Wednesday, March 27, 2013

চলতি হাওয়া | Anandabazar


 আমার আনন্দবাজার পত্রিকা থেকে সংগৃহীত 

ধরলে আজ তোমায় ছাড়ব না

অনির্বাণ চৌধুরী
কলকাতা, ২৬ মার্চ, ২০১৩

dol party songs
হুল্লুড়ে পার্টি করাই বিধেয়- শাস্ত্র এই বলছে, সামাজিকতাও। ছবি- অরণ্য সেন।
রাধা আর কৃষ্ণ নামে দুই ছোঁড়াছুঁড়ি নিয়ম করে রঙ নিয়ে যেই ধুম মাচিয়েছিল ইউপি মহল্লায়, তখন থেকেই সেটাই হয়ে দাঁড়াল দোল দিনের পার্টি করার সনাতনী প্রথা। তালিকায় বাকি ছিল কেবল বাঙালি কবিগুরুর অমোঘ ফরমান- 'আজ সবার রঙে রঙ মেশাতে হবে'! ভাবটা এই, না মেশালে আমার ঘেঁচু, তবে তোমার অনেক কিছু। অতএব, সব দিক মেপেজুপে সবাই যখন সাধছেই, তখন দোলের দিন প্রচুর রঙ দেওয়া, প্রচুর রঙ নেওয়া আর হুল্লুড়ে পার্টি করাই বিধেয়- শাস্ত্র এই বলছে, সামাজিকতাও। ওই ঠাকুরের লেখা ভাবুন, মনে পড়বে পুরনো কলকাতায় বিহারি দারোয়ানদের ঢোল বাজিয়ে নেচেগেয়ে রঙখেলার পার্টি। হুতোম প্যাঁচার নকশা বলছে জেলেপাড়ার সঙ-এর পার্টির পথে নামার কথা; যাদের ধেই নাচন দেখার জন্য ভিড় করেছে আমোদগেঁড়ে বাঙালি। ইতিহাস বলছে রাজা নবকৃষ্ণ দে-র বাড়ির দোলের সন্ধের বাঈনাচের কথা; সব দর্শক কনিয়াক হাতে সাহেবসুবো।সে দিন গেলেও ফূর্তি করার মনটা তো আর চলে যায়নি। সো, লেটস প্লে হোলি!তা, দোলের পার্টিতে গান হবে না- এ আবার কেমনধারা ব্যাপার? কী গান বাজাবেন, লিস্টি মিলিয়ে নিন।  পথে করে গমন। এই উদ্দামতা আসবে না মার্গসঙ্গীত বা ঠাকুরের গানে; তাই ডাইভ মারুন সিনেমাতেই। পার্টি পুরো জমে যাবে!
লাইসেন্সড অ্যাডালটারির গান : জানি, দোলের সকালের পার্টিতে না বললেও 'সিলসিলা' ছবির 'রঙ বরসে ভিগে চুনরওয়ালি' বাজবেই। শুধু দোহাই আপনাদের, এই গানটা দিয়ে পার্টি শুরু করবেন না- নিজেদের উচ্ছ্বাসই নিজেদের কাছে মেকি মনে হবে। আহা, পার্টি ওয়ার্মিং বলেও তো একটা ব্যাপার আছে; পার্টি করবেন আর তার নিয়ম মানবেন না- তা আবার হয় নাকি! এই গান হবে নেশা পুরো চড়ে গেলে; গেলাস গেলাস সনাতনী প্রথায় ভাঙ আর আধুনিকতায় ভদকা চড়িয়ে। তারপর শরীর-মন দুই যখন টলোমলো; নিজেকে সঁপে দিন ব্যারিটোন ভয়েসের কাছে। মাথায় থাকুক রাধা নামের পরের বউটাকে নিয়ে গিরিধারী নাগরের ঢলাঢলি; মাথায় থাকুক আয়ান ঘোষের অপ্রস্তুতের হাসিও। ভেবে নিন কেবল রেখা-অমিতাভ বচ্চন আর সঞ্জীব কুমার। ধর্মই যখন খোদ ছুঁকছঁকানির লাইসেন্স দিচ্ছে, প্রাণ খুলে রঙ মেখে অ্যাডালটারি করুন। তবে এই গানটা শুরুতে নয়। কোনটা তাহলে হতে পারে উদ্বোধনী সঙ্গীত?
অনুরোধের আসর : আমি বলি কী, কানু বিনে নয়, অমিতাভ বচ্চন বিনে ঠিক যেন দোলের পার্টির গানের নখরা জমে না। পার্টি শুরু করার জন্য তাই বেছে নিন ওই বুড়ো হাড়ের ভেলকি দেখানো 'ওয়াক্ত' নামের এক ছবির গান- 'ডু মি আ ফেভার, লেটস প্লে হোলি'। অমিতাভ বচ্চনের সঙ্গে অক্ষয় কুমার আর পিগি চপসও বহুত রঙঢং দেখিয়েছিলেন এই গানটায়। ভাবছেন নিশ্চয়ই, বুরবকটা শুরুতেই এই কম জনপ্রিয় গানটার কথা কেন বলল? তা আপনিই ভেবে দেখুন, সবাই কি আর পার্টি শুরু করার জন্য চেগে থাকবে? হোস্ট হিসেবে আপনাকেই তো জমিয়ে তুলতে হবে কেওড়াবাজি। আহা, শুরুটা করুনই না আলতোভাবে গলা ভেজাতে ভেজাতে; ধাপে ধাপে এগিয়ে যেতে তো আর কেউ বারণ করছে না।
বউদিবাজির দোল : পার্টি এবার খাতায়-কলমে যখন শুরু হয়েই গেছে, তখন তানানানা করে লাভ কি? ব্যাকগ্রাউন্ডে বাজান বলিউডের পেটেন্ট বউদিবাজির দোলের গান; 'শোলে' ছবির 'হোলি কে দিন দিল খিল যাতে হ্যায়'। বউদিবাজি এই গানের শব্দে-সুরে-চিত্রায়ণে সব জায়গায়। শুরুতেই তো এক মাতাল গ্রামের বউদির গায়ে ঢলে পড়ে বলেছে, 'ঠহের যা ভাবি'! বউদি অবশ্য বেশ কুলকাল, চাট্টি নথনাড়া দিয়ে সে 'আরে যা শরাবি' বলেই সটকে পড়েছে। আবার বীরু-বাসন্তী যখন নিজেদের রঙ মাখাতে ব্যস্ত, জয়ও তো তখন ঝাড়ি মেরেছে বিধবা বউদিকে। মন চাইলে আপনিও তার লাইসেন্স নিন; শুধু কবির মতো ঘরে খুঁজবেন না বাইরে- সে চিন্তা আপনার। বউদি অমিল হলেও ক্ষতি নেই, গানটার হুল্লোড় ঠিক টেনে নিয়ে যাবে রঙিন দুনিয়ায়। শুধু হ্যাঁ, মাঝে মাঝেই গলা ভেজাতে যেন ভুল না হয়।
