Sunday, June 24, 2012

মীমাংসা করে বরং শিল্পই হোক, চাইছেন অনেক ‘অনিচ্ছুক’ কৃষকও


মীমাংসা করে বরং শিল্পই হোক,
চাইছেন অনেক ‘অনিচ্ছুক’ কৃষকও

নিজস্ব সংবাদদাতা

সিঙ্গুর, ২৩শে জুন — সাহানাপাড়ার মানব পাঁজা অবশেষে তাঁর ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টের পাস বইয়ের প্রথম পাতার জেরক্স করলেন।
খুঁজে বের করেছেন তিনি গতবছরের জুন-জুলাই মাসের দরখাস্তের ‘রিসিভড্‌ কপি’-ও।
তিনি যে সিঙ্গুরের ‘অনিচ্ছুক’ কৃষক, জমির বিনিময়ে ক্ষতিপূরণ যে এখনও নেননি, তিনি জমি ফেরত চান, সেই মর্মে সিঙ্গুর বিডিও অফিসে গতবছর জুন-জুলাইয়ে হলফনামার মতো দরখাস্ত দিতে হয়েছিল। তখন তো রব উঠে গিয়েছিল, জমি ফেরত হয়ে যাবে এবার... আইন পাস হয়ে গেছে বিধানসভায়... আর কে আটকায়... অনিচ্ছুকরা এবার বিডিও অফিসে দরখাস্ত দিন... জমি ফেরত হবে...।
দরখাস্ত জমা পড়ছিল সেইসময়ে। যদিও পরে দেখা গিয়েছিল মাত্র ৪০ একরের জমিতে ‘অনিচ্ছুক’ কৃষক। মানব পাঁজা তাঁদেরই একজন। গতবছরের সেই দরখাস্তের ‘রিসিভড্‌ কপি’ ও বের করেছেন তিনি। জেরক্স করবেন।
এগুলি এখন লাগবে। যদি সিঙ্গুরের ‘অনিচ্ছুক’ জমিদাতাদের মাসে হাজার টাকা ভাতা পেতে হয়, ২ টাকা কেজি দরে চাল পেতে হয়, তাহলে ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট পাস বইয়ের প্রথম পাতার জেরক্স ও সেই দরখাস্তের জেরক্স এখন জমা দিতে হবে বিডিও অফিসে। নামের তালিকা হচ্ছে। এগুলি তাই এখন চাই।
তালিকা অবশ্য অনেকদিন ধরেই জানানো হচ্ছে! কিন্তু অনিচ্ছুক হলেও মানব পাঁজা এতদিন ওইসব কাগজপত্র জমা দেননি। দেননি কারণ, তাঁর বিশ্বাস ছিলো, কলকাতা হাইকোর্টের ডিভিসন বে‍‌ঞ্চে জিতে যাবে ‘দিদি’র সিঙ্গুর আইন। ফলে মানব পাঁজা মনে করছেন, জমি ফেরত দূর অস্ত। ওই হাজার টাকা ভাতা আর দু’টাকা কেজি চাল অতএব না নিয়ে উপায় নেই। তাই অবশেষে শনিবার তিনি কাগজপত্র জেরক্স করালেন। বিডিও অফিসে জমা দেবেন বলে।
মানব পাঁজা শুধু ‘অনিচ্ছুক’ বললে ভুল হবে। তাঁর আরো একটি পরিচয় আছে। তাঁর স্ত্রী সুষমা পাঁজা সিঙ্গুর পঞ্চায়েত সমিতির নির্বাচিত তৃণমূলী সদস্যা। অন্যতম কর্মধ্যক্ষও বটে। এ হেন মানব পাঁজার পরিবারও আর ভরসা রাখতে পারছেন না ‘দিদি’র উপর। সে তিনি এখন যতই সুপ্রিম কোর্টে যান না কেন। মানব পাঁজারা বুঝেছেন আশা নেই!
আরেক ‘অনিচ্ছুক’ জমিদাতা ঝন্টু ধাওয়া তো সরাসরি পাড়া প্রতিবেশীদের বলছেন, ‘সুপ্রিমকোর্টে যাওয়ার কী দরকার?’ তিন বিঘা জমি তাঁর গিয়েছে প্রোজেক্ট এলাকায়। টাকা নেননি এতদিন জমি ফেরতের আশায়। কলকাতা হাইকোর্টের রায় তার ভরসাকে ভেঙে দিয়েছে। রায় শুনে তাঁর প্রথম প্রতিক্রিয়া ছিলো, ‘সর্বনাশ হ‍‌য়ে গেল!’ এখন তিনি বলছেন, সুপ্রিমকোর্টে না গিয়ে আলোচনা করে শিল্প কিছু করার কথা কি ভাবা যায় না!’ প্রবল হতাশ দেখায় তাঁকে।
ক্ষুদিরাম সাহানার প্রশ্ন, হাইকোর্টের হারেই প্রমাণ হয়ে গেছে ইচ্ছুক-অনিচ্ছুক বলে কিছু হয় না। তাহলে ১০০০ টাকা ভাতা আর ২ টাকা কেজির চাল সবাই পাবে না কেন? পাঁচ ভাইয়ের সংসারে তিনি লরিতে মাল ওঠা-নামানোর কাজ করেন। তবে ভাতা আর চাল দিয়ে কি সংসার চলবে? হাজার টাকা ভাতা ভাগ হয়ে যাবে মা-বোন-দিদি-ভাইয়ের মধ্যে। ভাগে কী থাকবে একেকজনের? ৮ কেজি চালে মাস চলবে?
সব মিলিয়ে এভাবেই হতাশা আর প্রশ্ন সিঙ্গুরে কলকাতা হাইকোর্টের রায়ের পর। স্থানীয় প্রশাসনের অবশ্য এসব নিয়ে মাথাব্যথা নেই। সিঙ্গুর থানার ঘুম ছুটেছে একটি চিঠি পেয়ে। এম কে পি নামে নকশালপন্থী সংগঠন সিঙ্গুর থানায় চিঠি দিয়েছে। তাতে জানানো হয়েছে, আগামী ৫ ও ৬ই জুলাই ওই সংগঠন সিঙ্গুর থেকে নোনাডাঙা মিছিল করবে। হাওড়া হয়ে যাবে সেই মিছিল।
এই নিয়েই এখন মাথাব্যথা সিঙ্গুরের স্থানীয় প্রশাসনের।

Thursday, June 21, 2012

সংস্কৃতির দুর্দিন

সংস্কৃতির দুর্দিন

দেবু গোস্বামী

‘‘ক্ষয়িষ্ণু পুঁজিবাদই ফ্যাসিবাদের জন্ম দেয়। পুঁজিবাদী গণতন্ত্রের অবক্ষয়ের মধ্যে ফ্যাসিবাদের জন্ম।’’ এই মূল্যায়নের সঙ্গে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন রাজনীতিজ্ঞ রজনীপাম দত্ত আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে ঘোষণা করেছিলেন’, ‘‘ফ্যাসিবাদ সম্পর্কে যদি কোনো মোহ না থাকে এবং এবিষয়ে যদি পরিচ্ছন্ন ধারণা থাকে, তাহলেই তাকে প্রতিরোধ ও পরাভূত করা যায়।’’ বিশ্বব্যাপী ফ্যাসিবাদ-বিরোধী সংগ্রামের মূল দায়িত্ব শ্রমিকশ্রেণী ও কমিউনিস্ট পার্টিগুলোর ওপর ন্যস্ত হলেও এই অভূতপূর্ব দানবীয় শক্তির বিরুদ্ধে ১৯৩৫ সালে কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকের সপ্তম অধিবেশনে গৃহীত জর্জি ডিমিট্রভের ‘যুক্তফ্রন্ট থিসিস’ এবং ১৯৩৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে প্রকাশিত দত্ত ব্রাডলি দলিল যুক্ত হয়ে ‘‘সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী গণফ্রন্ট’’ গঠনের উদ্যোগ পৃথিবীময় শুরু হয়। কিন্তু ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে পরিচ্ছন্ন ধারণা সৃষ্টি সহজ কাজ ছিলো না বিশেষ করে প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর ভার্সাই চুক্তির পর। এই চুক্তির দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলির অভ্যন্তরে জাগ্রত উগ্রজাতীয়তাবাদ দূরবর্তী দেশের মানুষের কাছে কোনো কোনো ক্ষেত্রে সহানুভূতি আকর্ষণে সমর্থ হয়েছিলো। তাছাড়া প্রচারমাধ্যমগুলির ক্রমান্বয় শিবিরভুক্তি বিশ্বের প্রত্যন্তে ছড়িয়ে থাকা মানুষের মধ্যে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করেছিলো বেশি মাত্রায়।

ইতালিতে মুসোলিনীর নেতৃত্বে ফ্যাসিস্ত পার্টির ক্ষমতা দখলের মাধ্যমে যে ফ্যাসিবাদের সূচনা তার দৃঢ় ভিত্তি রচিত হয় ১৯৩৩ সালে জার্মানিতে। ইহুদি-বিরোধী, কমিউনিস্ট-বিরোধী, বিদেশী-বিরোধী ঘোষণার মধ্য দিয়ে হিটলারের ক্ষমতায় প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে। অন্যদিকে এই শিবিরে যুক্ত হলো স্পেনে জেনারেল ফ্রাঙ্কোর অভ্যুত্থান এবং জাপানের সমরবাদী শক্তি। সমগ্র ইউরোপে ছড়িয়ে পড়লো ফ্যাসিবাদের আতঙ্ক, আগ্রাসনের উদগ্র বাসনা এবং গণতন্ত্রের বহ্ন্যুৎসব। বিশ্ব দুটি অক্ষশক্তিতে বিভক্ত হয়ে গেল— বলাবাহুল্য বিপরীত শিবিরের প্রধান শক্তিরূপে মাথা তুলে রইল স্তালিনের নেতৃত্বে সোভিয়েত রাশিয়া।



।।দুই।।

কোনো অস্বচ্ছতা না রেখে কমিউনিস্টদেরই পয়লা নম্বরের শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করেছে ফ্যাসিস্তরা, সর্বদেশে সর্বকালে, আর বিপরীতটাও সমানভাবে সত্য। কাজেই এ প্রশ্নটা থেকেই যায় নিজেদের পয়লা নম্বর শত্রু সম্পর্কে ন্যূনতম সংজ্ঞাটি নির্ধারণ করতে এত দীর্ঘ সময় লাগলো কেন।



বিশ্বের আর পাঁচটা বিষয়ের মতই ফ্যাসিবাদের সংজ্ঞা এবং বিবরণ মতাদর্শগত বিতর্কে বিদীর্ণ। বিশেষত, সমাজতান্ত্রিক শিবিরের পতনের পর এই বিষয়টিকেও নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা হয়েছে সমাজতন্ত্র- বিরোধিতার জায়গায়। এই বিকৃতি দু’দিক থেকে করা হয়েছে। ঠাণ্ডাযুদ্ধের সময় থেকেই মার্কিন বিশ্ববিদ্যালয় এবং তাদের ‘বেস্ট সেলার’ লেখকরা হিটলার এবং স্তালিনকে এক পর্যায়ে দেখানোর চেষ্টা করেছেন। কিন্তু ১৮৮৯ সালের পর থেকে আক্রমণটা আরও তীব্র। এখন ফ্যাসিবাদ এবং সাম্যবাদকে একই ব্র্যাকেটভুক্ত করা হচ্ছে। যেন একদিকে বুর্জোয়া সংসদীয় গণতন্ত্র আর অন্যদিকে তার দুই শত্রু ফ্যাসিবাদ এবং সাম্যবাদ। আর ফ্যাসিবাদকে বর্ণনা করার গণতন্ত্র আর অন্যদিকে তার দুই শত্রু ফ্যাসিবাদ এবং সাম্যবাদকে। আর ফ্যাসিবাদকে বর্ণনা করার চেষ্টা হচ্ছে তার শ্রেণীউৎস থেকে বাদ দিয়ে, কেবল তার বাইরের লক্ষণ দিয়েই। এমন কি প্রচ্ছন্নভাবে ফ্যাসিবাদকে যথাসম্ভব সহনীয় করে উপস্থিত করার প্রচেষ্টাও বেশ চোখে পড়ার মতো। এর মুখ বন্ধ করা হয় ফ্যাসিবাদ সম্পর্কে তথাকথিত ‘নিরপেক্ষ’ বিচারের নাম করে। মানবতার চরমতম শত্রুর বিরুদ্ধাচরণকে বাদ দিয়ে, কোনো বিশ্লেষণ আসলে মানবতার বিরুদ্ধাচরণ করা, এ‍‌ই সামান্য নৈতিক অবস্থানটুকুও তারা নিতে রাজি নয়।

অনেকে মনে করেন ফ্যাসিবাদের চিরায়ত বাসস্থান হলো জার্মানি। কিন্তু তা নয়। ফ্যাসিবাদের জন্মস্থান ইতালিতে। অনেকের বিচারে ইতালিই হলো চিরায়ত ফ্যাসিবাদের জন্মস্থান। জার্মানিতে ফ্যাসিবাদ যখন মাথা তুলছে তখন জার্মানিতে পুঁজিবাদ শুধু প্রতিষ্ঠিত নয়, সে তার একচেটিয়া দশাও প্রাপ্ত হয়েছে। বিপরীতে ইতালিতে তখন বুর্জোয়ারা নির্বিবাদে ক্ষমতা ভাগ করে নিয়েছে সামন্ততন্ত্রের সঙ্গে। পুঁজিবাদের বিকাশ সীমাবদ্ধ উত্তর ইতালির মিলান-জেনোয়া— তুরিন এই ত্রিভুজে। বিস্তীর্ণ মধ্য এবং দক্ষিণ ইতালিতে রমরমিয়ে ক্ষমতাসীন প্রবল পরাক্রান্ত সামন্ততন্ত্র। উত্তর এবং মধ্য ইতালিতে সামন্ততন্ত্রের মধ্যে পুঁজিবাদী চরিত্রের প্রাথমিক লক্ষণ দেখা দিলেও দক্ষিণ ইতালিতে বর্গাদারির অনুরূপ ব্যবস্থা বহাল। এর ফলে হলো কি— আঞ্চলিক বৈষম্য, আঞ্চলিক রেষারেষি ইতালির রাজনৈতিক বৈশিষ্ট্য। এককথায় পুঁজিবাদ রাজনৈতিক ক্ষমতায় কিন্তু অনুপস্থিত বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব। ম্যাৎসিনি, গ্যারিবল্ডিদের নেতৃত্বে ইতালির ঐক্যসাধনকে বুর্জোয়া বিপ্লবের প্রথম পর্যায় বলা যায়, কিন্তু তা পরিপূর্ণভাবে সম্পন্ন হয়নি। কিন্তু এই অবস্থানের মধ্যেও পুঁজিবাদ তার প্রসার ঘটাচ্ছিল; এমন কি অসম্ভব দ্রুততার মধ্যে মাথা চাড়া দিচ্ছিল ফিয়াট, অলিভেট্টি পিরেল্লির মতো একচেটিয়া শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো। আর দক্ষিণ ইতালি জুড়ে রোজ চালাচ্ছিল মধ্যযুগীয় সামন্ততন্ত্র। আর যথারীতি রোম আর সংলগ্ন মধ্য ইতালির বিপুল অংশ পোপ এবং ভ্যাটিকানের দখলে। যা ইতালিতে পুঁজিবাদ বিকাশের পথে বাধার পাথর হয়ে দাঁড়িয়েছিলো।

।। তিন।।

বেনিতো মুসোলিনী তাঁর প্রথম রাজনৈতিক জীবনে সমাজতান্ত্রিক ছিলেন এটা তথ্য হিসেবে স্কুল পর্যায়ের সাধারণজ্ঞানের অন্তর্ভুক্ত হবার মতো। তিনি সমাজতান্ত্রিক পার্টির নেতা ছিলেন বললে কম বলা হয়, তিনি ছিলেন মুসোলিনীর বাবা আলেক্সান্দ্রো মুসোলিনী। রাজনৈতিক বিশ্বাসে ছিলেন সক্রিয় সমাজতান্ত্রিক।

