁর মামার বাড়ি থেকে বিতাড়িত হন। বিতাড়িত হয়ে তিনি সাময়িক আশ্রয় নিলেন বন্ধু দক্ষিণারঞ্জনের বাড়িতে কিন্তু সেখানেও ঠাঁই না হওয়ায় শেষে চৌরঙ্গি অঞ্চলে এক ইংরেজ বন্ধুর বাড়িতে আশ্রয় পেলেন। এই ঘটনা সম্পর্কে কৃষ্ণমোহন নিজে তাঁর পত্রিকায় লিখেছিলেন “Persecution has burst upon us so vehemently, that on Wednesday last at 12 o’clock we were left without a roof to cover our head ….. If our readers conceive the difficulties we were placed in without a house to lodge in expecting nothing but the rage of bigots and foes, and suffering the greatest hardships for the sake of truth and liberation, they will undoubtedly excuse our present defects.

ইংরেজ বন্ধুর বাড়িতে বসে এর মধ্যে তিনি লিখে ফেললেন পঞ্চাঙ্কের এক নাটক ‘The Persecuted’ , বাঙালির লেখা প্রথম প্রতিবাদী ইংরেজি নাটক যেটি প্রকাশিত হয়েছিল ১৮৩১ সালের নম্বের মাসে। নাটকটি প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গেই গোটা সমাজে এক অভূতপূর্ব সাড়া ফেলে দিয়েছিল। এর ঠিক এক বছর আগে ১৯৩০ সালে হিন্দু কলেজেরই আর এক কৃতী ছাত্র কাশীপ্রসাদ ঘোষ প্রথম বাঙালি হিসেবে প্রকাশ করেছিলেন বাঙালীর লেখা প্রথম ইংরাজী কাব্যগ্রন্থ ‘The Shair and other Poems’। প্রসঙ্গত ৫ই আগস্ট ২০০৯ সালে তাঁরও জন্মের দ্বি-শতবর্ষ পার হয়ে গেছে কিন্তু তিনি আজও বাঙালী সমাজে উপেক্ষিত থেকে গেছেন, অনেকে তাঁর নামই জানেন না।

হিন্দু সমাজে তুমুল আলোড়ন সৃষ্টি হলো যখন ১৬ই অক্টোবর ১৮৩২ সালে আলেকজান্ডার ডাফের কাছে কৃষ্ণমোহন খ্রিস্টধর্মে দীক্ষা নিয়ে ‘খ্রিস্টান’ হলেন। দীক্ষাগ্রহণের বিষয়ে তিনি তাঁর এক বন্ধুকে লিখেছিলেন “I intend being baptised this evening at the house of Rev.A.Duff.”

খ্রিস্টান কৃষ্ণমোহনের সঙ্গে শ্বশুরবাড়ির সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে গেল। তাঁর স্ত্রীকে শ্বশুরমশাই হাওড়ায় নিজের বাড়িতে নিয়ে চলে এলেন। প্রতিবাদী কৃষ্ণমোহন এতে দমে না গিয়ে হাওড়া কোর্টে মামলা দায়ের করলেন এবং স্ত্রী তাঁর পক্ষে থাকায় কঠিন পরিশ্রমে মামলায় জিতে আবার স্ত্রীকে নিয়ে এলেন নিজের কাছে। ১৮৩৬ সালে কৃষ্ণমোহন নিজের স্ত্রী ও ছোটভাই কালীচরণকে খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত করান। পাথুরিয়াঘাটার জমিদার প্রসন্নকুমার ঠাকুরের পুত্র জ্ঞানেন্দ্রমোহনকেও তিনি খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত করেন ও পরে ১৮৫১ সালে নিজের মেয়ে কমলমণির সঙ্গে তাঁর বিয়ে দেন। মাইকেল মধুসূদনের খ্রীস্টান হওয়ার পিছনে তাঁর প্রভাব ছিল। এখন যেখানে প্রেসিডেন্সি কলেজ সেই জায়গায় ১৮৩৮ সালে তিনি যখন এক গির্জা স্থাপনের উদ্যোগ নেন, এবং তৎকালীন বিশপকে দিয়ে তার শিলান্যাসও করান তখন আবার বিতর্ক শুরু হয়। এবার কিন্তু প্রতিবাদ এল সমাজের অন্য দিক থেকে। বহু গণ্যমান্য ইংরেজের সঙ্গে স্বয়ং ডেভিড হেয়ার এই চার্চ স্থাপনের বিরোধিতা করলেন। তাঁদের আশঙ্কা অমূলক ছিল না কারণ কাছাকাছি দু’টি কলেজ ছিল — হিন্দু কলেজ ও মেডিক্যাল কলেজ। চার্চ স্থাপিত হলে ছাত্ররা খ্রিস্টধর্মের দিকে প্রভাবিত হতে পারে এই আশঙ্কা তাঁদের ছিল। বাধ্য হয়ে কৃষ্ণমোহন সিদ্ধান্ত বদল করে হেদুয়ার কাছে ১৮৩৯ সালে নিজস্ব ‘ক্রাইস্ট চার্চ’ স্থাপন করেন এবং ১৩ বছর এখানে আচার্যের পদে অধিষ্ঠিত থেকে বাংলা ভাষায় খ্রিস্টধর্ম প্রচার করেন। চার্চ স্থাপনের সময় কবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত ব্যঙ্গ করে ছড়া লিখেছিলেন ‘‘হেদোর এঁদো জলে কেউ যেও না তায়, কৃষ্ণবন্দো জটে বুড়ি শিকলি দেবে পায়’’।

১৮৫২ সালে তিনি হাওড়ার বিশপস্‌ কলেজে অধ্যাপনার কাজে নিযুক্ত হন, সেখানে তিনি এক সময় ছাত্র ছিলেন। এজন্য তিনি শিবপুরে থাকতে আরম্ভ করেন। ছাত্রদরদী কৃষ্ণমোহন গরিব ছাত্রদের সাহায্য করার জন্য কলেজে ৮০০ টাকা দান করেছিলেন। ১৮৬৮ সাল পর্যন্ত ওই কলেজে পড়িয়েছেন। ওই বছরেই তাঁর স্ত্রী বিয়োগ ঘটে।

সংস্কারমুক্ত বিদগ্ধ পণ্ডিত মানুষ কৃষ্ণমোহন সমাজে কিভাবে সাধারণ মানুষের সঙ্গে মিশতেন তার একটি খণ্ডচিত্র ধরা আছে শিবপুরের বাসিন্দা বসন্তকুমার পালের লেখা ‘স্মৃতির অর্ঘ্য (প্রকাশ কাল ১৩৪৬ বঙ্গাব্দ) বইটিতে। বসন্তকুমার লিখেছেন ‘‘নিমাইচাঁদ পাল আমার পিতামহ, তিনি বিশপস্‌ কলেজে কাজ করিতেন... শুনিয়াছি তখনকার পাদ্রীরা এ দেশের বাঙালিদের সঙ্গে বেশ মেলামেশা করিতেন। রেভাঃ কে এম ব্যানার্জি (কৃষ্ণ বন্দো) প্রভৃতি সাহেবেরা আমোদ করে প্রত্যেক বত্সর​ আমাদের বাড়িতে অরন্ধনের দিন ‘পান্তাভাত’ ও পৌষ পার্বণের দিন ‘পিঠেভাত’ খাইতে আসিতেন ও আমাদের তখনকার মেটে দাওয়ায় পিঁড়ির উপর বসে সনাতন কদলিপত্রে সেইসব খাইতে কুণ্ঠিত হইতেন না। বড়দিনের সময় আমাদের বাড়ির প্রেরিত নপো ময়রার খেজুরের গুড়ের চাঁপাতক্তির আদর কৃষ্টমাস কেকের চেয়ে বড় কম ছিল না।’’

দীর্ঘ কর্মজীবনে কৃষ্ণমোহন অনেকগুলি পত্রিকা সম্পাদনা করেছিলেন এবং কয়েকটি মূল্যবান বই লিখেছিলেন। তাঁর সম্পাদিত পত্রিকাগুলির মধ্যে ছিল ‘হিন্দু ইউথ’ (১৮৩১), ‘গভর্নমেন্ট গেজেট’ (১৮৪০), ‘সংবাদ সুধাসিন্ধু’ (১৮৫০), ‘বেঙ্গল স্পেকটেটর’ প্রভৃতি। ‘ক্যালকাটা রিভিউ’, ‘মুখার্জিস ম্যাগাজিন’, ‘ক্যালকাটা ইনটেলিজেন্সার’ প্রভৃতি পত্রিকায় লিখেছেন অসংখ্য মূল্যবান প্রবন্ধ। ১৮৪৬-৫১ সময়কালের মধ্যে তিনি লিখেছিলেন ১৩ খণ্ডের বাংলা ইংরেজি দ্বিভাষিক বিশ্বকোষ ‘বিদ্যাকল্পদ্রুম’ যেটি তাঁর সর্বশ্রেষ্ঠ রচনা বলে পরিচিত। তার আগে এই ধরনের কাজ বাংলা ভাষায় আর হয়নি।

তাঁর লেখা অন্যান্য বইগুলির মধ্যে আছে ‘উপদেশমালা’ (১৮৪০), ‘Dialogues on the Hindu Philosophy’ (১৮৬১) ‘ষড়দর্শন সংবাদ’ (১৮৬৭), ‘দ্য এরিয়ান উইটনেস’ (১৮৫৭), কালিদাসের ‘রঘুবংশম’ ও ‘কুমার-সম্ভবম’-এর ইংরেজি ব্যাখ্যা। ‘সাধারণ জ্ঞানোপার্জ্জিকা সভা’, ‘ভারত সংস্কার সভা’, ‘বঙ্গীয় সমাজ বিজ্ঞান সভা’, ‘স্কুল বুক সোসাইটি’, ‘ইন্ডিয়ান লিগ’, ‘ভারতসভা’ প্রভৃতি নানা প্রতিষ্ঠানের তিনি ছিলেন সক্রিয় সদস্য, এছাড়া কলকাতা কর্পোরেশনের নির্বাচিত প্রতিনিধিও হয়েছিলেন। প্রতিবাদী কৃষ্ণমোহন নানা সময়ে তদানীন্তন ব্রিটিশ সরকারের নানা দমনমূলক কাজের ও নীতির তীব্র প্রতিবাদ করেছেন। ১৮৭৮ সালের ১৭ই এপ্রিল কলকাতার টাউন হলে - Ve

acular Press Act. Drama Act ও Arms Act. এর বিরুদ্ধে ‘ভারতসভা’ আয়োজিত বিশাল এক জনসভায় সভাপতির ভাষণে তিনি এই আইনগুলির তীব্র প্রতিবাদ করে তাঁর ভাষণে বলেছিলেন, ‘Dare Gove

ment Prosecute us’ আবার ১৮৮১ সালের ১৯শে এপ্রিল কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের হলে বেথুন সোসাইটি আয়োজিত এক সভায় এর উল্টো চিত্রটি দেখা যায়। কিশোর রবীন্দ্রনাথ গান সম্পর্কে তাঁর জীবনের প্রথম বক্তৃতাটি দেন এই সভায়। বক্তৃতার সিংহভাগ জুড়েই ছিল কিশোর রবীন্দ্রনাথের স্ব-কণ্ঠে গাওয়া টুকরো কিছু গানের অংশ। সভার সভাপতি কৃষ্ণমোহন সে গান শুনে তাঁর উচ্ছসিত ভাষণে ‘বন্দে বাল্মীকি কোকিলং’ বলে নবীন কবিকে সেদিন সাধুবাদ জানিয়েছিলেন। দীর্ঘ কর্মজীবনে কৃষ্ণমোহন বহু সম্মান পেয়েছিলেন। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ১৮৫৫ সালে পাওয়া ‘কমান্ডার অব দ্য ইন্ডিয়ান এম্পায়ার’, ১৮৬৪ সালে একই সঙ্গে তাঁর ও ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের লন্ডনের রয়‌্যাল এশিয়াটিক সোসাইটির সদস্য পদ পাওয়া এবং ১৮৭৬ খ্রিস্টাব্দের মার্চ মাসে মনিয়র ইউলিয়ামস ও রাজা রাজেন্দ্রলাল মিত্রর সঙ্গে একই মঞ্চে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক সাম্মানিক ‘Doctor of Law’ উপাধি লাভ। উপাধি তাঁর হাতে তুলে দেবার সময় তৎকালীন উপাচার্য আর্থার হবহাউস কৃষ্ণমোহনের সম্পর্কে বলেছিলেন “He too, has laboured long, honourably and successfully at the literature of his country”।