ভয় পেও না, ভয় : আপনাদের হুল্লোড় দেখে কি কোনও অতিথি ভড়কে গেছেন? না ভড়কালেও মাত্তর দুটো গানে সবার আড় ভাঙবে- এটা আশা করা অন্যায়। তা বাদেও এমন কেউ পার্টিতে থাকতেই পারেন, রঙ যাঁর পছন্দ নয়। তাঁকে অভয় দিন; ব্যাকগ্রাউন্ডে বাজিয়ে দিন 'একান্ত আপন' ছবির 'খেলব হোলি রঙ দেব না '! নইলে আপনারই পার্টির একশো আট বার হল বলে; একদল নেশাড়ুর মধ্যে সাদা মাথার কেউ তো আসলে হংস মধ্যে বক যথাই। তাছাড়া, বাঙালির দোলে বাংলা গান বাজবে না, 'তাও কখনও হয়'? এই গান বাজিয়ে, সবার আড় কাটিয়ে তারপর চলে যান 'রঙ বরসে'-তে। এটাই শেষ বার নয়; এর পর থেকে ঘুরে ফিরে সারা পার্টিতেই বাজতে পারে এই গান। তারপরে কিম কর্তব্য?
দুলকি চালের ফিমেল ফিভার : ভেবে দেখলে, দোলের গানের সবকটাতেই বড্ড পুরুষের গা-জোয়ারি গন্ধ। সংবিধানে যখন সমান অধিকার, দোলের মতো একটা পার্টিতে থাকবে না? মেয়েরা একজোট হন, কয়েক পা পিছিয়ে ধাঁ করে চলে যান রেট্রোযুগে, সম্বল করুন 'বসন্ত বিলাপ' ছবির 'ও শ্যাম যখন তখন'। ‘খেলব হোলি’ গানটা দিয়েই শুরু হয়ে গেছে উইমেন এমপাওয়ারমেন্ট; এবারে মৃদু ভড়কি দিয়ে বোঝানোর পালা, 'যখন তখন, খেলো না খেলা এমন, ধরলে আজ তোমায় ছাড়ব না'। একজন মেয়েই দোলের দিনে মদির চাউনিতে শুইয়ে দিতে পারে একদল পুরুষকে, জোট বাঁধলে কার সাধ্য ঘাঁটিয়ে বিপদ আনে? তাছাড়া এতক্ষণের হইচই একটু শান্ত হবে এই দুলকি চালে; দোলের দিনে খরগোশ হওয়ার বদলে কচ্ছপ হওয়াই ভাল- সারা দিনটা পড়ে আছে যে!
আরেকটা বসন্ত বিলাপ : 'অ্যাকশন রিপ্লে' ছবিতে নিদারুণ বসন্তে দারুণ বিলাপ করতে করতে একটা দোলের গানে নেচেছিলেন ঐশ্বর্য রাই বচ্চন আর নেহা ধুপিয়া, 'জ্বলি তো বুঝি না কসম সে কোয়লা হো গয়ি'! মনসই ছেলে না পেয়েই এই হাহাকার। সেটুকু ছেঁটে হুল্লোড়টুকু নিয়ে উদ্দামতার ট্র্যাকে ফিরে আসুন এই গানটা দিয়েই, বেশ একচোট ধেইধেই করতে এ গানের কোনও জুড়ি নেই। ছেলেরা অবিশ্যি দারুণ ফ্রাস্টু খাবেই এ গান বাজালে- সারা বছর যখন তাদের মুর্গি করেন মেয়েরা, দোলের দিনেই বা ছেড়ে দেবেন কেন?
ব্যাক টু বচ্চন : দোলের লুচি-মালপোয়ার মতো না ফুলে পাত্তা আদায় করার জন্য আর পার্টি আরও জমাবার জন্য বচ্চন সাহেবের গানেই যাওয়া ভাল। বেছে নিন তাই 'বাগবান' ছবির 'হোলি খেলে রঘুবীরা অবধ মে'। শাহি হোলিতে তো শুধুই রাধাকৃষ্ণ কথা; রামসীতার দোলের উদ্দামতাও সঙ্গে থাকুক না। অপশন যখন আছে, সুযোগ কেউ ছাড়ে? তাছাড়া পার্টির এই পর্যায়ে এসে হুল্লোড় বাড়ানোর জন্য ব্যারিটোন ভয়েসের কোনও বিকল্প হয় না। আর বচ্চন হয়েই সোজা চলে যান বলিউডের বাদশার শাহি দোলে; শিফট করুন আদরে, ব্যাকগ্রাউন্ডে বাজান 'ডর' ছবির 'অঙ্গ সে অঙ্গ লগানা/সাজন হমে অ্যায়সে রঙ লগানা'। বাউল-ফকিররা যে কামে-প্রেমের রঙে রঙিন হয়ে মশগুল, আপনিও সেই রঙের আলতো ছোঁওয়ায় রাঙিয়ে দিয়ে যান মনের মানুষটিকে। এবার তার নেশা দিনান্তেও নামবে কিনা, সেটা আমার পক্ষে বলা মুশকিল!
গান ভালবেসে গান : পা থেকে মাথা পর্যন্ত আপনি যখন রঙিন আর টলোমলো এবং পার্টির দশা হেই সামালো, তখন সঙ্গত করবে কোন গান? এ বড় দ্বন্দ্বের সময়। আপনি হয়তো বলবেন, 'হোলি আয়ি হ্যায়, আয়ি হ্যায়, হোলি আয়ি হ্যায়' গানটা বাজানোর কথা আর বাকিরা বলবেন, ওটা হোলি নয়, চিটঠি হবে ইত্যাদি প্রভৃতি, তখন কি হাতে থাকবে কেবল রঙের দাগ আর গেলাস? কে বলেছে এ কথা? সে বড় সুখের সময়ে সঙ্গে থাক 'মহব্বতে' ছবির 'হম তেরে দিওয়ানে হ্যায়'- নেশাগ্রস্ত মানুষমাত্রই জানেন প্রলাপের মূল্য। তারপর চলুক 'মঙ্গল পাণ্ডে' ছবির 'হোলি রে'; আহা, আবার একটানা ধুমে ছেদ পড়ে কেন? বেশ করে নেচেকুঁদে এক এক করে চান করতে যাওয়ার সময়ে বিশ্রামের মাঝে শুনতে পারেন 'নমক হারাম' 'নদিয়া সে দরিয়া' গানটাও; শুধু কাকার ভক্তদের বলি, বেশি সেন্টি না হওয়াই ভাল- ভাঙ খেলে কান্না থামার লক্ষণ কম। তারপর খেয়েদেয়ে একটু গড়িয়ে তৈরি হন সান্ধ্য মোচ্ছবের জন্য; আকাশ জুড়ে চাঁদ উঠবে যখন, তখন আপনি তার রঙে রঙ মেশাবেন না?
নিধুবাবু আর বাঙালিয়ানা : দোলের আসল পার্টি রঙ মাখায় নয়, বরং রঙিন হয়ে মজলিশি হওয়ায়- এই কেতাই বরাবর রপ্ত করে এসেছে শহর কলকাতা। দোলের দিন সকালে তাই যা খুশি করে নিয়ে সন্ধেবেলায় ফরাস পেতে ছাদে, বাগানে বা বারান্দায় বসুন দলবলের সঙ্গে আরেক প্রস্থ পানীয় নিয়ে। সঙ্গে থাকুক গড়গড়া। বৃথা হামাগুড়ি দিয়ে বাড়ি পৌঁছাতে চাওয়ায় কী বা লাভ! আর থাকুক রামকুমার মুখোপাধ্যায়-এর সুরে নিধুবাবুর টপ্পার বোলচাল। মন চাইলে আসুক ভানুসিংহের পদাবলী, দ্বিজেন্দ্রগীতি বা অতুলপ্রসাদের সুর। বসন্তের এই মাতাল সমীরণে সবার রঙে রঙ না মেশালে যে গুরুজনের কথার খেলাপ হবে!