মুসোলিনী সারা জীবনে সবচেয়ে বেশি ঘৃণা করেছেন যাকে সেই ভ্লাদিমির ‍‌ইলিচ লেনিনকে অনুকরণ করার চেষ্টা করেছেন। নিজেদের মধ্যে নিজেকে ইতালির ‘লেনিন’ বলে বর্ণনা করতেন। জেনিভাতে লেনিনের সাথে পরিচয় হয়েছিলো, দীর্ঘ আলোচনা হয়েছে— এরকম একটা নির্ভেজাল মিথ্যা অবলীলাক্রমে তাঁর জীবনীকারদের বলেছিলেন। শুধু এটা নয়, সারাজীবনে মিথ্যার সাথে আপস করেছেন, ব্যবহার করেছেন মিথ্যাকে, নিজের ভাবমূর্তি গড়ে তোলার জন্য। পৃথিবীর যে কোনো প্রান্তের ফ্যাসিবাদই এমন নেতাকেন্দ্রিক। এর ফলে তাদের ভাবমূর্তি গড়ে ফোলাটা ফ্যাসিস্তদের কাছে একটা প্রধান কাজ। এবং একাজে সত্যের প্রতি নীতিনিষ্ঠ থাকার সুযোগ কোনো ফ্যাসিস্ত নেতাই দেয় না। প্রায় বামপন্থী মুসোলিনী যে দ্রুততায় দক্ষিণের দিকে ঢলে পড়লেন, তাতে এটাই প্রমাণিত — তার কোনো দৃঢ় মতাদর্শ ছিলো না, ছিলো কেবল ক্ষমতালিপ্সা। মুসেলিনীর শুরুটা সমাজতন্ত্রে বা বামপন্থায়, গোড়ায় ফ্যাসিবাদও স্লোগানে বামপন্থী কেবল নয়, কখনও কখনও সমাজতান্ত্রিকদের থেকেও বেশি বামপন্থী। 

সমাজতান্ত্রিক পার্টি থেকে বহিষ্কৃত হবার পর মুসোলিনীর সাংগঠনিক উদ্যোগ মিলানে প্রথম ‘ফ্যাস্‌সি’ অর্থ গোষ্ঠী। লক্ষণীয়ভাবে পার্টি কথাটি ব্যবহৃত হয়নি। মিলান ইতালির অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক রাজধানী হিসাবে স্বীকৃত; সেই মিলানে ১৯১৯, ২৩শে মার্চ প্রথম সম্মেলন। সম্মেলনে অনেক লোকজন জড়ো হয়েছিলো তা না, মেরে কেটে জনা পঞ্চাশেক। যারা জড়ো হয়েছিলো তাদের রাজনৈতিক চরিত্র খুব গুরুত্বপূর্ণ, অন্তত ফ্যাসিবাদ গড়ে ওঠার ক্ষেত্রে। এক, মুসোলিনীর মতো সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধে যোগ দেবার পক্ষপাতী কিছু প্রাক্তন সমাজতান্ত্রিক, র‌্যাডিক্যাল সিন্ডিক্যালিস্ট এবং ফিউচারিস্টদের মতো ছোটো রাজনৈতিক ‍গোষ্ঠীর লোক। এবং কালো আধা সামরিক পোশাক পরা একদল প্রাক্তন সৈনিক (যার থেকে ব্ল্যাক শার্টস)।

সেখান থেকে যে কর্মসূচী ঘোষিত হয় তাই ফ্যাসিস্তদের প্রথম ঘোষিত কর্মসূচী। তার প্রধান দাবিগুলো এইরকম:

(১) আইন করে শ্রমিকদের ৮ ঘণ্টা কাজের অধিকারের স্বীকৃতি।

(২) ন্যূনতম মজুরির স্বীকৃতি।

(৩) শিল্প প্রতিষ্ঠানের কারিগরি পরিচালনার ক্ষেত্রে শ্রমিকদের অংশগ্রহণ।

(৪) শিল্প পুঁজি ও শিল্পপতিদের মুনাফার ওপর ক্রমবর্ধমান হারে কর।

(৫) মেয়েদের সর্বজনীন ভোটাধিকার, পার্লামেন্টে সমানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব।

(৬) ১৮ বছরে ভোটাধিকারের স্বীকৃতি।

(৭) দরিদ্র এবং ভূমিহীন কৃষকদের জন্য জমি।

(৮) নতুন সংবিধানের জন্য ন্যাশনাল এসেম্বলি গঠন।

১৯১৯-এ দাঁড়িয়ে ইতালিতে এটি ‘বিপজ্জনকভাবে’ বামপন্থী এক‍‌টি কর্মসূচী। এর মধ্যে প্রধান দিক হলো এই কর্মসূচী শ্রমিক-কৃষকের অধিকারের পক্ষে। এই কর্মসূচী চার্চ ও পোপের বিরুদ্ধে। এই কর্মসূচী রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে। এটা সূত্রপাত মাত্র।

ইতিহাস প্রমাণ দেয় : কতটা অর্থহীন ছিলো এই কথাগুলো। বিশ্বযুদ্ধের পটভূমিকায় তৈরি হওয়া প্রথম ফ্যাস্‌সি শান্তিবাদী। তারা শুধু শহুরে বিলাসী শান্তিবাদের বিরোধী, তাদের শান্তিবাদ ‘টেঞ্চের শান্তিবাদ’। নিঃসন্দেহে প্রাক্তন সৈনিকদের আকর্ষণ করেছিলা এই স্লোগান। ১৯১৯ এর কর্মসূচীতে লিগ অব নেশনস্‌-কে সর্বোচ্চ সংস্থা হিসেবে মেনে নেবার কথা বলা হয়েছিলো।। আর ১৯২১-এ ফ্যাসিস্তদের চোখে লিগ অব নেশন্‌স হয়ে গেল ইতালির বিরুদ্ধে পক্ষপাতদুষ্ট। সংস্থার পরিচালনায় শ্রমিকদের অংশগ্রহণের কথা বেমালুম ভুলে যাওয়া হলো ক্ষমতায় এসে। লাভের উপর ক্রমবর্ধমান কর এবং যুদ্ধের লভ্যাংশ বাজেয়াপ্তের গরম বক্তৃতা, ক্ষমতায় গিয়ে হয়ে গেল ‘অর্থহীন বক্তৃতা, যা উৎপাদন বৃদ্ধির উদ্যোগকে ব্যাহত করবে।’ এই উৎপাদন বৃদ্ধির সর্বাত্মক স্লোগান বা প্রোডাকশনিজম যার তোড়ে একচেটিয়া পুঁজিকে নিয়ন্ত্রণ করে শ্রমিকদের অধিকার — সব কিছু ভেসে গেল। কারণ ‘জাতি’র প্রয়োজন আরও উৎপাদন। আর সব কিছুই জাতির জন্য। শ্রমিকদের অধিকারের পক্ষে গলা ফাটিয়েছে যে ফ্যাসিস্তরা ১৯১৯-এ, তারাই শ্রমিকদের ধর্মঘট করার, এমনকি আলাদা ট্রেড ইউনিয়ন করার অধিকার কেড়েছে ১৯২৭ সালে। একচেটিয়া পুঁজিপতিদের সবচেয়ে বিশ্বস্ত স্বার্থরক্ষাকারী। সর্বজনীন গণতন্ত্র যারা চেয়েছে তারাই ইতালিতে ভোটের পাট তুলে দিয়েছে ১৯২৬ সালে।

আর যে ভ্যাটিকান এবং ভ্যাটিকানই হাতে ধরে মুসোলিনীকে ক্ষমতায় এনে বসিয়েছিলো। ফ্যাসিস্তদের রোম অভিযান যখন ইতালির সেনাবাহিনীর সামনে লেজ গুটিয়ে পালানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে রোমের গেট থেকে, তখন মিলানের হোটেল থেকে মুসোলিনীকে তুলে এনে প্রধানমন্ত্রী করেছিলেন রাজা তৃতীয় ভিক্টর এমানুয়েল।

প্রথম ফ্যাসিস্ত ম্যানিফেস্টো ১৯১৯-র পরিপূর্ণ সমাজতান্ত্রিক বা সমতুল্য প্রতিশ্রুতি না থাকলেও পুঁজিবাদ সম্পর্কে একটি শ্রেণীসংগ্রামের মনোভাব প্রস্ফুটিত ছিল। এর তেরো বছর পর ১৯৩২-এ ইতালিয়ান এনসাইক্লোপিডিয়ায়, তখন ক্ষমতায় সুপ্রতিষ্ঠিত ফ্যাসিস্তদের পক্ষ থেকে Doctrine of Faccism (ফ্যাসিবাদের তত্ত্ব) প্রকাশিত হয়। এর প্রাথমিক লেখক ছিলেন ফ্যাসিস্ত পার্টির তাত্ত্বিক মুখপত্রে এবং দার্শনিক জিওভান্নি জেস্টিলে। তাঁর করা মক্‌শটি দেখতে দেওয়া হয় মুসোলিনীকে। সংশোধন করার চেষ্টার ফল এই হয়, গোটাটি মুসোলিনী নিজে লেখেন। এই ডকট্রিন অব ফ্যাসিজম মুসোলিনীর জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ লেখা। ১৯১৯-এর ফ্যাসিস্ত কর্মসূচী যদি মু‍খোশ হয় তবে ১৯৩২-এর ডকট্রিন অব ফ্যাসিজম ফ্যাসিস্তদের তাত্ত্বিক মেক-আপ করা মুখ। ফ্যাসিবাদ মনে করে জীবন আসলে একটি ভাববাদী অস্তিত্ব। আর প্রতিটি মানুষের জীবনের লক্ষ্য হওয়া উচিত উন্নততর সত্তা যা রাষ্ট্রের স্বার্থে কাজে না লাগে। স্বাধীনতা বা গণতন্ত্র ও রাষ্ট্রের সামগ্রিক স্বার্থের বাইরে অস্তিত্বহীন এবং ফ্যাসিবাদ তার বিরোধিতা করে। রাষ্ট্রই চূড়ান্ত, স্বার্থের বাইরে কোনো কিছুর অস্তিত্ব নেই।

বেনিতো মুসোলিনী বলেছেন, ‘‘আমরা আমাদের মিথ তৈরি করেছি। মিথ একটি বিশ্বাস, মিথ একটি আবেগ, তা সত্য নাই হতে পারে, বাস্তবে মিথ মানুষকে উদ্দীপ্ত করে, মিথ আসলে একটি আশা, মিথ আসলে সাহস। আমাদের মিথ আমাদের জাতি, আমাদের জাতির মহত্ত্ব, এই মিথ, এই মহত্ত্ব একে বাস্তবায়িত করাই আমাদের একমাত্র কাজ, বাকি সবই গুরুত্বহীন’’। তাঁর যুগে উত্তেজনক বক্তা হিসেবে তাঁর ধারেকাছে কেউ আসে না। ফ্যাসিস্ত মিথের এর থেকে ভালো বিবরণ আর কেউ দিতে পারে না। আর এ বক্তৃতা এক ঐতিহাসিক মুহূর্তে, ফ্যাসিস্তদের ক্ষমতা দখলের জন্য রোম অভিযান শুরু হওয়ার ঠিক তিনদিন আগে ফ্যাসিস্ত পার্টির নেপল্‌স কংগ্রেসে।

ফরাসী র‌্যাডিক্যাল সিন্ডিকালিস্ট দার্শনিক জর্জ সোরেল বলেছিলেন সমাজতন্ত্র, যুক্তির দ্বারা প্রতিষ্ঠিত কোনো ধারণা নয়। সমাজতন্ত্র একটি ধর্ম বিশ্বাসের মতো, তা আবেগের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত। জনগণের মধ্যে এই আবেগ সৃষ্টি করেই একমাত্র সমাজতন্ত্র অর্জন করা সম্ভব। সোরেল এই মিথ সৃষ্টিতে বিশ্বাস করতেন। সোরেলের সবচেয়ে বিখ্যাত/কুখ্যাত ছাত্র মুসোলিনী এই মিথ সৃষ্টিতে বিশ্বাসী ছিলেন। তাঁর ফ্যাসিবাদ প্রতিষ্ঠিত ‘জাতি’ এই মিথের উপর। ইতালিকে ফিরে পেতে হবে পুরানো পৃথিবীতে রোম সাম্রাজ্যের যে মর্যাদা ছিল সেই মর্যাদা। একইভাবে জার্মান জাতির শ্রেষ্ঠত্বকে মিথ হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করে নাৎসিদের বিকাশ।

ফ্যাসিবাদ জানে জনগণের মধ্যে ‘মিথ’ তৈরি করতে হবে। সেই মিথ অর্জনের জন্য অলৌকিক ক্ষমতাসম্পন্ন একজন নেতা তৈরি করতে হবে। লাগামহীন মিথ্যাচার ছাড়া এ কাজ করা যায় না। ফ্যাসিবাদ জানে কারোর বিরুদ্ধে অন্ধ ঘৃণা তৈরি করতে হবে, এরজন্যও প্রয়োজন লাগামহীন যুক্তিহীন মিথ্যা। সব মিলিয়ে, এরজন্যই হিংসার মতোই মিথ্যাও একটি স্তম্ভ যাকে বাদ দিয়ে ফ্যাসিবাদ প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না।



শিশুকাল পার হয়ে হিটলার চিত্রকর হতে চেষ্টা করেছিলেন। শুধু তাই নয়, তঁর সঙ্গীত-প্রীতিও নাকি বিস্ময়কর। সুরকার ভাগ্‌নরের রেকর্ড শুনতে শুনতে তিনি ঘুমিয়ে পড়েন, সুরতরঙ্গের মধ্যে সমাধিস্থ হয়ে যান। নারীর বিলোল কটাক্ষ তাঁকে বশ করতে পারেনি। নেশা বা লোভ তাঁর ব্যক্তিগত জীবনকে কখনও স্পর্শ করেনি। তিনি অতি সহজেই সুরের ও রঙের অপরূপ সৌন্দর্যে মুগ্ধ হন, আত্মবিস্মৃত হন। শাসক ‍‌ও শিল্পীর এমন অদ্ভুত সমন্বয় হিটলার ভিন্ন আর অন্য কোনো রাষ্ট্রনেতার মধ্যে নাকি দেখা যায় না। তাই তাঁর গুণমুগ্ধ ভক্তবৃন্দ বলেন, হিটলারের দেশপ্রেম ও জাতিপ্রেম স্বার্থগন্ধ শূন্য। জাতির কল্যাণই তাঁর জীবনের একমাত্র স্বপ্ন! তাঁর ‘হাইনকেল’ ও ‘উৎকার’ মৃত্যুর দূত নয়, সৌন্দর্যের এঞ্জেল, আকাশ থেকে তারা নেমে আসে মাটির বুকে। হিটলার সাধক, উপাসক, সংযমের, সৌন্দর্যের ও স্বাধীনতার। আমাদের দেশের কোনো জনপ্রিয় ‘দেশপ্রেমিকে’র নিজের মুখ থেকে একথা একবার স্বকর্ণে শোনার সৌভাগ্য হয়েছিল অনেকের। আজ তিনি স্বাধীনতার সাধনায় বানপ্রস্থে।

