স্বপ্নস্মৃতি
কিন্তু গত কয়েক দিন ধরে একটা বিশেষ ঘটনা তার চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।বিশেষ বিশেষ সময় তার চোখের সামনে ভেসে উঠছে টুকরো টুকরো কিছু ছবি।অজয়বাবুর কেবলই মনে হচ্ছে,এই আবছা দৃশ্যগুলি আসলে তার শৈশবের স্মৃতি,যা বোধহয় তিনি ছোট থাকতে তার গ্রামে দেখেছিলেন।এত বছর ধরে অজয়বাবুর শৈশবের কোনো স্মৃতিবোধই ছিল না,কোনো কথায় তিনি মনে করতে পারেন না।এমনকি কোন অজপাড়াগাঁয়ে তার বাড়ি ছিল,সেই গ্রামের নাম পর্যন্ত তার মনে নেই।এত বছর বাদে হঠাৎ করে এরকম হওয়ার কোনো কারণ খুঁজে পাননি তিনি।ব্যাপারটা শুরু হয়েছিল গত সোমবার।
সেদিন অজয়বাবু ভাত রাঁধছিলেন,হঠাৎ তার চোখের সামনে ভেসে উঠলো একটা গ্রাম।জমিতে ধান ফলেছে,সবুজ প্রান্তরের মাঝে হাওয়ায় দুলছে ধানের গাছগুলো।ধান জমির মাঝে আল দিয়ে দুটো ছেলে হাতে কঞ্চি নিয়ে গল্প করতে করতে যাচ্ছে।দুজনেরই বয়স অল্প,মাঝে মধ্যেই হেসে উঠছে তারা।এই দৃশ্যটুকু থাকে কয়েক মুহূর্ত মাত্র।অজয়বাবু গা করেননি,মনে কত খেয়ালই তো আসে।কিন্তু পরেরদিন সেই একই দৃশ্য দেখতে পান তিনি,এবার কিন্তু স্বপ্নে।তারপর থেকে প্রায় একভাবে নানা দৃশ্য হঠাৎ হঠাৎ করে ভেসে উঠছে,তার চোখের সামনে,ঘুমে অথবা জাগা অবস্থায়।রবিবার দুপুরে তার একটু তন্দ্রাভাব এসেছিল,স্বপ্নে তিনি দেখলেন নদীর ধরে একটা ছোট্ট চায়ের দোকান,একজন বয়স্ক মানুষ বসে চা খাচ্ছে।তিনি লোকটার চেহারা ঠাহর করে উঠতে পারলেন না,ধড়মড় করে জেগে উঠে কিছুক্ষণ ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে রইলেন।দৃশ্যটা এতটাই জীবন্ত যে কিছুক্ষণের জন্যে অজয়বাবু বুঝেই উঠতে পারলেন না যে তিনি সেটা দেখেছেন স্বপ্নে,বাস্তবে নয়।স্বপ্ন দেখা আজগুবি কিছু নয়,জেগে থাকলেও মানুষের মনে কত খেয়ালই তো আসে।অজয়বাবুর সমস্যা অন্য জায়গায়।প্রতিটি দৃশ্য যেন তাকে নিজের দিকে টানছে,প্রতিবার কোনো দৃশ্য চোখের পর্দায় ভেসে ওঠার পর তার মনে হয়,এই জায়গায় তিনি আগে গেছেন।এই ধান জমি,নদী,চায়ের দোকান,আমবাগান,তিনি আগেও দেখেছেন।সত্যি সত্যি,সামনাসামনি।
অজয়বাবুর ভ্রমণপিপাসা নেই।তিনি কদাচিৎ জবলপুরের বাইরে কোথাও যান।অনেক ভেবে,তিনি নিশ্চিত হযেছেন,এই দৃশ্যগুলির সঙ্গে তার পরিচিতির একমাত্র কারণ,এগুলো তার ছেলেবেলার গ্রামের দৃশ্য।মনের কোনে কোথাও বাসা বেঁধে ছিল।যতবার এই স্মৃতির ঝলক তার চোখের সামনে ভেসে ওঠে,তিনি আরো বেশি অস্থির হয়ে ওঠেন।প্রতিবার সেই অসস্তি বেড়ে যায় কয়েক গুণ।তিনি এক অজানা টান অনুভব করছেন,ওই গ্রামটায় ফিরে যাওয়ার জন্যে।ওই জায়গাগুলো তার চেনা,তাকে যেন হাতছানি দিয়ে ডাকছে রোজ।জবলপুরে তার ভালো লাগছে না,কাজে মনোযোগ নেই।তিনি মনস্থির করে উঠতে পারছেন না কিছুই,এ কোন রোগে ধরল তাকে?তার গ্রামের নাম পর্যন্ত তার মনে নেই,পুরনো কাগজপত্র চিঠি উল্টে দেখেছেন তিনি এই কয়েক সপ্তাহের মধ্যে রোজ,যদি কথাও পাওয়া যায় নামটা!সেই গ্রামে তাকে ফিরে যেতেই হবে,অন্তত একবারের জন্যে ফিরে না গেলে তার মনে শান্তি হবে না।তাকে ফিরতেই হবে।গ্রামের নামটা কি মনে পড়বে না কিছুতেই?