Saturday, March 23, 2013

নিবন্ধ:- মেয়েমানুষদের এত বাড়তে নেই! - নিবেদিতা দাঁ

মেয়েরা কী না করতে পারে! ঘর সামলাচ্ছেন, অফিসে ডেডলাইন সামলাচ্ছেন, বাচ্চা সামলাচ্ছেন, শ্বশুরবাড়ির লোকলৌকিকতা সামলাচ্ছেন৷ এক কথায় আজকের নারী স্বনির্ভর এবং অবশ্যই স্বাধীন৷ কিন্তু 

তথাকথিত মর্ডান সমাজে আজও কেন
মেয়েদেরকেই দোষারোপ করা হয় ঘটে
যাওয়া অঘটনের জন্যে! কেনই বা
 তাঁদের দেখা হয় ভোগ্যপণ্য হিসেবে?
উত্তরের খোঁজে নিবেদিতা দাঁ

এই সবের মাঝে আজও কোথাও যেন নিরাপত্তার অভাবে ভোগেন তাঁরা৷ অটোয় বসে পাশের লোককে আপনি-আজ্ঞে করে বলতে হয়, 'দাদা হাতটা একটু ঠিক করে রাখুন৷' ভিড় মেট্রোতে দিনে-দুপুরে চমকে উঠতে হয়, কামিজের চেনটা নেমে গিয়েছে অনেকটাই বা ব্লাউজ পরা খোলা পিঠে অবলীলায় হাত রেখেছেন একজন৷ প্রতিবাদে সরব হলে শুনতে হয়, আরে দিদি, এতই যখন অসুবিধে ট্যাক্সি করে গেলেই তো পারেন! এত ভিড়ে ওরম তো হতেই পারে! 'হতেই পারে'? এটাই কী স্বাভাবিক?