১৮৮৫ সালের ১১ই মে কলকাতার ৭নং চৌরঙ্গী লেনের বাসভবনে কৃষ্ণমোহনের মৃত্যু হয়। মরদেহ শিবপুরে এনে বিশপস্‌ কলেজের অভ্যন্তরের কবরখানায় সমাহিত করা হয়। তাঁর স্মৃতিফলকটি সেখানে আজও বিদ্যমান। কৃষ্ণমোহনের কোনো পূর্ণাঙ্গ জীবনী গ্রন্থ বা তাঁর লেখা বইগুলি আজ দুর্লভ অথচ ১৮৩০-১৮৮৪ এই সুদীর্ঘ সময়কালে তিনি শিক্ষাবিস্তার ছাড়াও বহু সমাজ সংস্কারমূলক কাজে লিপ্ত ছিলেন।

কৃষ্ণমোহনের প্রথম জীবনী সম্ভবত লেখা হয়েছিলো ১৮৪২ সালের অক্টোবর মাসে ‘ইন্ডিয়া রিভিউ’ পত্রিকায় যেখানে লেখা হয় হিন্দু ধর্মের সমুদয় রীতিনীতির বিরুদ্ধে আন্দোলন চালানো হতো বলে রক্ষণশীল হিন্দু সমাজ তাঁর কাগজের ওপর ভীষণ খাপ্পা ছিলেন। তাঁর বিস্তারিত জীবনী লিখেছিলেন রামগোপাল সান্যাল ১৮৯৩ সালে এবং ৭০ পাতার এই জীবনীতে তিনি লিখেছিলেন কৃষ্ণমোহন তাঁর সময়ের চেয়ে চিন্তা ভাবনায় অনেক এগিয়ে ছিলেন। ১৯২৯ সালে Bengal Past and Present পত্রিকায় ৩৭ ও ৩৮নং সংখ্যায় (Jan-June ও July-Dec) তাঁর একটি অসাধারণ জীবনী লিখেছিলেন হরিদাস দাস মহাশয় যিনি তরু দত্তের প্রথম জীবনীকার ছিলেন। এছাড়া ২৫শে জানুয়ারি ১৯০৪ সালে প্রকাশিত শিবনাথ শাস্ত্রী মহাশয়ের লেখা ‘‘রামতনু লাহিড়ী ও তত্কালীন​ বঙ্গসমাজ’ গ্রন্থেও কৃষ্ণমোহন সম্পর্কে আলোচনা আছে যদিও সন তারিখের কিছু গোলমাল লক্ষ্য করা যায়। কৃষ্ণমোহনের লেখা ‘পারসিকিউটেড’ নাটকটি উদ্ধার করা গেছে এবং সম্প্রতি ‘ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন’-এর উদ্যোগে এটি অভিনীতও হয়েছে। কৃষ্ণমোহনের মাত্র দু’টি ছবির সন্ধান বর্তমান লেখকের গোচরে এসেছে, একটি বই প্রবন্ধে ছাপা হলো আর একটি কোলসওয়ার্দি গ্রান্ট (১৮১৩-১৮৮০)-এর আঁকা স্কেচ যেটি প্রথম ছাপা হয় ‘অ্যাংলো ইন্ডিয়ান ডোমেস্টিক স্কেচ’ গ্রন্থে, ১৮৪৯ সালে, পরে এটি মন্মথনাথ ঘোষের লেখা কিশোরীমোহন মিত্রের জীবনী গ্রন্থ ছাপা হয়েছিল। আর পাওয়া যায় তাঁর লেখা Dialogues of the Hindu বইটি। কিন্তু তাঁর লেখা অন্যান্য গ্রন্থগুলি ও চিঠিপত্র উদ্ধার করা প্রয়োজন, তাঁকে নিয়ে আলোচনাও হওয়া প্রয়োজন, না হলে কৃষ্ণমোহন আমাদের কাছে অধরাই থেকে যাবেন।


সৌজন্যেঃ- গণশক্তি (সম​য়ের সাথে)

Thursday, October 25, 2012

মুখোমুখি — আনা ফ্র্যাঙ্ক আর রাচেল কোরি







  মুখোমুখি — আনা ফ্র্যাঙ্ক আর রাচেল কোরি  

কৃশানু ভট্টাচার্য

‘‘আমার বাবা খুঁজে পেয়েছিলেন আমার ডায়েরিটা; তারপর ...’’

‘‘আমার মা’র কাছেই রয়েছে আমার ডায়েরি, কিন্তু ...’’

‘‘বাবা যুদ্ধশে‍‌ষে আমস্টারডামে ফিরে এসে অনেক কষ্টে খুঁজে বার করেন আমার ডায়েরিটা। আমি ডায়েরিটা লিখেছিলাম ডাচ ভাষায়। আমার ১৩ বছরের জন্মদিনে এই ডায়েরিটা কেউ উপহার দিয়েছিলেন। তার দু’বছর আগে নু‍‌রেমবার্গ আইনের দৌলতে আমরা নাগরিকতা হারালাম। কিছুদিন বাবার অফিসের একটা ঘরে লুকিয়ে ‍‌ছিলাম। ১৯৪২-র জুন মাসে অজ্ঞাতবাসের শুরু শেষ ১৯৪৪-এ। তারপর বার্গেন বেলসন কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে আমার আর বোন মার্গটের ঠিকানা। তারপর এসেছিল ১৯৪৫, জানুয়ারি, ফেব্রুয়ারি, মার্চ — এর পর কি হয়েছে আমি জানি না।’’

‘‘তোমার চেয়ে আমি পৃথিবীটাকে দেখেছি বেশিদিন — আট বছর। আট বছর মানে ২৯২০ দিন। তোমার চেয়ে পৃথিবীকে আমি আরেকটু বড় দে‍‌খেছি — নিজের দেশের বাইরে বেরিয়েও অন্য পৃথিবীকে দেখেছি। দেখেছি অনেক বেশি অত্যাচার অনেক বেশি কষ্ট। আমি শুনেছি তোমার কথা পড়েছি তোমার কষ্টকর জীবনের রোজনামচা। বুকের গহন কোণে ছবি এঁকেছি তোমার। তুমিও তো জানিয়েছিলে নাজিদের অত্যাচারের কথা। কেউ কেউ বলে তোমার লেখায় নগ্ন হয় হিটলারের বর্বরতা। তুমি আনা ফ্র্যাঙ্ক আমি সে অর্থে ততটা চেনাশুনা কেউ নই। কেউ কেউ বলে ‘পাগলি’ কেউ বলে বোকা। তবুও তোমার জ্বালানো মশাল থেকে আমায় একটু উত্তাপ দেবে? আমি যে মশাল জ্বালিয়েছিলাম তা তো নিভেই গেছে।’’

‘‘কে বলে তু‍‌মি পাগলি ? এখনও বাতাসে কান পাতলে তোমার নাম কেউ ফিস ফিস করে বলে যায়। জোরে বলতে পারে না তোমার দেশের সরকারের ভয়ে। ওদের জোরেই তো তোমার ঘাতকদের এতো শক্তি। ইতিহাস সাক্ষী ৬০ বছরেও বর্বরতার রোজনামচায় কোনো বদল হলো না।’’

‘‘আমি তখন ছোট ছিলাম যখন তোমার কথা পড়ি। শুনেছিলাম ১৪ বছরের মেয়ে হয়েও তু‍‌মি যা বলেছো তা অনেক প্রাপ্তবয়স্কও বলতে পারে না। শুনেছি হল্যান্ডের যেখানে তোমরা লুকিয়েছিলে সেখানে প্রতিবছর অনেক মানুষই যান দেখতে জানতে। সেই আগ্রহেই তোমায় পড়তে শুরু ক‍‌রি। আরও অনেক কিছু পড়ার ইচ্ছে ছিলো তা আর হলো কই? তার আগেই ডি-৯ অস্ত্রে সজ্জিত কাটারপিলার বুলডোজার আমায় পিষে মেরে ফেললো। তবে শুধু তো আমি নই ইজরায়েলের তাণ্ডবে প্রাণ হারিয়েছে অনেক মানুষ। রাফা, গাজা, রাসেল লাশের পাহাড় —রক্তের নদী— বীভৎসতার কোনো সীমা হয় না এটা জানতে গেলে একবার ইজরায়েলে যেতে হবেই।’’

‘‘তুমি কি জানো, এই সেদিন ২৮শে আগস্ট, ২০১২ নয় বছর শুনানির শেষে বিচারক ওডেড গ্যারসন দি বলেছেন?’’

‘‘জানি ওই যে আমার মৃত্যুকে আমিই আমন্ত্রণ করেছি। আসলে কি জানো আমার মৃত্যুর দায় স্বীকার করে নিলে তো আরও হাজারো খুনের দায়ও মাথা পেতে নিতে হবে। জানো ওদের সবাই বলে উদ্বাস্তু— আমি জানি ওরা গায়ের জোরের ভয়ে পালিয়ে বাঁচা হাজারো জনতা, ওরা ভয় পায় কামান, বুলডোজার। তাই ওদের বরাতে থাকে বহিষ্কার, ভীতি প্রদর্শন কিংবা মৃত্যু। ওদের তাড়িয়ে দি‍‌য়েই তৈরি হবে ইহুদি রাষ্ট্র ইজরায়েল।

‘‘হায়! ইতিহাসের এই পুনরাবৃ‍‌ত্তিও সহ্য করতে হচ্ছে।’’

‘‘পুনরাবৃত্তি-তবে তা আরও ভয়ঙ্কর। আর এনিয়ে‌ যতদিন না তারা অনুতপ্ত হচ্ছে ততদিন তাদের সৃষ্টি করা ক্ষত আরো গভীর হ‍‌বে, ছড়ি‌য়ে পড়বে মধ্য প্রাচ্যে ছড়িয়ে পড়বে দুনি‌য়ার চার কোণায়। তবে তারা অনুতপ্ত তো নয়— তারা জানে তাদের মাথার উপর রয়েছে মার্কিন আশীর্বাদ।’’

‘‘আমি অবাক হয়েছিলাম তোমার কথা শুনে —একটা ২৩ বছরের মেয়ে কলেজের ছাত্রী কেবলমাত্র সহমর্মিতা জানাবার জন্য তার নিজের দে‍‌শের বন্ধু দেশে গিয়ে প্রতিবাদ করছে। ইজরায়েলের বর্বরতার পাশবিক দিনলিপি লিপিবদ্ধ কর‍‌ছে, ভাষা হারা মানুষের মুখে ভাষা দিচ্ছে - আর তারপর খুন হচ্ছে — ভাবা যায় না।’’

‘‘মার্জনা করবেন, অ‌্যানা কখনও কোনো পশুকে দেখেছেন অপ্রয়োজনে কাউকে আক্রমণ করতে? পশু আক্রমণ করে আত্মরক্ষায় কিংবা খাদ্য সংগ্রহে। ইজরায়েলের পরিচালকদের সঙ্গে পশুর তুলনা করে পশুদের অসম্মান করবেন না — ওরা নিষ্ঠুর, হত্যাকারী তবে ওদের বর্বরতা দেখে পশুরাও লজ্জা পাবে।’’

