Thursday, January 31, 2013

ভারতে স্বাধীনতার ৬১ (কবি-শুভ দাশগুপ্ত)


ভারতে স্বাধীনতার ৬১

কদম কদম বঢ়ায়ে যা
খুশি কে গীত গায়ে যা ...
আজ ৬১তম স্বাধীনতা দিবস।   


সার্থক জনম (কবি-শুভ দাশগুপ্ত)
যে ছেলেটা চায়ের দোকানের এঁটো কাপ ধুচ্ছে রাস্তার ধারে, তাকে ডাকুন ।
তার কানে কানে বলুন সুজলাং সুফলাং মলয়জ শীতলাং
হ্যাঁ, বেশ সুন্দর করে বলুন,যে মেয়েটা চাকরির নাম করে
বনগাঁ কিংবা চাকদা থেকে রোজ সকালের ট্রেনে সেজেগুজে
শহরে আসছে, শরীর বেচে চাল, ডাল, নুন কিনতে, তাকে ডাকুন,
তার কানে কানে সুরেলা কন্ঠে বলুন, সার্থক জনম আমার জন্মেছি এই দেশে
যে ছেলেটি লটারির টিকিট নিয়ে দরজায় দরজায় ঘুরছে আর বলছে
বিশ্বাস করুন, আমি ভদ্রলোক, আজ ১০ বছর হল আমার
কারখানা বন্ধ, লক-আউট, তাকে ডাকুন, তার কানে কানে
বলুন, বল বল বল সবে শতবীণা বেণুরবে ভারত আবার
জগৎসভায় শ্রেষ্ঠ আসন লবে ।
রাতের আকাশ-কাঁপিয়ে অঝোর ধারায় বৃষ্টি নামলে, যে মা
আজও লন্ঠন হাতে টালির ঘরের দরজায় ঠায় দাঁড়িয়ে থাকেন
তাঁর খোকন ফিরে আসবে বলে । যে খোকনকে এমনই
এক বর্ষায় উন্মত্ত রাতে কালো গাড়ির পুলিশ ডেকে নিয়ে গিয়েছিল
আর বরানগরের রাস্তায় ভোরের ঘুম-ভাঙা
কুকুর প্রথম দেখেছিল যার গুলিবিদ্ধ রক্তাক্ত লাশ,
সেই মাকে ডাকুন, তাঁর কানে কানে বলুন,
হাম বুলবুলি হ্যায় ইসকি ইয়ে গুলিস্তা হামারা, সারে যাঁহা......হামারা ।
সবাইকে সব বলা শেষ হলে, সুনসান শীতের রাতে
পাঁচমাথার মোড়ে ঘোড়ায় চড়ে বসা সেই মহাবিপ্লবীর
পায়ের সামনে ধীরে ধীরে এগিয়ে যান
ফাঁকা রাস্তায় রাতের বাতাসে কান পাতুন
শুনতে পাবেন সেই বিপ্লবী পুরুষের বজ্রকণ্ঠ
আমি তোমাদের কাছে রক্ত চেয়েছিলাম
তোমাদের স্বাধীনতা এনে দেব বলে, আমি পারিনি
কিন্তু আমি আমার সমস্ত জীবন উৎসর্গ করেছি ।

আর তোমরা ? --- তোমরা ??

(কবি-শুভ দাশগুপ্ত)

আমিই সেই মেয়ে / শুভ দাশগুপ্ত


আমিই সেই মেয়ে / শুভ দাশগুপ্ত

আমিই সেই মেয়ে।
বাসে ট্রেনে রাস্তায় আপনি যাকে রোজ দেখেন
যার শাড়ি, কপালের টিপ কানের দুল আর পায়ের গোড়ালি
আপনি রোজ দেখেন।
আর
আরও অনেক কিছু দেখতে পাবার স্বপ্ন দেখেন।
স্বপ্নে যাকে ইচ্ছে মতন দেখেন।
আমিই সেই মেয়ে।

বিহারের প্রত্যন্ত গ্রামে দিনের আলোয় যার ছায়া মাড়ানো
আপনার ধর্মে নিষিদ্ধ, আর রাতের গভীরে যাকে বস্তি থেকে
তুলে আনতে পাইক বরকন্দাজ পাঠান আপনি
আর সুসজ্জিত বিছানায় যার জন্য অপেক্ষায় অধীন হয়
আপনার রাজকীয় লাম্পট্য
আমিই সেই মেয়ে।

আমিই সেই মেয়ে- আসামের চাবাগানে ঝুপড়ি কামিন বস্তি থেকে
যাকে আপনি নিয়ে যেতে চান সাহেবি বাংলোয় মধ্যরাতে
ফায়ার প্লেসের ঝলসে ওঠা আলোয় মদির চোখে দেখতে চান
যার অনাবৃত শরীর
আমি সেই মেয়ে।

রাজস্থানের শুকনো উঠোন থেকে পিপাসার জল আনতে যাকে আপনি
পাঠিয়ে দেন দশ মাইল দূরে সরকারি ইঁদারায়- আর কুড়ি মাইল
হেঁটে কান্ত বিধ্বস্ত যে রমণী ঘড়া কাঁখে ঘরে ফিরলেই যাকে বসিয়ে দেন
চুলার আগুনের সামনে আপনার রুটি বানাতে
আমিই সেই মেয়ে।

আমিই সেই মেয়ে- যাকে নিয়ে আপনি মগ্ন হতে চান গঙ্গার ধারে কিংবা
ভিক্টোরিয়ার সবুজে কিংবা সিনেমা হলের নীল অন্ধকারে, যার
চোখে আপনি একে দিতে চান ঝুটা স্বপ্নের কাজল আর ফুরিয়ে যাওয়া
সিগারেটের প্যাকেটের মত যাকে পথের পাশে ছুঁড়ে ফেলে আপনার ফুল সাজানো
গাড়ি শুভবিবাহ সুসম্পন্ন করতে ছুটে যায় শহরের পথে-
কনে দেখা আলোর গোধুলিতে একা দাঁড়িয়ে থাকা
আমিই সেই মেয়ে।

আমিই সেই মেয়ে- এমন কি দেবতারাও যাকে ক্ষমা করেন না। অহংকার
আর শক্তির দম্ভে যার গর্ভে রেখে যান কুমারীর অপমান
আর চোখের জলে কুন্তী হয়ে নদীর জলে
বিসর্জন দিতে হয় কর্ণকে। আত্মজকে।
আমিই সেই মেয়ে।