যে কোনো একজন রাষ্ট্রনেতা কর্পোরাল যে কবি বা শিল্পী পারেন না তা নয়। রাষ্ট্রনেতার সকলের জীবনী আমাদের জানা নেই। শোনা যায় রুজভেল্ট ডলারের স্কাইস্ক্রেপার গড়তেই ভা‍‌লোবাসেন, চার্চিল সাহিত্যরসিক, চিয়াং-কাই-সেক যোদ্ধা, মুসোলিনী বক্তা, তোজো কি জানা নেই, স্তালিন কৈশোরে কবি ও গায়ক ছিলেন। এ যুগের সাম্প্রতিক ইতিহাস থেকে আরও অনেক দৃষ্টান্ত দেওয়া যেতে পারে। র‌্যালফ ফক্স, কডওয়েল কর্নফোডের মতো সাহিত্যিক ও শিল্পীরা যোদ্ধাও ছিলেন। টম উইন্ট্রিয়ম রণনীতি বিশারদ হলেও কবি। টি ই লরেন্স-এর ‘Seven Piller of Wisdom’এ ও কবি আর্নস্ট টলার ব্যাভেরিয়ান রিপাবলিকের প্রেসিডেন্ট ছি‍‌লেন, বিপ্লবের নেতা ছিলেন ‍‌এবং শেষ পর্যন্ত তাকে ‘শিল্পী-শাসক হিটলারের’ ফ্যাসিস্ত অমরাবতীর বন্দী শিবিরেই প্রাণত্যাগ করতে হয়েছে। এরকম আরও অনেক শিল্পী ও সাহিত্যিক আছেন যাঁরা যোদ্ধা ও দেশকর্মী। অনেক বীর যোদ্ধা, কর্পোরাল ও ক্যাপ্টেন আছেন যাঁরা যোদ্ধা ও দেশকর্মী। শিল্পীর প্রাণ যে ধ্বংসের মধ্যেও কাতর হয় না, কবির হাত যে কামান ও টমিগানও শক্ত করে ধরতে পারে, কুৎসিত ধ্বংসলীলার মধ্যে যে সৌন্দর্যের সাধনা করা যায়, কবিতা লেখা যায় স্পেনের গৃহযু‍‌দ্ধে, সোভিয়েত ও হেমিংওয়ে (Ea

est Hemingway) স্পেনে এসেছিলেন তাঁর সাহিত্যের প্রেরণার সন্ধানে। স্পেনের গেরিলাদের সঙ্গে তিনি ফ্যাসিস্ত শত্রুদের পেছনে পেছনে বহুদিন ঘুরেছিলেন। তাই তাঁর পক্ষে লেখা সম্ভব হয়েছে ‘For Whom The Bell Tolls’-এর মতো সুন্দর উপন্যাস। আঁদ্রে মালরোর (Andre Malrous) বিশ্ববিখ্যাত উপন্যাস ‘Days of Hope’ স্পেনের গৃহযুদ্ধেরই অবদান। রিপাবলিকানদের পক্ষে মালরো বৈমানিক হয়েও যুদ্ধ করেছিলেন। এছাড়াও আরও অনেক শিল্পীর প্রতিভার বিকাশ হয়েছে স্পেনের রণক্ষেত্রে, অনেক তরুণ শিল্পী তাঁদের প্রতিভার সামান্য পরিচয় রেখে যুদ্ধক্ষেত্রে প্রাণ বিসর্জন দিয়েছেন।

কিন্তু রণক্ষেত্রের একদিকে যখন দেখতে পাই কামান গর্জন ও বোমা-বিস্ফোরণের মধ্যেকারের স্ফূরণ হয় না, শিল্প ও সাহিত্যের বিকাশ হয় না, আর একদিকে কামান ও কালি-কলম, রাইফেল ‍‌ও তুলি, এক হাতে সৃষ্টি করে, ধ্বংস করে সৃষ্টির জন্যে, তখন মনে প্রশ্ন জাগে ভাগ্‌নরের ভক্ত হিটলারের সঙ্গীত-প্রীতি ও সৌন্দর্য-পিপাসা আর শত শত শিল্পী ও রূপকারের সৌন্দর্যসাধনা কি একই? ফ্যাসিস্ত ‘শিল্পী’ হিটলার যেখানে সৌন্দর্যসাধনায় ধ্যানস্থ সেখানে দেখতে পাই অনুর্বর প্রান্তরের উপর অসংখ্য নরকঙ্কাল, কুশকাঠ ও শুকনো সকাল, মৃত্যুর পৈশাচিক উল্লাস। সেখানে প্রতিভার বিকাশ নেই, মানবতার নিষ্ঠুর অগ্নিপরীক্ষায় শিল্পীর আত্মত্যাগ নেই। আর একদিকে, ফ্যাসিস্তদের এই শব-সাধকদের তপোভঙ্গের জন্য যেদিকে অসংখ্য মানুষ বজ্রমুষ্টি তুলে রয়েছে, সেখানে মৃত্যু ‍‌ও ধ্বংসের মধ্যেও দেখা যায় নতুন জীবন, নতুন সৃষ্টির কাজ নিয়ত চলছে। শিল্পী সেখানে সৃষ্টি করেছেন একহাতে, ধ্বংস করছেন আর এক হাতে। ধ্বংস করছেন কি? মৃত্যুর ও নৈরাশ্যের কালো দিন। সৃষ্টি করছেন কি? ‘Days of Hope’, আঁদ্রে মাল‍‌রোর মতো তিনি ‘AVIATOR’ ও ‘ARTIST’ দুই-ই। আজ তাই একদিকে হিটলার হামলার, গোয়েরিং-গোয়েবলস, টোজো-মুসোলিনী, সুরশিল্পী ভাগ্‌নরের বিকারগ্রস্ত শিষ্য ‍‌ও বুদ্ধের ভক্তের দল, আর একদিকে বিশ্বের মানবজাতির সঙ্গে একছন্দে, একতালে আগুয়ান পৃথিবীর সকল শ্রেণীর প্রবীণ ও নবীন শিল্পী ও মনীষী। একদিকে মৃত্যুর বীক্ষণাগারে বন্দী রাসায়নিক ও পদার্থবিদ, আর একদিকে বিশ্বমানবের কল্যাণের পথে যাত্রী বৈজ্ঞানিক। ভাগ্‌নরের সুরে একদিকে হয়েছে অসুরের আবির্ভাব আর একদিকে মানুষের, জীবনের ও নব-মানবতার শিল্পীর ‍‌ও কবির, স্বাধীনতার ও মুক্তির শহীদ।

ভাগ্‌নরের সুর যিনি অসুরের কান দিয়ে শুনেছেন তিনি ধ্বংসের দুঃস্বপ্নই দেখবেন, ‍‌যিনি মানুষের কান দিয়ে শুনেছেন তিনি দেখবেন নতুন জীবন ও সৃষ্টির স্বপ্ন। কানের পার্থক্য এখানে দৃষ্টির, অনুভূতির ও আদর্শের পার্থক্য। ভাগ্‌নরের বিখ্যাত Nibelung’s Ring রচনার মধ্যে ফ্যাসিস্ত সর্দার তাঁর নিজের প্রেরণা পাবেন, কারণ এই সুরকাব্যের নায়ক-নায়িকারা হত্যা করছে, ধ্বংস করছে, খুন হচ্ছে, আত্মহত্যা করছে। Hunding হত্যা করছে, Siegmund’কে Siegfried বধ করছে ড্রাগন, Brunhilde আগুনের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ছে। ফ্যাসিজমের খোরাক আছে এরমধ্যে, কিন্তু ভাগ্‌নরের সুরকাব্যে এই পাশবিক মৃত্যুর ও ধ্বংসের ঝংকারই কি আসল? ভাগ্‌নর ১৮৪৮ সালের বৈপ্লবিক আন্দোলনে নিজে যোগ দিয়েছিলেন। তিনি ঊনবিংশ শতাব্দীর জার্মানির বিপ্লবী সুরকার। তাঁর Ring-এর প্রধান সুর হচ্ছে ‘অর্থ’ ও ‘অন্তরের দ্বন্দ্ব’, ‘জড় ও জীবনের’ সংঘর্ষ, শক্তির শৃঙ্খল ও মুক্তির স্ফূর্তির মধ্যে বিরোধ। এই বিরোধ ও সংঘর্ষ বিপ্লবউত্তীর্ণ হয়ে মুক্তির নির্মল প্রভাতের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। Brunhilde তাই যখন ‘আগুনের উপর ঝাঁপ দিচ্ছে তখন গান গাইছে:

Not goods nor gold nor glory of gods

Not house nor hall lordly pomp

Not guileful bargain’s treacherous bonds

Nor figning custom’s hard decrees,

Blessing in well or woe Love alone bring…..

Ring এর ধ্বংস ‍‌ও হত্যার রণঝংকার পৌঁছেছে ফ্যাসিজমের কানে, আর সজীব ও সুন্দর মানুষের কানে পৌঁছেছে ব্রুনহিল্ডের গান। শুধু কানে নয়, কানের ভেতর দিয়ে মর্মে। বেশ কিছুকাল আগে কলকাতায় গ্লোব থিয়েটারের হলঘরে বসে রাত দশটার সময় ভাগ্‌নরের এই ‘Siegfried Idyll’ তন্ময় হয়ে অনেকে শুনেছিলেন।
সৌজন্যেঃ- গণশক্তি (সম​য়ের সাথে)

পুর্ণেন্দু পত্রী

 
 
 কথোপকথন -- ৪                  -- পুর্ণেন্দু পত্রী 
- যে কোন একটা ফুলের নাম বল
- দুঃখ ।
- যে কোন একটা নদীর নাম বল
- বেদনা ।
- যে কোন একটা গাছের নাম বল
- দীর্ঘশ্বাস ।
- যে কোন একটা নক্ষত্রের নাম বল
- অশ্রু ।
- এবার আমি তোমার ভবিষ্যত বলে দিতে পারি ।
- বলো ।
- খুব সুখী হবে জীবনে ।
শ্বেত পাথরে পা ।
সোনার পালঙ্কে গা ।
এগুতে সাতমহল
পিছোতে সাতমহল ।
ঝর্ণার জলে স্নান
ফোয়ারার জলে কুলকুচি ।
তুমি বলবে, সাজবো ।
বাগানে মালিণীরা গাঁথবে মালা
ঘরে দাসিরা বাটবে চন্দন ।
তুমি বলবে, ঘুমবো ।
অমনি গাছে গাছে পাখোয়াজ তানপুরা,
অমনি জোৎস্নার ভিতরে এক লক্ষ নর্তকী ।
সুখের নাগর দোলায় এইভাবে অনেকদিন ।
তারপর
বুকের ডান পাঁজরে গর্ত খুঁড়ে খুঁড়ে
রক্তের রাঙ্গা মাটির পথে সুড়ঙ্গ কেটে কেটে
একটা সাপ
পায়ে বালুচরীর নকশা
নদীর বুকে ঝুঁকে-পড়া লাল গোধূলি তার চোখ
বিয়েবাড়ির ব্যাকুল নহবত তার হাসি,
দাঁতে মুক্তোর দানার মত বিষ,
পাকে পাকে জড়িয়ে ধরবে তোমাকে
যেন বটের শিকড়
মাটিকে ভেদ করে যার আলিঙ্গন ।
ধীরে ধীরে তোমার সমস্ত হাসির রং হলুদ
ধীরে ধীরে তোমার সমস্ত গয়নায় শ্যাওলা
ধীরে ধীরে তোমার মখমল বিছানা
ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টিতে, ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টিতে সাদা ।
- সেই সাপটা বুঝি তুমি ?
- না ।
- তবে ?
- স্মৃতি ।
বাসর ঘরে ঢুকার সময় যাকে ফেলে এসেছিলে
পোড়া ধুপের পাশে ।

শক্তি চট্টোপাধ্যায়


 শক্তি চট্টোপাধ্যায় 


 চতুর্দশপদী কবিতাবলী                        --শক্তি চট্টোপাধ্যায় 
ভালোবাসা পেলে সব লন্ডভন্ড করে চলে যাবো
যেদিকে দুচোখ যায়- যেতে তার খুশি লাগে খুব ।
ভালোবাসা পেলে আমি কেন পায়সান্ন খাবো
যা খায় গরিবে, তাই খাবো বহুদিন যত্ন করে ।
ভালোবাসা পেলে আমি গায়ের সমস্ত মুগ্ধকারী
আবরণ খুলে ফেলে দৌড় ঝাঁপ করবো কড়া রোদে...
ভালোবাসা পেলে জানি সব হবে । না পেলে তোমায়
আমি কি বোবার মতো বসে থাকবো-
ভালোবাসা না পেলে কি আমার এমনি দিন যাবে
চোরের মতন, কিংবা হাহাকারে সোচ্চার , বিমনা--
আমি কি ভীষণ ভাবে তাকে চাই ভালোবাসা জানে।

 একবার তুমি 
         --শক্তি চট্টোপাধ্যায় 

একবার তুমি ভালোবাসতে চেষ্টা করো--
দেখবে, নদির ভিতরে, মাছের বুক থেকে পাথর ঝরে পড়ছে
পাথর পাথর পাথর আর নদী-সমুদ্রের জল
নীল পাথর লাল হচ্ছে, লাল পাথর নীল
একবার তুমি ভালোবাসতে চেষ্টা করো ।

বুকের ভেতর কিছু পাথর থাকা ভালো- ধ্বনি দিলে প্রতিধ্বনি পাওয়া যায়
সমস্ত পায়ে-হাঁটা পথই যখন পিচ্ছিল, তখন ওই পাথরের পাল একের পর এক বিছিয়ে
যেন কবিতার নগ্ন ব্যবহার , যেন ঢেউ, যেন কুমোরটুলির সালমা-চুমকি- জরি-মাখা প্রতিমা
বহুদূর হেমন্তের পাঁশুটে নক্ষত্রের দরোজা পর্যন্ত দেখে আসতে পারি ।

বুকের ভেতরে কিছু পাথর থাকা ভাল
চিঠি-পত্রের বাক্স বলতে তো কিছু নেই - পাথরের ফাঁক - ফোকরে রেখে এলেই কাজ হাসিল-
অনেক সময়তো ঘর গড়তেও মন চায় ।

মাছের বুকের পাথর ক্রমেই আমাদের বুকে এসে জায়গা করে নিচ্ছে
আমাদের সবই দরকার । আমরা ঘরবাড়ি গড়বো - সভ্যতার একটা স্থায়ী স্তম্ভ তুলে ধরবো
রূপোলী মাছ পাথর ঝরাতে ঝরাতে চলে গেলে
একবার তুমি ভলবাসতে চেষ্টা করো ।


 এক অসুখে দুজন অন্ধ 
                  --শক্তি চট্টোপাধ্যায় 

আজ বাতাসের সঙ্গে ওঠে, সমুদ্র, তোর আমিষ গন্ধ
দীর্ঘ দাঁতের করাত ও ঢেউ নীল দিগন্ত সমান করে
বালিতে আধ-কোমর বন্ধ
এই আনন্দময় কবরে
আজ বাতাসের সঙ্গে ওঠে, সমুদ্র, তোর আমিষ গন্ধ |
হাত দুখানি জড়ায় গলা, সাঁড়াশি সেই সোনার অধিক
উজ্জ্বলতায় প্রখর কিন্তু উষ্ণ এবং রোমাঞ্চকর
আলিঙ্গনের মধেযে আমার হৃদয় কি পায় পুচ্ছে শিকড়
আঁকড়ে ধরে মাটির মতন চিবুক থেকে নখ অবধি ?
সঙ্গে আছেই
রুপোর গুঁড়ো, উড়ন্ত নুন, হল্লা হাওয়ার মধ্যে, কাছে
সঙ্গে আছে
হয়নি পাগল
এই বাতাসে পাল্লা আগল
বন্ধ ক’রে
সঙ্গে আছে …
এক অসুখে দুজন অন্ধ !
আজ বাতাসের সঙ্গে ওঠে, সমুদ্র, তোর আমিষ গন্ধ ।



 ভিতর-বাইরে বিষম যুদ্ধ 
                         --শক্তি চট্টোপাধ্যায় 


ইচ্ছে ছিলো তোমার কাছে ঘুরতে-ঘুরতে যাবোই
আমার পুবের হাওয়া।
কিন্তু এখন যাবার কথায়
কলম খোঁজে অস্ত্র কোথায়
এবং এখন তোমার পাশে দাঁড়িয়ে-থাকা কুঞ্জলতায়
রক্তমাখা চাঁদ ঢেকেছে
আকুল চোখ ও মুখের মলিন
আজকে তোমার ভিতর-বাইরে বিষম যুদ্ধ পুবের হাওয়া।।
মনে মনে বহুদূর চলে গেছি
মনে মনে বহুদূর চলে গেছি - যেখান থেকে ফিরতে হলে আরো একবার জন্মাতে হয়
জন্মেই হাঁটতে হয়
হাঁটতে-হাঁটতে হাঁটতে-হাঁটতে
একসময় যেখান থেকে শুরু করেছিলাম সেখানে পৌঁছুতে পারি
পথ তো একটা নয় –
তবু, সবগুলোই ঘুরে ফিরে ঘুরে ফিরে শুরু আর শেষের কাছে বাঁধা
নদীর দু - প্রান্তের মূল
একপ্রান্তে জনপদ অন্যপ্রান্ত জনশূণ্য
দুদিকেই কূল, দুদিকেই এপার-ওপার, আসা-যাওয়া, টানাপোরেন –
দুটো জন্মই লাগে
মনে মনে দুটো জন্মই লাগে।
 
 
 
  অবনী বাড়ি আছো?                    --শক্তি চট্টোপাধ্যায় 

অবনী বাড়ি আছো?
দুয়ার এঁটে ঘুমিয়ে আছে পাড়া
কেবল শুনি রাতের কড়ানাড়া
‘অবনী বাড়ি আছো?