‘‘ঠিক, তুমিই ঠিক। ওরা এতোটাই নীচ যে ওদের ঘৃণা করতেও কুণ্ঠা হয়। আর আরও নীচ তোমার দেশের সরকার। ইতিহাসের পাতা থেকে তোমার নাম মুখে দেবার জন্য তাদের তৎপরতা তুলনাহীন। আধুনিক যুগের রাজনৈতিক ইতিহাসে তোমার নাম নেই এটাও সত্যি।’’

‘‘থাকতে পারে না — থাকলে তো প্রমাণ হয়ে যাবে বর্বরতায় ইজরায়েলের মানিকজোড়টির নাম মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। যারা নিজেদের মানবাধিকারের পূজারী বলে ঢাক পেটায় তাদের ফানুস যে ফেটে যাবে। তাই আমার স্থান মার্কিন ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে। ওরা বিমানবন্দরে আমাকে হেনস্তা করেছিল। মে‍‌ক্সিকো সীমান্তে আমাকে বিব্রত করেছিল। আমাকে হত্যা করার পরও তাই ওদের ভয় কাটেনি। ওরা আসলে ভয় পায় আমার অস্তিত্বকেই।’’

‘‘তুমি তো লিখেছিলে সেই অত্যাচারের দিনলিপি যা কেউ পড়ার সুযোগ পেলো না— পেলে হয়তো তো‍মাকে আর আমাকে একই আসনে ওরা বসাতো। জানো আমার ছেলেবেলার বন্ধু ছিলো ফ্রিটজ্‌ লোয়েনস্টাইন’ সে শেষ জীবনে থাকতো উইলকিন‍‌সিনের মাডিসনে। ফ্রিটজের বাবা ছিলেন ডাক্তার— ফ্রিটজই আমার ডায়েরির পিটার। ফ্রিটজ রোজ ওর বাবার চেম্বারের দরজায় আঁকা স্বস্তিকা চিহ্ন মুছে দিতো। ওরা থাকতো ওসনাব্রুকে। তারপর আত্ম‍‌‍‌গোপনের পর আত্মগোপন। শেষে ওরা চলে যায় আমেরিকায়। তাই ওরা বেঁচে গেলো। জানো ফ্রিটজকে জীবনের প্রায় শেয় সময় পর্যন্ত সবাই ডাকতো আমার কথা বলবার জন্য। তোমার কথা বলার তো কেউই রইলো না।’’

‘‘না সময় তার স্রোতেই রাচেল কোরিকে ভাসিয়ে নেবে। তবুও একটা জাতিকে মু‍‌‍‌ছে দেবার চক্রান্ত যার নায়ক ইজরায়েল তার ইতিহাস মুছে দেওয়া সহজ নয়। স্থানান্তরণ, জা‍‌তি নিশ্চিহ্নকরণ, প্রতিবাদের স্বর রোধ করা, অন্যের সম্পদ দখল করা প্যালেস্তাইনের নিজস্ব ইতিহাস ও সংস্কৃতিকে ধ্বংস করা, জাতি বিদ্বেষ থেকে একটা দেশের ভৌগোলিক চেহারাকে বিকৃত করা অন্যায়ের তা‍‌লিকা তো দীর্ঘ। সেই দীর্ঘ তালিকার শেষে আমাকে হত্যা। আমাকে হত্যা করে সেদিন যে রক্তের দাগ ইজরায়েলের হাতে লেগেছে তা হয়তো মার্কিন দেশের নদীর জল মুছে দেবে, কিন্তু হাজারো নিরীহ মানুষের রক্তের দাগ— তা মুছতে গিয়ে মার্কিন শাসকদের দেহেও তো রক্তের ছোঁয়া লাগলো, কেউ না কেউ তো তা দেখে শিউরে উঠবে চোখ মুখ বিকৃত করে বলবে ছিঃ। এতোটা হিংস্রও মানুষ হতে পারে।’’

‘‘তুমি তো সব জেনেই রাফায় গিয়েছিলে ?’’

ইজরায়েল চেয়েছিল নিজেদের মতো করে দুটো জনপদের সীমানা আঁকবে। ওদেত মদত দিচ্ছিল আমেরিকা, ওদের অভিযানের নাম ছিলো অপারেশন ফাস্ট লিড। ২০০৬-এ নির্বাচনে জেতে হামাস। তীব্র হয় প্রতি‍‌রোধ। আমি গিয়ে দেখেছিলাম কিভাবে রোজ অত্যাচারিত হচ্ছে মানুষ। সৈনিকের গুলি এ‍‌‍‌ফোঁড় ওফোঁড় করে দিচ্ছে নিরীহ মানুষের দেহ, গুঁড়িয়ে দিচ্ছে বাড়িঘর, রাস্তার দখল নিচ্ছে, দখল নিচ্ছে সম্পত্তির। মানুষ বলে নিজেকে সে সময় পরিচয় দিতেও লজ্জা হতো। আর মার্কিনী বলে পরিচয় দি‍‌তে হচ্ছিল ঘৃণা —নিজেকে ওদের একজন বলে পরিচয় দিয়েই যন্ত্রণাকে লুকোছিলাম। সে যন্ত্রণা আমার মনের। আর ওরা কাতরাচ্ছিল শরীরের যন্ত্রণায় কামানের গোলা, বোমা, বুলেট শিশু নারী বৃদ্ধ কাউকে রেয়াত করেনি। মানুষকে মেরে ওদের উল্লাস দেখে রোজ শিউরে উঠেছি। আর খবর পাচ্ছিলাম কিভাবে ইজরায়েলের হয়ে গলা ফাটাচ্ছেন মহামতি বুশ — ইজরায়েলের প্রধানমন্ত্রী শ্যারণ তখন আত্মরক্ষাকারী মানুষগুলোকে বলছেন ‘সন্ত্রাসবাদী’ আর ‘সন্ত্রাসবাদ’ নিয়ে বুশ সাহেবের চেনা কীর্তন চলছে অষ্টপ্রহর। দুনিয়া শুনছে সেই কীর্তনের কলনাদ —চাপা পড়ে যাচ্ছে মানুষের কান্না তারপর চাপা পড়ে গেলাম আমি।’’

‘‘শ্যারণ তো বলেছিলেন ওরা নাকি আল কায়েদার মতোই সন্ত্রাসবাদী। তাই তার এ লড়াই মার্কিনী ধর্মযুদ্ধেরই অংশ। আর সে কারণেই বুশ সাহেব ছিলেন ওদের পাশে।’’

‘‘সেদিন আমার সামনে ছিলো বুলডোজার, সেটা তার আগে গুঁড়িয়ে দিয়েছে বহু দেওয়াল, মাড়িয়ে এসেছে বহু মানুষের দেহ। তার আগে গরিব বসতিগুলোতে নির্বিচারে ছোঁড়া হয়েছে গ্রেনেড। মানুষগুলো রক্তাক্ত, হাতে নেই কোনো অস্ত্র। আমি সে সময় এধরনেরই হতভাগ্য এক পরিবারের বিপন্ন আশ্রয়ের সামনে হাজির। শুনেছি ওদেরকেও সন্ত্রাসবাদী তকমা পরিয়ে তৃপ্ত হয়েছেন শ্যারণ আর বুশ। আমি তখন ওদের বাড়ির দরজায় দাঁড়িয়ে আছি। তারপর এগিয়ে এলো বুলডোজার পিষে ফেললো আমায় ....’’

‘‘এটা দুর্ঘটনা। অন্তত হৃদয়হীন সরকারী ভাষ্যে এটা একান্তই অনিচ্ছাকৃত ভুল। তুমি তো পালাতেও পারতে। তা না করে তুমি দাঁড়িয়ে পড়লে বুলডোজারের সামনে। এমন জায়গায় প্রতিরোধ গড়তে চাইলে যে জায়গা তোমার রাফা পৌঁছনোর অনেক আগেই ঘোষিত হয়েছে মিলিটা‍‌রি জোন হিসাবে। আর তাই তো তোমার নামই সময় মুছে দেবে। তুমি কোনো পাঠ্যপুস্তকেও ঠাঁই পা‍‌বে না এটা তোমার দেশের শাসকদেরই হাজারো বিবেচনার উপসংহার।’’

‘‘তবে তাই হোক মুছে দাও আমার নাম ইতিহাস থেকে, মুছে দাও সভ্যতার প্রতিটি‍‌ ইমারত। মাথা উঁচু করে বাঁচুক লা‍‌শের স্তূপ আর তার উপর উড়িয়ে দাও বর্বরতার ধ্বজা।’’

‘‘বর্বরতা শেষ কথা বলে না রাচেল। বললে ফ্রিটজকে বারবার বলতে হতো না আমার কথা। তুমি তো আমার সন্তান আমার চেতনার সন্তান। তোমার মা তো কাঁদেন না —বলেন তিনি আর সবাই দাঁড়িয়ে আছেন আজও নিষ্ঠুর সভ্যতার শত্রুদের বুলডোজারের সামনে। তোমাকে বু‍‌কে করে আজও বাঁচে কয়েকজন— আগামীদিনে ওদের সংখ্যা বাড়বে বাড়বেই। আর তখন ওরাই ছিঁড়ে ফেলবে বুশ সাহে‍‌বের সরকারী ইতিহাস। তোমার মা সিন্ডা দেবেন তোমার ডায়েরি তাদেরই হাতে তুলে। আর ওদের কণ্ঠেই বেঁচে থাকবো তুমি আর আমি আনা ফ্র্যাঙ্ক ও রাচেল কোরি।’’


সৌজন্যেঃ- গণশক্তি (সম​য়ের সাথে)


মহিলা নির্যাতন রোধ নয়, অন্ধবিশ্বাস অক্ষুণ্ণ রাখতে অর্থ বরাদ্দ করে কর্ণাটক সরকার




  মহিলা নির্যাতন রোধ নয়, অন্ধবিশ্বাস অক্ষুণ্ণ  রাখতে অর্থ বরাদ্দ করে কর্ণাটক সরকার  


‘‘আমাকে এখানে আরও একমাস বসবাস করতে হবে। তারপর আমাকে স্নান করে মন্দিরে যেতে হবে, সেখানে আমার সন্তানের নামকরণ হবে। শুধুমাত্র তারপরেই আমি বাড়িতে প্রবেশের অনুমতি পাবো।’’ মাত্র ২০ দিনের সন্তানের মা জয়াম্মা, ছোট্ট ঝুপড়ি থেকে বেরিয়ে এসে এই কথাগুলি জানালেন। ভরা বর্ষায় গ্রাম থেকে দূরে চাষের জমির মাঝে একাকী দিন কাটাচ্ছেন। বাড়ির লোকজন তাঁর খাবার ঝুপড়ির পাশে রেখে চলে যায় বা থালায় ফেলে দেয়। যাতে তারা ‘‘দূষিত’’ না হয়ে যায়। কর্ণাটকের হিরিয়ুর তালুকের দিণ্ডাভারা পঞ্চায়েতের অন্তর্গত সুরাপ্পানাহাট্টিতে কাডু গোল্লা পশুপালক গোষ্ঠীর ২০০ ঘরের বসবাস। জয়াম্মা সেই আদিবাসী জনগোষ্ঠীর একজন। কর্ণাটকে গোল্লা বা পশুপালক জনগোষ্ঠীর মধ্যে অনেক বিভাজন রয়েছে। প্রধান দু’টি ভাগ হলো ‘‘ওরু গোল্লা এবং ‘‘কাডু গোল্লা’’। উত্তর ভারতের যাদব সম্প্রদায় থেকে এদের উৎপত্তি বলে কথিত রয়েছে। ওরু গোল্লা গোষ্ঠীর মানুষজন শহরাঞ্চলে বাসস্থান গড়লেও, বিপরীতে কাডু গোল্লা সম্প্রদায় ঐতিহাসিকভাবে নিজস্ব ক্ষুদ্রপল্লী গঠন করে যা হাট্টি বলে পরিচিত। মূলত শহরের প্রান্তে বা বৃহৎ গ্রামাঞ্চলের, এমনকি জঙ্গল ঘেঁষা অঞ্চলে তারা এই পল্লী নির্মাণ করে। কাঁটা‍ঝোপের বেড়া দিয়ে ঘেরা এদের বাসস্থানকে সহজেই চিহ্নিত করা যায়।