রবিবার সকালে অজয়বাবু নিবিষ্ট মনে একটা বইয়ের পাতা ওল্টাচ্ছেন,বই পড়া তাঁর নতুন শখগুলোর মধ্যে একটা।এমন সময় দরজার ডোরবেলটা বেজে ওঠে।অজয়বাবু উঠে দরজা খোলেন।তাঁরই নামে চিঠি।চিঠিটা এসেছে হিজলতলা বলে একটি গ্রামের সরকারী দপ্তর থেকে।চিঠির বক্তব্য এইরূপ,"হিজলতলা মহকুমা দপ্তর থেকে আপনাকে জানানো হচ্ছে যে এই গ্রামে অবস্থিত থাকা আপনার পিতার মালিকানা জমি নিতে সরকার ইচ্ছে প্রকাশ করেছে।যেহেতু আপনার পিতা অথবা আপনার কোনো রকম ঠিকানা এতদিন খুঁজে পাওয়া যায়নি,কোনরকম সংবাদ দেওয়াও সম্ভব হয়ে ওঠেনি।অনেক চেষ্টার পর আপনার ঠিকানা পাওয়ায় আপনাকে এই চিঠি দেওয়া হচ্ছে।যদি আপনি আপনার পিতার মালিকানা জমি বিক্রয় করতে রাজি থাকেন,যথাশীঘ্র যোগাযোগ করুন।আপনার মত থাকিলে সেই জমিতে সরকার একটা স্কুল খুলিতে চায়।শৈশবে কাটানো আপনার গ্রামের বালক-বালিকাদের মঙ্গলের জন্যে আপনি সম্মত হবেন বলে আশা করি।--হিজলতলা মহকুমা দপ্তর" ।
চিঠির বক্তব্য পড়ে অজয়বাবু হতভম্ব হয়ে গেলেন।এই সবের মানে কী?হিজলতলা,এই নাম তো তিনি কোনওদিন শোনেননি।তাঁর শৈশবের গ্রাম তো সুরুচিপুর।তিনি সেখানে গেছেন,সব কিছুই তাঁর চেনা।হিজলতলা বলে কোনো জায়গার কথা তো তিনি জানেন না,তিনি সেখানে ছিলেনই বা কবে?কিন্তু তাহলে ওই চিঠি...সরকারী মহল থেকে কি না জেনেশুনে চিঠি দেওয়া হয?একটা কথা তাঁর ভালোভাবে জানা আছে,তাঁর বাবা একটি মাত্র গ্রামেই ছিলেন,কলকাতা চলে আসার পর কোনদিন সেখানে ফেরা হয়নি,অন্য কোনো গ্রামে গিয়ে জমি কেনারও মানে হয় না।কিন্তু তাদের বাসস্থান যদি হিজলতলাই হয়,তাহলে তিনি সুরুচিপুরের স্বপ্ন দেখবেন কেন?ভাবতে ভাবতে অজায়বাবুর মাথা গরম হয়ে গেল।তিনি কিছুই বুঝে উঠতে পারছেন না।ভেবেচিন্তে তিনি ঠিক করলেন যে,তিনি চিঠি লিখে জানাবেন যে হিজলতলা বলে কোনো গ্রামে তিনি কোনদিন ছিলেন না।তারপর কী হয় দেখা যাক।
"কিন্তু আমি তাহলে বার বার সুরুচিপুরের স্মৃতি দেখতে পেলাম কি করে?আমি তো সেখানে যাইনি কোনদিন", অজয়বাবু উৎকন্ঠিত হয়ে জানতে চাইলেন।প্রদীপ তাকে প্রশ্ন করল,"আচ্ছা আপনি কি করে বুঝতে পারলেন যা দেখেছেন,সেইগুলো আপনার শৈশবের স্মৃতি?আপনি কি আপনাকে অথবা আপনার মা বাবাকে দেখেছিলেন ছবিগুলোতে?"