সংসারে অসময়ের আমিই ভরসা।
আমার ছাত্র পড়ানো টাকায় মায়ের ওষুধ কেনা হয়।
আমার বাড়তি রোজগারে ভাইয়ের বই কেনা হয়।
আমার সমস্ত শরীর প্রবল বৃষ্টিতে ভিজতে থাকে।
কালো আকাশ মাথায় নিয়ে
আমি ছাতা হয়ে থাকি।
ছাতার নিচে সুখে বাঁচে সংসার।

আপনি
আপনারা
আমার জন্য অনেক করেছেন।
সাহিত্যে কাব্যে শাস্ত্রে লোকাচারে আমাকে
মা বলে পুজো করেছেন।
প্রকৃতি বলে আদিখ্যেতা করেছেন- আর
শহর গঞ্জের কানাগলিতে
ঠোঁটে রঙ মাখিয়ে কুপি হাতে দাঁড় করিয়েও দিয়েছেন।
হ্যা, আমিই সেই মেয়ে।
একদিন হয়ত
হয়ত একদিন- হয়ত অন্য কোন এক দিন
আমার সমস্ত মিথ্যে পোশাক ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে
আমিই হয়ে উঠবো সেই অসামান্যা !
খোলা চুল মেঘের মত ঢাকবে আমার খোলা পিঠ।
দু চোখে জ্বলবে ভীষণ আগুন।
কপাল-ঠিকরে বেরুবে ভয়ঙ্কর তেজরশ্মি।
হাতে ঝলসে উঠবে সেই খড়গ।
দুপায়ের নুপুরে বেজে উঠবে রণদুন্দভি।
নৃশংস অট্টহাসিতে ভরে উঠবে আকাশ।
দেবতারাও আতঙ্কে স্তব্ধ হয়ে বলতে থাকবেন
মহামেঘপ্রভাং ঘোরাং মুক্তকেশীং চতুর্ভুজাং
কালিকাং দক্ষিণাং মুণ্ডমালা বিভুষিতাং।

বীভৎস দাবানলের মত
আমি এগোতে থাকবো ! আর আমার এগিয়ে যাবার পথের দুপাশে
মুণ্ডহীন অসংখ্য দেহ ছটফট করতে থাকবে-
সভ্যতার দেহ
প্রগতির দেহ-
উন্নতির দেহ-
সমাজের দেহ

হয়ত আমিই সেই মেয়ে ! হয়ত ! হয়ত বা।
...

কবিতা – শক্তি চট্টোপাধ্যায়


ধর্মে আছো, জিরাফেও আছো – শক্তি চট্টোপাধ্যায়

মনে পড়লো, তোমায় পড়লো মনে     
বাঁশি বাজলো হঠাত্ই জংশনে
লেভেল ক্রশিং এ দাঁড়িয়ে আছে ট্রেন
এখন তুমি পড়ছো কি হার্ট ক্রেন?
দেড়শো মাইল পেরিয়ে গেলাম কাছে
বললে তুমি এমন করলে বাঁচে
ঐ সামান্য বিদ্যাদানের টাকা!
সত্যি, পকেট – ইঁদুর বাদে, ফাঁকা।
এমন সময় বুদ্ধি দিলে ভারি
বসেছিলাম চাঁদের আড়াআড়ি
বললে, এই যে – রাখো তোমার কাছে
তোমার ছবি আমার বাক্সে আছে।
মনে পড়লো, তোমায় পড়লো মনে
বাঁশি বাজলো হঠাত্ই জংশনে
লেভেল ক্রশি -ং দাঁড়িয়ে আছে ট্রেন
অনাবশ্যক পড়ছো কি হার্ট ক্রেন?

ধর্মে আছো, জিরাফেও আছো– শক্তি চট্টোপাধ্যায়

আজ সেই ঘরে এলায়ে পড়েছে ছবি    
এমন ছিলো না আষাঢ় শেষের বেলা
উদ্যানে ছিল বরষা-পীড়িত ফুল
আনন্দ-ভৈরবী।
আজ সেই মাঠে আসে না রাখাল ছেলে
কাঁদে না মোহনবাঁশিতে বটের মূল
এখনো বরষা কোদালে মেঘের ফাঁকে
বিদ্যুত্-রেখা মেলে।
সে কি জানিত না এমনি দু:সময়
লাফ মেরে ধরে মোরগের লাল ঝুঁটি
সে কি জানিত না হদৃয়ের অপচয়
কৃপণের বামমুঠি
সে কি জানিত না যত বড়ো রাজধানী
তত বিখ্যাত নয় এ হদৃয়পুর
সে কি জানিত না আমি তারে যত জানি
আনন্দ-সমুদ্দুর
আজ সেই ঘরে এলায়ে পড়েছে ছবি
এমন ছিলো না আষাঢ় শেষের বেলা
উদ্যানে ছিল বরষা-পীড়িত ফুল
আনন্দ-ভৈরবী।

কবিতা – লালন ফকির


আপনাকে আপনে যে জন জানে – লালন ফকির


আপনাকে আপনে যে জন জানে,
আপন আত্মাকে দেখেছে নয়নে।
সবে বলে আমি আমি,
আমি কে তা কেউ না জানে।।
ও মন আপনাকে যে চিনেছে,
নিগূঢ় তত্ত্ব সেই পেয়েছে,
সে জন নিগুমে বসে
আগমে ধরে টানে।।
ও মন মালাকুতের মোকামে পানি,
লাহুতের মোকামে অগ্নি,
জবরুতের মোকামে পানি
হাওয়া চালাচ্ছে নাসুতের মোকামে।।
ও মন তার উপরে মণিকোঠা
তাতে কিছু না যায় টোটা
সে তো বসিয়ে আছে হয়ে টোটা
সে ঢাকায় বসে দিল্লীর খবর জানে।।

এমন মানব জনম আর কি হবে – লালন ফকির

এমন মানব জনম আর কি হবে।                     
মন যা কর, ত্বরায় কর এই ভবে।।
অনন্ত রূপ সৃষ্টি করলেন সাঁই,
শুনি মানবের তুলনা কিছুই নাই ।
দেব-দানবগণ,
করে আরাধন
জনম নিতে মানবে।।
কত ভাগ্যের ফলে না জানি,
মন রে, পেয়েছ এই মানব-তরণী
বেয়ে যাও ত্বরায়
তরী সুধারায়,
যেন ভরা না ডোবে।।
এই মানুষে হবে মাধুর্য্য ভজন,
তাইতে মানুষ রূপ এই গঠিল নিরঞ্জন,
এবার ঠিকিলে আর
না দেখি কিনার,
লালন কয় কাতর ভাবে।।