যাযাবর প্রকৃতির এই কাডু গোল্লা সম্প্রদায়ের মানুষ অতীতে গোরু ও ছাগল পালন করতেন। ইতোমধ্যে স্বল্পসংখ্যক মানুষ ক্ষুদ্র জমির মালিকানা লাভে সমর্থ হয়েছেন। শিক্ষিত অংশটি শহর এলাকায় স্থানান্তরিত হয়েছে। এদের মূলত চিত্রদুর্গ ও টুমকুর জেলায় দেখা যায়। এছাড়াও এদের উল্লেখযোগ্য অংশকে পার্শ্ববর্তী হাসান জেলায় দেখতে পাওয়া যায়। বিচ্ছিন্নভাবে কর্ণাটকজুড়েই এদের লক্ষ্য করা যাবে এবং অন্ধ্র প্রদেশের কিছু অংশেও তারা বসবাস করেন । ১৯৯০ সালে কর্ণাটকের তৃতীয় অনগ্রসর শ্রেণী কমিশনের প্রতিবেদনে উল্লেখ রয়েছে গোল্লারা হলো রাজ্যের ১.৩শতাংশ জনগণ। এরমধ্যে কাডু গোল্লাদের শতাংশ পৃথকভাবে না থাকলেও অনগ্রসর শ্রেণী ও সংখ্যালঘু মন্ত্রকের হিসেবে চিত্রদুর্গ জেলায় প্রায় ২৫১টি কাডু গোল্লা পল্লী রয়েছে। যার জনসংখ্যা প্রায় ১লক্ষ। সংলগ্ন জেলাগুলির হিসাব যোগ করলে কর্ণাটকে এই জনগোষ্ঠীর পরিসংখ্যান প্রায় ৩লক্ষ দাঁড়াবে। অত্যন্ত ধর্মভীরু এই সম্প্রদায় সমাজের মূলস্রোত থেকে নিজেদের পৃথক করে রেখে নিজেদের ধর্মবিশ্বাস ও কুসংস্কারের বাতাবরণকে অনেকখানি বহির্প্রভাব থেকে রক্ষার নামে সামাজিক কুপ্রথাকে লালন করে যেতে সক্ষম হচ্ছে। যার মূল শিকার হচ্ছেন সমাজের মহিলারা। কর্ণাটকের কুভেম্পু বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞানের অধ্যাপক এম গুরুলিঙ্গাইয়া তাঁর উপজাতি সংস্কৃতি সংক্রান্ত গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন — ‘‘এরা মনে করে যে তাদের জীবনযাত্রা নিয়ন্ত্রিত ও পরিপুষ্ঠ হয় একধরনের অপ্রাকৃতিক, আত্মিক ও জাদুশক্তির দ্বারা। কাডু গোল্লাদের সমগ্র জীবনধারাটি ধর্ম দ্বারা নিয়ন্ত্রিত বলা যায়। এরা বিভিন্ন দেব-দেবী, আত্মা ও ভূত-প্রেতে আস্থা রাখে, যা তাদের সমগ্র জীবনপ্রণালীকে নির্দেশিত করে থাকে।’’

কাডু গোল্লাদের বিশুদ্ধতা সম্পর্কে একটা অস্বাভাবিক ধারণা রয়েছে। তারা মনে করে কোনো মহিলা তার ঋতুচক্রের সময়পর্বে বা সন্তানপ্রসবের পরবর্তীতে সে অশুদ্ধ। সেই সময় তাকে গ্রামের বাইরে তিন থেকে পাঁচদিন পর্যন্ত থাকতে হবে প্রতিমাসে। প্রসূতি মহিলাদের ক্ষেত্রে এই নিষেধাজ্ঞা দু’ থেকে তিন মাস পর্যন্ত গড়ায়। এই পিতৃতান্ত্রিক ও ধর্মীয় সমাজে ঋতুচক্রের মতো জৈব প্রক্রিয়া ‘‘অভিশাপ’’, যার পরিণতিস্বরূপ রক্তপাত হয়। এই ধারণা এতটাই বদ্ধমূল কাডু গোল্লা সমাজে যে এমনকি সম্প্রদায়ভুক্ত শিক্ষিত পেশাজীবী মানুষরাও এই মতকে গ্রহণ করেন। চিত্রদুর্গ জেলার চাল্লাকেরে শহরের সরকারী কলেজের সমাজবিজ্ঞানের অধ্যাপক এইচ আজ্জাইয়ার মন্তব্য — ‘‘আমরা যখন হাট্টিতে ফিরে যাই, আমাদেরকে বিশুদ্ধতা সংক্রান্ত নিয়মকানুন অনুসরণ করতে হয়।’’ — এই ধারণাকেই পুষ্ট করে, যদিও গ্রামীণ হাট্টির তুলনায় শহর সংলগ্ন হাট্টিগুলিতে এই অন্ধ কুসংস্কার তুলনামূলক কম বলে অনেকে মনে করেন। চাল্লাকেরে শহরের কাটাপুনো হাট্টিতে এ ধরনের অন্ধ কুসংস্কার মানা হয় না বলে অনেকে বলে থাকেন।

কর্ণাটকে গোল্লা সম্প্রদায় ‘‘যাযাবর ও প্রায় ভবঘুরে আদিবাসী’’ হিসেবে স্বীকৃত। ১৯৯০-র দশকের প্রথমভাগে গোষ্ঠীর লোকজন রাজ্যজুড়ে মিছিল করলে কর্ণাটক সরকার ১৯৯৪ সালের সেপ্টেম্বরে তাদেরকে সবচেয়ে অনগ্রসর আদিবাসী হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে শিক্ষা ও সরকারী চাকরিতে ৪ শতাংশ সংরক্ষণ ঘোষণা করে। কাডু গোল্লারা তাদেরকে আদিবাসী হিসেবে ঘোষণার দাবি জানিয়েছে। স্থানীয় চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীরা এদের মধ্যেকার কুসংস্কার দূর করে মহিলাদের স্বাস্থ্যবিধান ও শিশুমৃত্যুর হার রোধ করার ক্ষেত্রে কার্যকর ভূমিকা গ্রহণ করতে পারেন। কিন্তু তারা যেকোন স্বাস্থ্য কর্মসূচী ব্যর্থ হওয়ার কথাই জানিয়েছেন। এমনকি মাত্র ৩০ বছর বয়সী মহিলারাও হিস্টেরকটমি অপারেশন করাচ্ছেন। প্রসূতি মহিলাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার প্রয়োজনেও কোন গ্রামবাসী তাঁকে স্পর্শ করেন না। স্বাস্থ্যকর্মীদের অভিজ্ঞতা হলো যে, গ্রামের সর্বত্র ঘুরে যাওয়ার পরেই গ্রামের বাইরের ঝুপড়িতে অবস্থানরত মহিলাদের স্বাস্থ্য পরিষেবা দিতে হবে।

এই ঘৃণ্য কুসংস্কার থেকে অনগ্রসর গোষ্ঠীর জনগণকে মুক্ত করার কোনো সরকারী উদ্যোগ না থাকলেও ‘‘মহিলা ভবন’’ গ‍‌ড়ে দেওয়ার পরিকল্পনা অনুসারে বিভিন্ন হাট্টিতে তা তৈরি করা হচ্ছে কাডু গোল্লাদের ‘‘অভিনব সাংস্কৃতিক প্রথা’’কে সম্মান জানিয়ে। শুধু চিত্রদুর্গ জেলায় ইতোমধ্যে ১৩টি মহিলা ভবন গড়ে তোলা হয়েছে প্রায় ৬৫লক্ষ টাকা ব্যয় করে। আবার গ্রাম পঞ্চায়েত অনেক ক্ষেত্রে এই নবনির্বিত গৃহকে পঞ্চায়েতের সম্পত্তি বলে ঘোষণা করছে, মহিলা ভবন নয়। কর্ণাটক সরকারের এই উদ্যোগ অত্যন্ত সমালোচিত হচ্ছে। আদতে এই ঘরগুলি অন্য উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হবে এবং মহিলাদের প্রতি পরিহাসস্বরূপ এই ঘটনা আধুনিক ভারতের যে চিত্র তুলে ধরা হচ্ছে তা মর্মান্তিক। যাদব সম্প্রদায়কে শিক্ষিত করে তুলে এ ধরনের অবৈজ্ঞানিক ও সনাতন প্রথা থেকে বের করে আনার উদ্যোগ না গ্রহণ করে সস্তা সমর্থন লাভের আশায় যে কর্মসূচী নেওয়া হয়েছে তা সমস্ত অংশের যুক্তিবাদী জনমতের পক্ষে নিন্দা করা হয়েছে। বিভিন্ন মহিলা সংগঠনের পক্ষে দাবি জানানো হয়েছে পিছিয়ে পড়া সম্প্রদায়ের বাসস্থান এলাকাগুলিকে রাজস্ব গ্রাম হিসেবে ঘোষণা করে বিভিন্ন সরকারী প্রকল্পের সুযোগ তাদের কাছে পৌঁছে দেওয়ার মাধ্যমে তাদের মধ্যে শিক্ষার ও স্বাস্থ্যের মান বাড়িতে তুলতে হবে। চিত্রদুর্গ, টুমকুর, হাসানের রাস্তার পাশে পরিত্যক্ত বাসস্ট্যান্ড, গাছতলা, পরিত্যক্ত বাড়ি, গোয়ালঘর এমনকি খোলা আকাশের নিচে বা ছোট্ট ঝুপড়িতে মহিলারা দিন কাটাচ্ছেন দেখতে পাওয়া যাবে। যদিও আজকের দিনে ঐ সম্প্রদায়েরই মহিলা ও যুব সম্প্রদায়ের মধ্যে এই অন্ধ কুসংস্কারের বিরুদ্ধে তীব্র জনমত পরিলক্ষিত হচ্ছে। কিন্তু প্রবীণ জনমত ও পুরোহিতরা এই ঘৃণ্য প্রথাকে মদত জোগাচ্ছে। সংস্কারের পক্ষে যখন মনোভাব জোরালো হচ্ছে, তখন রাজ্য সরকারকে অবশ্যই নীতি গ্রহণ করতে হবে যা এই প্রথাকে দূর করতে সহায়ক হবে। সংস্কারকদের পক্ষ গ্রহণ করতে হবে কুপ্রথাকে মদত জোগানোর পরিবর্তে। 


সৌজন্যেঃ- গণশক্তি (সম​য়ের সাথে)

র‌্যাচেল কেরি— নিষ্ঠুর বিচার



  র‌্যাচেল কেরি— নিষ্ঠুর বিচার  

     

