Tuesday, April 16, 2013

জন্মদিন - শুভ দাসগুপ্ত

জন্মদিন - শুভ দাসগুপ্ত
আজ পয়লা শ্রাবণ।
খোকনআজ তোর জন্মদিন।
তুই যখন জন্মেছিলিআমরা তখন যাদবপুরে
নতুন গড়ে ওঠা কলোনীর টালির ঘরে। 
তোর ইস্কুল মাস্টার বাবা 
সেই হ্যারিকেনের আলো জ্বলা ঘরেই 
আনন্দে আর খুশিতে ঝলমলে হয়ে উঠেছিলেন 
তুই আসার পর। তোর নাম রেখেছিলেন -     সুকল্যাণ। 
মানুষটার মনটা ছিল শিশুর মতন 
অভাবে অনটনেবেঁচে থাকার নানা দুর্বিপাকেও 
ভেঙ্গে পড়তেন না কখনও। সকলের ভাল চাইতেন মন থেকে। 
বলতেন দেখো একদিন এই দেশের মানুষ 
ঠিক খুঁজে পাবে মুক্তির পথ। শোষণ থেকে মুক্তি 
দারিদ্র থেকে মুক্তি অশিক্ষা থেকে মুক্তি...

আজ পয়লা শ্রাবণ 
খোকনআজ তোর জন্মদিন।
ছোটবেলায়তোর মনে আছেআমাদের ভাঙ্গা মেঝেতে 
বাক্স থেকে বার করা মেজো-মাসীর হাতে তৈরি আসনটা
পেতে দিতাম। সামনে রাখতাম ঠাকুরের আসনের প্রদীপখানা।
তুই বসতিস বাবু হয়ে চুপটি করে।
তোকে আমরা একে একে ধান দুব্বো মাথায় দিয়ে আশীর্বাদ করতাম।
বাবা বলতেন বড় হও মানুষ হও।
তোর বাবার সেই বন্ধু -ঘোষ কাকা তিনি বলতেন 
বেঁচে বর্তে থাকো। 
তুই জিগ্যেস করতিস -মাবর্তে মানে কি মা?
আমি শুধু তোর মাথায় ধান-দুব্বোই দিতাম। 
বলতাম না কিছুই। শুধু মনে মনে বলতাম 
ঠাকুরআমার খোকনকে মস্ত বড় মানুষ করে তোলো
আমার খোকন যেন সত্যিই মানুষ হয়।
ওর যেন কখনো কোনো বিপদ না হয় ঠাকুর।
অভাবের সংসারে ওই একটা দিন- পয়লা -    শ্রাবণ 
কষ্টের পয়সায় একটু বাড়তি দুধ নিতাম। 
পায়েস রান্না করে দিতাম তোকে।
তুই খুব ভালবাসতিস পায়েস খেতে।
তোর বাবা বাসস্টান্ডের দোকান থেকে নিয়ে আসতেন 
তোর প্রিয় মিষ্টি ছানার গজা।
সামান্য ইস্কুল মাস্টারিতে কীই বা আয় হত;
ঘরে বসে ছাত্র পড়িয়ে আসতো কিছু।
দাউ দাউ অভাবের আগুনে সে রসদ পুড়তে সময় লাগত না।
তোর বাবার জামা সেলাই করতাম আর বার বার বলতাম 
আসছে মাসে একটা জামা বানিয়ে নিও।
উনি হেসে উঠে বলতেনবাদ দাও তোখোকন বড় হচ্ছে।
ওর জন্য ভাবছি দুধ রাখতে হবে আরো আধসের-
দুধে শক্তি বাড়ে। বুদ্ধি বাড়ে। শক্তি আরে বুদ্ধি না হলে 
তোমার খোকন মস্ত বড় মানুষ হয়ে উঠবে কি করে?
ভাবছি আরো দুটো টিউশনি নেব।