তারপর আস্তে আস্তে বড় হয়েছি, বুঝতে শিখেছি আশপাশের জগতটাকে৷ মাঝে মাধ্যে নিজের অজান্তেই আওড়েছি-'যা নেই ভারতে, তা নেই ভারতে৷' আওড়েছি, কিন্তু আমরা কতজনই বা খেয়াল করে দেখেছি, মেলানোর চেষ্টা করেছি আমাদের আজকের জীবনকে সেই মহাকাব্যের সঙ্গে?
আজকে আমাদের সমাজে নারীদের উপর যে অন্যায়, অত্যাচার হচ্ছে তার বীজ বপন তো কয়েক হাজার যুগ আগেই হয়ে গিয়েছিল৷ অবাক লাগছে? মনে হচ্ছে হাতে কলম পেয়ে মেয়েটি যা ইচ্ছে তাই লিখছে! না, যা ইচ্ছে (যাচ্ছেতাই) লিখছি না৷
শ্রীকৃষ্ণের লীলাখেলার বৃত্তান্ত তো ভক্তিভরে শোনেন! কিন্তু কখনও কি প্রশ্ন করেছেন শ্রীকৃষ্ণ কেন স্নানরতা গোপিনীদের গাছের আড়ালে লুকিয়ে দেখেছিলেন? কেনই বা তাঁদের পোশাক সরিয়ে রেখেছিলেন? এর মধ্যে কী একবারও 'ভয়ারিজম' বা শ্লীলতাহানি নজরে পড়েনি কারও!
বাংলা সিনেমার গানের দু'কলি ধার করেই বলতে ইচ্ছে করে, 'কৃষ্ণ করলে লীলা, আমরা করলে বিলা!' হ্যাঁ, আজকের দিনে এমন ঘটনা ঘটলে নিন্দুকেরা বলবেন বেলেল্লাপনা বা চরিত্রহীনতা৷ একশ ভাগ হক কথা৷ কিন্তু এই ঘটনা তো দলছুট, সৃষ্টিছাড়া নয়৷ তথাকথিত সৃষ্টিকর্তাই তো মেয়েদের সঙ্গে লীলা খেলায় মেতে থেকেছেন৷ রতিক্রিয়া করেছেন রাধার সঙ্গে, বিয়ে করেছেন অন্য নারীকে৷ সেই প্রেমলীলা আবার বর্ণিত হয়েছে কাব্যে! তখনও তো এক নারীকেই ব্যবহার করা হয়েছিল ভালবাসার নামে! সেদিন অর্জুন যখন সুভদ্রাকে অপহরণ করেছিলেন, তখন তো কারও আপত্তি জানানোর কথা মনে হয়নি। উল্টে অর্জুনকে সাহায্য করেছিলেন স্বয়ং কৃষ্ণ। জবাব অবশ্য তৈরি ছিল--- এটাই যে বিধির বিধান! ব্যস ইচ্ছে হোক না হোক সুভদ্রাকে দোজবর অর্জুনকে বিয়ে করতে হয়েছিল। তাও আবার হাসিমুখে! আজও সেই ট্র্যাডিশন বিদ্যমান! হ্যাঁ, যুগের দোষ, তবে এ যুগের নয়, হাজার যুগ আগে থেকেই মেয়েদের উপর জোর করাটাকে স্বাভাবিক হিসেবেই স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছিল। ওই 'বিধির বিধান' গোছের জিনিস৷
আজ 'নির্ভয়া' বা 'দুর্গা'-কে নিয়ে প্রতিবাদে সারা দেশ উত্তাল৷ কিন্তু একি একেবারেই নতুন কোনও ঘটনা ভারতবাসীর কাছে? যাঁরা নাক সিঁটকে, ভ্রু কুঁচকে বলছেন যে, দেশটা দিন দিন রসাতলে যাচ্ছে, তাঁদের একটা কথা মনে করিয়ে দিতে বড্ড ইচ্ছে করছে... যে মহাকাব্যকে লাল শালুতে মুড়ে রেখে দিয়েছেন, তার আত্মজা দ্রৌপদীর কথা কি ভুলেই গেলেন? ভুলে গেলেন হাজার লোকের মাঝে, মহারথী পাঁচ স্বামীর সামনে কীভাবে বেআব্রু করা হয়েছিল তাঁকে? আজকের মতো সেদিনও সবাই নীরব দর্শকেরই ভূমিকা পালন করেছিলেন৷
আজ 'নির্ভয়া' বা 'দুর্গা'-কে নিয়ে প্রতিবাদে সারা দেশ উত্তাল৷ কিন্তু একি একেবারেই নতুন কোনও ঘটনা ভারতবাসীর কাছে? যাঁরা নাক সিঁটকে, ভ্রু কুঁচকে বলছেন যে, দেশটা দিন দিন রসাতলে যাচ্ছে, তাঁদের একটা কথা মনে করিয়ে দিতে বড্ড ইচ্ছে করছে... যে মহাকাব্যকে লাল শালুতে মুড়ে রেখে দিয়েছেন, তার আত্মজা দ্রৌপদীর কথা কি ভুলেই গেলেন? ভুলে গেলেন হাজার লোকের মাঝে, মহারথী পাঁচ স্বামীর সামনে কীভাবে বেআব্রু করা হয়েছিল তাঁকে? আজকের মতো সেদিনও সবাই নীরব দর্শকেরই ভূমিকা পালন করেছিলেন৷
না মহাভারতের মতো কোনও মহাকাব্যকে বা কোনও ঐশ্বরিক চরিত্রকে অপমান করার বিন্দুমাত্র উদ্দেশ্য আমার নেই৷ শুধু এইটুকুই বলতে চাইছি যে আজ বলে নয়, যুগ যুগ ধরে লাঞ্ছিতা হয়ে এসেছেন নারীরা৷ বেআব্রু করা হয়েছে তাঁদের৷ ভোগ্যপণ্য হিসেবে দেখা হয়েছে তাঁদের সব সময়৷ মানুষ নয়, বস্তু হিসেবেই সমাজ মেয়েদের দেখতে অভ্যস্ত৷ তাই তো দ্রৌপদী ভিক্ষাসামগ্রী হিসেবে ভাগ হয়ে যান পাঁচ স্বামীর মধ্যে৷ প্রতিবাদ করেন পাঞ্চালী, কিন্তু ধোপে টেঁকে না৷
আজও সমাজ এতটুকু পাল্টায়নি৷ আজকের তথাকথিত স্বাধীন নারীরা ততটাই নিরাপত্তাহীন৷ মধ্যযুগীয় বর্বরতার শিকার হচ্ছেন বারবার৷ আজও প্রতিপদে তাঁদের কন্ঠরোধ করা হয়৷ ধর্ষিতা হলে কখনও ফিসফিস করে আবার কখনও উচ্চস্বরে বলা হয়, 'দোষ বাবা মেয়েটারই ছিল৷ কী দরকার রাতবিরেতে বাড়ি ফেরার!' ঠিক ‌যেমন শুনতে হয়েছিল দ্রৌপদীকে৷ তাঁর অহংকারই নাকি তিলেতিলে তঁকে সেই লজ্জাজনক ঘটনার দিকে ঠেলে দিয়েছিল৷ 'কী দরকার ছিল বাপু কথায় কথায় দুর্যোধন-দুঃশাসন বা কর্ণকে নিয়ে ঠাট্টা তামাসা করার! মেয়েমানুষের এত বাড়তে নেই৷'
৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস৷ দেশ-বিদেশ সর্বত্র মহিলাদের নিয়ে হাজারটা অনুষ্ঠান, ক্যাম্পেন, বিদ্বজ্জনেদের নানা রাশভারী বক্তৃতার ছড়াছড়ি৷ কিন্তু তাতে লাভটা কী! একদিকে যখন এমন সব অনুষ্ঠানে নারীদের গুণ গাওয়া হবে, তাঁদের মহিমাণ্বিত করার চূড়ান্ত প্রয়াস চলবে, তখনই পৃথিবীর কোনও এক প্রান্তে গণধর্ষিতা হবেন কোনও অজ্ঞাতপরিচয় এক নারী, অজানা অপরাধে পুড়ে মরতে হবে কাউকে!
তাই বলি কি, অনেক তো হল এই দ্যাখনেপনা৷ একটা দিনের জন্যে 'নারী মহান' স্লোগান দিয়ে লাভটা কী? একটা বিশেষ দিন কেন? এই একটা দিন নারীকে সোনার সুতোয় বোনা বেনারসি শাড়ি বা ভার্সাচের কোটি টাকার গাউনের মতো ট্রিট নাই বা করলেন! বরং আটপৌরে নারীকে মন থেকে তাঁর অধিকারের প্রাপ্য সম্মানটুকু দিন, ব্যাস, তাহলেই হবে!


ছোটবেলায় রবিবার সকাল মানেই টিভির পর্দায় মহাভারত৷ উফ! কী উত্তেজনা৷ এই অর্জুন তির ছুড়ে মারল তো পরক্ষণেই কৃষ্ণের হাতে সাঁই সাঁই করে ঘুরতে থাকা সুদর্শন চক্র ঘচাং করে কেটে ফেলল কারও মাথা! কিংবা খপ করে সুভদ্রার হাত ধরে অর্জুন টেনে নিয়ে তুলল রথে৷ ডিডি ১ ডিডি২-র যুগে স্পেশাল এফেক্টে ভরপুর মহাভারত দেখতে দেখতে যেন পাড়ি দিতাম ছোট্ট অপুর মতোই এক ভিন জগতে৷ মনের মধ্যে উঁকি মারত হাজারটা প্রশ্ন৷ গুটি গুটি পায়ে দিদার কাছে গিয়ে ঝাঁপি খুলে বসতাম৷ সেই সময়ে মাঝে মাঝেই দিদা একটা কথা বলতেন, 'যা নেই ভারতে, তা নেই ভারতে'৷ সহজে বলতে গেলে, মহাভারতে যা নেই, ভারতবর্ষে তা নেই! তখন মাথার উপর দিয়ে কথাটা ট্যান হয়ে বেরিয়ে যেত৷












প্রবন্ধ | Anandabazar


কেবল পাশে থাকব? প্রশ্ন তুলব না?