বৃষ্টি পড়ে এখানে বারোমাস
এখানে মেঘ গাভীর মতো চরে
পরাঙ্মুখ সবুজ নালিঘাস
দুয়ার চেপে ধরে–
‘অবনী বাড়ি আছো?’

আধেকলীন হৃদয়ে দূরগামী
ব্যথার মাঝে ঘুমিয়ে পড়ি আমি
সহসা শুনি রাতের কড়ানাড়া
‘অবনী বাড়ি আছো?’

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর





শেষের কবিতা
--রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

কালের যাত্রার ধ্বনি শুনিতে কি পাও?
তারি রথ নিত্য উধাও।
জাগিছে অন্তরীক্ষে হৃদয়স্পন্দন
চক্রে পিষ্ট আধারের বক্ষ-ফাটা তারার ক্রন্দন।
ওগো বন্ধু,
সেই ধাবমান কাল
জড়ায়ে ধরিল মোরে ফেলি তার জাল
তুলে নিল দ্রুতরথে
দু'সাহসী ভ্রমনের পথে
তোমা হতে বহু দূরে।
মনে হয় অজস্র মৃত্যুরে
পার হয়ে আসিলাম
আজি নব প্রভাতের শিখর চুড়ায়;
রথের চঞ্চল বেগ হাওয়ায় উড়ায়
আমার পুরানো নাম।
ফিরিবার পথ নাহি;
দূর হতে যদি দেখ চাহি
পারিবে না চিনিতে আমায়।
হে বন্ধু বিদায়।
কোনদিন কর্মহীন পূর্ণো অবকাশে
বসন্তবাতাসে
অতীতের তীর হতে যে রাত্রে বহিবে দীর্ঘশ্বাস,
ঝরা বকুলের কান্না ব্যাথিবে আকাশ,
সেইক্ষণে খুজে দেখো, কিছু মোর পিছে রহিল সে
তোমার প্রাণের প্রানে, বিস্মৃতি প্রাদোষে
হয়তো দিবে সে জ্যোতি,
হয়তো ধরিবে কভু নামহারা স্বপ্নে মুরতি।
তবু সে তো স্বপ্ন নয়,
সব চেয়ে সত্য মোর সেই মৃত্যুঞ্জয় -
সে আমার প্রেম।
তারে আমি রাখিয়া এলাম
অপরিবর্তন অর্ঘ্য তোমার উদ্দেশ্যে।
পরিবর্তনের স্রোতে আমি যাই ভেসে
কালের যাত্রায়।
হে বন্ধু বিদায়।
তোমায় হয় নি কোন ক্ষতি।
মর্তের মৃত্তিকা মোর, তাই দিয়ে অমৃতমুরতি
যদি সৃষ্টি করে থাক তাহারি আরতি
হোক তবে সন্ধ্যা বেলা-
পূজার সে খেলা
ব্যাঘাত পাবে না মোর প্রত্যহের ম্লান স্পর্শ লেগে;
তৃষার্ত আবেগবেগে
ভ্রষ্ট্র নাহি হবে তার কোন ফুল নৈবদ্যের থালে।
তোমার মানস ভোজে সযত্নে সাজালে
যে ভাবরসের পাত্র বাণীর ত'ষায়
তার সাথে দিব না মিশায়ে
যা মোর ধূলির ধন, যা মোর চক্ষের জলে ভিজে।
আজও তুমি নিজে
হয়তো বা করিবে বচন
মোর স্মৃতিটুকু দিয়ে স্বপ্নবিষ্ট তোমার বচন
ভার তার না রহিবে, না রহিবে দায়।
হে বন্ধু বিদায়।
মোর লাগি করিয় না শোক-
আমার রয়েছে কর্ম রয়েছে বিশ্বলোক।
মোর পাত্র রিক্ত হয় নাই,
শুন্যেরে করিব পূর্ণো, এই ব্রত বহিব সদাই।
উ'কন্ঠ আমার লাগি কেহ যদি প্রতীক্ষিয়া থাকে
সে ধন্য করিবে আমাকে।
শুক্লপখক হতে আনি
রজনী গন্ধার বৃন্তখানি
যে পারে সাজাতে
অর্ঘ্যথালা কৃষ্ণপক্ষ রাতে
সে আমারে দেখিবারে পায়
অসীম ক্ষমায়
ভালমন্দ মিলায়ে সকলি,
এবার পূজায় তারি আপনারে দিতে চাই বলি।
তোমারে যা দিয়েছিনু তার
পেয়েছ নিশেষ অধিকার।
হেথা মোর তিলে তিলে দান,
করূন মুহূর্তগুলি গন্ডুষ ভরিয়া করে পান
হৃদয়-অঞ্জলি হতে মম,
ওগো নিরূপম,
হে ঐশ্বর্যবান
তোমারে যা দিয়েছিনু সে তোমারই দান,
গ্রহণ করেছ যত ঋণী তত করেছ আমায়।
হে বন্ধু বিদায়।



অমন আড়াল দিয়ে লুকিয়ে গেলে

--রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

অমন আড়াল দিয়ে লুকিয়ে গেলে
চলবে না।
এবার হৃদয় মাঝে লুকিয়ে বোসো,
কেউ জানবে না, কেউ বলবে না।
বিশ্বে তোমার লুকোচুরি,
দেশ বিদেশে কতই ঘুরি -
এবার বলো আমার মনের কোণে
দেবে ধরা, ছলবে না।
আড়াল দিয়ে লুকিয়ে গেলে
চলবে না।

জানি আমার কঠিন হৃদয়
চরণ রাখার যোগ্য সে নয় -
সখা, তোমার হাওয়া লাগলে হিয়ায়
তবু কি প্রাণ গলবে না।

না হয় আমার নাই সাধনা,
ঝরলে তোমার কৃপার কণা
তখন নিমেষে কি ফুটবে না ফুল
চকিতে ফল ফলবে না।
আড়াল দিয়ে লুকিয়ে গেলে
চলবে না।

ক্ষণিকা
--রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
খোলো খোলো, হে আকাশ, স্তব্ধ তব নীল যবনিকা -
খুঁজে নিতে দাও সেই আনন্দের হারানো কণিকা।
কবে সে যে এসেছিল আমার হৃদয়ে যুগান্তরে
গোধূলিবেলার পান্থ জনশূন্য এ মোর প্রান্তরে
     লয়ে তার ভীরু দীপশিখা!
দিগন্তের কোন্ পারে চলে গেল আমার ক্ষণিকা।।


 
যাবার দিন
--রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
 
যাবার দিনে এই কথাটি বলে যেন যাই -
যা দেখেছি, যা পেয়েছি, তুলনা তার নাই।
এই জ্যোতিসমুদ্র মাঝে     যে শতদল পদ্ম রাজে
তারি মধু পান করেছি, ধন্য আমি তাই।
যাবার দিনে এই কথাটি জানিয়ে যেন যাই।।

বিশ্বরূপের খেলাঘরে কতই গেলেম খেলে,
অপরূপকে দেখে গেলেম দুটি নয়ন মেলে।
পরশ যাঁরে যায় না করা     সকল দেহে দিলেন ধরা,
এইখানে শেষ করেন যদি শেষ করে দিন তাই -
যাবার বেলা এই কথাটি জানিয়ে যেন যাই।।

 
দায়মোচন
--রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
 
চিরকাল রবে মোর প্রেমের কাঙাল,
     এ কথা বলিতে চাও বোলো।
এই ক্ষণটুকু হোক সেই চিরকাল -
     তার পরে যদি তুমি ভোল
মনে করাব না আমি শপথ তোমার,
আসা যাওয়া দু দিকেই খোলা রবে দ্বার -
যাবার সময় হলে যেয়ো সহজেই,
     আবার আসিতে হয় এসো।
সংশয় যদি রয় তাহে ক্ষতি নেই,
     তবু ভালোবাস যদি বেসো।।

বন্ধু, তোমার পথ সম্মুখে জানি,
     পশ্চাতে আমি আছি বাঁধা।
অশ্রুনয়নে বৃথা শিরে কর হানি
     যাত্রায় নাহি দিব বাধা।
আমি তব জীবনের লক্ষ্য তো নহি,
ভুলিতে ভুলিতে যাবে হে চিরবিরহী,
তোমার যা দান তাহা রহিবে নবীন
     আমার স্মৃতির আঁখিজলে -
আমার যা দান সেও জেনো চিরদিন
     রবে তব বিস্মৃতিতলে।।

দূরে চলে যেতে যেতে দ্বিধা করি মনে
     যদি কভু চেয়ে দেখ ফিরে,
হয়তো দেখিবে আমি শূন্য শয়নে -
     নয়ন সিক্ত আঁখিনীরে।
মার্জনা কর যদি পাব তবে বল,
করুণা করিলে নাহি ঘোচে আঁখিজল -
সত্য যা দিয়েছিলে থাক্ মোর তাই,
     দিবে লাজ তার বেশি দিলে।
দুঃখ বাঁচাতে যদি কোনোমতে চাই
     দুঃখের মূল্য না মিলে।।

দুর্বল ম্লান করে নিজ অধিকার
     বরমাল্যের অপমানে।
যে পারে সহজে নিতে যোগ্য সে তার,
     চেয়ে নিতে সে কভু না জানে।
প্রেমেরে বাড়াতে গিয়ে মিশাব না ফাঁকি,
সীমারে মানিয়া তার মর্যাদা রাখি -
যা পেয়েছি সেই মোর অক্ষয় ধন,
     যা পাই নি বড়ো সেই নয়।
চিত্ত ভরিয়া রবে ক্ষণিক মিলন
     চিরবিচ্ছেদ করি জয়।।


চির-আমি
--রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
 
যখন     পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন এই বাটে,
বাইব না মোর খেয়াতরী এই ঘাটে,
চুকিয়ে দেব বেচা-কেনা,     মিটিয়ে দেব লেনা-দেনা
বন্ধ হবে আনাগোনা এই হাটে -
আমায় তখন নাই বা মনে রাখলে,
তারার পানে চেয়ে চেয়ে নাই বা আমায় ডাকলে।।
যখন     জমবে ধুলা তানপুরাটার তারগুলায়,
কাঁটালতা উঠবে ঘরের দ্বারগুলায়,
ফুলের বাগান ঘন ঘাসের     পরবে সজ্জা বনবাসের,
শ্যাওলা এসে ঘিরবে দিঘির ধারগুলায় -
আমায় তখন নাই বা মনে রাখলে,
তারার পানে চেয়ে চেয়ে নাই বা আমায় ডাকলে।।
যখন     এমনি করেই বাজবে বাঁশি এই নাটে,
কাটবে গো দিন যেমন আজও দিন কাটে।
ঘাটে ঘাটে খেয়ার তরী     এমনি সেদিন উঠবে ভরি,
চরবে গোরু, খেলবে রাখাল ওই মাঠে।
আমায় তখন নাই বা মনে রাখলে,
তারার পানে চেয়ে চেয়ে নাই বা আমায় ডাকলে।।
তখন     কে বলে গো, সেই প্রভাতে নেই আমি?
সকল খেলায় করবে খেলা এই-আমি।
নতুন নামে ডাকবে মোরে,     বাঁধবে নতুন বাহুর ডোরে,
আসব যাব চিরদিনের সেই-আমি।
আমায় তখন নাই বা মনে রাখলে,
তারার পানে চেয়ে চেয়ে নাই বা আমায় ডাকলে।।