নীরা ও জীরো আওয়ার


নীরা ও জীরো আওয়ার       সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

এখন অসুখ নেই, এখন অসুখ থেকে সেরে উঠে            
পরবর্তী অসুখের জন্য বসে থাকা। এখন মাথার কাছে
জানলা নেই, বুক ভরা দুই জানলা, শুধু শুকনো চোখ
দেয়ালে বিশ্রাম করে, কপালে জলপট্টির মতো
ঠাণ্ডা হাত দূরে সরে গেছে, আজ এই বিষম সকালবেলা
আমার উত্থান নেই, আমি শুয়ে থাকি, সাড়ে দশটা বেজে যায়।
প্রবন্ধ ও রম্যরচনা, অনুবাদ, পাঁচ বছর আগের
শুরু করা উপন্যাস, সংবাদপত্রের জন্য জল-মেশানো
গদ্য থেকে আজ এই সাড়ে দশটায় আমি সব ভেঙেচুরে
উঠে দাঁড়াতে চাই–অন্ধ চোখ, ছোট চুল–ইস্ত্রিকরা পোশাক ও
হাতের শৃঙ্খল ছিঁড়ে ফেলে আমি এখন তোমার
বাড়ির সামনে, নীরা থুক্‌ করে মাটিতে থুতু ছিটিয়ে‌
বলি : এই প্রাসাদ একদিন আমি ভেঙে ফেলবো! এই প্রাসাদে
এক ভারতবর্ষব্যাপী অন্যায়। এখান থেকে পুনরায় রাজতন্ত্রের
উৎস। আমি
ব্রীজের নিচে বসে গম্ভীর আওয়াজ শুনেছি, একদিন
আমূলভাবে উপড়ে নিতে হবে অপবিত্র সফলতা।
কবিতায় ছোট দুঃখ, ফিরে গিয়ে দেখেছি বহুবার
আমার নতুন কবিতা এই রকম ভাবে শুরু হয় :
          নীরা, তোমায় একটি রঙিন
                        সাবান উপহার
                        দিয়েছি শেষবার;
আমার সাবান ঘুরবে তোমার সারা দেশে।
       বুক পেরিয়ে নাভির কাছে মায়া স্নেহে
       আদর করবে, রহস্যময় হাসির শব্দে
       ক্ষয়ে যাবে, বলবে তোমার শরীর যেন
                        অমর না হয়…
অসহ্য! কলম ছুঁড়ে বেরিয়ে আমি বহুদূর সমুদ্রে
চলে যাই, অন্ধকারে স্নান করি হাঙর-শিশুদের সঙ্গে
ফিরে এসে ঘুম চোখ, টেবিলের ওপাশে দুই বালিকার
মতো নারী, আমি নীল-লোভী তাতার বা কালো ঈশ্বর-খোঁজা
নিগ্রোদের মতো অভিমান করি, অভিমানের স্পষ্ট
শব্দ, আমার চা-মেশানো ভদ্রতা হলুদ হয়!
এখন, আমি বন্ধুর সঙ্গে সাহাবাবুদের দোকানে, এখন
বন্ধুর শরীরে ইঞ্জেকশন ফুঁড়লে আমার কষ্ট, এখন
আমি প্রবীণ কবির সুন্দর মুখ থেকে লোমশ ভ্রুকুটি
জানু পেতে ভিক্ষা করি, আমার ক্রোধ ও হাহাকার ঘরের
সিলিং ছুঁয়ে আবার মাটিতে ফিরে আসে, এখন সাহেব বাড়ীর
পার্টিতে আমি ফরিদপুরের ছেলে, ভালো পোষাক পরার লোভ
সমেত কাদা মাখা পায়ে কুৎসিত শ্বেতাঙ্গিনীকে দু’পাটি
দাঁত খুলে আমার আলজিভ দেখাই, এখানে কেউ আমার
নিম্নশরীরের যন্ত্রনার কথা জানে না। ডিনারের আগে
১৪ মিনিটের ছবিতে হোয়াইট ও ম্যাকডেভিড মহাশূন্যে
উড়ে যায়, উন্মাদ! উন্মাদ! এক স্লাইস পৃথিবী দূরে,
                                          সোনার রজ্জুতে
বাঁধা একজন ত্রিশঙ্কু। কিন্তু আমি প্রধান কবিতা
পেয়ে গেছি প্রথমেই, ৯, ৮, ৭, ৬, ৫…থেকে ক্রমশ শূন্যে
এসে স্তব্ধ অসময়, উলটোদিকে ফিরে গিয়ে এই সেই মহাশূন্য,
সহস্র সূর্যের বিস্ফোরণের সামনে দাঁড়িয়ে ওপেনহাইমার
প্রথম এই বিপরীত অঙ্ক গুনেছিল ভগবৎ গীতা আউড়িয়ে?
কেউ শূন্যে ওঠে কেউ শূন্যে নামে, এই প্রথম আমার মৃত্যু
ও অমরত্বের ভয় কেটে যায়, আমি হেসে বন্দনা করি :
ওঁ শান্তি! হে বিপরীত সাম্প্রতিক গণিতের বীজ
তুমি ধন্য, তুমি ইয়ার্কি, অজ্ঞান হবার আগে তুমি সশব্দ
অভ্যুত্থান, তুমি নেশা, তুমি নীরা, তুমিই আমার ব্যক্তিগত
পাপমুক্তি। আমি আজ পৃথিবীর উদ্ধারের যোগ্য

পাগলী, তোমার সঙ্গে… – জয় গোস্বামী


পাগলী, তোমার সঙ্গে… – জয় গোস্বামী

   পাগলী, তোমার সঙ্গে ভয়াবহ জীবন  কাটাব                                                  পাগলী, তোমার সঙ্গে ধুলোবালি কাটাব জীবন
এর চোখে ধাঁধা করব, ওর জল করে দেব কাদা
পাগলী, তোমার সঙ্গে ঢেউ খেলতে যাব দু’কদম।