অজয়বাবু বললেন,"না,সেরকম দেখিনি।কিন্তু আমার সব কিছু আরো চেনা মনে হত পরিবার ছবিগুলি ঝিলিক দেওয়ার পর।একটা যোগাযোগ অনুভব করতাম প্রচন্ড ভাবে।"
প্রদীপ এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে অজয়বাবুর দিকে,কিছুক্ষণ পর বলে," বুঝেছি অজয়দা,উত্তরটা আমি পেয়েছি।"
অজয়বাবু অস্থির হয়ে বলে ওঠেন,"কি বুঝেছ?"
প্রদীপ শান্ত স্বরে বলে,"যেই দৃশ্যগুলো আপনি দেখেছেন এতদিন ধরে স্বপ্নে অথবা জেগে,সেগুলে আসলে অতীতের নয়,ভবিষ্যতের।"
"তার মানে?"অজয়বাবু হতভম্ব।
অজয়বাবু মন দিয়ে শুনছিলেন।বললেন,"কিন্তু এগুলো তো ডেজাভু,তুমি বলতে চাও আমার ব্যাপারটাও ডেজাভু।"
প্রদীপ একটু হেসে বলল,"না।এই অনুভূতিকে বলে প্রিকগনিশান।আপনার ব্যাপারটা ডেজাভু নয় কেননা ডেজাভু র আক্ষরিক অর্থ যা আপনি আগেই দেখেছেন।মানুষের মনে একটা ধারণা জন্মায় যে সে এই ঘটনাটা আগে দেখেছে,এখন সেটা ঘটে থাকতে পারে অথবা নাও পারে,মোট কথা ডেজাভু মানে অতীত।স্বপ্ন অনেক রকম হয়।কখনো সেটা অতীতের প্রতিচ্ছবি,কখনো ভবিষ্যতের আয়না।আপনার ক্ষেত্রে দ্বিতীয়টা ঠিক।
অজয়বাবু অধৈর্য হয়ে বললেন,"কি বলছ বল তো?এরকম হয়?যেটা দেখিনি সেটা দিয়ে স্বপ্ন?এটা কি সম্ভব?
প্রদীপ উত্তর দিল,"সম্ভব অজয়দা,সম্ভব।আমাদের মস্তিস্ক অদ্ভুত জিনিষ।কোটি কোটি স্নায়ুতে ঠাসা আমাদের মস্তিস্ক বৈদ্যুতিক স্পন্দন তৈরী করে অতীত,বর্তমান আর ভবিষ্যত সব দেখাতে পারে।আপনার মনে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক,কিন্তু মনে করে দেখুন,আপনি সুরুচিপুরে গিয়ে যা দেখেছেন,আর যা আগে স্বপ্নে দেখেছিলেন সব একদম এক রকম...ঠিক কি না?
অজয়বাবু উত্তর দিতে পারলেন না।কথাটায় কোনো ভুল নেই।আগে এরকম করে ভেবে দেখেননি।
তিনি একসময় ভেবে বললেন,"কিন্তু একটা জিনিষ আমি দেখতে পাইনি।একজন লোক নদীর ধরে বসে চা খাচ্ছিল,তাকে দেখিনি"।
প্রদীপ হেসে বলল,"ওটা আপনি নিজেকেই দেখেছেন,আপনি তো চা খেয়েছিলেন সেখানে,না কি?"
অজয়বাবু অস্বীকার করতে পারলেন না।
প্রদীপ আরো বলল,"এককথায় বলতে গেলে অজয়দা,আপনার ক্ষেত্রে যেটা হয়েছে সেটা প্রিকগনিশান.বাংলায় এই কথাগুলোর ঠিক ঠিক প্রতিশব্দ নেই..মানে আপনি যা দেখলেন স্বপ্নে,অথবা জেগে,আপনার জীবনে হয়নি,কিন্তু হবে,অন্যরকম ভাবে হতে পারে,কিন্তু হবেই..না,আপনি বিশেষ ক্ষমতাঁর অধিকারী নন,যদি হতেন তাহলে একটা বিশেষ ঘটনা মাত্র দেখতেন না।এর সবকিছুর ব্যাখা আছে যদিও,সময়ের কম্পাঙ্কের হিসেব অনুযায়ী যদি একটা বেড়াল তার সমস্ত জীবন একটা বন্ধ সিন্দুকে কাটায় সেই সিন্দুকটার দিকে তাকিয়ে আমরা এক মুহুর্তে একসঙ্গে তাঁর জন্ম,জীবন ও মৃত্য দেখতে পারি,মানুষের মস্তিস্কের এতটাই ক্ষমতা। এমনিতে আমরা মানুষের স্বাভাবিক সীমাবদ্ধতায় থাকি বলে কিছু এই ক্ষমতা বুঝতে পারি না,কিন্তু স্বপ্নে এই সীমানা থেকে নিজের অজান্তেই বেরিয়ে আসতে পারি,তাই অবচেতনে ভবিষ্যত দেখতে বাধা থাকে না..