ছাত্র পড়িয়ে পড়িয়ে মানুষটা দিনের শেষে ক্লান্ত হয়ে যেতেন।
বারান্দার ধার ঘেঁষে যখন রাতের অন্ধকারে জোনাকির ব্যস্ততা,
আর ঘরে তোর পড়া মুখস্থ করার একটানা সুর 
আমাদের কলোনীর ভাঙ্গাচূড়া বাড়িটাকে জীবন্ত করে রাখতো-
তখন বলতেন আমায়খাওয়া দাওয়া একটু করো - তোমার চেহারাটা 
বড় ভেঙ্গে পড়ছে দিন দিন... শাড়িটাও তো দেখছি বেশ ছিঁড়েছে- 
কালই আমি ফেরার পথে একটা শাড়ি নিয়ে আসব। ধারেই আনব। 
আমি বলতাম-ধুর। সামনে খোকনের উঁচু ক্লাস-
কত বই পত্তর কিনতে হবেকত খরচ। 
উনি দীর্ঘশ্বাস ফেলে চুপ করে যেতেন। 
জোনাকিরা নিঃশব্দ অদৃশ্য আলোর আলপনা আঁকত
উঠনের আগাছার ঝোপে।
আবহ সঙ্গীতের মত তুই ভেতরে বসে বসে পড়া মুখস্থ করতিস।
ইতিহাসভূগোলগ্রামার।

ঈশ্বর আমাদের নিরাশ করেননি।
তুই কত বড় হলি।
সব পরীক্ষায় কত ভাল ফল হল তোর।
বাবা বললেনআরও পড়। উচ্চ শিখাই উচ্চ সম্মানের 
এক মাত্র পথ। তুই আরও পড়লি।

তারপর...
তোর চাকরি হল কত বড় অফিসে 
মনে আছে খোকাপ্রথম মাসের মাইনে হাতে পেয়েই 
তুই কত কী কিনে এনেছিলি?
তখন তো আমরা উঠে এসেছি শ্যামবাজারে।
দু'কামরার বেশ সাজানো ঘোচানো গোছানো বড় ফ্লাট।
তোর অফিস থেকেই তো দিয়েছিল।
সেই বাড়ি সেই ঘর সেই বেলকনিকত স্মৃতিকত ছবি!
ঐ বাড়িতেই তো
আশ্বিনের ঝড়ো বিকেলে- -  তোর মনে আছে খোকন
তোর বাবা যেদিনটাতে চলে গেলেন মনে আছে?
তুই বাবার বুকের ওপর পড়ে যখন কাঁদছিলি হাপুস নয়নে 
সদ্য স্বামীহারাআমি সেদিন তোর সেই অসহায় মুখ দেখে 
আরো বেশি করে ভেঙ্গে পড়েছিলাম।
তোকে বুকে টেনে নিয়েছিলাম ছোটবেলার মত।
বলেছিলাম- 
কাঁদিস না খোকা। আমিতো আছি। 

আজ পয়লা শ্রাবণ 
কলকাতা থেকে অনেক দুরে মফস্বলের এই বৃদ্ধাশ্রমে 
আমি একেবারে একাখোকন। 
তোকে বড় দেখতে ইচ্ছে করছে রে। 
তোকেবৌমাকে আর ছোট্ট বিল্টুকে। 
তোরা এখন কত দুরে- 
সল্ট-লেকের মার্বেল বসানো ঝকঝকে বাড়িতে। 
আজ তোর জন্মদিনের নিশ্চয়ই খুব বড় পার্টি হচ্ছে-
তাই নারে খোকনলোকজনহৈচৈখাওয়া-দাওয়া।
খুব ভালখুব ভাল।
খোকনআজ পয়লা শ্রাবণ
আমার বড় মনে পড়ছে যাদবপুরের ভাঙ্গা ঘরে রাত্রে 
তুই আমার পাশে শুয়ে মাঝে মধ্যে হঠাৎ খুব ভয় পেয়ে 
জড়িয়ে ধরতিস আমাকে। আমি বলতামভয় কী রে?
আমি তো আছি। মা তো আছে খোকনের। যার মা থাকে 
তাকে কী ভুতে ধরে
তুই নিশ্চিন্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়তিস আমার বুক জুড়ে।
তোর আধুনিক সংসারে 
এই বুড়িটার একটু ঠাই হল নারে?
প্রতিমাও তো মা। ওরও তো আছে আমার খোকনেরই মত 
কোল আলোকরা এক চাঁদের টুকরো।
কিন্তু সময়ের কী আশ্চর্য পরিবর্তন!