     অশান্তি চরমে তুলব, কাকচিল বসবে না বাড়িতে
তুমি ছুঁড়বে থালা বাটি, আমি ভাঙব কাঁচের বাসন
পাগলী, তোমার সঙ্গে বঙ্গভঙ্গ জীবন কাটাব
পাগলী, তোমার সঙ্গে ৪২ কাটাব জীবন।
    মেঘে মেঘে বেলা বাড়বে, ধনে পুত্রে লক্ষ্মী লোকসান
লোকাসান পুষিয়ে তুমি রাঁধবে মায়া প্রপন্ঞ্চ ব্যন্জ্ঞন
পাগলী, তোমার সঙ্গে দশকর্ম জীবন কাটাব
পাগলী, তোমার সঙ্গে দিবানিদ্রা কাটাব জীবন।
    পাগলী, তোমার সঙ্গে ঝোলভাত জীবন কাটাব
পাগলী, তোমার সঙ্গে মাংসরুটি কাটাব জীবন
পাগলী, তোমার সঙ্গে নিরক্ষর জীবন কাটাব
পাগলী, তোমার সঙ্গে চার অক্ষর কাটাব জীবন।
    পাগলী, তোমার সঙ্গে বই দেখব প্যারামাউন্ট হলে
মাঝে মাঝে মুখ বদলে একাডেমি রবীন্দ্রসদন
পাগলী, তোমার সঙ্গে নাইট্যশালা জীবন কাটাব
পাগলী, তোমার সঙ্গে কলাকেন্দ্র কাটাব জীবন।
    পাগলী, তোমার সঙ্গে বাবুঘাট জীবন কাটাব
পাগলী, তোমার সঙ্গে দেশপ্রিয় কাটাব জীবন
পাগলী, তোমার সঙ্গে সদা সত্য জীবন কাটাব
পাগলী, তোমার সঙ্গে ‘কী মিথ্যুক’ কাটাব জীবন।
    এক হাতে উপায় করব, দুহাতে উড়িয়ে দেবে তুমি
রেস খেলব জুয়া ধরব ধারে কাটাব সহস্র রকম
লটারি, তোমার সঙ্গে ধনলক্ষ্মী জীবন কাটাব
লটারি, তোমার সঙ্গে মেঘধন কাটাব জীবন।
    দেখতে দেখতে পুজো আসবে, দুনিয়া চিত্‍কার করবে সেল
দোকানে দোকানে খুঁজব রূপসাগরে অরূপরতন
পাগলী, তোমার সঙ্গে পুজোসংখ্যা জীবন কাটাব
পাগলী, তোমার সঙ্গে রিডাকশনে কাটাব জীবন।
    পাগলী, তোমার সঙ্গে কাঁচা প্রুফ জীবন কাটাব
পাগলী, তোমার সঙ্গে ফুলপেজ কাটাব জীবন
পাগলী, তোমার সঙ্গে লে আউট জীবন কাটাব
পাগলী, তোমার সঙ্গে লে হালুয়া কাটাব জীবন।
    কবিত্ব ফুড়ুত্‍ করবে, পিছু পিছু ছুটব না হা করে
বাড়ি ফিরে লিখে ফেলব বড়ো গল্প উপন্যাসোপম
পাগলী, তোমার সঙ্গে কথাশিল্প জীবন কাটাব
পাগলী, তোমার সঙ্গে বকবকম কাটাব জীবন।
    নতুন মেয়ের সঙ্গে দেখা করব লুকিয়ে চুরিয়ে
ধরা পড়ব তোমার হাতে, বাড়ি ফিরে হেনস্তা চরম
পাগলী, তোমার সঙ্গে ভ্যাবাচ্যাকা জীবন কাটাব
পাগলী, তোমার সঙ্গে হেস্তনেস্ত কাটাব জীবন।
    পাগলী, তোমার সঙ্গে পাপবিদ্ধ জীবন কাটাব
পাগলী, তোমার সঙ্গে ধর্মমতে কাটাব জীবন
পাগলী, তোমার সঙ্গে পুজা বেদি জীবন কাটাব
পাগলী, তোমার সঙ্গে মধুমালা কাটাব জীবন।
    দোঁহে মিলে টিভি দেখব, হাত দেখাতে যাব জ্যোতিষীকে
একুশটা উপোস থাকবে, ছাব্বিশটা ব্রত উদযাপন
পাগলী, তোমার সঙ্গে ভাড়া বাড়ি জীবন কাটাব
পাগলী, তোমার সঙ্গে নিজ ফ্ল্যাট কাটাব জীবন।
    পাগলী, তোমার সঙ্গে শ্যাওড়াফুলি জীবন কাটাব
পাগলী, তোমার সঙ্গে শ্যামনগর কাটাব জীবন
পাগলী, তোমার সঙ্গে রেল রোকো জীবন কাটাব
পাগলী, তোমার সঙ্গে লেট স্লিপ কাটাব জীবন।
    পাগলী, তোমার সঙ্গে আশাপূর্ণা জীবন কাটাব
আমি কিনব ফুল, তুমি ঘর সাজাবে যাবজ্জীবন
পাগলী, তোমার সঙ্গে জয় জওয়ান জীবন কাটাব
পাগলী, তোমার সঙ্গে জয় কিষান কাটাব জীবন।
    সন্ধেবেলা ঝগড়া হবে, হবে দুই বিছানা আলাদা
হপ্তা হপ্তা কথা বন্ধ মধ্যরাতে আচমকা মিলন
পাগলী, তোমার সঙ্গে ব্রক্ষ্মচারী জীবন কাটাব
পাগলী, তোমার সঙ্গে আদম ইভ কাটাব জীবন।
    পাগলী, তোমার সঙ্গে রামরাজ্য জীবন কাটাব
পাগলী, তোমার সঙ্গে প্রজাতন্ত্রী কাটাব জীবন
পাগলী, তোমার সঙ্গে ছাল চামড়া জীবন কাটাব
পাগলী, তোমার সঙ্গে দাঁতে দাঁত কাটাব জীবন।
    এর গায়ে কনুই মারব রাস্তা করব ওকে ধাক্কা দিয়ে
এটা ভাঙলে ওটা গড়ব, ঢেউ খেলব দু দশ কদম
পাগলী, তোমার সঙ্গে ধুলোঝড় জীবন কাটাব
পাগলী, তোমার সঙ্গে ‘ভোর ভয়োঁ’ কাটাব জীবন।