মৌলবাদের বিরুদ্ধে এক দল তরুণ প্রাণশক্তি, সৎ আবেগ, দেশাত্মবোধ সম্বল করে রাস্তায় নেমেছেন। তাঁদের পাশে দাঁড়ানো অবশ্যই আমাদের দায়িত্ব। কিন্তু তাঁদের দাবিগুলিকে যুক্তি দিয়ে যাচাই করাও কম দায়িত্ব নয়।

তমোঘ্ন হালদার
কলকাতা, ২০ মার্চ ২০১৩

dhaka
ফাঁসি চাই? কেন? প্রশ্নটা কিন্তু আছে, থাকা দরকার। ঢাকা, ফেব্রুয়ারি ২০১৩। ছবি- এএফপি।
২৪ আষাঢ়, ১৩৭৪
সরকারের এক বিশেষ নির্দেশে রেডিয়ো পাকিস্তান, ঢাকা থেকে রবীন্দ্রসঙ্গীত প্রচার বন্ধ হয়ে গেছে। আজ এরা রবীন্দ্রসঙ্গীত বাদ দিচ্ছে, কাল এরাই বলবে রবীন্দ্রসঙ্গীত মুসলিম ঐতিহ্যের অনুকূলে নয়। এদের এই বহুল ব্যবহৃত মুসলিম ঐতিহ্যের দোহাই দিয়ে এরা আরও কত কী যে করবে, তা ‘খোদাই মালুম’ না বলে, বলতে হয়, ‘মুজিবই মালুম’...
ডায়েরির মালকিন লুৎফান্নাহার হেলেন। মাত্র কুড়ি বছর বয়সে যখন লিখতে পেরেছেন এই লাইনগুলো, তখন কয়েক বছরের মধ্যে শুরু হওয়া মুক্তিযুদ্ধেও তিনি ঝাঁপিয়ে পড়বেন, তাতে আর আশ্চর্য কী? এবং ধরাও পড়লেন, রাজাকারদের মদতে। হেলেন ইতিমধ্যে ২ বছর ৫ মাসের ফুটফুটে ছেলের (দিলীর) মা। ধরা পড়ার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই আনা হল পাক বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মীদের কাছে, জিজ্ঞাসাবাদের জন্য। ক’দিন বাদে তাঁর ছেলেকে পাঠিয়ে দেওয়া হল মামাবাড়িতে। তার পর? অত্যাচারে, উপর্যুপরি ধর্ষণে ক্ষতবিক্ষত মৃতদেহটি জিপের পিছনে দড়ি দিয়ে বেঁধে ছেঁচড়ে নিয়ে যাওয়া হল শহরের রাস্তা দিয়ে, ফেলে আসা হল নবগঙ্গার ডাইভারশন ক্যানালে। তখনও ২৪ পেরোননি হেলেন।
হেলেন উদাহরণমাত্র। রাজাকার, আল-বদ্র, আল-শামস্-দের অত্যাচারে প্রাণ হারানো আরও অনেক অনেক হেলেনের আত্মীয়রা কোনও দিন কি ক্ষমা করতে পারবেন এই রাজাকারদের? তাই শাহবাগের ‘প্রজন্ম চত্বর’ থেকে যখন স্লোগান ওঠে যুদ্ধাপরাধী রাজাকারদের ফাঁসির দাবিতে, মৌলবাদী সংগঠনগুলি নিষিদ্ধ করার দাবিতে, অনুমান করা যায়, মুক্তিযুদ্ধের শহিদদের আত্মীয়রা আশ্বস্ত হন ইনসাফ হবে।
শাহবাগকে অভিবাদন। শাহবাগ আন্দোলনের পাশে দাঁড়ানো এ পার বাংলার মানুষ, আর প্রকাশ্যে সরব হওয়া ‘বুদ্ধিজীবী’দেরও। নিজেদের কোনও রাজনৈতিক শিবিরে ভাগ না করে, একই প্রশ্নে একই সঙ্গে সবাই একই সুরে গলা মেলাচ্ছেন শেষ কবে এমনটা হয়েছে, মনে পড়ে না।
কিন্তু প্রাথমিক বাহবা-প্রদান-পর্ব মিটলে পর, একটু তলিয়ে ভাবলে, তিনটে ব্যাপারে খটকা লাগতে বাধ্য। প্রথম খটকা, আজমল কসাব কিংবা আফজল গুরুর ফাঁসির ক্ষেত্রে যাঁরা যুক্তি দিয়েছিলেন যে, মৃত্যুদণ্ড কোনও অপরাধকে নির্মূল করতে পারে না, তাঁরা অনেকে শাহবাগের ‘রাজাকারের ফাঁসি চাই’ স্লোগানকে প্রশ্নহীন সমর্থন জোগাচ্ছেন? যদি মেনে নিতে হয় যে, দুই ক্ষেত্রেই তাঁদের অবস্থান যুক্তিযুক্ত, অর্থাৎ কাদের মোল্লা সহ অন্যান্য রাজাকারদের সঙ্গে আফজল গুরু বা কসাবের অপরাধের গুণগত ফারাক আছে, তাই মৃত্যুদণ্ড ‘প্রেক্ষিত’নির্ভর, তা হলে তো সর্বনাশ! কারণ এই যুক্তির লাইনে খানিক আপ-ডাউন করলে অমোঘ স্টেশন: মাওবাদীদের জ্ঞানেশ্বরী এক্সপ্রেসে হামলা আর লস্করের ২৬/১১ হামলার প্রেক্ষিত যেহেতু ভিন্ন, তাই একটা ঘটনা আর একটার চেয়ে কম নিন্দনীয়! ঘটনা হল, মৃত্যুদণ্ড যে প্রেক্ষিতে, যে অপরাধেই দেওয়া হোক না কেন সমর্থনযোগ্য নয়। আর তাই যত লক্ষ মানুষই স্লোগান তুলুক না কেন, রাজাকারদের ফাঁসির দাবি সমর্থন করা যায় না।
শাহবাগের দ্বিতীয় দাবি: মৌলবাদী সন্ত্রাস ছড়ানো সংগঠনগুলিকে নিষিদ্ধ করা। অধিকাংশ বুদ্ধিজীবীই এ দাবিও সমর্থন করছেন। এবং দ্বিতীয় খটকা। এই তো সে দিন সলমন রুশদিকে ঢুকত না দেওয়া নিয়ে মিডিয়ায় খানিক হইচই, অনেকেরই হালকা গাঁইগুঁই, বাক্-স্বাধীনতার পক্ষে প্রাথমিক সওয়াল, কিন্তু সংখ্যালঘু ভোটব্যাঙ্কের কথা মাথায় রেখে কোনও পক্ষই তেমন ভাবে মাঠে নামলেন না, কেউ-বা বললেন, “লেখকেরও তো একটা দায়িত্ব থাকে, না কী? যদি কেউ প্রোভোক্ড হয়?” তা, এহেন বুদ্ধিজীবীরা হঠাৎ শাহবাগ আন্দোলনের ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞার পাশে কেন? সীমান্ত পেরিয়ে অ্যাসিড বোমা এসে গায়ে লাগবে না, তাই জামাত-এর বিরুদ্ধে মুখ খোলা নিরাপদ? বহু কট্টরপন্থী, হিন্দুত্ববাদী দল, যারা প্রতিনিয়ত নানা প্রশ্নে ধর্মীয় জিগির তুলে লোক খেপাচ্ছে, তাদের বিরুদ্ধে এঁরা কিন্তু পথে নামছেন না। অর্থাৎ মোদ্দা কথা: ‘সেফ ডিসট্যান্স’-এর সুবাদে বিদেশ-নীতি যতই খাপখোলা হোক, স্বরাষ্ট্র-খাতে সেই মশারি।