পুরস্কার
--রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
 
সেদিন বরষা ঝরঝর ঝরে
   কহিল কবির স্ত্রী
`রাশি রাশি মিল করিয়াছ জড়ো,
রচিতেছ বসি পুঁথি বড়ো বড়ো,
মাথার উপরে বাড়ি পড়ো-পড়ো,
   তার খোঁজ রাখ কি!
গাঁথিছ ছন্দ দীর্ঘ হ্রস্ব---
মাথা ও মুণ্ড, ছাই ও ভস্ম,
মিলিবে কি তাহে হস্তী অশ্ব,
   না মিলে শস্যকণা।
অন্ন জোটে না, কথা জোটে মেলা,
নিশিদিন ধ'রে এ কি ছেলেখেলা!
ভারতীরে ছাড়ি ধরো এইবেলা
   লক্ষ্মীর উপাসনা।
ওগো, ফেলে দাও পুঁথি ও লেখনী,
যা করিতে হয় করহ এখনি।
এত শিখিয়াছ এটুকু শেখ নি
   কিসে কড়ি আসে দুটো!'
দেখি সে মুরতি সর্বনাশিয়া
কবির পরান উঠিল ত্রাসিয়া,
পরিহাসছলে ঈষত্‍‌ হাসিয়া
   কহে জুড়ি করপুট,
`ভয় নাহি করি ও মুখ-নাড়ারে,
লক্ষ্মী সদয় লক্ষ্মীছাড়ারে,
ঘরেতে আছেন নাইকো ভাঁড়ারে
   এ কথা শুনিবে কেবা!
আমার কপালে বিপরীত ফল---
চপলা লক্ষ্মী মোর অচপল,
ভারতী না থাকে থির এক পল
   এতো করি তাঁর সেবা।
তাই তো কপাটে লাগাইয়া খিল
স্বর্গে মর্তে খুঁজিতেছি মিল,
আনমনা যদি হই এক-তিল
   অমনি সর্বনাশ!'
মনে মনে হাসি মুখ করি ভার
কহে কবিজায়া, `পারি নেকো আর,
ঘরসংসার গেল ছারেখার,
   সব তাতে পরিহাস!'
এতেক বলিয়া বাঁকায়ে মুখানি
শিঞ্জিত করি কাঁকন-দুখানি
চঞ্চল করে অঞ্চল টানি
   রোষছলে যায় চলি।
হেরি সে ভুবন-গরব-দমন
অভিমানবেগে অধীর গমন
উচাটন কবি কহিল, `অমন
   যেয়ো না হৃদয় দলি।
ধরা নাহি দিলে ধরিব দু পায়,
কী করিতে হবে বলো সে উপায়,
ঘর ভরি দিব সোনায় রুপায়---
   বুদ্ধি জোগাও তুমি।
একটুকু ফাঁকা যেখানে যা পাই
তোমার মুরতি সেখানে চাপাই,
বুদ্ধির চাষ কোনোখানে নাই---
   সমস্ত মরুভূমি।'
`হয়েছে, হয়েছে, এত ভালো নয়'
হাসিয়া রুষিয়া গৃহিণী ভনয়,
`যেমন বিনয় তেমনি প্রণয়
   আমার কপালগুণে।
কথার কখনো ঘটে নি অভাব,
যখনি বলেছি পেয়েছি জবাব,
একবার ওগো বাক্য-নবাব
   চলো দেখি কথা শুনে।
শুভ দিন ক্ষন দেখো পাঁজি খুলি,
সঙ্গে করিয়া লহো পুঁথিগুলি,
ক্ষনিকের তরে আলস্য ভুলি
   চলো রাজসভা-মাঝে।
আমাদের রাজা গুণীর পালক,
মানুষ হইয়া গেল কত লোক,
ঘরে তুমি জমা করিলে শোলোক
   লাগিবে কিসের কাজে!'
কবির মাথায় ভাঙি পড়ে বাজ,
ভাবিল--- বিপদ দেখিতেছি আজ,
কখনো জানি নে রাজা মহারাজ,
   কপালে কী জানি আছে!
মুখে হেসে বলে, `এই বৈ নয়!
আমি বলি, আরো কী করিতে হয়!
প্রাণ দিতে পারি, শুধু জাগে ভয়
   বিধবা হইবে পাছে।
যেতে যদি হয় দেরিতে কী কাজ,
ত্বরা করে তবে নিয়ে এসো সাজ---
হেমকুণ্ডল, মণিময় তাজ,
   কেয়ূর, কনকহার।
বলে দাও মোর সারথিরে ডেকে
ঘোড়া বেছে নেয় ভালো ভালো দেখে,
কিঙ্করগণ সাথে যাবে কে কে
   আয়োজন করো তার।'
ব্রাহ্মণী কহে, `মুখাগ্রে যার
বাধে না কিছুই, কী চাহে সে আর
মুখ ছুটাইলে রথাশ্বে তার
   না দেখি আবশ্যক।
নানা বেশভূষা হীরা রুপা সোনা
এনেছি পাড়ার করি উপাসনা,
সাজ করে লও পুরায়ে বাসনা,
   রসনা ক্ষান্ত হোক।'
এতেক বলিয়া ত্বরিতচরণ
আনে বেশবাস নানান-ধরন,
কবি ভাবে মুখ করি বিবরন---
   আজিকে গতিক মন্দ।
গৃহিণী স্বয়ং নিকটে বসিয়া
তুলিল তাহারে মাজিয়া ঘষিয়া,
আপনার হাতে যতনে কষিয়া
   পরাইল কটিবন্ধ।
উষ্ণীষ আনি মাথায় চড়ায়,
কণ্ঠী আনিয়া কণ্ঠে জড়ায়,
অঙ্গদ দুটি বাহুতে পরায়,
   কুণ্ডল দেয় কানে।
অঙ্গে যতই চাপায় রতন
কবি বসি থাকে ছবির মতন,
প্রেয়সীর নিজ হাতের যতন
   সেও আজি হার মানে।
এইমতে দুই প্রহর ধরিয়া
বেশভূষা সব সমাধা করিয়া
গৃহিণী নিরখে ঈষত সরিয়া
   বাঁকায়ে মধুর গ্রীবা।
হেরিয়া কবির গম্ভীর মুখ
হৃদয়ে উপজে মহা কৌতুক;
হাসি উঠি কহে ধরিয়া চিবূক,
   `আ মরি, সেজেছ কিবা!'
ধরিল সমুখে আরশি আনিয়া;
কহিল বচন অমিয় ছানিয়া,
`পুরনারীদের পরান হানিয়া
   ফিরিয়া আসিবে আজি।
তখন দাসীরে ভুলো না গরবে,
এই উপকার মনে রেখো তবে,
মোরেও এমন পরাইতে হবে
   রতনভূষণরাজি।'
কোলের উপরে বসি বাহুপাশে
বাঁধিয়া কবিরে সোহাগে সহাসে
কপোল রাখিয়া কপোলের পাশে
   কানে কানে কথা কয়।
দেখিতে দেখিতে কবির অধরে
হাসিরাশি আর কিছুতে না ধরে,
মুগ্ধ হৃদয় গলিয়া আদরে
   ফাটিয়া বাহির হয়।
কহে উচ্ছ্বসি, `কিছু না মানিব,
এমনি মধুর শ্লোক বাখানিব
রাজভাণ্ডার টানিয়া আনিব
   ও রাঙা চরণতলে!'
বলিতে বলিতে বুক উঠে ফুলি,
উষ্ণীষ-পরা মস্তক তুলি
পথে বাহিরায় গৃহদ্বার খুলি,
   দ্রুত রাজগৃহে চলে।
কবির রমণী কুতুহলে ভাসে,
তাড়তাড়ি উঠি বাতায়নপাশে
উঁকি মারি চায়, মনে মনে হাসে---
   কালো চোখে আলো নাচে।
কহে মনে মনে বিপুলপুলকে---
রাজপথ দিয়ে চলে এত লোকে,
এমনটি আর পড়িল না চোখে
   আমার যেমন আছে॥
এ দিকে কবির উত্‍‌সাহ ক্রমে
নিমেষে নিমেষে আসিতেছে কমে,
যখন পশিল নৃপ-আশ্রমে
   মরিতে পাইলে বাঁচে।
রাজসভাসদ্ সৈন্য পাহারা
গৃহিণীর মতো নহে তো তাহারা,
সারি সারি দাড়ি করে দিশাহারা---
   হেথা কী আসিতে আছে!
হেসে ভালোবেসে দুটো কথা কয়
রাজসভাগৃহ হেন ঠাঁই নয়,
মন্ত্রী হইতে দ্বারীমহাশয়
   সবে গম্ভীরমুখ।
মানুষে কেন যে মানুষের প্রতি
ধরি আছে হেন যমের মুরতি
তাই ভাবি কবি না পায় ফুরতি---
   দমি যায় তার বুক।
বসি মহারাজ মহেন্দ্ররায়
মহোচ্চ গিরিশিখরের প্রায়,
জন-অরণ্য হেরিছে হেলায়
   অচল-অটল ছবি।
কৃপানির্ঝর পড়িছে ঝরিয়া
শত শত দেশ সরস করিয়া,
সে মহামহিমা নয়ন ভরিয়া
   চাহিয়া দেখিল কবি।
বিচার সমাধা হল যবে, শেষে
ইঙ্গিত পেয়ে মন্ত্রী-আদেশে
জোড়করপুটে দাঁড়াইল এসে
   দেশের প্রধান চর।
অতি সাধুমত আকার প্রকার,
এক-তিল নাহি মুখের বিকার,
ব্যবসা যে তাঁর মানুষ-শিকার
   নাহি জানে কোনো নর।
ব্রত নানামত সতত পালয়ে,
এক কানাকড়ি মুল্য না লয়ে
ধর্মোপদেশ আলয়ে আলয়ে
   বিতরিছে যাকে তাকে।
চোরা কটাক্ষ চক্ষে ঠিকরে---
কী ঘটিছে কার, কে কোথা কী করে
পাতায় পাতায় শিকড়ে শিকড়ে
   সন্ধান তার রাখে।
নামাবলি গায়ে বৈষ্ণবরূপে
যখন সে আসি প্রণমিল ভূপে,
মন্ত্রী রাজারে অতি চুপে চুপে
   কী করিল নিবেদন।
অমনি আদেশ হইল রাজার,
`দেহো এঁরে টাকা পঞ্চ হজার।'
`সাধু সাধু' কহে সভার মাঝার
   যত সভাসদ্‌জন।
পুলক প্রকাশে সবার গাত্রে---
`এ যে দান ইহা যোগ্যপাত্রে,
দেশের আবাল-বনিতা-মাত্রে
   ইথে না মানিবে দ্বেষ।'
সাধু নুয়ে পড়ে নম্রতাভরে,
দেখি সভাজন `আহা আহা' করে,
মন্ত্রীর শুধু জাগিল অধরে
   ঈষত্‍‌ হাস্যলেশ।
আসে গুটি গুটি বৈয়াকরণ
ধুলিভরা দুটি লইয়া চরণ
চিহ্নিত করি রাজাস্তরণ
   পবিত্র পদপঙ্কে।
ললাটে বিন্দু বিন্দু ঘর্ম,
বলি-অঙ্কিত শিথিল চর্ম,
প্রখরমুর্তি অগ্নিশর্ম---
   ছাত্র মরে আতঙ্কে।
কোনো দিকে কোনো লক্ষ না ক'রে
পড়ি গেল শ্লোক বিকট হাঁ ক'রে,
মটর কড়াই মিশায়ে কাঁকরে
   চিবাইল যেন দাঁতে।
কেহ তার নাহি বুঝে আগুপিছু,
সবে বসি থাকে মাথা করি নিচু;
রাজা বলে, `এঁরে দক্ষিণা কিছু
   দাও দক্ষিণ হাতে।'
তার পরে এল গনত্‍‌কার,
গণনায় রাজা চমত্‍‌কার,
টাকা ঝন্ ঝন্ ঝনত্‍‌কার
   বাজায়ে সে গেল চলি।
আসে এক বুড়ো গণ্যমান্য
করপুটে লয়ে দুর্বাধান্য,
রাজা তাঁর প্রতি অতি বদান্য
   ভরিয়া দিলেন থলি।
আসে নট ভাট রাজপুরোহিত---
কেহ একা কেহ শিষ্য-সহিত,
কারো বা মাথায় পাগড়ি লোহিত
   কারো বা হরিত্‍‌বর্ণ।
আসে দ্বিজগণ পরমারাধ্য---
কন্যার দায়, পিতার শ্রাদ্ধ---
যার যথামত পায় বরাদ্দ;
   রাজা আজি দাতাকর্ণ।
যে যাহার সবে যায় স্বভবনে,
কবি কী করিবে ভাবে মনে মনে,
রাজা দেখে তারে সভাগৃহকোণে
   বিপন্নমুখছবি।
কহে ভূপ, `হোথা বসিয়া কে ওই,
এস তো, মন্ত্রী, সন্ধান লই।'
কবি কহি উঠে, `আমি কেহ নই,
   আমি শুধু এক কবি।'
রাজা কহে, `বটে! এসো এসো তবে,
আজিকে কাব্য-আলোচনা হবে।'
বসাইলা কাছে মহাগৌরবে
   ধরি তার কর দুটি।
মন্ত্রী ভাবিল, যাই এই বেলা,
এখন তো শুরু  হবে ছেলেখেলা---
কহে, `মহারাজ, কাজ আছে মেলা,
   আদেশ পাইলে উঠি।'
রাজা শুধু মৃদু নাড়িলা হস্ত,
নৃপ-ইঙ্গিতে মহা তটস্থ
বাহির হইয়া গেল সমস্ত
   সভাস্থ দলবল---
পাত্র মিত্র অমাত্য আদি,
অর্থী প্রার্থী বাদী প্রতিবাদী,
উচ্চ তুচ্ছ বিবিধ-উপাধি
   বন্যার যেন জল॥
চলি গেল যবে সভ্যসুজন
মুখোমুখি করি বসিলা দুজন;
রাজা বলে, `এবে কাব্যকূজন
   আরম্ভ করো কবি।'
কবি তবে দুই কর জুড়ি বুকে
বাণীবন্দনা করে নত মুখে,
`প্রকাশো জননী নয়নসমুখে
   প্রসন্ন মুখছবি।
বিমল মানসসরস-বাসিনী
শুক্লবসনা শুভ্রহাসিনী
বীণাগঞ্জিতমঞ্জুভাষিণী
   কমলকুঞ্জাসনা,
তোমারে হৃদয়ে করিয়া আসীন
সুখে গৃহকোণে ধনমানহীন
খ্যাপার মতন আছি চিরদিন
   উদাসীন আনমনা।
চারি দিকে সবে বাঁটিয়া দুনিয়া
আপন অংশ নিতেছে গুনিয়া,
আমি তব স্নেহবচন শুনিয়া
   পেয়েছি স্বরগসুধা।
সেই মোর ভালো, সেই বহু মানি,
তবু মাঝে মাঝে কেঁদে ওঠে প্রাণী---
সুরের খাদ্যে জানো তো মা, বাণী,
   নরের মিটে না ক্ষুধা।
যা হবার হবে সে কথা ভাবি না,
মা গো, একবার ঝংকারো বীণা,
ধরহ রাগিণী বিশ্বপ্লাবিনী
   অমৃত-উত্‍‌স-ধারা।
যে রাগিণী শুনি নিশিদিনমান
বিপুল হর্ষে দ্রব ভগবান
মলিনমর্ত-মাঝে বহমান
   নিয়ত আত্মহারা।
যে রাগিণী সদা গগন ছাপিয়া
হোমশিখাসম উঠিছে কাঁপিয়া,
অনাদি অসীমে পড়িছে ঝাঁপিয়া
   বিশ্বতন্ত্রী হতে।
যে রাগিণী চিরজন্ম ধরিয়া
চিত্তকুহরে উঠে কুহরিয়া---
অশ্রুহাসিতে জীবন ভরিয়া
   ছুটে সহস্র স্রোতে।
কে আছে কোথায়, কে আসে কে যায়,
নিমেষে প্রকাশে, নিমেষে মিলায়---
বালুকার'পরে কালের বেলায়
   ছায়া-আলোকের খেলা।
জগতের যত রাজা মহারাজ
কাল ছিল যারা কোথা তারা আজ,
সকালে ফুটিছে সুখদুখলাজ---
   টুটিছে সন্ধ্যাবেলা।
শুধু তার মাঝে ধ্বনিতেছে সুর
বিপুল বৃহত্‍‌ গভীর মধুর,
চিরদিন তাহে আছে ভরপুর
   মগন গগনতল।
যে জন শুনেছে সে অনাদি ধ্বনি
ভাসায়ে দিয়েছে হৃদয়তরণী---
জানে না আপনা, জানে না ধরণী,
   সংসারকোলাহল।
সে জন পাগল, পরান বিকল---
ভবকূল হতে ছিঁড়িয়া শিকল
কেমনে এসেছে ছাড়িয়া সকল,
   ঠেকেছে চরণে তব।
তোমার অমল কমলগন্ধ
হৃদয়ে ঢালিছে মহা-আনন্দ---
অপূর্ব গীত, আলোক ছন্দ
   শুনিছ নিত্য নব।
বাজুক সে বীণা, মজুক ধরণী---
বারেকের তরে ভুলাও, জননী,
কে বড়ো কে ছোটো, কে দীন কে ধনী,
   কেবা আগে কেবা পিছে---
কার জয় হল কার পরাজয়,
কাহার বৃদ্ধি কার হল ক্ষয়,
কেবা ভালো আর কেবা ভালো নয়,
   কে উপরে কেবা নীচে।
গাঁথা হয়ে যাক এক গীতরবে
ছোটো জগতের ছোটোবড়ো সবে,
সুখে প'ড়ে রবে পদপল্লবে
   যেন মালা একখানি।
তুমি মানসের মাঝখানে আসি
দাঁড়াও মধুর মুরতি বিকাশি,
কুন্দবরণ-সুন্দর-হাসি
   বীণা হাতে বীণাপাণি।
ভাসিয়া চলিবে রবি শশী তারা
সারি সারি যত মানবের ধারা
অনাদিকালের পান্থ যাহারা
   তব সংগীতস্রোতে।
দেখিতে পাইব ব্যোমে মহাকাল
ছন্দে ছন্দে বাজাইছে তাল,
দশ দিক্‌বধূ খুলি কেশজাল
   নাচে দশ দিক হতে।'
এতেক বলিয়া ক্ষণপরে কবি
করুণ কথায় প্রকাশিল ছবি
পূণ্যকাহিনী রঘুকুলরবি
   রাঘবের ইতিহাস।
অসহ দুঃখ সহি নিরবধি
কেমনে জনম গিয়েছে দগধি,
জীবনের শেষ দিবস অবধি
   অসীম নিরাশ্বাস।
কহিল, `বারেক ভাবি দেখো মনে
সেই একদিন কেটেছে কেমনে
যেদিন মলিন বাকলবসনে
   চলিলা বনের পথে---
ভাই লক্ষ্মণ বয়স নবীন,
ম্লানছায়াসম বিষাদবিলীন
নববধূ সীতা আভরণহীন
   উঠিলা বিদায়রথে।
রাজপুরী-মাঝে উঠে হাহাকার,
প্রজা কাঁদিতেছে পথে সারে-সার,
এমন বজ্র কখনো কি আর
   পড়েছে এমন ঘরে!
অভিষেক হবে, উত্‍‌সবে তার
আনন্দময় ছিল চারি ধার---
মঙ্গলদীপ নিবিয়া আঁধার
   শুধু নিমেষের ঝড়ে।
আর-একদিন, ভেবে দেখো মনে,
যেদিন শ্রীরাম লয়ে লক্ষ্মণে
ফিরিয়া নিভৃত কুটিরভবনে
   দেখিলা জানকী নাহি---
`জানকী' `জানকী' আর্ত রোদনে
ডাকিয়া ফিরিলা কাননে কাননে,
মহা-অরণ্য আঁধার-আননে
   রহিল নীরবে চাহি।
তার পরে দেখো শেষ কোথা এর,
ভেবে দেখো কথা সেই দিবসের---
এত বিষাদের এত বিরহের
   এত সাধনার ধন,
সেই সীতাদেবী রাজসভা-মাঝে
বিদায়বিনয়ে নমি রঘুরাজে
দ্বিধা ধরাতলে অভিমানে লাজে
   হইলা অদর্শন।
সে-সকল দিন সেও চলে যায়,
সে অসহ শোক--- চিহ্ন কোথায়---
যায় নি তো এঁকে ধরণীর গায়
   অসীম দগ্ধরেখা।
দ্বিধা ধরাভুমি জুড়েছে আবার,
দণ্ডকবনে ফুটে ফুলভার,
সরযূর কূলে দুলে তৃণসার
   প্রফুল্লশ্যামলেখা।
শুধু সে দিনের একখানি সুর
চিরদিন ধ'রে বহু বহু দূর
কাঁদিয়া হৃদয় করিছে বিধুর
   মধুর করুণ তানে।
সে মহাপ্রাণের মাঝখানটিতে
যে মহারাগিণী আছিল ধ্বনিতে
আজিও সে গীত মহাসংগীতে
   বাজে মানবের কানে।'
তার পরে কবি কহিল সে কথা,
কুরুপাণ্ডবসমরবারতা---
গৃহবিবাদের ঘোর মত্ততা
   ব্যাপিল সর্ব দেশ;
দুইটি যমজ তরু পাশাপাশি,
ঘর্ষণে জ্বলে হুতাশনরাশি,
মহাদাবানল ফেলে শেষে গ্রাসি
   অরণ্যপরিবেশ।
এক গিরি হতে দুই-স্রোত-পারা
দুইটি শীর্ণ বিদ্বেষধারা
সরীসৃপগতি মিলিল তাহারা
   নিষ্ঠুর অভিমানে,
দেখিতে দেখিতে হল উপনীত
ভারতের যত ক্ষত্রশোণিত---
ত্রাসিত ধরণী করিল ধ্বনিত
   প্রলয়বন্যাগানে।
দেখিতে দেখিতে ডুবে গেল কূল,
আত্ম ও পর হয়ে গেল ভুল,
গৃহবন্ধন করি নির্মূল
   ছুটিল রক্তধারা---
ফেনায়ে উঠিল মরণাম্বুধি,
বিশ্ব রহিল নিশ্বাস রুধি
কাঁপিল গগন শত আঁখি মুদি
   নিবায়ে সূর্যতারা।
সমরবন্যা যবে অবসান
সোনার ভারত বিপুল শ্মশান,
রাজগৃহ যত ভূতলশয়ান
   পড়ে আছে ঠাঁই ঠাঁই।
ভীষণা শান্তি রক্তনয়নে
বসিয়া শোণিতপঙ্কশয়নে,
চাহি ধরা-পানে আনতবয়নে
   মুখেতে বচন নাই।
বহু দিন পরে ঘুচিয়াছে খেদ,
মরণে মিটেছে সব বিচ্ছেদ,
সমাধা যজ্ঞ মহা-নরমেধ
   বিদ্বেষহুতাশনে।
সকল কামনা করিয়া পূর্ণ
সকল দম্ভ করিয়া চূর্ণ
পাঁচ ভাই গিয়া বসিলা শূন্য
   স্বর্ণসিংহাসনে।
স্তব্ধ প্রাসাদ বিষাদ-আঁধার,
শ্মশান হইতে আসে হাহাকার
রাজপুরবধূ যত অনাথার
   মর্মবিদার রব।
`জয় জয় জয় পাণ্ডুতনয়'
সারি সারি দ্বারী দাঁড়াইয়া কয়---
পরিহাস বলে আজ মনে হয়,
   মিছে মনে হয় সব।
কালি যে ভারত সারা দিন ধরি
অট্ট গরজে অম্বর ভরি
রাজার রক্তে খেলেছিল হোরি
   ছাড়ি কুলভয়লাজে,
পরদিনে চিতাভস্ম মাখিয়া
সন্ন্যাসীবেশে অঙ্গ ঢাকিয়া
বসি একাকিনী শোকার্তহিয়া
   শূন্যশ্মশানমাঝে।
কুরুপাণ্ডব মুছে গেছে সব,
সে রণরঙ্গ হয়েছে নীরব,
সে চিতাবহ্নি অতি ভৈরব
   ভস্মও নাহি তার।
যে ভূমি লইয়া এত হানাহানি
সে আজি কাহার তাহাও না জানি,
কোথা ছিল রাজা কোথা রাজধানী
   চিহ্ন নাহিকো আর।
তবু কোথা হতে আসিছে সে স্বর---
যেন সে অমর সমরসাগর
গ্রহণ করেছে নব কলেবর
   একটি বিরাট গানে।
বিজয়ের শেষে সে মহাপ্রয়াণ,
সফল আশার বিষাদ মহান্,
উদাস শান্তি করিতেছে দান
   চিরমানবের প্রাণে।
হায়, এ ধরায় কত অনন্ত
বরষে বরষে শীত বসন্ত
সুখে দুখে ভরি দিক্-দিগন্ত
   হাসিয়া গিয়াছে ভাসি।
এমনি বরষা আজিকার মতো
কতদিন কত হয়ে গেছে গত,
নবমেঘভারে গগন আনত
   ফেলেছে অশ্রুরাশি।
যুগে যুগে লোক গিয়েছে এসেছে,
দুখিরা কেঁদেছে, সুখীরা হেসেছে,
প্রেমিক যেজন ভালো সে বেসেছে
   আজি আমাদেরই মতো;
তারা গেছে, শুধু তাহাদের গান
দু হাতে ছড়ায়ে করে গেছে দান---
দেশে দেশে তার নাহি পরিমাণ,
   ভেসে ভেসে যায় কত।
শ্যামলা বিপুলা এ ধরার পানে
চেয়ে দেখি আমি মুগ্ধ নয়ানে,
সমস্ত প্রাণে কেন-যে কে জানে
   ভরে আসে আঁখিজল---
বহু মানবের প্রেম দিয়ে ঢাকা,
বহু দিবসের সুখে দুখে আঁকা,
লক্ষ যুগের সংগীতে মাখা
   সুন্দর ধরাতল!
এ ধরার মাঝে তুলিয়া নিনাদ
চাহি নে করিতে বাদ প্রতিবাদ,
যে ক' দিন আছি মানসের সাধ
   মিটাব আপন-মনে---
যার যাহা আছে তার থাক্ তাই,
কারো অধিকারে যেতে নাহি চাই
শান্তিতে যদি থাকিবারে পাই
   একটি নিভৃত কোণে।
শুধু বাঁশিখানি হাতে দাও তুলি,
বাজাই বসিয়া প্রাণমন খুলি,
পুষ্পের মত সংগীতগুলি
   ফুটাই আকাশভালে।
অন্তর হতে আহরি বচন
আনন্দলোক করি বিরচন,
গীতরসধারা করি সিঞ্চন
   সংসারধুলিজালে।
অতিদুর্গম সৃষ্টিশিখরে
অসীম কালের মহাকন্দরে
সতত বিশ্বনির্ঝর ঝরে
   ঝর্ঝরসংগীতে,
স্বরতরঙ্গ যত গ্রহতারা
ছুটিছে শূন্যে উদ্দেশহারা---
সেথা হতে টানি লব গীতধারা
   ছোটো এই বাঁশরিতে।
ধরণীর শ্যাম করপুটখানি
ভরি দিব আমি সেই গীত আনি,
বাতাসে মিশায়ে দিব এক বাণী
   মধুর-অর্থ-ভরা।
নবীন আষাঢ়ে রচি নব মায়া
এঁকে দিয়ে যাব ঘনতর ছায়া,
করে দিয়ে যাব বসন্তকায়া
   বাসন্তীবাস-পরা।
ধরণীর তলে গগনের গায়
সাগরের জলে অরণ্যছায়
আরেকটুখানি নবীন আভায়
   রঙিন করিয়া দিব।
সংসার-মাঝে কয়েকটি সুর
রেখে দিয়ে যাব করিয়া মধুর,
দু-একটি কাঁটা করি দিব দূর---
   তার পরে ছুটি নিব।
সুখহাসি আরো হবে উজ্জ্বল,
সুন্দর হবে নয়নের জল,
স্নেহসুধামাখা বাসগৃহতল
   আরো আপনার হবে।
প্রেয়সী নারীর নয়নে অধরে
আরেকটু মধু দিয়ে যাব ভরে,
আরেকটু স্নেহ শিশুমুখ-'পরে
   শিশিরের মত রবে।
না পারে বুঝাতে, আপনি না বুঝে
মানুষ ফিরিছে কথা খুঁজে খুঁজে---
কোকিল যেমন পঞ্চমে কূজে
   মাগিছে তেমনি সুর।
কিছু ঘুচাইব সেই ব্যাকুলতা,
কিছু মিটাইব প্রকাশের ব্যথা,
বিদায়ের আগে দু-চারিটা কথা
   রেখে যাব সুমধুর।
থাকো হৃদাসনে জননী ভারতী---
তোমারি চরণে প্রাণের আরতি,
চাহি না চাহিতে আর কারো প্রতি,
   রাখি না কাহারো আশা।
কত সুখ ছিল হয়ে গেছে দুখ,
কত বান্ধব হয়েছে বিমুখ,
ম্লান হয়ে গেছে কত উত্‍‌সুক
   উন্মুখ ভালোবাসা।
শুধু ও চরণ হৃদয়ে বিরাজে,
শুধু ওই বীণা চিরদিন বাজে,
স্নেহসুরে ডাকে অন্তর-মাঝে---
   আয় রে বত্‍‌স, আয়,
ফেলে রেখে আয় হাসি ক্রন্দন,
ছিঁড়ে আয় যত মিছে বন্ধন,
হেথা ছায়া আছে চিরনন্দন
   চিরবসন্ত-বায়।
সেই ভালো মা গো, যাক যাহা যায়,
জন্মের মত বরিনু তোমায়---
কমলগন্ধ কোমল দু পায়
   বার বার নমোনম।'
এত বলি কবি থামাইল গান,
বসিয়া রহিল মুগ্ধনয়ান,
বাজিতে লাগিল হৃদয় পরান
   বীণাঝংকার-সম।
পুলকিত রাজা, আঁখি ছলছল্,
আসন ছাড়িয়া নামিলা ভূতল---
দু বাহু বাড়ায়ে, পরান উতল,
   কবিরে লইলা বুকে।
কহিলা `ধন্য, কবি গো, ধন্য,
আনন্দে মন সমাচ্ছন্ন,
তোমারে কী আমি কহিব অন্য---
   চিরদিন থাকো সুখে।
ভাবিয়া না পাই কী দিব তোমারে,
করি পরিতোষ কোন্ উপহারে,
যাহা-কিছু আছে রাজভাণ্ডারে
   সব দিতে পারি আনি।'
প্রেমোচ্ছ্বসিত আনন্দজলে
ভরি দু নয়ন কবি তাঁরে বলে,
`কণ্ঠ হইতে দেহো মোর গলে
   ওই ফুলমালাখানি।'
মালা বাঁধি কেশে কবি যায় পথে,
কেহ শিবিকায় কেহ ধায় রথে,
নানা দিকে লোক যায় নানামতে
   কাজের অন্বেষণে।
কবি নিজমনে ফিরিছে লুব্ধ,
যেন সে তাহার নয়ন মুগ্ধ
কল্পধেনুর অমৃতদুগ্ধ
   দোহন করিছে মনে।
কবির রমণী বাঁধি কেশপাশ
সন্ধ্যার মতো পরি রাঙা বাস
বসি একাকিনী বাতায়ন-পাশ---
   সুখহাস মুখে ফুটে।
কপোতের দল চারি দিকে ঘিরে
নাচিয়া ডাকিয়া বেড়াইছে ফিরে---
যবের কণিকা তুলিয়া সে ধীরে
   দিতেছে চঞ্চুপুটে।
অঙ্গুলি তার চলিছে যেমন
কত কী-যে কথা ভাবিতেছে মন,
হেনকালে পথে ফেলিয়া নয়ন
   সহসা কবিরে হেরি
বাহুখানি নাড়ি মৃদু ঝিনিঝিনি
বাজাইয়া দিল করকিঙ্কিণী,
হাসিজালখানি অতুলহাসিনী
   ফেলিলা কবিরে ঘেরি।
কবির চিত্ত উঠে উল্লাসি;
অতি সত্বর সম্মুখে আসি
কহে কৌতুকে মৃদু মৃদু হাসি,
   `দেখো কী এনেছি বালা!
নানা লোকে নানা পেয়েছে রতন,
আমি আনিয়াছি করিয়া যতন
তোমার কণ্ঠে দেবার মতন
   রাজকণ্ঠের মালা।'
এত বলি মালা শির হতে খুলি
প্রিয়ার গলায় দিতে গেল তুলি,
কবিনারী রোষে কর দিল ঠেলি
   ফিরায়ে রহিল মুখ।
মিছে ছল করি মুখে করে রাগ,
মনে মনে তার জাগিছে সোহাগ,
গরবে ভরিয়া উঠে অনুরাগ,
   হৃদয়ে উথলে সুখ।
কবি ভাবে বিধি অপ্রসন্ন,
বিপদ আজিকে হেরি আসন্ন
বসি থাকে মুখ করি বিষণ্ণ
   শূন্যে নয়ন মেলি।
কবির ললনা আধখানি বেঁকে
চোরা কটাক্ষে চাহে থেকে থেকে,
পতির মুখের ভাবখানা দেখে
   মুখের বসন ফেলি
উচ্চকণ্ঠে উঠিল হাসিয়া,
তুচ্ছ ছলনা গেল সে ভাসিয়া,
চকিতে সরিয়া নিকটে আসিয়া
   পড়িল তাহার বুকে।
সেথায় লুকায়ে হাসিয়া কাঁদিয়া
কবির কণ্ঠ বাহুতে বাঁধিয়া
শতবার করি আপনি সাধিয়া
   চুম্বিল তার মুখে।
বিস্মিত কবি বিহ্বলপ্রায়
আনন্দে কথা খুঁজিয়া না পায়,
মালাখানি লয়ে আপন গলায়
   আদরে পরিলা সতী।
ভক্তি-আবেগে কবি ভাবে মনে
চেয়ে সেই প্রেমপূর্ণ বদনে---
বাঁধা প'ল এক মাল্যবাঁধনে
   লক্ষ্মীসরস্বতী॥