রাখাল – হেলাল হাফিজ


রাখাল – হেলাল হাফিজ


আমি কোনো পোষা পাখি নাকি?                                      
যেমন শেখাবে বুলি
সেভাবেই ঠোঁট নেড়ে যাবো, অথবা প্রত্যহ
মনোরঞ্জনের গান ব্যাকুল আগ্রহে গেয়ে
অনুগত ভঙ্গিমায় অনুকূলে খেলাবো আকাশ,
আমি কোনো সে রকম পোষা পাখি নাকি?
আমার তেমন কিছু বাণিজ্যিক ঋণ নেই,
কিংবা সজ্ঞানে এ বাগানে নির্মোহ ভ্রমণে
কোনোদিন ভণিতা করিনি। নির্লোভ প্রার্থনা
শর্ত সাপেক্ষে কারো পক্ষপাত কখনো চাবো না।
তিনি, শুধু তিনি
নাড়ীর আত্মীয় এক সংগঠিত আর অসহায় কৃষক আছেন
ভেতরে থাকেন, যখন যেভাবে তিনি আমাকে বলেন
হয়ে যাই শর্তাহীন তেমন রাখাল বিনা বাক্য ব্যয়ে।
কাঙাল কৃষক তিনি, জীবনে প্রথম তাকে যখন বুঝেছি
স্বেচ্ছায় বিবেক আমি তার কাছে শর্তাহীন বন্ধক রেখেছি।

ভালবাসার সময় তো নেই – রুদ্র মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ


ভালবাসার সময় তো নেই – রুদ্র মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ

ভালবাসার সময় তো নেই                                          
ব্যস্ত ভীষন কাজে,
হাত রেখো না বুকের গাড় ভাজে।
ঘামের জলে ভিজে সাবাড়
করাল রৌদ্দুরে,
কাছএ পাই না, হৃদয়- রোদ দূরে।
কাজের মাঝে দিন কেটে যায়
কাজের কোলাহল
তৃষ্নাকে ছোয় ঘড়ায় তোলা জল।
নদী আমার বয় না পাশে
স্রোতের দেখা নেই,
আটকে রাখে গেরস্থালির লেই।
তোমার দিকে ফিরবো কখন
বন্দী আমার চোখ
পাহারা দেয় খল সামাজিক নখ।

Wednesday, January 30, 2013

পশ্চিমবঙ্গ কোন পথে?

পশ্চিমবঙ্গ কোন পথে?

        'অতীত যাঁরা মনে রাখতে পারেন না, তাঁরা অতীতের পুনরাবৃত্তি করার দণ্ডে দণ্ডিত'৷ দার্শনিক জর্জ সান্তায়ানা-র এই উক্তিটি পশ্চিমবঙ্গে হঠাত্ ভারি প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে৷ এ রাজ্যে রাজনৈতিক ক্ষমতার হাত বদল চট করে ঘটে না৷ ইতিহাস তাই বলে৷ আবার অতীতে এও দেখা গেছে, রাজনৈতিক ক্ষমতা-পরিবর্তনের পর এক ধরণের হিংসাত্মক অরাজকতা সারা রাজ্যকে গ্রাস করেছে৷ ১৯৭৭ থেকে ২০১১ পর্যন্ত রাজ্যবাসীকে প্রথম ইতিহাসটির পুনরাবৃত্তি করতে দেখেছে সারা দুনিয়া৷ ১৯৪৭ থেকে ১৯৬৭ পর্যন্ত কুড়ি বছরের কংগ্রেস শাসনের পর চৌত্রিশ বছরের বামফ্রন্ট জমানা৷ প্রশ্ন হল, ১৯৬৭ থেকে ১৯৭৭ অবধি যে অস্থিরতা এ রাজ্যকে ক্রমাগত উত্তাল করে প্রায় সমস্ত ক্ষেত্রেই রাজ্যের উন্নয়নকে প্রশ্নচিহ্নের মুখে দাঁড় করিয়ে ছিল, পশ্চিমবঙ্গে সেই অতীতও ফিরে আসতে চলেছে কি না? বিগত কয়েক দিনের ঘটনা প্রবাহের নিরিখে বলতেই হয়, সে আশঙ্কা অমূলক নয়৷ বর্তমানে এ রাজ্য নজিরবিহীন অর্থনৈতিক সঙ্কটে আকীর্ণ৷ এই সময় রাজনৈতিক হিংসার আগুন বিধ্বংসী দাবানল হয়ে ওঠার আগেই যে তা নিভিয়ে ফেলা দরকার তা নিয়ে সংশয় থাকার কোনও কারণ নেই৷ এর মূল দায়িত্ব যে ক্ষমতাসীন তৃণমূল কংগ্রেস এবং প্রধান বিরোধী দল সি পি আই এম-এর তা নিয়েও বিতর্কের খুব বেশি অবকাশ নেই৷ কিন্ত্ত এ রাজ্যের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলির নেতৃবর্গের মধ্যে সে শুভবুদ্ধি ঠিক কবে জাগবে কিংবা আদৌ জাগবে কী না, আসল প্রশ্ন সেটাই৷ গণতন্ত্রে রাজনৈতিক দলগুলির মধ্যে প্রতিযোগিতা স্বাভাবিক৷ বস্ত্তত তা কাম্যও৷ প্রতিযোগিতাহীন একক ক্ষমতার দীর্ঘ শাসনের কী পরিণতি হতে পারে তা চৌত্রিশ বছরের বাম শাসনে দেখা গিয়েছে৷ দশকের পর দশক শাসক পরিবর্তন না করার ভুলের পুনরাবৃত্তি করে পশ্চিমবঙ্গবাসী কী পেয়েছেন? অনেকেই বলবেন, প্রায় প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের রন্ধ্রে রন্ধ্রে স্বজন-পোষণ, দুর্নীতি ও চরম আর্থিক দেউলিয়াপনা৷ অবশেষে ২০১১-র ১৩ মে রাজ্যের ভোটাররা বামফ্রন্টকে ক্ষমতা থেকে ছুড়ে ফেলার পর অনেকেই আশা করেছিলেন এই 'পরিবর্তন' রাজ্যকে আবার উন্নয়নমুখী করবে৷ যে উদ্যমে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দার্জিলিং থেকে জঙ্গলমহল ছুটে বেড়িয়ে শান্তি ও সুশাসনের আশ্বাস দিয়ে নতুন সরকারের সূচনা ঘটিয়েছিলেন তাতে রাজ্যবাসীর পক্ষে খানিকটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলা স্বাভাবিক ছিল৷ কিন্ত্ত কয়েক মাস যেতে না যেতেই প্রথমে স্কুল ও কলেজের বিভিন্ন নির্বাচন ও পরে সাধারণ ভাবে এলাকা দখলকে কেন্দ্র করে রাজ্যের বহু এলাকা থেকেই প্রতিনিয়ত ছোটো ছোটো হিংসার ঘটনার খবর প্রকাশিত হতে থাকে৷ ভাঙড়ের সাম্প্রতিক সংঘাত তাই কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়৷ বরং হয়তো আগামী দিনের পরিস্থিতির ইঙ্গিত৷ বিগত বিধানসভা নির্বাচনে পর্যুদস্ত হলেও সি পি আই এম রাজ্য-রাজনীতি থেকে উবে গেছে এমন ধরে নেওয়ার কোনও কারণ নেই৷ সাড়ে তিন দশক ধরে বিস্তৃত তার শিকড় প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের গভীরে৷ রাজ্যের প্রায় অর্ধেক পঞ্চায়েত এবং ১৪ টি জেলা পরিষদ এখনও বামফ্রন্টের দখলে৷ আগামী পঞ্চায়েত নির্বাচনে এগুলির দখল নিয়ে তৃণমূল কংগ্রেস এবং সি পি আই এম-এর মধ্যে রেষারেষি চরমে পৌঁছনই স্বাভাবিক৷ সামনেই একাধিক গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা৷ সার্বিক অর্থনৈতিক সংকট বেড়েই চলেছে৷ রাজ্যে বিনিয়োগের পরিস্থিতি নিয়ে বণিকমহলে এখনও গভীর সন্দেহ৷ এ অবস্থায় যদি পশ্চিমবঙ্গের প্রধান রাজনৈতিক শক্তি দুটি এই রাজনৈতিক প্রতিযোগিতাকে লাগামহীন হিংসায় পর্যবসিত করে তাহলে সে লড়াইয়ে কে জিতবে তা এখুনি বলা মুশকিল হলেও রাজ্যবাসী যে গভীরে পরাজিত হবেন তা নিশ্চিত৷ আগামী দিনের ক্ষমতার লোভে অতীত-বিস্মৃত নেতৃকুল কি রাজ্যের পায়ে ইতিহাসের পুনরাবৃত্তির বেড়ি পরিয়ে রাখবেনই? উত্তর জানা যাবে শীঘ্রই৷