তৃতীয় খটকা, যাঁরা বছর কয়েক আগেও মাওবাদী ও অন্যান্য অতি-বাম সংগঠনকে নিষিদ্ধ করার বিরুদ্ধে মুখ খুলেছিলেন, তাঁরাই সহমত পোষণ করছেন জামাতকে নিষিদ্ধ করার দাবির সঙ্গে। কেন? মাওবাদীদের ক্ষেত্রে যুক্তি ছিল: “সন্ত্রাসের পথ বা রাষ্ট্রের সঙ্গে সরাসরি সংঘাতের পথে যাঁরা হাঁটছেন, তাঁদের এই পথ থেকে সরাতে গেলে, আগে বোঝা দরকার এই পথে হাঁটার কারণটা কী।” তা হলে, জামাতের ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম কেন হবে? বস্তুত, যে কোনও মৌলবাদী সংগঠন মনে করে তারা যা ভাবছে তা ঠিক, সেই ‘ঠিক’টা তারা তাদের নিজস্ব পন্থায় পৌঁছে দিতে চায় আমজনতার কাছে। তা হলে রাষ্ট্র কী করবে? বাক্-স্বাধীনতার মানে কিন্তু ভুল বক্তব্য বলারও সমান স্বাধীনতা। যুক্তিহীনকেও তার কথা বলার সুযোগ দেওয়া। যদি কেউ বাক্-স্বাধীনতার অপব্যবহার করে প্ররোচনা বা উস্কানি দেয়, ত্রিগুণ প্রাবল্যে রাষ্ট্রকে ঝাঁপিয়ে পড়ে পাল্টা যুক্তি সাজিয়ে পৌঁছতে হবে মানুষের কাছে। সংঘাত হোক যুক্তির। পেশির নয়। বুদ্ধিজীবীরা এ সবই জানেন, বোঝেন, কিন্তু ঘরোয়া আলোচনায়। মিডিয়া সভা ডাকলে সেখানে দলে পড়ে সক্কলে মিলে বলে ওঠেন, ‘পাশে আছি, শাহবাগ’। দাবির গভীরতা নিয়ে মুখে কুলুপ এঁটে নিজেদেরই হাস্যকর করে তোলেন।
দ্বিগুণ হাস্যকর কমিউনিস্ট পার্টির অবস্থান। তাদেরই শাসনকালে রাজ্য-ছাড়া হতে হয় তসলিমা নাসরিনকে। তিনি ভয় পাননি, রাজ্য সরকারই ভয় পেয়েছিল মৌলবাদীদের। আর আজ তাঁরাই বিবৃতি দিয়ে মৌলবাদ-বিরোধী আন্দোলনের পাশে থাকার ডাক দিচ্ছেন। তাঁরাও জানেন দূরত্ব বুঝে নিয়ে প্রতিবাদ করতে হয়। আমেরিকা তাই বরাবর সবচেয়ে সহজ টার্গেট।
এ লেখা একটি বারের জন্যও শাহবাগ আন্দোলনের বিপক্ষে কথা বলছে না। মৌলবাদের মতো সমস্যাকে উপড়ে ফেলতে এক দল তরুণ তাঁদের উদ্দাম প্রাণশক্তি, সৎ আবেগ, দেশাত্মবোধকে সম্বল করে রাস্তায় নেমেছেন। তাঁদের মাথার ওপর তেমন কোনও রাজনৈতিক নেতৃত্ব নেই। এঁরা আওয়ামি লিগের একচেটিয়া হয়ে যাওয়া ‘জয় বাংলা’ স্লোগানে ফিরিয়ে এনেছেন মুক্তিযুদ্ধের সময়ের প্যাশন, এঁদের পাশে না দাঁড়ানো মূর্খামি। কিন্তু শাহবাগের সবচেয়ে বড় মূলধন আবেগ। আর আবেগ বলেই, পদে পদে যুক্তির পথ থেকে বিচ্যুতির ভয়। যাঁরা এই মুহূর্তে শাহবাগে, এ-রকম অনেক ভুল তাঁদের চোখে পড়বে না। সেটাই স্বাভাবিক। এবং ঠিক সেখানেই বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের মেরুদণ্ডের প্রয়োজন। ‘পাশে আছি’ বলে কাব্য করলে, গান বাঁধলে যতখানি পাশে থাকা হয়, আন্দোলনকারীদের কাছে যুক্তির মাধ্যমে আত্মবিশ্লেষণের বার্তা পৌঁছে দিলে তা অনেক বেশি দায়িত্বশীল ভাবে পাশে থাকার নমুনা হয়ে ওঠে। এ পার বাংলায় থেকে ও পারের আন্দোলনে আন্তরিক ভাবে শামিল হতে গেলে প্রয়োজনে শাহবাগ থেকে ওঠা দাবিকে প্রশ্ন করতে হবে। না হলে পৃথিবীর ইতিহাসে যা অতি গুরুত্বপূর্ণ আন্দোলন হয়ে উঠতে পারে, তা পর্যবসিত হবে আর পাঁচটা দারুণ শুরু করেও ভুস করে নিভে যাওয়া তুবড়ি গোত্রের আন্দোলনে।
তবে তার আগে নিজেদের প্রশ্ন করার সময় হয়েছে। আর কত দিন আমরা মৌলবাদী সংগঠন বলতে লস্কর-ই-তইবা বা যাবতীয় মুসলিম মৌলবাদীদের কথা মনে করব? হিন্দুত্বের শিবিরেও মৌলবাদীরা আছে, তারাও সমান নিন্দনীয়। আর আমার দেশে এই দ্বিতীয় সংখ্যাটাই বেশি। তাই মৌলবাদ-বিরোধিতার নামে স্রেফ বর্ডার পারের মৌলবাদকে ইঙ্গিত করা বন্ধ হোক। তসলিমা নাসরিনকে ফিরিয়ে আনতে পথে নামা হোক। খোলা মঞ্চে বক্তব্য রাখতে দেওয়া হোক সলমন রুশদিকে। প্রয়োজনে আমরা দেব নিরাপত্তা।
আর বুদ্ধিজীবীরা অনুগ্রহ করে মশারি ছেড়ে বেরোন। দেখবেন চেনা ছকের বাইরে, অ্যাঙ্করের নাটকীয় সংলাপ, ক্যামেরা, বুম-এর বাইরে একটা বিশাল জগৎ অপেক্ষা করছে আপনাদের জন্য। যা বদলাতে পারেন আপনারাই। এখনও সময় আছে, সেই সিপাহি বিদ্রোহের সময় থেকে বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের গায়ে লেগে থাকা ‘হিপোক্রিট’ তকমাটা ঝেড়ে ফেলার।