বিক্রমজিৎ ভট্টাচার্য


র‌্যাচেল কেরি— একবিংশ শতাব্দীর প্রতিবাদের আরেক নাম। সাম্রাজ্যবাদী পেশিশক্তির বর্বরতম খুনের অন্যতম প্রতীক। ২০০৩ এর মার্চে মধ্যপ্রাচ্যের গাজা ভূখণ্ডে ইজরায়েলী সেনাবাহিনীর বুলডোজার পিষে মেরে ফেলেছি‍‌লো ২৪ বছর বয়সী মার্কিন যুবতী র‌্যাচেলকে। তার অপরাধ, প্যালেস্তা‍‌ইনের সমর্থনে গলা ফাটানো, গাজা ভূখণ্ডে ইজরায়েলী সরকারের আক্রমণে গৃহহীন অসহায় মানুষগুলোর পাশে সহমর্মিতায় দাঁড়িয়েছিলেন র‌্যাচেল। আন্দোলন করছিলেন, Inte

ation Solidarity Movement এর অন্যতম সদস্যা হিসেবে।

র‌্যাচেল এর মৃত্যুর পর তার পরিবার ইজরায়েলের আদালতে একটি মামলা দায়ের করেছিলেন, যাতে তাদের আইনজীবী পরিষ্কারভাবে র‌্যাচেলের মৃত্যুর জন্য ইজরায়েলী সেনাবাহিনীকে দায়ী করে তার বক্তব্য পেশ করেছিলেন। কিন্তু দীর্ঘ শুনানির শেষে ৯ বছর পরে আগস্ট ২০১২ তে ইজরায়েল এর ‍‌ডিস্ট্রিক্ট কোর্ট রায় দি‍লো ইজরায়েলী সেনাবাহিনীর স্বপক্ষেই। র‌্যাচেল এবং ISM -এর কর্মকাণ্ডকে বলা হলো, ‘বেআইনী, হটকারিতা’। পরিষ্কারভাবে বোঝা যায়, ইজরায়েলী সরকারের চাপে পড়ে কোর্টের এই একতরফা সিদ্ধান্ত। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলির চাপে বাধ্য হয়ে শেষপর্যন্ত তেল আভিভ-এ নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূতও বাধ্য হন বলতে ‘তদন্তে ত্রুটি ছিলো, আরও স্বচ্ছ্বতার প্রয়োজন ছিলো। অথচ র‌্যাচেল কিন্তু ছিলো মার্কিন নাগরিক। মার্কিনী রাষ্ট্রদূতের প্রতিক্রিয়াটি একেবারেই লঘু, কারণ মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ বিস্তারের অন্যতম দোসর হলো ইজরায়েল, ওবামার এক নম্বর ঘনিষ্ঠ সহযোগীও বটে।

র‌্যাচেলকে খুনের এই মামলাটি যাতে গুরুত্ব হারায়, সেটা করতে ইজরায়েল প্রশাসন চেষ্টার কোন ত্রুটি রাখেনি। প্রথমেই, যে চিকিৎসক র‌্যাচেলের মৃতদেহ পরীক্ষা করে মৃত্যুর কারণ সম্পর্কে সুনিশ্চিত রিপোর্ট দেন। সেই চিকিৎসকে আদালতে জবানবন্দী দেওয়ার ব‌্যাপারে সরকারী নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। এছাড়াও প্রত্যক্ষদর্শী কারোরই বক্তব্য কোর্টে গ্রাহ্য করা হয়নি। বিচারক ওতেত গারসন তার রায়দান প্রক্রিয়ার সময় স্পষ্ট ভাষায় বলেন, ‘এটি একটি দুর্ঘটনা, এরজন্য কোনভাবেই ইজরায়েলী প্রশাসন বা সেনাবাহিনীকে দায়ী করা যুক্তিযুক্ত নয়। র‌্যাচেল নিজে ইচ্ছে করেই বুলডোজারের সামনে এসেছিলেন, একজন দায়িত্ববান, সুস্থ মহিলা কখনই এমন কাজ করেন না’।

বিশ্বের সকল প্রগতিশীল প্রতিবাদী মানুষের কাছে এই রায়ের কোন মূল্য নেই এবং ইজরায়েলী প্রশাসন দ্বারা সম্পূর্ণরূপে নিয়ন্ত্রিত সে দেশের বিচার ব্যবস্থা সম্পর্কেও পৃথিবীর মানুষ অবহিত হওয়ার সুযোগ পেলেন।

বিচারক গারসন তার ৬২পাতার রায়ে ইজরায়েলী সেনাবাহিনীর বিন্দুমাত্রও কোন দোষত্রুটির কথা উল্লেখ করেননি অথচ প্রত্যক্ষদর্শীদের বয়ান অনুযায়ী ঘটনাটি ছিলো : ‘গাজা ভূখণ্ডে প্যালেস্তিনীয় সমর্থক জনৈক নাসারেল্লার বাড়িটিকে গুঁড়িয়ে দেওয়ার লক্ষ্যে এগিয়ে আস‍‌ছিলো ইজরায়েলী সেনাবাহিনীর বুলডোজারটি। র‌্যাচেল বাধাদান করতে এগিয়ে আসে একটি লাউডস্পিকার হাতে নিয়ে, আসেপাশে কিছু প্যালেস্তিনীয় সমর্থকও ছিলো। কিন্তু বুলডোজারের গতি কমেনি, বিন্দুমাত্র মানবিকতাবোধটিকেও দূরে সরিয়ে রেখে র‌্যাচেলকে প্রথম ধাক্কায় মাটিতে ফেলে তার ওপর দিয়ে চালিয়ে দেওয়া হয় প্রাণহন্তা যান্ত্রিক বস্তুটি। রীতিমতো আওয়াজ হয়ে ভেঙে যায় র‌্যাচেলের শরীরের সমস্ত হাড় ও তার মাথার খুলি।’

পৃথিবীর ইতিহাসে অন্যতম নারকীয় ও বর্বর হত্যাকাণ্ড। ইজরায়েল সরকারের নিয়ন্ত্রিত ‘পুতুল’ বিচারক ও তার বিচারসভা কোন কথাই শুনতে চায়নি।

র‌্যাচেলের মা কান্তি কেরি কো‍‌র্টের বাইরে এসে সাংবাদিকদের বলেন, ‘শুধু আমাদের পরিবারের জন্যই নয়, সারা পৃথিবীর মানবাধিকার রক্ষার ক্ষেত্রে এই রায় চূড়ান্ত হতাশাজনক এবং আজকের দিনটি মানবতা-বিরোধী দিন হিসেবেও চিহ্নিত হয়ে রইল।’ র‌্যাচেলের পক্ষে দাঁড়ানো আইনজীবী হুসেন আবু হুসেনের কথায়, ‘এই রায় আগামীদিনে ইজরায়েলী সেনাবাহিনীকে আরও উদ্বুদ্ধ করলো মানবাধিকার লঙ্ঘনের ক্ষেত্রে।’

গাজা ভূখণ্ডে ২০০০ সাল থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত চার বছরের মধ্যে মার্কিন মদতপুষ্ট ইজরায়েল সম্পূর্ণ অন্যায়ভাবে প্রায় ২৫০০ প্যালেস্তিনীয় সমর্থকের বাড়ি গুঁড়িয়ে দিয়েছে বুলডোজার দিয়ে। গৃহহীন হয়েছেন প্রায় পঁচিশ হাজার নিরপরাধ মানুষ এবং সবচেয়ে দুর্ভাগ্যজনক, পূর্ববর্তী কোন ঘোষণা ছাড়াই ধ্বংস করা হয়েছে গরিব মানুষের বাসস্থানগুলো। সাম্রাজ্যবাদী শক্তির এই নিষ্ঠুর আগ্রাসনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলো র‌্যাচেল। বিগত আট বছর ধরে চলতে থাকা র‌্যাচেল হত্যার এই বিচার প্রক্রিয়াটিতে ইজরায়েল কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রচ্ছন্ন মদত পেয়ে আসছে। প‌্যালেস্তাইনের ওপর আক্রমণের ধারও ক্রমাগত বাড়িয়ে চলেছে ইজরায়েল। নিশ্চুপ সারা পৃথিবীর স্বঘোষিত গণতন্ত্র ও মানবাধিকার রক্ষার পাহারাদার আমেরিকা।
সৌজন্যেঃ- গণশক্তি (সম​য়ের সাথে)


Tuesday, October 16, 2012

পুষ্টির ঘাটতি



  পুষ্টির ঘাটতি  

কেয়া পাল

ভারতের জনসংখ্যা পৃথিবীর জনসংখ্যার মানচিত্রে একটি উল্লেখযোগ্য স্থান দখল করে আছে। চীনের পরই ভারতের স্থান। কিন্তু পুষ্টির গুরুত্বের দিক থেকে আমাদের দেশ সারা পৃথিবীর মধ্যেই পিছিয়ে রয়েছে। কৃষিপ্রধান দেশ হয়েও এদেশের সব মানুষ দু’বেলা পেট ভরে খেতে পায় না। অপুষ্টি তাই এদেশের এক-তৃতীয়াংশ মানুষের নিত্যসঙ্গী। এই অপুষ্টির পেছনে রয়েছে অজ্ঞতা, কুসংস্কার, পুষ্টিশিক্ষার অভাব প্রভৃতি কারণসমূহ। ভারতীয় চিকিৎসা গবেষণা পরিষদ (আই সি এম আর) পুষ্টি বিষয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা চালিয়েছে। আই সি এম আর-র বিভিন্ন ধরনের গবেষণা থেকে দেখা গেছে যে, ভারতীয় মহিলারা পুষ্টিকর খাদ্যের অভাবে বিভিন্ন ধরনের রোগের শিকার হয়ে দীর্ঘদিন ভুগেছেন এবং অনেকেই অপুষ্টির কারণে পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছেন। আই সি এম আর-র পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, ভারতে মোট মৃত্যু সংখ্যার ৪০% হলো ‍‌‍‌শিশু, যাদের বয়স মূলত ৬বছরের মধ্যে। অথচ একটি উন্নত দেশে এই জাতীয় শিশু মৃত্যুর হার মাত্র ৪%।

আই সি এম আর-এর গবেষণায় দেখা গেছে যে, ভারতীয়দের খাদ্যে ক্যালোরির পরিমাণ প্রয়োজনের তুলনায় অনেকটাই কম।

জাতীয় পুষ্টি মনিটরিং ব্যুরো (এন এন বি এন) যে ‍‌রিপোর্ট পেশ করেছে তাতে দেখা গেছে বর্তমানে ভারতের জনগণের ৫০% পরিবার যে ধরনের খাদ্য গ্রহণ করে তাতে‍‌ প্রোটিন, শক্তি উভয়েরই যথেষ্ট ঘাটতি আছে। এক্ষেত্রে মানুষের দারিদ্র্যের সঙ্গে পুষ্টি বিষয়ক জ্ঞানের অভাবও এক‍‌টি গুরুত্বপূর্ণ কারণ হিসেবে দেখা যায়।

ভারতীয়দের মধ্যে ক্যালোরি এবং প্রোটিন ছাড়াও অন্যান্য পুষ্টি উপাদানের অভাব লক্ষ্য করা যায়। এগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ‘ভিটামিন এ’, ‘ভিটামিন বি কমপ্লেক্স’, লৌহ, প্রভৃতি। সমীক্ষায় জানা গেছে, ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের বহু মানুষ, বিশেষ করে মহিলা ও শিশুরা ‘ভিটামিন এ’ জনিত অপুষ্টির কারণে দৃষ্টিশক্তি হারাচ্ছে। আজও লক্ষ লক্ষ মহিলা চোখের রোগে ভুগছেন। লৌহের অভাবে গর্ভবতী নারী, প্রসূতি নারী এবং শিশুরা অ্যানিমিয়া বা রক্তাল্পতা রোগের শিকার হচ্ছে। ‘ভিটামিন বি কমপ্লেক্স’-র অভাবে মহিলা ও শিশুরা গ্লোসাইটিস, চিলোসিস প্রভৃতি রোগে কষ্ট পাচ্ছেন।