অনন্ত প্রেম


অনন্ত প্রেম

তোমারেই যেন ভালোবাসিয়াছি শত রূপে শতবার
জনমে জনমে যুগে যুগে অনিবার।
চিরকাল ধরে মুগ্ধ হৃদয় গাঁথিয়াছে গীতহার–
কত রূপ ধরে পরেছ গলায়, নিয়েছ সে উপহার
জনমে জনমে যুগে যুগে অনিবার।

যত শুনি সেই অতীত কাহিনী, প্রাচীন প্রেমের ব্যথা,
অতি পুরাতন বিরহমিলন কথা,
অসীম অতীতে চাহিতে চাহিতে দেখা দেয় অবশেষে
কালের তিমিররজনী ভেদিয়া তোমারি মুরতি এসে
চিরস্মৃতিময়ী ধ্র“বতারকার বেশে।

আমরা দুজনে ভাসিয়া এসেছি যুগলপ্রেমের স্রোতে
অনাদি কালের হৃদয়-উৎস হতে।
আমরা দুজনে করিয়াছি খেলা কোটি প্রেমিকের মাঝে
বিরহবিধুর নয়নসলিলে, মিলনমধুর লাজে–
পুরাতন প্রেম নিত্যনূতন সাজে।

আজি সেই চির-দিবসের প্রেম অবসান লভিয়াছে,
রাশি রাশি হয়ে তোমার পায়ের কাছে।
নিখিলের সুখ, নিখিলের দুখ, নিখিল প্রাণের প্রীতি,
একটি প্রেমের মাঝারে মিশেছে সকল প্রেমের স্মৃতি–
সকল কালের সকল কবির গীতি।

চির-আমি


চির-আমি

যখন     পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন এই বাটে,
বাইব না মোর খেয়াতরী এই ঘাটে,
চুকিয়ে দেব বেচা-কেনা,     মিটিয়ে দেব লেনা-দেনা
বন্ধ হবে আনাগোনা এই হাটে -
আমায় তখন নাই বা মনে রাখলে,
তারার পানে চেয়ে চেয়ে নাই বা আমায় ডাকলে।।

যখন     জমবে ধুলা তানপুরাটার তারগুলায়,
কাঁটালতা উঠবে ঘরের দ্বারগুলায়,
ফুলের বাগান ঘন ঘাসের     পরবে সজ্জা বনবাসের,
শ্যাওলা এসে ঘিরবে দিঘির ধারগুলায় -
আমায় তখন নাই বা মনে রাখলে,
তারার পানে চেয়ে চেয়ে নাই বা আমায় ডাকলে।।

যখন     এমনি করেই বাজবে বাঁশি এই নাটে,
কাটবে গো দিন যেমন আজও দিন কাটে।
ঘাটে ঘাটে খেয়ার তরী     এমনি সেদিন উঠবে ভরি,
চরবে গোরু, খেলবে রাখাল ওই মাঠে।
আমায় তখন নাই বা মনে রাখলে,
তারার পানে চেয়ে চেয়ে নাই বা আমায় ডাকলে।।

তখন     কে বলে গো, সেই প্রভাতে নেই আমি?
সকল খেলায় করবে খেলা এই-আমি।
নতুন নামে ডাকবে মোরে,     বাঁধবে নতুন বাহুর ডোরে,
আসব যাব চিরদিনের সেই-আমি।
আমায় তখন নাই বা মনে রাখলে,
তারার পানে চেয়ে চেয়ে নাই বা আমায় ডাকলে।। 


(কাব্যগ্রন্থঃ সঞ্চয়িতা)

আজকের রবীন্দ্রনাথ





'এই সময়'-এর নিবেদনে 'রবির আলোয়-নোবেল জয়ের শতবর্ষ উদযাপন' অনুষ্ঠানটির প্রথম দিনে, প্রমিতা মল্লিকের 'রবীন্দ্রসংগীত ও নবীন প্রজন্ম' শিরোনামের বক্তৃতা৷ শুনলেন দেবর্ষি বন্দ্যোপাধ্যায়।