ফেলে আসা স্বাদগুলো | Anandabazar


ফেলে আসা স্বাদগুলো

দামু মুখোপাধ্যায়

ভাইঝিকে টিকটিকি লজেন্সের কথা বলে এমন বিপদে পড়তে হবে, কস্মিন কালেও ভাবিনি। ফস্ করে আবদার ধরে বসল, খাওয়াতেই হবে। ভাবলাম, সস্তার ওপর দিয়েই পার পাওয়া গেল এ যাত্রায়। কিন্তু ঠাকুরঘরের দৈব সমাবেশে কে একজন খ্যাকখেকিয়ে হেসে উঠেছিলেন, তা ঠিক খেয়াল করিনি।
সত্যি বলতে কী, গত চার দশকে বস্তুটা যে অ্যান্টিকের খাতায় নাম লিখিয়েছে, তাও জানা ছিল না। কিন্তু পাড়ার মুদির দোকান থেকে শুরু করে আশেপাশের পান-সিগারেট-গুটখার দোকানিও যখন আকাশ থেকে পড়তে শুরু করলেন, বুঝলাম বেমক্কা চ্যালেঞ্জ নেওয়াটা বাড়াবাড়ি হয়ে গিয়েছে। কিন্তু ভবি এত সহজে ভোলার নয়! রোজই অফিস ফেরত তার সামনে পড়লে দস্তুর মতো জেরা সেশন চলতে থাকল। এ অবস্থা থেকে রক্ষা পেতে শেষে মরিয়া হয়ে হানা দিতে হল চার দশক আগে ছেড়ে আসা দক্ষিণ শহরতলির পাড়ায়।
গত বিয়াল্লিশ বছরে সাকুল্যে সাড়ে তিনবারও ওমুখো হইনি। শহরের সর্বত্র যা হয়েছে, তার ব্যতিক্রমী কিছু ঘটেনি এ পাড়াতেও। ফ্ল্যাটবাড়ির ভিড়ে হারিয়ে গিয়েছে এঁদো পুকুর, পোড়ো মাঠ, লালবাড়ির রোয়াক, ললিত মাস্টারের কোচিং সেন্টার। প্রায় সব গিয়ে পড়ে রয়েছে একটেরে ব্যায়াম সমিতি। তবে অ্যাসবেস্টসের ছাউনি ছেড়ে দোতলা পাকাবাড়ির ধরাচূড়ায় রীতিমতো ধোপদুরস্ত সেও।
আর রয়ে গিয়েছে পাড়ার সাবেক দর্জির দোকান। আদি মালিক নিতাইদা মারা যাওয়ায় যার দখল নিয়েছে তাঁর মেজো ছেলে শ্যামল। আমার আকুল জিজ্ঞাসা নিয়ে তার কাছেই অগত্যা ধর্ণা দিলাম। প্রথমে হতভম্ব, পরে চিন্তিত এবং সব শেষে গম্ভীর হয়ে সে জানাল, 'বাজারে টিকটিকি লজেন্স বলে এখন কিছু পাওয়া যায় না'।
মন খারাপ করে চলেই আসছিলাম, হঠাৎ মগজে খেলে গেল বিদ্যুৎতরঙ্গ। বাস স্ট্যান্ডের রাস্তা ছেড়ে হাঁটা লাগালাম গুমটির উল্টো দিকে রাস্তার মোড়ে দাঁড়ানো ‘সুশীলাকুমারী শিশু নিকেতনের’ উদ্দেশ্যে। হাতেখড়ির পর এখানেই শুরু হয় আমার প্রাথমিক মগজধোলাই। পাশে এখনও কদমগাছের গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে কাঠের খুঁটির ওপর আলকাতরা মাখা টিনের চালা। আর তাতে সে মুহূর্তেও কুঁজো হয়ে বসে পান সাজছে নটবরদা। একমাথা টাক বেড় দিয়ে চুলগুলো সাদা হয়ে গিয়েছে, এই যা।
দোকানের সামনে গিয়ে দাঁড়াই। গৌরচন্দ্রিকা না করে সটান জিজ্ঞেস করি, টিকটিকি লজেন্স আছে? কয়েক সেকেন্ডের অপলক চাউনি। পরক্ষণেই অভ্যস্ত ভঙ্গিতে আধো অন্ধকার হাতড়ে বেরিয়ে এল বয়াম। চার দশক আগের স্মৃতি উসকে দিয়ে কাগজের ঠোঙায় টাপুর-টুপুর ঝরে পড়তে থাকল লাল-হলুদ-কালো-সবুজ গুলির বৃষ্টি।
অভীষ্ট সিদ্ধি হতেই মাথায় নড়াচড়া শুরু করল গুবরে পোকারা। টিকটিকি লজেন্স পাওয়া গেলে অবশ্যই পাওয়া যাবে ‘দাঁতের লড়াই’, ‘চটচটে’, ‘কালো হজমি’, ‘চিনে কুল’, ‘কালো নুন’, ‘বুড়ির চুল’, ‘ডিম লজেন্স’ আর ‘মালাই বরফ’। পরের কয়েক দিন লেগে পড়লাম গুপ্তধনের সন্ধানে।
স্বীকার করতে বাধা নেই, অতি দুরূহ সে অন্বেষণ। শুরু করলাম দাঁতের লড়াই দিয়ে। স্কুলে নতুন ছেলে ভর্তি হলে এই অমোঘ চিজটি দিয়ে তাকে আপ্যায়ন করাই ছিল রেওয়াজ। সেলোফেন কাগজে মোড়া শক্ত হাল্কা বাদামি রঙের আপাত নিরীহ পিরামিড আকৃতির চিজটি যে কী মারাত্মক কাণ্ড ঘটাতে পারে তা আন্দাজই করতে পারত না বেচারা নবাগতরা। দোস্তি পাতানোর অছিলায় তাকে বাড়িয়ে দেওয়া হত তেকোনা বিভীষিকা। মুখে দিয়ে চুষলে 'নো চিন্তা'। কিন্তু ভুলেও যদি তাতে কামড় দেওয়া হয়েছে, তাহলেই চিত্তির! দাঁতের দু-পাটিকে ফেভিকুইকের কায়দায় জাপটে ধরবে আঠালো টফি। ওদিকে পাশে দাঁড়ানো মিচকে পটাশ অ্যাডভাইস দেবে, 'চেষ্টা কর জিভ দিয়ে ঠেলতে'। বলা বাহুল্য টোটকায় কাজ তো হবেই না, উলটে দাঁতের পাটিতে আরও লেপ্টে যাবে মিঠে দুশমন। যতক্ষণ না সে গলে যাবে, ততক্ষণ চুপটি করে মুখ বন্ধ করে গুডবয় হয়ে থাকো। কিন্তু বহু চেষ্টা করেও তার কোনও খোঁজ পেলাম না।