অজয়বাবু তাকে থামিয়ে বলল,"কিন্তু আমার মত সকলের সঙ্গেই কি এরকম হয়,মানে..."
প্রদীপ এগিয়ে এসে অজয়বাবুর কাঁধে হাত রেখে বলল,"না অজয়দা,আপনার ক্ষেত্রে যেটা হযেছে সেটা চমকপ্রদ।একটা বিশেষ জায়গা আপনাকে আদর করে টেনে এনেছে,আপনাকে দেখিয়েছে তার সৌন্দর্য ও স্নিগ্ধতা,বারবার...কিছুক্ষণের জন্য ভুলে যান সুরুচিপুর আপনার ছোটবেলার না!শুধু বলুন ..সেখানে গিয়ে আপনার কেমন লাগলো...কী মনে হল?কিছুক্ষণের জন্য ভুলে যান সুরুচিপুর আপনার ছোটবেলার গ্রাম কি না!শুধু বলুন ..সেখানে গিয়ে আপনার কেমন লাগল...কী মনে হল?"
অজয়বাবু উদাস চোখে প্রদীপের দিকে তাকালেন।
প্রদীপ তাকে বলল,"আপনাকে উত্তর দিতে জোর করব না অজয়দা।আপনিও জানেন আর আমিও জানি সুরুচিপুর আপনাকে কিভাবে আর কতটা বদলেছে?আপনি এখন জানেন আপনি কী হারাচ্ছিলেন?কী আসে যায় সুরুচিপুর আপনার নিজের গ্রাম কি না..."
কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে অজয়বাবু বললেন,"সব বুঝলাম।কিন্তু এবার আমি কী করব?ভুলে যাব সেই জায়গাটাকে যেখানে গিয়ে ভেবেছিলাম এই আমার শিকড়,আমার গ্রাম।সেই আকাশ,নদী,সবুজ...ভুলে যাব সব?"
প্রদীপ ধীর স্বরে বলল,"আপনাকে কিছুই ভুলতে হবে না অজয়দা।আপনার জীবনের এই অভিজ্ঞতাকে কে আপনি ভগবানের আশীর্বাদ মনে করুন।এর আগে আপনি জীবনটা কাটিয়ে দিচ্ছিলেন খালি,কিছুই উপভোগ করতেন না।এই অভিজ্ঞতাটা আপনাকে বুঝিয়েছে আমাদের এই পৃথিবীটা কত সুন্দর..যদি নাই দেখেন দু চোখ ভরে এই আকাশ,জঙ্গল,নদী,কথা না বলেন মানুষের সাথে,যদি এই সুন্দর পৃথিবীর সঙ্গে বাঁধন অনুভব না করেন,কোনো কিছুর জন্যে উৎসাহ না প্রকাশ করেন তাহলে বেঁচে থেকে কী লাভ?আপনি এখন আনন্দে আছেন,ফিরে যেতে চাইছেন সুরুচিপুরের নদীর ধরে,এই চাওয়াপাওয়াটাই তো জীবন।বোধহয় সুরুচিপুরের সঙ্গে পূর্বজন্ম অথবা পরের জন্মের কোন যোগাযোগ আছে আপনার ?আমরা আর কতটুকু জানি?আজ থেকে মনে করুন,সুরুচিপুরই আপনার গ্রাম,দেশ।সুখী হবেন।"
অজয়বাবু ইতস্তত করে বললেন,"কিন্তু হিজলতলার জমির ব্যাপারটা..."
প্রদীপ বলল,"বিক্রি করে দিন।ভালই তো হবে।ওখানে ছোটদের স্কুল হবে।ছোট ছেলেমেয়েরা শিখবে জীবনের পথ।আপনাকে ভগবান যা দিয়েছেন সুরুচিপুর দিয়ে,তাঁর বদলে এইটুকু না হয় ফেরৎ দিলেন নিজের মত করে"।
অজয়বাবুর মুখ প্রশান্তিতে ভরে গেল।
ছবিঃ নভোনীল দে