কৃষ্ণকলি
--রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
 
কৃষ্ণকলি আমি তারেই বলি, 
        কালো তারে বলে গাঁয়ের লোক।
মেঘলাদিনে দেখেছিলেম মাঠে 
        কালো মেয়ের কালো হরিণ-চোখ।
ঘোমটা মাথায় ছিলনা তার মোটে, 
মুক্তবেণী পিঠের 'পরে লোটে।
        কালো? তা সে যতই কালো হোক, 
        দেখেছি তার কালো হরিণ-চোখ।

ঘন মেঘে আঁধার হল দেখে 
        ডাকতেছিল শ্যামল দুটি গাই,
শ্যামা মেয়ে ব্যস্ত ব্যাকুল পদে 
        কুটির হতে ত্রস্ত এল তাই।
আকাশ-পানে হানি যুগল ভুরু 
শুনলে বারেক মেঘের গুরুগুরু।
        কালো? তা সে যতই কালো হোক, 
        দেখেছি তার কালো হরিণ-চোখ।

পূবে বাতাস এল হঠাত্‍‌ ধেয়ে,
        ধানের ক্ষেতে খেলিয়ে গেল ঢেউ।
আলের ধারে দাঁড়িয়েছিলেম একা,
        মাঠের মাঝে আর ছিল না কেউ।
আমার পানে দেখলে কিনা চেয়ে,
আমি জানি আর জানে সেই মেয়ে।
        কালো? তা সে যতই কালো হোক,
        দেখেছি তার কালো হরিণ-চোখ।

এমনি করে কাজল কালো মেঘ 
        জ্যৈষ্ঠমাসে আসে ঈশান কোণে।
এমনি করে কালো কোমল ছায়া
        আষাঢ়মাসে নামে তমাল-বনে।
এমনি করে শ্রাবণ-রজনীতে
হঠাত্‍‌ খুশি ঘনিয়ে আসে চিতে।
        কালো? তা সে যতই কালো হোক,
        দেখেছি তার কালো হরিণ-চোখ।

কৃষ্ণকলি আমি তারেই বলি, 
        আর যা বলে বলুক অন্য লোক।
দেখেছিলেম ময়নাপাড়ার মাঠে
        কালো মেয়ের কালো হরিণ-চোখ।
মাথার পরে দেয়নি তুলে বাস,
লজ্জা পাবার পায়নি অবকাশ।
        কালো? তা সে যতই কালো হোক,
        দেখেছি তার কালো হরিণ-চোখ।
 
ঝুলন
--রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
 
 আমি   পরানের সাথে খেলিব আজিকে মরণখেলা
              নিশীথবেলা।
       সঘন বরষা, গগন আঁধার
       হেরো বারিধারে কাঁদে চারিধার---
       ভীষণ রঙ্গে ভবতরঙ্গে ভাসাই ভেলা;
       বাহির হয়েছি স্বপ্নশয়ন করিয়া হেলা
              রাত্রিবেলা॥

 ওগো,   পবনে গগনে সাগরে আজিকে কী কল্লোল!
              দে দোল্ দোল্।
       পশ্চাত্‍‌ হতে হাহা ক'রে হাসি
       মত্ত ঝটিকা ঠেলা দেয় আসি,
       যেন এ লক্ষ যক্ষশিশুর অট্টরোল।
       আকাশে পাতালে পাগলে মাতালে হট্টগোল!
              দে দোল্ দোল্।