কলকাতার এমাথা থেকে ওমাথা চষে ফেললেও অধরাই থেকে গেল চটচটেও। না, চরিত্রগত খানিক মিল থাকলেও দাঁতের লড়াইয়ের তুলনায় এ বেশ নিরুপদ্রব। বিকেলে পাড়ায় পাড়ায় ঘুরত চটচটেওয়ালা। তার কাঁধে গোলপানা লম্বা কাঠের লাঠি। আর তাতে জড়ানো হরেক রঙের চিনির ফিতে। এক টাকায় মুঠোভরা পাঁচ-ছ রঙা মিষ্টি ফিতে পাওয়া যেত মনে আছে। কাঠির আগায় তা পেঁচিয়ে দিত ফেরিওয়ালা। অনেক সময় আবদারে সায় দিয়ে ঘড়ি, আংটি বানিয়ে হাতেই লেপটে দিত। ললিপপের কায়দায় অনন্তকাল ধরে তা চেটে যাওয়াতেই ছিল মজা।
কালো হজমির আড়তদার ছিল স্কুলের সামনে ঘাঁটি গাড়া ফেরিওয়ালারা। বড় যত্ন করে লাল আর কালো নুনের সঙ্গে বেড়ে দিত কুটকুটে কালো হজমিগুলি। ইদানিং নামী ব্র্যান্ডের বোতল, ফাইল বা স্যাশেজাত হজমির সাধ্য কি তার সঙ্গে পাল্লা দেয়! হজমির গায়ে কিন্তু সেঁটে থাকত না কোনও মশলা। হালের কায়দা অনুযায়ী জোয়ান-টোয়ানও ঠেসে দিত না কেউ। বিলিতি আমড়া আর কাঁচামিঠে আমের সঙ্গেও কালো নুন মাখিয়ে দিত। অনেক সময় ওই নুনের লোভেই দোকানে হাজিরা দিতাম। টক-মিষ্টি স্বাদের মাঝে কালো নুনের তীব্রতা আর লাল নুনের ঝাল-ঝাল অনবদ্য ব্যাপারটা সমসাময়িক অনেকেই মনে করতে পারবেন।
হজমি ছাড়াও রবারের লাল-সবুজ ছিপি আঁটা কাচের ছোট শিশিতে মিলত স্পেশ্যাল কালো নুন। সে যুগে 'মাঙ্কি ব্র্যান্ড'-এর মাজন পাওয়া যেত, হুবহু তার মতোই চেহারা। কিন্তু 'কহাঁ রাজা ভোজ, কহাঁ গঙ্গু তেলি'! কোনও তুলনাই চলে না। এক খাবলা কালো নুন জিভের মাঝ-মধ্যিখানে রেখে দিলে ডবল মজা! জিভে কাঁটা দেওয়া বেদম টক মিলিয়ে যেতে যেতে পাওয়া যেত মধুরতার আভাস। আর নুনের প্রকোপে কালচে জিভ বের করে পরস্পরকে ভেংচি কাটা ছিল বনেদি ব্যাপার-স্যাপার। সুখের কথা, পার্ক সার্কাসের ডন বস্কো স্কুলের সামনেই ফের দেখা হয়ে গেল তার সঙ্গে।
বিরল হয়ে এলেও পাওয়া গেল চিনে কুলের হদিশও। বারো মাস কোন মুলুক থেকে যে এদের আমাদানি করেন হজমিওয়ালারা, তা ঈশ্বরই জানেন। রসিকজন মাত্রই মানবেন, মিষ্টি কুলের গায়ে আলতো জড়ানো লঙ্কার গুঁড়ো মেশানো নুন সমেত পেশ করাই রিয়াসত।
স্কুলের সামনে সারি দিয়ে দাঁড়ানো ফেরিওয়ালাদের প্রায় সবার সামনেই পাটকাঠির লম্বা মোড়ার ওপর বসানো থাকত কাঠের ফ্রেমযুক্ত কাচের বাক্স। তাতে জিভে-জল-আনা রকমারি পদের সমাহার। আমসি, চুরন, হজমির সঙ্গেই ছোট বয়াম ঠাসা তিন-চার কিসিমের আচার। এদের মধ্যে সেরা তেঁতুলের আচার। একফালি কাগজের ওপর কমলা রঙা পাতলা সেই ঝোলের ওপর ছড়িয়ে দেওয়া হত ঝাল নুন, বিটনুনের অমোঘ স্প্রেড। আহা! কতদিন যে ঝোল চাটতে গিয়ে কাগজের কালিও পেটে চালান হয়ে গিয়েছে তার হিসেব কে রেখেছে!
টংটং ঘন্টির আওয়াজ পেলে আজও মনে পড়ে ‘বুড়ির চুল’ওয়ালাকে। ছোট ছোট গোলাপি আর সাদা নরম তুলোর মিষ্টি গোল্লা নিয়ে আসত সে। এক বারে একখানা সোজা মুখে দিলেই গলে ফুস্। এরাই হচ্ছে আজকের ক্যান্ডিফ্লসের আদি পুরুষ। তবে হালের ওই ঢাউস বস্তুগুলির প্রতি আমি মোটেও সদয় নই। বুড়ির চুল পেলে আজও খেতে রাজি আছি, কিন্তু ক্যান্ডিফ্লস, নৈব নৈব চ। কাচের বাক্স ছেড়ে প্লাস্টিক প্যাকেট করা ‘বুড়ির চুল’ নিয়ে আজও মাঝেসাঝে চোখে পড়ে দু-একজন ফেরিওয়ালা।
কাচের বাক্স থাকত না শুধু মালাই বরফওয়ালার কাছে। সে আসত চাকাওয়ালা হাতগাড়ি ঠেলতে ঠেলতে। অ্যালুমিনিয়ামের পাতে ঢাকা তার গাড়ির মাথায় কারুকাজ করা কাঠের কেয়ারি। বাক্স আকৃতির গাড়ির মাথায় ফুটখানেক ব্যাসের হাতল সাঁটা ঢাকনা। মাটির একরত্তি খুরিতে স্টিলের চামচ দিয়ে ঠেসেঠুসে মাখনরঙা মালাই ভরে দিত দোকানি। আর গার্নিশিং হিসেবে ফেলত দু’ফোঁটা লাল সিরাপ। অসাধারণ সেই মালাইয়ের স্বাদে বিভোর হয়ে কখন যে পেরিয়ে আসতাম স্কুল থেকে বাড়ি ফেরার পথটুকু, তা টেরই পেতাম না।
ঝাপসা হয়ে আসা শৈশব স্মৃতি হাঁটকে অতীতের অমৃত কুম্ভের সন্ধান করা হয়তো বাতুলতা। সুইস চকোলেটস, হরেক স্বাদের ওয়েফার আর বহুজাতিকের দুর্দান্ত প্যাকেজিং করা নানান পণ্য সম্ভারের ধাঁধায় হারিয়ে গিয়েছে কালো হজমি, চটচটে, দাঁতের লড়াই বা মালাই বরফের সাবেক সাকিন। সাইবার কেতায় দুরস্ত শিশুদের কাছে প্রজন্ম ফারাকের পসরা সাজাতে গেলে নিজের নাক কাটা যাওয়ার সমূহ সম্ভাবনা। তাই সাধু সাবধান!

অ-মানুষ নামে এক প্রজাতি | Anandabazar

অ-মানুষ নামে এক প্রজাতি | Anandabazar