ভারতের প্রতিটি নাগরিক (মহিলা ও শিশু) কী জাতীয় খাদ্য কত পরিমাণ গ্রহণ করে তাতে কী পরিমাণ পুষ্টিমূল্য তথা ক্যালোরি থাকে এসব নিয়ে দেশজুড়ে গবেষণামূলক সমীক্ষা চালিয়ে পুষ্টি বিষয়ক জাতীয় প্রতিষ্ঠান (এ আই এন) যেসব তথ্য প্রকাশ করেছে তা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, ভারতীয় মহিলারা প্রয়োজনের তুলনায় অধিক পরিমাণ শস্যজাতীয় খাদ্যসামগ্রী গ্রহণ করেন। তাঁরা দৈনিক গ্রহণ করেন ৪৮৬গ্রাম শস্যজাতীয় খাদ্য। পশ্চিমবঙ্গের অধিবাসীরা দৈনিক এই জাতীয় খাদ্যগ্রহণ করেন ৪৩৫গ্রাম। মোট কথা ভারতীয় মহিলাদের মধ্যে শস্য জাতীয় খাদ্যকণাই প্রধান খাবার হিসাবে গৃহীত। এইসব শস্য জাতীয় খাদ্যের মধ্যে থাকে চাল, গম, যব, জোয়ার, বাজরা এবং রাগি। সমীক্ষা থেকে জানা যায় যে, ভারতীয় মহিলাদের মোট ক্যালোরি এবং প্রোটিনের সিংহভাগই (প্রায় ৮০%) আসে শস্যকণা থেকে।

ভারতীয় মহিলাদের প্রতিদিন মাথাপিছু ৭০গ্রাম ডাল গ্রহণ করা উচিত। কিন্তু প্রতিদিন তাঁরা গড়ে ডাল গ্রহণ করেন মাত্র ৪১গ্রাম যা প্রয়োজনের তুলনায় ২৯গ্রাম করে কম। যদিও পশ্চিমবঙ্গের অধিবাসীদের ক্ষেত্রে একজন প্রাপ্তবয়স্ক মহিলা দৈনিক ৪৭গ্রাম ডাল গ্রহণ করে। সারা ভারতের নিরিখে বিহার, মধ্য প্রদেশ এবং উত্তর প্রদেশের অধিবাসীরা তুলনামূলকভাবে বে‍‌শি মাত্রায় ডাল গ্রহণ করেন। অন্যদিকে অন্ধ্র প্রদেশ, কেরালা, জম্মু-কাশ্মীর এবং তামিলনাডুর বাসিন্দারা তুলনামূলকভাবে কম ডাল খান।

আই সি এম আর-র সমীক্ষা থেকে জানা গেছে ভারতীয়দের ডাল এবং শস্য জাতীয় খাদ্য গ্রহণের অনুপাত ১:১২। কিন্তু এই অনুপাত হওয়া উচিত ১:৫, কেননা ডালের মধ্যে থাকা দ্বিতীয় শ্রেণীর এবং খাদ্যশস্যের মধ্যে থাকা দ্বিতীয় শ্রেণীর প্রোটিন একত্রে দেহে গৃহীত হলে তা মহিলাদের দেহ গঠনের ক্ষেত্রে কার্যকর ভূমিকা পালনে সাহায্য করে।

পুষ্টি বিষয়ক জাতীয় সমীক্ষা থেকে আরও জানা যায়, ভারতীয় মহিলাদের খাদ্যে মাছ, মাংস, ডিম, দুধ, ফল, ইত্যাদি ভিটামিন, খনিজ লবণ এবং প্রোটিন সমৃদ্ধ খাদ্যের যথেষ্ট ঘাটতি রয়েছে। তবে একথা ঠিক যে, মহিলাদের শারীরিক গঠন, দৈহিক সুস্থতা বজায় রাখা, কর্মক্ষমতা বজায় রাখার জন্য এইসব খাদ্য বিশেষভাবে প্রয়োজন। তবুও আর্থিক কারণে, কোথাও ধর্মীয় গোঁড়ামি, আবার কোথাও বা কুসংস্কারের ফলে এইসব খাবার তাঁদের খাদ্য তালিকায় থাকে না। রাজস্থান, হরিয়ানা, পাঞ্জাব এবং মধ্য প্রদেশের মানুষ ছাড়া অন্যান্য রাজ্যের মহিলা ও শিশুরা দুধ এবং দুগ্ধজাত খাদ্য তুলনামূলকভাবে কম গ্রহণ করেন।

ভারতবর্ষের উৎপাদনের ঘাটতি এবং বাজারে আমদানি না হওয়ার কারণেও ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের মহিলা ও শিশুরা বিভিন্ন ধরনের খাদ্যসামগ্রী প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম পরিমাণে খান। তাছাড়া, ভারতীয় মহিলাদের খাদ্যে আর একটি বড় ঘাটতি হলো স্নেহ পদার্থ। একজন প্রাপ্তবয়স্ক মহিলার গড়ে দৈনিক স্নেহজাতীয় পদার্থের পরিমাণ হওয়া উচিত ৩৮গ্রাম। কিন্তু বাস্তবে লক্ষ্য করা যায় একজন প্রাপ্তবয়স্ক মহিলা দৈনিক ১৯গ্রাম স্নেহপদার্থ গ্রহণ করেন। এটি প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম। স্নেহপদার্থ যেহেতু ভিটামিন এ, ডি, ই এবং কে- র শোষণে সাহায্য করে, তাই স্নেহপদার্থের অভাবে এই সব ভিটামিন খাদ্যের মাধ্যমে দেহে গৃহীত হলেও তা মহিলাদের দেহের মধ্যে পুরোমাত্রায় শোষিত হয় না।

ওপরের বিভিন্ন সমীক্ষা ও গবেষণামূলক তথ্য থেকে বোঝা যায় ভারতীয় মহিলা ও শিশুদের মধ্যে পুষ্টিগত ঘাটতি এক‍‌টি অন্যতম সমস্যা। পুষ্টির এই ঘাটতি মেটাতে না পারলে সামগ্রিকভাবে মহিলা ও শিশুদের শারীরিক বিকাশ সম্ভব নয়। একমাত্র সুষম আহারই পারে এই ঘাটতি মেটাতে।
সৌজন্যেঃ- গণশক্তি (সম​য়ের সাথে)

সুখী গৃহকোণ, শোভে গ্রামোফোন



সুখী গৃহকোণ, শোভে গ্রামোফোন :- 


অশোক দাস

            বিগত শতকের তিন-চারের দশকে ‘বিচিত্রা’ ‘ভারতবর্ষ’ ‘বঙ্গশ্রী’ ‘সাহানা’ ‘দুন্দুভি’ ‘খেয়ালী’ ‘ছন্দা’ ‘দীপালি’ ‘প্রবাসী’ ইত্যাদি মাসিক বা সাপ্তাহিক পত্রিকাগুলি খুললেই চোখে পড়তো একটি বিশেষ বিজ্ঞাপন ‘সুখী গৃহকোণ, শোভে গ্রামোফোন।’ এছাড়াও তখন হিজ মাস্টার্স ভয়েস, টুইন, হিন্দুস্থান রেকর্ডস, রিগ্যাল, মেগাফোন, সেনোলা, পাইওনিয়ার ইত্যাদি গ্রামোফোন কোম্পানিগুলি থেকে যে নিয়মিত ক্যাটালগ প্রকাশিত হতো তাতে এই বিজ্ঞাপনটি থাকতো, সাথে থাকতো একটি বক্স গ্রামোফোনের ছবি। হিজ মাস্টার্স ভয়েস-এর ক্যাটালগে একাধিক মডেলের গ্রামোফোনের ছবি থাকতো। বক্স গ্রামোফোন, চোঙাওলা গ্রামোফোন এবং নানা মাপের টেবিল গ্রামোফোনের ছবি ও তাদের দাম লেখা থাকতো এই সমস্ত বিজ্ঞাপনে। আমাদের বাড়িতে ‍‌ যখন এইসব পত্রিকা আর ক্যাটালগ আসতো, তখন আমি পৃথিবীর আলো দেখিনি। (বাবা নিত্যানন্দ কলকাতায় গ্রামোফোন কোম্পানিতে গান বাঁধতেন, সুর দিতেন, নিজেও গাইতেন। শচীন সেনগুপ্ত’র মতো নাট‌্যকারদের নাটকের জন্যেও গান লিখতেন। ছোট বড় পত্রিকায় তাঁর লেখা গানও ছাপা হতো।) 

আমাদের ছোট গ্রামটিতে আমাদের ছাড়া ডাক্তারবাবুদেরও একটি চোঙাওলা গ্রামোফোন ছিল! মহিম ডাক্তারবাবুর বড় ছেলে চারুবাবু কিনেছিলেন সেটি। বাজতো, ‘কাদের কূলের বৌ গো তুমি, কাদের কূলের বৌ’ অথবা কানা কেষ্ট অর্থাৎ কৃষ্ণচ্ন্দ্র দে-র গান ‘ছুঁয়ো না ছুঁয়ো না বধূ ঐখানে থাকো’, অথবা ইন্দুবালার গাওয়া কাজীর গান ‘মোর ঘুমঘোরে এলে মনোহর।’ সে সুরের সাথে আজকের সুর মেলে না! চারুবাবুর সেজভাই ডাক্তার ছিলেন। তিনি অবশ্য গ্রামোফোন কেনেননি। পরে অনেক পরে চারুবাবুর ছোটছেলে বাদলকাকু কিনলেন বক্স গ্রামোফোন—সিঙ্গল স্প্রিং-এর। কুকুরের ছাপওয়ালা হিজ মাস্টার্স ভয়েস অথবা যমজ শিশুর ছবিওয়ালা টুইন পিনের বাক্স থেকে পিন বের করে তা সাউন্ড বক্সে ফিট করে স্প্রিং-এ দম দিয়ে রেকর্ডটি একটি প্লেটে চাপিয়ে দিয়ে ‘অন’ করলেই রেকর্ডটি ঘুরতে থাকতো এবং যত্ন করে রেকর্ডের কোণায় পিনটি লাগিয়ে দিলেই বেজে উঠতো মিউজিক, ভেসে আসতো ধনঞ্জয় ভট্টাচার্যের গলা ‘শোনা শোনো, কথাটি শোনো’ আমরা পুলকে শিউরে উঠতাম এই আজব কুদরতি দেখে।

মনে পড়ে, প্রতিমা রঙ করা হয়ে গেছে, বীরভূমের হজরতপুরের ত্রিভঙ্গ মিস্ত্রিমশাই তাঁর ছেলে গোপালকে নিয়ে প্রতিমায় বার্নিশ লাগাচ্ছেন, আমরা বলতাম ঘামতেল লাগানো হচ্ছে। ষষ্ঠীর দিন ইটাপাড়া থেকে ডাকসাজ নিয়ে আসবে থানাদার শুক্র সোনা। বাবা কলকাতা থেকে এলেন পুজোর কাপড়ের বাজার নিয়ে, সঙ্গে কয়েকটি শারদ সংখ্যার পত্রিকা, কয়েকটি গানের ক্যাটালগ এবং বেশ কয়েকটি গ্রা‌মোফোন রেকর্ড। বাদলকাকুরা তার আগেই আসানসোল থেকে কিনে এনেছেন জগন্ময় মিত্র, ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য, সুপ্রীতি ঘোষ, সুপ্রভা সরকার, উৎপলা সেন, হেমন্ত মুখার্জির গানের রেকর্ড। বাবাও এনেছেন শচীন দেববর্মণ, সত্য চৌধুরী, সুবীরলাল চক্রবর্তী, শীলা সরকার, দীপালী তালুকদার, কাননবালা, কমলা ঝরিয়ার গানের রেকর্ড।