 আজি   জাগিয়া উঠিয়া পরান আমার বসিয়া আছে
              বুকের কাছে।
       থাকিয়া থাকিয়া উঠিছে কাঁপিয়া,
       ধরিছে আমার বক্ষ চাপিয়া,
       নিঠুর নিবিড় বন্ধনসুখে হৃদয় নাচে;
       ত্রাসে উল্লাসে পরান আমার ব্যাকুলিয়াছে
              বুকের কাছে॥

 হায়,   এতকাল আমি রেখেছিনু তারে যতনভরে
              শয়ন-'পরে।
       ব্যথা পাছে লাগে---- দুখ পাছে জাগে
       নিশিদিন তাই বহু অনুরাগে
       বাসরশয়ন করেছি রচন কুসুমথরে;
       দুয়ার রুধিয়া রেখেছিনু তারে গোপন ঘরে
              যতনভরে॥

 কত    সোহাগ করেছি চুম্বন করি নয়নপাতে
              স্নেহের সাথে।
       শুনায়েছি তারে মাথা রাখি পাশে
       কত প্রিয়নাম মৃদুমধুভাষে,
       গুঞ্জরতান করিয়াছি গান জ্যোত্‍‌স্নারাতে;
       যা-কিছু মধুর দিয়েছিনু তার দুখানি হাতে
              স্নেহের সাথে॥

 শেষে   সুখের শয়নে শ্রান্ত পরান আলসরসে
              আবেশবশে।
       পরশ করিলে জাগে না সে আর,
       কুসুমের হার লাগে গুরুভার,
       ঘুমে, জাগরণে মিশি একাকার নিশিদিবসে
       বেদনাবিহীন অসাড় বিরাগ মরমে পশে
              আবেশবশে॥

 ঢালি   মধুরে মধুর বধূরে আমার হারাই বুঝি,
              পাই নে খুঁজি।
       বাসরের দীপ নিবে নিবে আসে,
       ব্যাকুল নয়ন হেরি চারি পাশে
       শুধু রাশি রাশি শুষ্ক কুসুম হয়েছে পুঁজি;
       অতল স্বপ্নসাগরে ডুবিয়া মরি যে যুঝি
              কাহারে খুঁজি॥

 তাই   ভেবেছি আজিকে খেলিতে হইবে নূতন খেলা
              রাত্রিবেলা
       মরণদোলায় ধরি রশিগাছি
       বসিব দুজনে বড়ো কাছাকাছি,
       ঝঞ্ঝা আসিয়া অট্ট হাসিয়া মারিবে ঠেলা;
       আমাতে প্রাণেতে খেলিব দুজনে ঝুলনখেলা
              নিশীথবেলা॥

            দে দোল্ দোল্।
            দে দোল্ দোল্।
          এ মহাসাগরে তুফান তোল্
       বধূরে আমার পেয়েছি আবার, ভরেছে কোল।
       প্রিয়ারে আমার তুলেছে জাগায়ে প্রলয়রোল।
       বক্ষশোণিতে উঠেছে আবার কী হিল্লোল!
       ভিতরে বাহিরে জেগেছে আমার কী কল্লোল!
          উড়ে কুন্তল, উড়ে অঞ্চল,
          উড়ে বনমালা বায়ুচঞ্চল,
       বাজে কঙ্কণ বাজে কিঙ্কিণী--- মত্তরোল।
              দে দোল্ দোল্।

       আয় রে ঝঞ্ঝা, পরানবধূর
       আবরণরাশি করিয়া দে দূর,
       করি লুণ্ঠন অবগুণ্ঠন-বসন খোল্।
              দে দোল্ দোল্।

       প্রাণেতে আমাতে মুখোমুখি আজ
       চিনি লব দোঁহে ছাড়ি সব লাজ,
       বক্ষে বক্ষে পরশিব দোঁহে ভাবে বিভোল।
              দে দোল্ দোল্।
       স্বপ্ন টুটিয়া বাহিরিছে আজ দুটি পাগল।
              দে দোল্ দোল্।





আজি বসন্ত জাগ্রত দ্বারে
--রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

আজি   বসন্ত জাগ্রত দ্বারে।
তব অবগুন্ঠিত কুন্ঠিত জীবনে
কোরো না বিড়ম্বিত তারে।
      আজি   খুলিয়ো হৃদয়দল খুলিয়ো,
      আজি   ভুলিয়ো আপনপর ভুলিয়ো,
      এই    সংগীতমুখরিত গগনে
      তব    গন্ধ করঙ্গিয়া তুলিয়ো।
      এই    বাহিরভূবনে দিশা হারায়ে
      দিয়ো   ছড়ায়ে মাধুরী ভারে ভারে।
অতি   নিবিড় বেদনা বনমাঝে রে
আজি   পল্লবে পল্লবে বাজে রে -
দূরে   গগনে কাহার পথ চাহিয়া
আজি ব্যকুল বসুন্ধরা সাজে রে।
      মোর   পরানে দখিন বায়ু লাগিছে,
      কারে   দ্বারে দ্বারে কর হানি মাগিছে,
      এই    সৌরভবিহবল রজনী
      কার   চরণে ধরণীতলে জাগিছে।
      ওগো   সুন্দর, বল্লভ, কান্ত,
      তব   গম্ভীর আহবান কারে।



আমার মাঝে তোমার লীলা হবে
--রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
 
আমার মাঝে তোমার লীলা হবে,
তাই তো আমি এসেছি এই ভবে।
     এই ঘরে সব খুলে যাবে দ্বার,
     ঘুচে যাবে সকল অহংকার,
     আনন্দময় তোমার এ সংসার
          আমার কিছু আর বাকি না রবে।

মরে গিয়ে বাঁচব আমি, তবে
আমার মাঝে তোমার লীলা হবে।
     সব বাসনা যাবে আমার থেমে
     মিলে গিয়ে তোমারি এক প্রেমে,
     দুঃখসুখের বিচিত্র জীবনে
          তুমি ছাড়া আর কিছু না রবে।




আমার খেলা যখন ছিল তোমার সনে
--রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
 
আমার   খেলা যখন ছিল তোমার সনে
         তখন   কে তুমি তা কে জানত।
তখন   ছিল না ভয়, ছিল না লাজ মনে,
         জীবন   বহে যেত অশান্ত।
         তুমি   ভোরের বেলা ডাক দিয়েছ কত
               যেন আমার আপন সখার মতো,
         হেসে   তোমার সাথে ফিরেছিলাম ছুটে
               সেদিন  কত-না বন-বনান্ত।

ওগো,   সেদিন তুমি গাইতে যে সব গান
         কোনো   অর্থ তাহার কে জানত।
শুধু   সঙ্গে তারি গাইত আমার প্রাণ,
         সদা   নাচত হৃদয় অশান্ত।
         হঠাৎ খেলার শেষে আজ কী দেখি ছবি -
               স্তব্ধ আকাশ, নীরব শশী রবি,
         তোমার   চরণপানে নয়ন করি নত
               ভুবন   দাঁড়িয়ে গেছে একান্ত।




আমার এ প্রেম নয় তো ভীরু
--রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
 
আমার এ প্রেম নয় তো ভীরু,
নয় তো হীনবল -
শুধু কি এ ব্যাকুল হয়ে
ফেলবে অশ্রুজল।
মন্দমধুর সুখে শোভায়
প্রেম কে কেন ঘুমে ডোবায়।
তোমার সাথে জাগতে সে চায়
আনন্দে পাগল।

নাচ' যখন ভীষণ সাজে
তীব্র তালের আঘাত বাজে,
পালায় ত্রাসে পালায় লাজে
সন্দেহ বিহবল।
সেই প্রচন্ড মনোহরে
প্রেম যেন মোর বরণ করে,
ক্ষুদ্র আশার স্বর্গ তাহার
দিক সে রসাতল।




আছে আমার হৃদয় আছে ভরে
--রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
 
আছে আমার হৃদয় আছে ভরে,
এখন তুমি যা খুশি তাই করো।
এমনি যদি বিরাজ' অন্তরে
বাহির হতে সকলই মোর হরো।
  সব পিপাসার যেথায় অবসান
  সেথায় যদি পূর্ণ করো প্রাণ,
  তাহার পরে মরুপথের মাঝে
  উঠে রৌদ্র উঠুক খরতর।

এই যে খেলা খেলছ কত ছলে
এই খেলা তো আমি ভালবাসি।
এক দিকেতে ভাসাও আঁখিজলে,
আরেক দিকে জাগিয়ে তোল' হাসি।
  যখন ভাবি সব খোয়ালাম বুঝি
  গভীর করে পাই তাহারে খুঁজি,
  কোলের থেকে যখন ফেল' দূরে
  বুকের মাঝে আবার তুলে ধর'।




আমার মিলন লাগি তুমি
--রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
 
আমার মিলন লাগি তুমি
আসছ কবে থেকে।
তোমার চন্দ্র সূর্য তোমায়
রাখবে কোথায় ঢেকে।
          কত কালের সকাল-সাঁঝে
          তোমার চরণধ্বনি বাজে,
          গোপনে দূত গৃহ-মাঝে
               গেছে আমায় ডেকে।

ওগো পথিক, আজকে আমার
সকল পরাণ ব্যেপে
থেকে থেকে হরষ যেন
উঠছে কেঁপে কেঁপে
          যেন সময় এসেছে আজ,
          ফুরালো মোর যা ছিল কাজ -
          বাতাস আসে, হে মহারাজ,
               তোমার গন্ধ মেখে।




গানের পারে
--রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
 
 দাঁড়িয়ে আছো তুমি আমার     গানের ও পারে।
আমার    সুরগুলি পায় চরণ, আমি     পাই নে তোমারে।
        বাতাস বহে মরি মরি,     আর বেঁধে রেখো না তরী,
        এসো এসো পার হয়ে মোর     হৃদয়-মাঝারে।।
        তোমার সাথে গানের খেলা     দূরের খেলা যে -
        বেদনাতে বাঁশি বাজায়     সকল বেলা যে।
        কবে নিয়ে আমার বাঁশি     বাজাবে গো আপনি আসি
        আনন্দময় নীরব রাতের     নিবিড় আঁধারে?।

চিরায়মানা
--রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
 
যেমন আছ তেমনি এসো, আর কোরো না সাজ।
বেণী নাহয় এলিয়ে রবে,        সিঁথি নাহয় বাঁকা হবে,
নাই-বা হল পত্রলেখায় সকল কারুকাজ।
কাঁচল যদি শিথিল থাকে নাইকো তাহে লাজ।
যেমন আছ তেমনি এসো, আর করো না সাজ।।
এসো দ্রুত চরণদুটি তৃণের 'পরে ফেলে।
ভয় কোরো না - অলক্তরাগ        মোছে যদি মুছিয়া যাক,
নূপুর যদি খুলে পড়ে নাহয় রেখে এলে।
খেদ কোরো না মালা হতে মুক্তা খসে গেলে।
এসো দ্রুত চরণদুটি তৃণের 'পরে ফেলে।
হেরো গো ওই আঁধার হল, আকাশ ঢাকে মেঘে।
ও পার হতে দলে দলে        বকের শ্রেণী উড়ে চলে,
থেকে থেকে শূন্য মাঠে বাতাস ওঠে জেগে।
ওই রে গ্রামের গোষ্ঠমুখে ধেনুরা ধায় বেগে।
হেরো গো ওই আঁধার হল, আকাশ ঢাকে মেঘে।।
প্রদীপখানি নিবে যাবে, মিথ্যা কেন জ্বালো?
কে দেখতে পায় চোখের কাছে        কাজল আছে কি না আছে,
তরল তব সজল দিঠি মেঘের চেয়ে কালো।
আঁখির পাতা যেমন আছে এমনি থাকা ভালো।
কাজল দিতে প্রদীপখানি মিথ্যা কেন জ্বালো?।
এসো হেসে সহজ বেশে, আর কোরো না সাজ।
গাঁথা যদি না হয় মালা        ক্ষতি তাহে নাই গো বালা,
ভূষণ যদি না হয় সারা ভূষণে নাই কাজ।
মেঘ মগন পূর্বগগন, বেলা নাই রে আজ।
এসো হেসে সহজ বেশে, নাই-বা হল সাজ।।
ছল
--রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
 
তোমারে পাছে সহজে বুঝি     তাই কি এত লীলার ছল -
বাহিরে যবে হাসির ছটা     ভিতরে থাকে আঁখির জল।
বুঝি গো আমি, বুঝি গো তব     ছলনা -
যে কথা তুমি বলিতে চাও     সে কথা তুমি বল না।।

তোমারে পাছে সহজে ধরি     কিছুরই তব কিনারা নাই -
দশের দলে টানি গো পাছে     কিরূপ তুমি, বিমুখ তাই।
বুঝি গো আমি, বুঝি গো তব     ছলনা -
যে পথে তুমি চলিতে চাও     সে পথে তুমি চল না।।

সবার চেয়ে অধিক চাহ,     তাই কি তুমি ফিরিয়া যাও -
হেলার ভরে খেলার মতো     ভিক্ষাঝুলি ভাসায়ে দাও?
বুঝেছি আমি, বুজেছি তব     ছলনা -
সবার যাহে তৃপ্তি হল     তোমার তাহে হল না।।



ব্যর্থ
--রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
 
যদি     প্রেম দিল না প্রাণে
কেন     ভোরের আকাশ ভরে দিলে     এমন গানে গানে?
কেন     তারার মালা গাঁথা,
কেন     ফুলের শয়ন পাতা,
কেন     দখিন হাওয়া গোপন কথা     জানায় কানে কানে?।
যদি     প্রেম দিলে না প্রাণে
কেন     আকাশ তবে এমন চাওয়া     চায় এ মুখের পানে?
তবে     ক্ষণে ক্ষণে কেন
আমার     হৃদয় পাগল হেন,
তরী     সেই সাগরে ভাসায় যাহার     কূল সে নাহি জানে?।
 
 
বর্ষার দিনে
--রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
 
এমন দিনে তারে বলা যায়
এমন ঘনঘোর বরিষায় -
এমন মেঘস্বরে          বাদল-ঝরঝরে
তপনহীন ঘন তমসায়।।
সে কথা শুনিবে না কেহ আর,
নিভৃত নির্জন চারি ধার।
দুজনে মুখোমুখি          গভীর দুখে দুখি,
আকাশে জল ঝরে অনিবার -
জগতে কেহ যেন নাহি আর।।
সমাজ সংসার মিছে সব,
মিছে এ জীবনের কলরব।
কেবল আঁখি দিয়ে          আঁখির সুধা পিয়ে
হৃদয় দিয়ে হৃদি-অনুভব -
আঁধারে মিশে গেছে আর সব।।
বলিতে ব্যথিবে না নিজ কান,
চমকি উঠিবে না নিজ প্রাণ।
সে কথা আঁখিনীরে          মিশিয়া যাবে ধীরে,
বাদলবায়ে তার অবসান -
সে কথা ছেয়ে দিবে দুটি প্রাণ।।
তাহাতে এ জগতে ক্ষতি কার
নামাতে পারি যদি মনোভার!
শ্রাবণবরিষনে          একদা গৃহকোণে
দু কথা বলি যদি কাছে তার
তাহাতে আসে যাবে কিবা কার।।
আছে তো তার পরে বারো মাস -
উঠিবে কত কথা, কত হাস।
আসিবে কত লোক,          কত-না দুখশোক,
সে কথা কোনখানে পাবে নাশ -
জগৎ চলে যাবে বারো মাস।।
ব্যাকুল বেগে আজি বহে বায়,
বিজুলি থেকে থেকে চমকায়।
যে কথা এ জীবনে          রহিয়া গেল মনে
সে কথা আজি যেন বলা যায়
এমন ঘনঘোর বরিষায়।।
মানসী
--রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
 
শুধু বিধাতার সৃষ্টি নহ তুমি নারী!
পুরুষ গড়েছে তোরে সৌন্দর্য সঞ্চারি
আপন অন্তর হতে। বসি কবিগণ
সোনার উপমাসূত্রে বুনিছে বসন।
সঁপিয়া তোমার 'পরে নূতন মহিমা
অমর করেছে শিল্পী তোমার প্রতিমা।
কত বর্ণ, কত গন্ধ, ভূষণ কত-না -
সিন্ধু হতে মুক্তা আসে, খনি হতে সোনা,
বসন্তের বন হতে আসে পুষ্পভার,
চরণ রাঙাতে কীট দেয় প্রাণ তার।
লজ্জা দিয়ে, সজ্জা দিয়ে, দিয়ে আবরণ,
তোমারে দুর্লভ করি করেছে গোপন।
পড়েছে তমার 'পরে প্রদীপ্ত বাসনা -
অর্ধেক মানবী তুমি, অর্ধেক কল্পনা।।