বছরে তিরিশবার 'চিত্রাঙ্গদা' আর 'শ্যামা', 'শাপমোচন'-এ অভ্যস্ত বাঙালির কাছে রবীন্দ্রচর্চা নতুন কিছু নয়৷ তাই 'এই সময়'-এর নিবেদনে 'রবির আলোয়-নোবেল জয়ের শতবর্ষ উদ্যাপন' অনুষ্ঠানটির প্রথম দিনে, প্রমিতা মল্লিকের 'রবীন্দ্রসংগীত ও নবীন প্রজন্ম' শিরোনামের বক্তৃতাটি সম্পর্কে সাধারণ কিছু ধারণা করা খুব কঠিন কিছু ছিল না৷ কিন্তু ফর্টিএ ক্রিয়েটিভ স্টুডিও'র কাঠের সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে, সুজয় প্রসাদ চট্টোপাধ্যায়ের আবিষ্কার করা বুটিক-মল-পাব-এর এই নতুন রবীন্দ্রনাথের দিকে একটু অন্য নজরে তাকাতেই হল৷ কারণ এখানে রবীন্দ্রনাথ যতটা আধুনিক, ততটাই তাঁর সঙ্গে ঐতিহ্যের রক্তের সম্পর্ক৷

সম্পর্ক খুঁজে পাওয়া গেল যখন প্রমিতা বলছিলেন, সাম্প্রতিক সিরিয়াল-এফএম প্রমুখ গণমাধ্যমে রবীন্দ্রসংগীতের ব্যবহার নিয়ে৷ বলছিলেন ঠিক কতটা অন্তঃসারশূন্যভাবে নাগাড়ে রবীন্দ্র-বাণিজ্য চলছে৷ ভাবনা-চিন্তা ছাড়াই সঞ্চারী বাদ দিয়ে দেওয়া, মৌনমুখর গানে চিত্‍কারের বাহুল্য, ঝিনচ্যাক জনপ্রিয় আড়ম্বরের মাঝে প্রাণ আটকে মরা রবীন্দ্রসংগীত-প্রমুখ বিষয়গুলো ফিরে ফিরে আসছিল তাঁর আলোচনায়৷ 'আজকাল তো পাবলিক রবীন্দ্রনাথের গান খায়'৷ প্রমিতার এই উক্তিতে হাসিতে ফেটে পড়ল গোটা 'সুচিত্রা' প্রেক্ষাগৃহ৷ কিন্তু তাঁর আলোচনা প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠল আরও যখন তিনি হালের রবীন্দ্রনাথের গান নিয়ে এক্সপেরিমেন্টকে হেলায় নস্যাত্‍ করে দিলেন না৷ বরং জানালেন সাশা বা জয়'রা যে মুন্সিয়ানায় 'বাধ ভেঙে দাও আলো' দু'হাত তুলে গান, তাতে প্রাণ টের পাওয়া যায়৷

নবীন প্রজন্মের সুরকার জয় সরকার জানালেন, তাঁর কখনওই মনে হয় না, রবীন্দ্রনাথ তাঁর 'গুরুদেব'৷ নিশ্চয়ই তাঁর অগ্রজ হিসাবে সম্মান রয়েছে, তা বলে অন্তঃসারশূন্য স্তুতি নেই তাঁর৷ 'আমার বয়স একচল্লিশ হল৷ আমার রবীন্দ্রনাথের বয়সও আমার সঙ্গে সঙ্গেই একচল্লিশ হল৷ উনি আমার সঙ্গে সঙ্গেই চলেছেন৷ আমার সমসাময়িক তিনি৷'

পরিশেষে সুজয় জানালেন, 'এই সময়' সংবাদপত্রের সহযোগিতা ছাড়া একবছর ব্যাপী তাঁর এই স্বপ্নের প্রোজেক্টের বাস্তবায়ন সম্ভব হত না৷ সেই সঙ্গে সংবাদপত্রটির মননশীলতা বিষয়েও দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন তিনি৷

'সংগীতচিন্তা' গ্রন্থে নিজের গান নিয়ে বরীন্দ্রনাথের যে তর্কের স্বাস্থ্যকর প্ররোচনার কথা ফিরে ফিরে আসে, তারই রেশ টের পাচ্ছিলাম এদিনের আনুষ্ঠানে৷ থাকলই বা তাতে কিছুটা বাহুল্য৷ আমরা যদি এই আকালেও স্বপ্ন দেখি, কার তাতে কি?

আজকের রবীন্দ্রনাথ      

আজকের রবীন্দ্রনাথ

তুই কি আমার দুঃখ হবি?


তুই কি আমার দুঃখ হবি?  

       আনিসুল হক



তুই কি আমার দুঃখ হবি?এই আমি এক উড়নচন্ডী আউলা বাউলরুখো চুলে পথের ধুলোচোখের নীচে কালো ছায়াসেইখানে তুই রাত বিরেতে স্পর্শ দিবি।তুই কি আমার দুঃখ হবি?তুই কি আমার শুষ্ক চোখে অশ্রু হবি?মধ্যরাতে বেজে ওঠা টেলিফোনেরধ্বনি হবি?তুই কি আমার খাঁ খাঁ দুপুরনির্জনতা ভেঙে দিয়েডাকপিয়নের নিষ্ঠ হাতেক্রমাগত নড়তে থাকা দরজাময়কড়া হবি?একটি নীলাভ এনভেলাপে পুরে রাখাকেমন যেন বিষাদ হবি?তুই কি আমার শুন্য বুকেদীর্ঘশ্বাসের বকুল হবি?নরম হাতের ছোঁয়া হবি?একটুখানি কষ্ট দিবি,নীচের ঠোট কামড়ে ধরা রোদন হবি?একটুখানি কষ্ট দিবিপ্রতীক্ষার এই দীর্ঘ হলুদ বিকেলবেলায়কথা দিয়েও না রাখা এক কথা হবি?একটুখানি কষ্ট দিবি।তুই কি একা আমার হবি?তুই কি আমার একান্ত এক দুঃখ হবি? 