বাবার কাছে কেনা রেকর্ড ছাড়াও কিছু স্যাম্পল রেকর্ড ছিল। ফাইনাল রেকর্ডিং হওয়ার আগে স্যাম্পল রেকর্ড বের করা হতো। সাদা কাগজের লেবেলে ফাউন্টেন পেনে গানের প্রথম লাইন, গীতিকার ও সুরকারের নাম লেখা থাকতো। এইরকম একটা স্যাম্পল রেকর্ডে ছিল কাজী নজরুলের লেখা কে মল্লিকের গাওয়া একটি আগমনী গান। এই কে মল্লিকের নাম কাশেম মল্লিক, বাড়ি বর্ধমানে, অনেক বয়সে একথা জেনেছিলাম। আমাদের বৈঠকখানায় গ্রামোফোন বাজলেই ছোটোছোটো ছেলেরা ছাড়াও রজনী বাউড়ির ছেলে হরেন্দ্র, যুগল বাউড়ি, চমন সওদাগর, রমজান চাচা, পাড়ার যুবক ভুতুদা, মণীন্দ্রদা, তারাপদকাকু, প্রহ্লাদ ঘোষ এরাও এসে গান শুনতো। পুজোর আগে কাজী নজরুল লিখছেন আগমনী গান, গাইছেন কাশেম ‍‌মল্লিক, শুনছেন রমজান চাচা। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এর চেয়ে প্রকৃষ্ট উদাহরণ আর কী হতে পারে? এছাড়াও বাজতো জ্ঞানেন্দ্রপ্রসাদ গোস্বামীর গাওয়া কাজী নজরুলের ‘আমার শ্যামা মায়ের কোলে চড়ে’ আর ‘শ্মশানে জাগিছে শ্যামা মা’ গান দুটি। ম্যাজেন্টা রঙের লেবেলে ‘চোঙাওয়ালা গ্রামোফোনে গান শুনছে একটি প্রভুভক্ত কুকুর। এই ছাপা ছিল হিজ মাস্টার্স-এর ট্রেড মার্ক। গ্রামোফোন কোম্পানি থেকে ‘হিজ মাস্টার্স ভয়েস’ ছাড়াও ‘কলম্বিয়া’ রেকর্ড প্রকাশিত হতো। কলম্বিয়াতে গাইতেন হেমন্ত মুখার্জি, ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য, সন্ধ্যা মুখার্জি, আর হিজ মাস্টার্স ভয়েস’- এ গাইতেন শ্যামল মিত্র, সতীনাথ মুখার্জি, তরুণ বন্দ্যোপাধ্যায়। প্রথমে ভায়োলেট রঙের পরে নীল রঙের লেবেলে বাঘের ছবি আঁকা থাকতো কলম্বিয়া রেকর্ডে। ১৯৩৯সালে বাবা হিজ মাস্টার্সে রেকর্ড করেছিলেন ‘ব্রজের কানাইয়া জাদুকর’ আর ‘রূপে মায়ের ত্রিভুবন আলা’ ঝুমুর গান দুটি। সেই সিরিজেই দীপালী তালুকদার রেকর্ড করে‍‌ছিলেন তাঁর প্রথম গান ‘মেঘ মেদুর বরষায়’ আর ‘রুমঝুম রুমঝুম নূপুর বোলে’ জয়জয়ন্তী আর নটবেহাগ রাগে নিবদ্ধ কাজী নজরুলের লেখা বাংলা খেয়াল দুটি। বাবাকে তিনি এই রেকর্ডটি প্রেজেন্ট করেছিলেন, কভারে তাঁর সই ছিল। সেই রেকর্ডটি এবং কভারটি কালের গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। হিজ মাস্টার্সের রেকর্ডের নম্বরের আগে ‘এন’ এবং কলম্বিয়ার নম্বরের আগে জি ই লেখা থাকতো, আরেকটি জনপ্রিয় রেকর্ড কোম্পানি থে‍‌কে টুইন রেকর্ড প্রকাশিত হতো। এই রেকর্ড কোম্পানির সাথে প্রখ্যাত সুরকার গিরীন চক্রবর্তী যুক্ত ছিলেন। হলুদ রঙের লেবেলে কালো কালিতে যমজ শিশুর ছবির নিচে গানের লাইন, গীতিকার ও সুরকারের নাম লেখা থাকতো। রেকর্ডের নম্বরের আগে একটি লেখা থাকতো। টুইন কোম্পানি থেকেও নজরুলের বহু গান প্রকাশিত হয়েছিল। গিরীন চক্রবর্তী নজরুলের বেশ কিছু গানে সুর দিয়েছিলেন। টুইন রেকর্ডে নজরুলের কিছু ইসলামী গান প্রকাশিত হয়েছিল, গাইতেন চিত্ত রায়, ধীরেন দাসেরা। নজরুল চিত্ত রায়ের গানকে ইসলামী সমাজে গ্রহণযোগ্য করতে তাঁর নাম দিয়েছিলেন দেলওয়ার হোসেন। নজরুল যেমন গান লেখা ও সুর দেওয়ায় দক্ষ ছিলেন তেমনি রেকর্ডের বাণিজ্য কীভাবে হবে সেটাও ভালো বুঝতেন।

টুইন রেকর্ড থেকে বাবার একটা গান গেয়েছিলেন জ্ঞানপ্রিয়া বৈষ্ণবী, গানটি ছিল ‘ঝুলন খেলায় বাঁশি ফুকারে গো’। উলটো পি‍‌ঠে ছিল নিকুঞ্জ চক্রবর্তীর লেখা বাবার সুর দেওয়া ‘কানে গুঁজে ধুতুরার ফুল গো’, পুজোর দিনগুলিতে দুপুরে মা-পিসিমা শুনতেন পালা রেকর্ড। সেনোলা রেকর্ডে ‘উমার তপস্যা’ আর রিগ্যাল রেকর্ডে’ দস্যু রত্নাকর’ নামে আমাদের দুটো পালা ছিল। ‘উমার তপস্যা’ ছিল চারটি রেক‍‌র্ডে আর ‘দস্যু রত্নাকর’ ছিল তিনটি রেকর্ডে। সেনোলার লেবেল ছিল হালকা সবুজ রঙের কাগজের উপর ময়ূরের ছবি। এতে নবদ্বীপ হালদার বেশ কিছু কমিক গানের রেকর্ড করেছিলেন। আমাদের বাড়িতে ছিল ‘ফ‌্যান্তা ফ‌্যাচাং তরকারি’ আর ‘শরীরটা আজ বেজায় খারাপ’ গান দুটির একটি রেকর্ড। রিগ্যাল রেকর্ডের লেবেলের রঙ ছিল হিজ মাস্টার্স ভয়েসের মতোই আগুন রঙের বা ম্যাজেন্টা রঙের। তবে কোনো ছাপ থাকতো না। বাদলকাকুর বাড়িতে ছিল হিজ মাস্টার্স ভয়েসের ‘লক্ষণ ঊর্মিলা’ পালা। এই পালার ‘ভুলি নাই, ভুলি নাই, আজো মনে পড়ে নাম ধরে ডাকা’। গানটি আমাদের বন্ধু নব গলায় তুলে নিতে পেরেছিল। আর সে গাইতো কলম্বিয়া রেকর্ডে কানন দেবীর গাওয়া ‘মেজদিদি’ ফিল্মের গান ‘প্রণাম তোমায় ঘনশ্যাম’। গানটি আমাকেও ডুয়েটে তার সাথে গাইতে হতো। আমরা তখন ক্লাস সিক্স সেভেন-এর ছাত্র। রিগ্যাল রেকর্ড থেকেও বাবার দু’খানি গান ‘খেলা খেলিব রে’ আর ‘কাল কেউটে সাপালি’ প্রকাশিত হয়েছিল।

‘উদয়ের পথে’ ছবিতে রবীন্দ্রনাথের ‘চাঁদের হাসির বাঁধ ভেঙেছে’ গানটি ব্যবহৃত হয়েছিল। গানটি পাইওনিয়ার রেকর্ড থেকেও প্রকাশিত হয়েছিল। বড় সুন্দর ছিল পাইওনিয়ার রেকর্ডের লেবেলটি। একটি বহুবর্ণে চিত্রিত লেবেলে একটি উড্ডীয়মান মরালের ছবি আঁকা থাকতো। আমাদের বাড়িতে পাইওনিয়ার কোম্পানির দু’খানা রেকর্ড ছিল। আমি নয়ন ভরে এর লেবেলটি দেখতাম, আর দেখতাম! ‘উদয়ের পথে’ ফিল্ম এবং ‘চাঁদের হাসির বাঁধ ভেঙেছে’ গান এতই জনপ্রিয় হয়েছিল যে চুরুলিয়ার সাধুরা তাঁদের গৌরাংডি-বরাকর রুটের বাসের নাম রাখলেন ‘উদয়ের পথে’। আর রাস্তাঘাটে লোকের মুখে মুখে ফিরতে লাগলো রবীন্দ্রনাথের গান। মেগাফোন থেকে জে এন জি নম্বর সংবলিত হালকা সবুজ রঙের কাগজে হরিণের ছবি আঁকা লেবেল দেওয়া রেকর্ডে নজরুলের নিজের গলায় গাওয়া ‘পাষাণের ভাঙালে ঘুম’ রেকর্ডটিও আমাদের — বাড়িতে ছিল। তুলসী লাহিড়ীর লেখা কিছু গান মেগাফোনে রেকর্ড হয়েছিল। কমলা ঝরিয়া মেগাফোনেই গাইতেন। তাঁর গাওয়া কীর্তন গানের কিছু রেকর্ড আমাদের বাড়িতে ছিল। মেগাফোনে বাবার লেখা ‘আমি তার মূল্য দিব ধরে’ এবং ‘ব্রজপুরে কত সহি জালাতন’ গান দুটি রেকর্ড হয়েছিল।

শচীন দেববর্মণ গাইতেন হিন্দুস্থান রেকর্ডে। তাঁর নামের আগে কুমার লেখা থাকতো, কারণ তিনি ছিলেন ত্রিপুরার রাজকুমার। ‘প্রেমের সমাধি তীরে নেমে এলো শুভ্র মেঘের দল’ এবং ‘আমি ছিনু একা বাসর জাগায়ে’ গান দুটির রেকর্ডও ছিল আমাদের বাড়িতে। হিন্দুস্থান রেকর্ডের লেবেলে বরাবর বংশীবাদন-রত একটি বালকের ছবি থাকতো। পরবর্তীকালে পূর্ণদাস বাউল এবং অংশুমান রায় হিন্দুস্থানেই রেকর্ড করতেন। শচীন দেববর্মণ হিজ মাস্টার্স ভয়েসে প্রথম রেকর্ড করেন ১৯৫৬সালে পুজো সংখ্যা। গান দুটি ছিল ‘মন দিল না বধূ’ আর ‘তুমি আর নেই সে তুমি’। বাদলকাকু ছিলেন হেমন্ত মুখার্জির ফ্যান। তিনি কলম্বিয়া রেকর্ডে হেমন্ত মুখার্জি আর সন্ধ্যা মুখার্জির গান বেশি কিনতেন। তিনি তাঁর দোতলার রুমে গ্রা‌মোফোন বাজাতেন আর আমাদের ডেকে ডেকে শোনাতেন হেমন্ত মুখার্জির ‘আকাশ মাটি ওই ঘুমালো’, শোনাতেন ‘গাঁয়ের বধূ’। তাঁর কাছে শুনলাম সুপ্রীতি ঘোষের গাওয়া ‘আকাশে লক্ষ তারার দেয়ালী/পলাশের মনে রঙের হেঁয়ালী/বলতো, বলতো দোষ কি এমন/ওগো বলতো/বলতো দোষ কি এমন হয় যদি মন হঠাৎ কিছু খেয়ালী।’ শুনলাম সত্য চৌধুরীর গাওয়া মোহিনী চৌধুরীর গান ‘পৃথিবী আমারে চায়’। নব শিখে নিলো জগন্ময় মিত্রের গান ‘তুমি আজ কত দূরে’ গানটি। নবমীর রাত। ফুটবল মাঠের আমরা চার বন্ধু। জ্যোৎস্না নেমেছে পাহাড়ীর জঙ্গলে, নব গেয়ে চলেছে জগন্ময় মিত্রের ‘চিঠি’ আর ‘সাতটি বছর আগে’ ‘সাতটি বছর পরে’ গানগুলি! সে স্মৃতি‍‌ ভোলার নয়। গান দুটির প্রথম লাইন ছিল ‘এমনি শারদ রাতে’ পুজোয় কলকাতা থেকে এসেছেন ছকুকাকু—সাদা ধুতি, সাদা পাঞ্জাবি, সাদা নিউকাট, সাদা ঘড়ির বেল্ট, রিমলেশ চশমা পরে। বাবার সাথে বৈঠকখানায় গাইছেন ‘ওগো নদী আপন বেগে পাগল পারা’ আর গাইছেন সুধীরলাল চক্রবর্তীর বিখ্যাত গান ‘মধুর আমার মায়ের হাসি চাঁদের মুখে ঝরে —’ বোধহয় ‘দাগ’ কথাচিত্রের গান। ছকুকাকু বাদলকাকুদের পিসতুতো ভাই নলিনীকাকুর সাথে এসেছেন তাঁর শ্যালিকা, আমাদের বুজু মাসি। তখন ফ্রক পরে বেনি দুলোয় বাবার কাছে গানটি তুলে নিচ্ছেন। বুজুমাসি সুধীরলালের ফ্যান শুনে বাদলকাকু কিনে আনলেন ‘স্বপ্ন সুরভি মাখা দুর্লভ রাত্রি’ আর ‘খেলাঘর মোর ভেসে গেছে হায় নয়নের যমুনায় —’ গান দুটি। পানুড়িয়ার সোনেলাল শিখে নিয়ে এই গান দুটির সাথে ‘গরমিল’ ছবিতে রবীন মজুমদারের গাওয়া ‘এই কি গো শেষ দান’ গানটি তুলেছেন। পুজোর বৈঠকী গানের আসরে তখন তাঁকে নিয়ে টানাটানি। এই গানগুলিই তিনি গাইছেন সব আসরে।