 
প্রিয়তমাসু
--রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
 
সীমান্তে আজ আমি প্রহরী।
অনেক রক্তাক্ত পথ অতিক্রম ক'রে
আজ এখানে এসে থমকে দাড়িয়েছি-
স্বদেশের সীমানায়।

দূসর তিউনিসিয়া থেকে স্নিগ্ধ ইতালী,
স্নিগ্ধ ইতালী থেকে ছুটে গেছি বিপ্লবী ফ্রান্সে
নক্ষত্রনিয়ন্ত্রিত নিয়তির মতো
দুর্নিবার, অপরাহত রাইফেল হাতে;
- ফ্রান্স থেকে প্রতিবেশী বার্মাতেও।

আজ দেহে আমার সৈনিকের কড়া পোশাক,
হাতে এখনো দুর্জয় রাইফেল,
রক্তে রক্তে তরঙ্গিত জয়ের আর শক্তির দুর্বহ দম্ভ,
আজ এখন সীমান্তের প্রহরী আমি।
আজ নীল আকাশ আমাকে পাঠিয়েছে নিমন্ত্রণ,
স্বদেশের হাওয়া বয়ে এনেছে অনুরোধ,
চোখের সামনে খুলে ধরেছে সবুজ চিঠিঃ
কিছুতেই বুঝি না কী ক'রে এড়াব তাকে?
কী ক'রে এড়াব এই সৈনিকের কড়া পোশাক?
যুদ্ধ শেষ। মাঠে মাঠে প্রসারিত শান্তি,
চোখে এসে লাগছে তারই শীতল হাওয়া,
প্রতি মুহূর্তে শ্লথ হয়ে আসে হাতের রাইফেল,
গা থেকে খসে পড়তে চায় এই কড়া পোশাক,
রাত্রে চাঁদ ওঠেঃ আমার চোখে ঘুম নেই।

তোমাকে ভেবেছি কতদিন,
কত শত্রুর পদক্ষেপ শোনার প্রতীক্ষার অবসরে,
কত গোলা ফাটার মুহূর্তে।
কতবার অবাধ্য হয়েছে মন, যুদ্ধজয়ের ফাঁকে ফাঁকে
কতবার হৃদয় জ্বলেছে অনুশোচনার অঙ্গারে
তোমার আর তোমাদের ভাবনায়।
তোমাকে ফেলে এসেছি দারিদ্র্যের মধ্যে
ছুঁড়ে দিয়েছি দুর্ভিক্ষের আগুনে,
ঝড়ে আর বন্যায়, মারী আর মড়কের দুঃসহ আঘাতে
বাব বার বিপন্ন হয়েছে তোমাদের অস্তিত্ব।
আর আমি ছুটে গেছি এক যুদ্ধক্ষেত্র থেকে আর এক যুদ্ধক্ষেত্র।
জানি না আজো, আছ কি নেই,
দুর্ভিক্ষে ফাঁকা আর বন্যায় তলিয়ে গেছে কিনা ভিটে
জানি না তাও।

তবু লিখছি তোমাকে আজঃ লিখছি আত্মম্ভর আশায়
ঘরে ফেরার সময় এসে গেছে।
জানি, আমার জন্যে কেউ প্রতীক্ষা ক'রে নেই
মালায় আর পতাকায়, প্রদীপে আর মঙ্গলঘটে;
জানি, সম্বর্ধনা রটবে না লোক মুখে,
মিলিত খুসিতে মিলবে না বীরত্বের পুরস্কার।
তবু, একটি হৃদয় নেচে উঠবে আমার আবির্ভাবে
সে তোমার হৃদয়।
যুদ্ধ চাই না আর, যুদ্ধ তো থেমে গেছে;
পদার্পণ করতে চায় না মন ইন্দোনেশিয়ায়
আর সামনে নয়,
এবার পেছনে ফেরার পালা।

পরের জন্যে যুদ্ধ করেছি অনেক,
এবার যুদ্ধ তোমার আর আমার জন্যে।
প্রশ্ন করো যদি এত যুদ্ধ ক'রে পেলাম কী? উত্তর তার-
তিউনিসিয়ায় পেয়েছি জয়,
ইতালীতে জনগণের বন্ধুত্ব,
ফ্রান্সে পেয়েছি মুক্তির মন্ত্র;
আর নিষ্কণ্টক বার্মায় পেলাম ঘরে ফেরার তাগাদা।

আমি যেন সেই বাতিওয়ালা,
সে সন্ধ্যায় রাজপথে-পথে বাতি জ্বালিয়ে ফেরে
অথচ নিজের ঘরে নেই যার বাতি জ্বালার সামর্থ্য,
নিজের ঘরেই জমে থাকে দুঃসহ অন্ধকার।।




অস্তচাঁদে
--রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
 
ভালোবাসিয়াছি আমি অস্তচাঁদ, -ক্লান্ত শেষপ্রহরের শশী!
-অঘোর ঘুমের ঘোরে ঢলে যবে কালো নদী-ঢেউয়ের কলসী,
নিঝ্ঝুম বিছানার পরে
মেঘবৌ'র খোঁপাখসা জোছনাফুল চুপে চুপে ঝরে,-
চেয়ে থাকি চোখ তুলে'-যেন মোর পলাতকা প্রিয়া
মেঘের ঘোমটা তুলে' প্রেত-চাঁদে সচকিতে ওঠে শিহরিয়া!
সে যেন দেখেছে মোরে জন্মে জন্মে ফিরে' ফিরে' ফিরে'
মাঠে ঘাটে একা একা, -বুনোহাঁস-জোনাকির ভিড়ে!
দুশ্চর দেউলে কোন্-কোন্ যক্ষ-প্রাসাদের তটে,
দূর উর-ব্যাবিলোন-মিশরের মরুভূ-সঙ্কটে,
কোথা পিরামিড তলে, ঈসিসের বেদিকার মূলে,
কেউটের মতো নীলা যেইখানে ফণা তুলে উঠিয়াছে ফুলে,
কোন্ মনভুলানিয়া পথচাওয়া দুলালীর মনে
আমারে দেখেছে জোছনা-চোর চোখে-অলস নয়নে!
আমারে দেখেছে সে যে আসরীয় সম্রাটের বেশে
প্রাসাদ-অলিন্দে যবে মহিমায় দাঁড়ায়েছি এসে-
হাতে তার হাত, পায়ে হাতিয়ার রাখি
কুমারীর পানে আমি তুলিয়াছি আনন্দের আরক্তিম আঁখি!
ভোরগেলাসের সুরা-তহুরা, ক'রেছি মোরা চুপে চুপে পান,
চকোরজুড়ির মতো কুহরিয়া গাহিয়াছি চাঁদিনীর গান!
পেয়ালায়-পায়েলায় সেই নিশি হয় নি উতলা,
নীল নিচোলের কোলে নাচে নাই আকাশের তলা!
নটীরা ঘুমায়েছিল পুরে পুরে, ঘুমের রাজবধূ-
চুরি করে পিয়েছিনু ক্রীতদাসী বালিকার যৌবনের মধু!
সম্রাজ্ঞীর নির্দয় আঁখির দর্প বিদ্রূপ ভুলিয়া
কৃষ্ণাতিথি-চাঁদিনীর তলে আমি ষোড়শীর উরু পরশিয়া
লভেছিনু উল্লাস-উতরোল!-আজ পড়ে মনে
সাধ-বিষাদের খেদ কত জন্মজন্মান্তের, রাতের নির্জনে!

আমি ছিনু 'ক্রবেদুর' কোন্ দূর 'প্রভেন্স্'-প্রান্তরে!
-দেউলিয়া পায়দল্-অগোচর মনচোর-মানিনীর তরে
সারেঙের সুর মোর এমনি উদাস রাত্রে উঠিত ঝঙ্কারি!
আঙুরতলায় ঘেরা ঘুমঘোর ঘরখানা ছাড়ি
ঘুঘুর পাখনা মেলি মোর পানে আসিল পিয়ারা;
মেঘের ময়ূরপাখে জেগেছিল এলোমেলো তারা!
-'অলিভ' পাতার ফাঁকে চুন চোখে চেয়েছিল চাঁদ,
মিলননিশার শেষে-বৃশ্চিক, গোক্ষুরাফণা, বিষের বিস্বাদ!

স্পেইনের 'সিয়েরা'য় ছিনু আমি দস্যু-অশ্বারোহী-
নির্মম-কৃতান্ত-কাল-তবু কী যে কাতর, বিরহী!
কোন্ রাজনন্দিনীর ঠোঁটে আমি এঁকেছিনু বর্বর চুম্বন!
অন্দরে পশিয়াছিনু অবেলার ঝড়ের মতন!
তখন রতনশেজে গিয়েছিল নিভে মধুরাতি,
নীল জানালার পাশে-ভাঙা হাটে-চাঁদের বেসাতি।
চুপে চুপে মুখে কার পড়েছিনু ঝুঁকে!
ব্যাধের মতন আমি টেনেছিনু বুকে
কোন্ ভীরু কপোতীর উড়ু-উড়ু ডানা!
-কালো মেঘে কেঁদেছিল অস্তচাঁদ-আলোর মোহানা!

বাংলার মাঠে ঘাটে ফিরেছিনু বেণু হাতে একা,
গঙ্গার তীরে কবে কার সাথে হয়েছিল দেখা!
'ফুলটি ফুটিলে চাঁদিনী উঠিলে' এমনই রূপালি রাতে
কদমতলায় দাঁড়াতাম গিয়ে বাঁশের বাঁশিটি হাতে!
অপরাজিতার ঝাড়ে- নদীপারে কিশোরী লুকায়ে বুঝি!-
মদনমোহন নয়ন আমার পেয়েছিল তারে খুঁজি!
তারই লাগি বেঁধেছিনু বাঁকা চুলে ময়ূরপাখার চূড়া,
তাহারই লাগিয়া শুঁড়ি সেজেছিনু-ঢেলে দিয়েছিনু সুরা!
তাহারই নধর অধর নিঙাড়ি উথলিল বুকে মধু,
জোনাকির সাথে ভেসে শেষরাতে দাঁড়াতাম দোরে বঁধু!
মনে পড়ে কি তা!-চাঁদ জানে যাহা, জানে যা কৃষ্ণাতিথির শশী,
বুকের আগুনে খুন চড়ে-মুখ চুন হয়ে যায় একেলা বসি!




বেদিয়া
--রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
 
চুলিচালা সব ফেলেছে সে ভেঙে, পিঞ্জরহারা পাখি!
পিছুডাকে কভু আসে না ফিরিয়া, কে তারে আনিবে ডাকি?
উদাস উধাও হাওয়ার মতন চকিতে যায় সে উড়ে,
গলাটি তাহার সেধেছে অবাধ নদী-ঝর্ণার সুরে;
নয় সে বান্দা রংমহলের, মোতিমহলের বাঁদী,
ঝোড়ো হাওয়া সে যে, গৃহপ্রাঙ্গণে কে তারে রাখিবে বাঁধি!
কোন্ সুদূরের বেনামী পথের নিশানা নেছে সে চিনে,
ব্যর্থ ব্যথিত প্রান্তর তার চরণচিহ্ন বিনে!
যুগযুগান্ত কত কান্তার তার পানে আছে চেয়ে,
কবে সে আসিবে ঊষর ধূসর বালুকা-পথটি বেয়ে
তারই প্রতীক্ষা মেগে ব'সে আছে ব্যাকুল বিজন মরু!
দিকে দিকে কত নদী-নির্ঝর কত গিরিচূড়া-তরু
ঐ বাঞ্ছিত বন্ধুর তরে আসন রেখেছে পেতে
কালো মৃত্তিকা ঝরা কুসুমের বন্দনা-মালা গেঁথে
ছড়ায়ে পড়িছে দিগ্‌দিগন্তে ক্ষ্যাপা পথিকের লাগি!
বাবলা বনের মৃদুল গন্ধে বন্ধুর দেখা মাগি
লুটায়ে রয়েছে কোথা সীমান্তে শরৎ উষার শ্বাস!
ঘুঘু-হরিয়াল-ডাহুক-শালিখ-গাঙচিল-বুনোহাঁস
নিবিড় কাননে তটিনীর কূলে ডেকে যায় ফিরে ফিরে
বহু পুরাতন পরিচিত সেই সঙ্গী আসিল কি রে!
তারই লাগি ভায় ইন্দ্রধনুক নিবিড় মেঘের কূলে,
তারই লাগি আসে জোনাকি নামিয়া গিরিকন্দরমূলে।
ঝিনুক-নুড়ির অঞ্জলি ল'য়ে কলরব ক'রে ছুটে
নাচিয়া আসিছে অগাধ সিন্ধু তারই দুটি করপুটে।
তারই লাগি কোথা বালুপথে দেখা দেয় হীরকের কোণা,
তাহারই লাগিয়া উজানী নদীর ঢেউয়ে ভেসে আসে সোনা!
চকিতে পরশপাথর কুড়ায়ে বালকের মতো হেসে
ছুড়ে ফেলে দেয় উদাসী বেদিয়া কোন্ সে নিরুদ্দেশে!
যত্ন করিয়া পালক কুড়ায়, কানে গোঁজে বনফুল,
চাহে না রতন-মণিমঞ্জুষা হীরে-মাণিকের দুল,
-তার চেয়ে ভালো অমল উষার কনক-রোদের সীঁথি,
তার চেয়ে ভালো আলো-ঝল্মল্ শীতল শিশিরবীথি,
তার চেয়ে ভালো সুদূর গিরির গোধূলি-রঙিন জটা,
তার চেয়ে ভালো বেদিয়া বালার ক্ষিপ্র হাসির ছটা!
কী ভাষা বলে সে, কী বাণী জানায়, কিসের বারতা বহে!
মনে হয় যেন তারই তরে তবু দুটি কান পেতে রহে
আকাশ-বাতাস-আলোক-আঁধার মৌন স্বপ্নভরে,
মনে হয় যেন নিখিল বিশ্ব কোল পেতে তার তরে!
 
দান
--রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
 
কাঁকন-জোড়া এনে দিলেম যবে,
     ভেবেছিলেম, হয়তো খুশি হবে।
তুলে তুমি নিলে হাতের 'পরে,
ঘুরিয়ে তুমি দেখলে ক্ষণেক-তরে,
পরেছিলে হয়তো গিয়ে ঘরে -
     হয়তো বা তা রেখেছিলে খুলে।
এলে যেদিন বিদায় নেবার রাতে
কাঁকনদুটি দেখি নাই তো হাতে,
          হয়তো এলে ভুলে।।
     দেয় যে জনা কী দশা পায় তাকে,
     দেওয়ার কথা কেনই মনে রাখে!
পাকা যে ফল পড়ল মাটির টানে
শাখা আবার চায় কি তাহার পানে।
বাতাসেতে-উড়িয়ে-দেওয়া গানে
     তারে কি আর স্মরণ করে পাখি?
দিতে যারা জানে এ সংসারে
এমন ক'রেই তারা দিতে পারে
          কিছু না রয় বাকি।।

     নিতে যারা জানে তারাই জানে,
     বোঝে তারা মূল্যটি কোনখানে।
তারাই জানে, বুকের রত্নহারে
সেই মণিটি কজন দিতে পারে
হৃদয় দিতে দেখিতে হয় যারে -
     যে পায় তারে সে পায় অবহেলে।
পাওয়ার মতন পাওয়া যারে কহে
সহজ ব'লেই সহজ তাহা নহে,
          দৈবে তারে মেলে।।

     ভাবি যখন ভেবে না পাই তবে
     দেবার মতো কী আছে এই ভবে।
কোন্ খনিতে কোন্ ধনভান্ডারে,
সাগর-তলে কিম্বা সাগর-পারে,
যক্ষরাজের লক্ষমণির হারে
     যা আছে তা কিছুই তো নয় প্রিয়ে!
তাই তো বলি যা-কিছু মোর দান
গ্রহণ করেই করবে মূল্যবান
          আপন হৃদয় দিয়ে।।