‘‘ মায়ের কাছে চিঠি ’’
—তসলিমা নাসরিন

কেমন আছ তুমি?
কতদিন, কত সহস্র দিন তোমাকে দেখি না মা,
কত সহস্র দিন তোমার কন্ঠ
শুনি না,
কত সহস্র দিন কোনো স্পর্শ নেই
তোমার।
তুমি ছিলে, কখনও বুঝিনি ছিলে।
যেন তুমি থাকবেই, যতদিন আমি থাকি ততদিন তুমি-
যেন এরকমই কথা ছিল।
আমার সব ইচ্ছে মেটাতে যাদুকরের মত।
কখন আমার ক্ষিদে পাচ্ছে,
কখন তেষ্টা পাচ্ছে,
কি পড়তে চাই, কী পরতে,
কখন খেলতে চাই, ফেলতে চাই,
মেলতে চাই হৃদয়,
আমি বোঝার আগেই বুঝতে
তুমি।
সব দিতে হাতের কাছে, পায়ের
কাছে, মুখের কাছে।
থাকতে নেপথ্যে।
তোমাকে চোখের আড়ালে রেখে, মনের আড়ালে রেখে
যত সুখ আছে সব নিয়েছি নিজের
জন্য।
তোমাকে দেয়নি কিছু কেউ, ভালবাসেনি,
আমিও দিইনি, বাসিনি।
তুমি ছিলে নেপথ্যের মানুষ।
তুমি কি মানুষ ছিলে?
মানুষ বলে তো ভাবিনি কোনোদিন,
দাসী ছিলে, দাসীর মত সুখের যোগান দিতে।
যাদুকরের মত হাতের কাছে, পায়ের কাছে,
মুখের কাছে যা কিছু চাই দিতে, না চাইতেই দিতে।
একটি মিষ্টি হাসিও তুমি পাওনি বিনিময়ে,
ছিলে নেপথ্যে, ছিলে জাঁকালো উৎসবের বাইরে
নিমগাছতলে অন্ধকারে, একা।
তুমি কি মানুষ ছিলে !
তুমি ছিলে সংসারের খুঁটি,
দাবার ঘুঁটি, মানুষ ছিলে না।
তুমি ফুঁকনি ফোঁকা মেয়ে,
ধোঁয়ার আড়ালে ছিলে,
তোমার বেদনার ভার একাই বইতে তুমি,
তোমার কষ্টে তুমি একাই কেঁদেছো।
কেউ ছিল না তোমাকে স্পর্শ করার, আমিও না।
যাদুকরের মত সারিয়ে তুলতে অন্যেরঅসুখ-বিসুখ,
তোমার নিজের অসুখ সারায়নি কেউ,
আমি তো নইই, বরং তোমাকে,
তুমি বোঝার আগেই হত্যা করেছি।

তুমি নেই, হঠাৎ আমি হাড়ে-
মাংসে-মজ্জায় টের পাচ্ছি তুমি নেই।
যখন ছিলে, বুঝিনি ছিলে।
যখন ছিলে, কেমন ছিলে জানতে চাইনি।
তোমার না থাকার বিশাল পাথরের তলে চাপা পড়ে আছে আমার দম্ভ।
যে কষ্ট তোমাকে দিয়েছি,
সে কষ্ট আমাকেও চেয়েছি দিতে, পারিনি।
কি করে পারব বল!
আমি তো তোমার মত অত নিঃস্বার্থ নই,
আমি তো তোমার মত অত বড় মানুষ নই।‘‘ মায়ের কাছে চিঠি ’’
     তসলিমা নাসরিন

কেমন আছ তুমি?
কতদিন, কত সহস্র দিন তোমাকে দেখি না মা,
কত সহস্র দিন তোমার কন্ঠ
শুনি না,
কত সহস্র দিন কোনো স্পর্শ নেই
তোমার।
তুমি ছিলে, কখনও বুঝিনি ছিলে।
যেন তুমি থাকবেই, যতদিন আমি থাকি ততদিন তুমি-
যেন এরকমই কথা ছিল।
আমার সব ইচ্ছে মেটাতে যাদুকরের মত।
কখন আমার ক্ষিদে পাচ্ছে,
কখন তেষ্টা পাচ্ছে,
কি পড়তে চাই, কী পরতে,
কখন খেলতে চাই, ফেলতে চাই,
মেলতে চাই হৃদয়,
আমি বোঝার আগেই বুঝতে
তুমি।
সব দিতে হাতের কাছে, পায়ের
কাছে, মুখের কাছে।
থাকতে নেপথ্যে।
তোমাকে চোখের আড়ালে রেখে, মনের আড়ালে রেখে
যত সুখ আছে সব নিয়েছি নিজের
জন্য।
তোমাকে দেয়নি কিছু কেউ, ভালবাসেনি,
আমিও দিইনি, বাসিনি।
তুমি ছিলে নেপথ্যের মানুষ।
তুমি কি মানুষ ছিলে?
মানুষ বলে তো ভাবিনি কোনোদিন,
দাসী ছিলে, দাসীর মত সুখের যোগান দিতে।
যাদুকরের মত হাতের কাছে, পায়ের কাছে,
মুখের কাছে যা কিছু চাই দিতে, না চাইতেই দিতে।
একটি মিষ্টি হাসিও তুমি পাওনি বিনিময়ে,
ছিলে নেপথ্যে, ছিলে জাঁকালো উৎসবের বাইরে
নিমগাছতলে অন্ধকারে, একা।
তুমি কি মানুষ ছিলে !
তুমি ছিলে সংসারের খুঁটি,
দাবার ঘুঁটি, মানুষ ছিলে না।
তুমি ফুঁকনি ফোঁকা মেয়ে,
ধোঁয়ার আড়ালে ছিলে,
তোমার বেদনার ভার একাই বইতে তুমি,
তোমার কষ্টে তুমি একাই কেঁদেছো।
কেউ ছিল না তোমাকে স্পর্শ করার, আমিও না।
যাদুকরের মত সারিয়ে তুলতে অন্যেরঅসুখ-বিসুখ,
তোমার নিজের অসুখ সারায়নি কেউ,
আমি তো নইই, বরং তোমাকে,
তুমি বোঝার আগেই হত্যা করেছি।

তুমি নেই, হঠাৎ আমি হাড়ে-
মাংসে-মজ্জায় টের পাচ্ছি তুমি নেই।
যখন ছিলে, বুঝিনি ছিলে।
যখন ছিলে, কেমন ছিলে জানতে চাইনি।
তোমার না থাকার বিশাল পাথরের তলে চাপা পড়ে আছে আমার দম্ভ।
যে কষ্ট তোমাকে দিয়েছি,
সে কষ্ট আমাকেও চেয়েছি দিতে, পারিনি।
কি করে পারব বল!
আমি তো তোমার মত অত নিঃস্বার্থ নই,
আমি তো তোমার মত অত বড় মানুষ নই।