বাবা অকাল প্রয়াত হয়েছেন। বাদলকাকুও। অমন একজন দুর্দান্ত ফুটবল প্লেয়ার, খেলার জন্যই যাঁর চিত্তরঞ্জনে চাকরি, তিনি মাত্র বাইশ বছর বয়সে চলে গেলেন।

গ্রামোফোন দুটিও খারাপ হয়ে গেল।

স্কুলের উঁচু ক্লাসে পড়ছি। বার্ষিক পরীক্ষার রেজাল্ট আউটের দিন। আমরা বাইরে ঘোরাফেরা করছি। ডিসেম্বরের রোদে গা সেঁকে নিচ্ছি। স্কুল সংলগ্ন ক্লাবের বারান্দায় জমিদার বাড়ির হারুদা তাঁদের ঢাউস টেবিল গ্রামোফোনখানা নিয়ে নতুন রেকর্ড বাজাচ্ছেন, নতুন ধরনের গান— ‘ধিতাং ধিতাং বোলে/ কে মাদলে তান তোলে/ কার আনন্দ উচ্ছলে/ আকাশ ভরে জোছনায়।’ সলিল চৌধুরীর কথা ও সুরে — হেমন্ত মুখোপাধ্যায় গাইছেন সে গান। মানিকদা বলছেন, ‘গণনাট্য দেখছি বাংলা গানেও নতুন দিক নিয়ে এলো! দেখো কথা কত সুন্দর— এদেশ তোমার আমার/ আমরা ভরি খামার/ আমরা গড়ি স্বপন দিয়ে সোনার কামনায়।’ সঙ্গে সঙ্গে গানটা গলায় তুলে নিলাম! সন্ধ্যা মুখার্জির নতুন গান বাজছে ‘আয় বৃষ্টি ঝেঁপে!’ বিমলচন্দ্র ঘোষের কবিতায় সলিল চৌধুরী সুর দিয়েছেন, সন্ধ্যা মুখার্জি গাইছেন, ‘উজ্জ্বল, এক ঝাঁক পায়রা/ সূর্যের উজ্জ্বল রৌদ্রে/ চঞ্চল পাখনায় উড়ছে।’ নকুলকে বলছেন, ‘এ ধরনের কথায় সুর দিয়ে যে গান হতে পারে একথা ভাবিনি তো!’ পানুদা চটুল গান পছন্দ করেন না। নতুন নতুন কথা ও সুরে হিজ মাস্টার্স ভয়েস আর কলম্বিয়ায় গাইছেন ধনঞ্জয়, হেমন্ত, শ্যামল, মানবেন্দ্র, তরুণ, দ্বিজেন, সতীনাথ, পান্নালাল, অখিলবন্ধু, মৃণাল চক্রবর্তী, অপরেশ লাহিড়ী, সন্ধ্যা, আলপনা, প্রতিমা, মাধুরী, উৎপলা, গীতা রায় (দত্ত), গাইছেন শচীন দেববর্মণ আর মান্না দে। যে বছর শচীন দেব বর্মণ ‘মন দিল না বঁধূ’ রেকর্ড করলেন এইচ এম ভি-তে সেই বছরই কলম্বিয়ায় পান্নালাল গাইলেন ‘আমার সাধ না মিটিল, আশা না পুরিল, সকলি ফুরায়ে যায় মা!’ মাঠে, ঘাটে, মাইকে, ফাংশনে সর্বত্র ঘুরতে লাগল সেই গান। একটা শ্যামাসঙ্গীত যে এতটা জনপ্রিয় হতে পারে ভাবা যায় না। রেকর্ড সংখ্যক রেকর্ড বিক্রি হলো। সে বছরই হেমন্ত রেকর্ড করেছিলেন’ ‘আর কতো রহিব শুধু পথ চেয়ে।’ যে ধনঞ্জয় তাঁর প্রথম রেকর্ড করেছিলেন ভারত রেকর্ডে— ‘ভুলে যাও মোরে’— অনেকটা জগন্ময়- সুবীরলাল — রবীন মজুমদারদের স্টাইলে, তিনিই আবার ‘সলিল চৌধুরীর সুরে ‘পাশের বাড়ি’ ফিল্মে গাইলেন — ‘ঝির ঝির ঝির ঝির বরষা/ আমার হয় কি গো ভরসা/ আমার ভাঙা ঘরে তুমি বিনে!’

বন্ধু দুলাল মিত্র নেমন্তন্ন করলো গান শোনার তাদের ক্লাব বাংলোর কোয়ার্টারে। আমরা তখন ফাস্ট ক্লাসের অর্থাৎ ক্লাস টেনের ছাত্র। শুনলাল— শ্যামল মিত্র’র ‘মহুল ফু‍‌লে জমেছে মউ,’ মান্না দে-র ‘তুমি আর ডেকে না!’ ‘এ জীবনে যত ব্যথা পেয়েছি।’ সতীনাথের ‘সোনার হাতে সোনার কাঁকন/ কে কার অলঙ্কার!’ উলটোপিঠে ‘এলো বরষা যে সহসা মনে তাই।’

গান গেয়ে আর গান শুনে এভাবে‍‌ই কেটে যায় দিন। রেডিও তখন জনপ্রিয় হতে শুরু করেছে। বাজারে তখন অনেকেই রেডিও কিনেছেন, কিন্তু গ্রামোফোনের সে স্বাদ, রেডিওতে কোথায়? সলিল চৌধুরী গান বাঁধছেন, ‘তখন এ গান, তু‍‌লে তুফান, নবীন প্রাণের প্লাবন আনে দিকে দিকে/ কিসের বাধা, মরণ হরণ চরণ ফেলে সে যায় হেঁকে।’ চাঁদ ফুল জোছনা ছাড়াই, গুণ গুণ গুঞ্জন বাদ দিয়েও, ‍‌প্রেমের ডোর খুলে ফেলেও পথে নেমে মানুষের হাতে হাত দিয়ে যে গান গাওয়া যায় সলিল চৌধুরী তা প্রমাণ করলেন, বললেন— ‘পথ হারাবো বলেই এবার পথে নেমেছি।’ তারও অনেক পরে ব‍‌লেছেন, ‘আমি পথ খুঁজি না তো, পথ মোরে খোঁজে।’ কী সুন্দর অ‌্যালিটারেশন, সিমিলি, মেটাফরের ছড়াছড়ি বাংলা গানে! সুবীর সেন গাইছেন, ‘ছুটে আয়রে মিলন বীণ, ঐ তো তুলেছে তান/ শোনো আহ্বান।’

মনে পড়ে, তখন সেকেন্ড ইয়ার, মানে আজকের বারো ক্লাসের ছাত্র। যে বাসে কলেজ যেতাম, সেই একই বাসে যেত জয়শ্রী, ক্লাস টেনে পড়তো। শ্যামলা, ছিপছিপে শুচিস্মিতা মেয়েটিকে দেখলেই মনটা পবিত্র হয়ে যেত। সে বছর শ্যামল মিত্র পুজোতে রেকর্ড করলেন ‘কার মঞ্জির বাজে রিনিঠিনিঠিনি।’ আর ‘চোখের নজর কম হলে আর কাজল দিয়ে কী হবে।’ গান দুটো গলায় তুলতেই হলো। কলেজের কমনরুমে যখন প্রথম গানটার অন্তরা গাইতাম, ‘তুমি যে আমার চোখের আলো/ প্রথম দেখায় আমি বেসেছি ভালো’ তখন কেন জানে না, জয়শ্রীর হাসিমুখটাই চোখের সামনে ভেসে উঠতো। সে যেদিন মন খারাপ করে মুখ ভার করে থাকতো, সেদিন মনে মনে গাইতাম শচীন দেববর্মণের গান’ তোমার চোখের পাতা নাচে না/ নাচে না আমার পথ চেয়ে/ তোমার হাসিতে সাড়া জাগে না/ জাগে না আমার সাড়া পেয়ে/ হাসো না হাসো না সে হাসি মধুময়/ তুমি আর নেই সে তুমি।’ জয়শ্রী জানতো না সে কথা! জানে না এখনো।

তারপর কেটে গেছে কত কাল! এখন কালো কালো গোল গোল রেকর্ডগুলো স্থান পেয়েছে অমিত গুহ-র সংগ্রহশালায়, আমার ছেলেমেয়েরাও সেই ছোট ছোট পিনগুলো দেখেনি। চোঙাওলা বা বক্স গ্রামোফোন‍‌ও তাদের কাছে জাদুঘরের সামগ্রী। এভাবেই পুরাতন বিদায় নেয়। আসে নতুনেরা, এসে গেছে নতুন নতুন ইলেকট্রনিক্স যন্ত্র। স্বাগত জানাতেই হবে— কিন্তু আর কী করে শুনবো তরুণের সেই গান— ‘কাজল নদীর জলে’/ ভরা ঢেউ ছলো ছলে/ প্রদীপ ভাসাও কারে স্মরিয়া,’ বা ‘ওগো কৃষ্ণচূড়া বলো আবার কবে তুমি চাঁদের আলোয় যাবে ভরে!’ কিংবা উৎপলা সেনের ‘ঝিকমিক জোনাকির দীপ 
 জ্বলে শিয়রে!’ ‘আমার এ গানে স্বপ্ন যদি আনে আঁখি পল্লব ছায়/ ছন্দভরা রাতে স্বপ্ন দেখে যাব/ তুমি আমি দু’জনায়। কোথায় পাবো, শ্যামল মিত্রের ‘সেদিনের সোনাঝরা সন্ধ্যা’ ‘চৈতালী চাঁদ যাক, যাক ডুবে যাক।’ সেসব রেকর্ড হারিয়ে গেলেও মনের রেকর্ড থেকে মুছে ফেলা যাবে না কোনোদিন।
সৌজন্যেঃ- গণশক্তি (সম​য়ের সাথে)