খোকন!
তুই বোধহয় আর এখন পায়েস খাস নাতাই নারে?
তুই জানিস না খোকন 
আজ আমি সকালে পায়েস রান্না করেছি। হ্যাঁ 
তোরই পাঠানো টাকায়।
সারাদিন সেই পায়েসের বাটি সামনে নিয়ে বসে আছি রে।
এখানে এই বৃদ্ধাশ্রমে 
আমার একলা ঘরে 
আর কেউ নেই।
তুই একবার আসবি খোকন। 
একবার.... 
শুধু একবার...

বাতাসে লাশের গন্ধ - রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ


বাতাসে লাশের গন্ধ

রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ 

আজো আমি বাতাসে লাশের গন্ধ পাই
আজো আমি মাটিতে মৃত্যূর নগ্ননৃত্য দেখি,ধর্ষিতার কাতর চিৎকার শুনি আজো আমি তন্দ্রার ভেতরেএ দেশ কি ভুলে গেছে সেই দু:স্বপ্নের রাতসেই রক্তাক্ত সময় ?বাতাসে লাশের গন্ধ ভাসে
মাটিতে লেগে আছে রক্তের দাগ।
এই রক্তমাখা মটির ললাট ছুঁয়ে একদিন যারা বুক বেঁধেছিলো-
জীর্ণ জীবনের পুঁজে তারা খুঁজে নেয় নিষিদ্ধ আঁধার,আজ তারা আলোহীন খাঁচা ভালোবেসে জেগে থাকে রাত্রির গুহায়।
এ যেন নষ্ট জন্মের লজ্জায় আড়ষ্ট কুমারী জননী, 
স্বাধীনতা - একি তবে নষ্ট জন্ম ?একি তবে পিতাহীন জননীর লজ্জার ফসল ?জাতির পতাকা খামচে ধরেছে আজ পুরোনো শকুন। 
বাতাসে লাশের গন্ধ
নিয়ন আলোয় তবু নর্তকীর দেহে দুলে মাংসের তুফান।
মাটিতে রক্তের দাগ -
চালের গুদামে তবু জমা হয় অনাহারী মানুষের হাড়
এ চোখে ঘুম আসেনা। সারারাত আমার ঘুম আসেনা-
তন্দ্রার ভেতরে আমি শুনি ধর্ষিতার করুণ চিৎকারনদীতে পানার মতো ভেসে থাকা মানুষের পচা লাশ
মুন্ডহীন বালিকার কুকুরে খাওয়া বিভৎস্য শরীর
ভেসে ওঠে চোখের ভেতরে। আমি ঘুমুতে পারিনাআমি
ঘুমুতে পারিনারক্তের কাফনে মোড়া - কুকুরে খেয়েছে যারেশকুনে খেয়েছে যারে
সে আমার ভাইসে আমার মাসে আমার প্রিয়তম পিতা।
স্বাধীনতাসে আমার স্বজন হারিয়ে পাওয়া একমাত্র স্বজন -
স্বাধীনতা - আমার প্রিয় মানুষের রক্তে কেনা অমূল্য ফসল।
ধর্ষিতা বোনের শাড়ী ওই আমার রক্তাক্ত জাতির পতাকা।

Sunday, April 7, 2013

প্রবন্ধ | Anandabazar


আমরা মাতামাতি না করলেই ওঁদের মঙ্গল

দোহাই, শাহবাগ প্রাঙ্গণে ভিড় জমানো জনগণের প্রতি একাত্ম হওয়ার আগ্রহে এমন কিছু যেন আমরা করে না ফেলি, যা শেষ পর্যন্ত তাঁদেরই মস্ত ক্ষতি করে বসবে।

অশোক মিত্র
কলকাতা, ৩ এপ্রিল ২০১৩

probondho
আমাদেরও? অ্যাকাডেমি অব ফাইন আর্টস-এর সামনে। কলকাতা, মার্চ ২০১৩। ছবি- প্রদীপ আদক।
ঢাকা শহরের উত্তর উপকণ্ঠে শাহবাগ প্রাঙ্গণে অহোরাত্র মাতৃভাষা-প্রেমিকরা জড়ো হয়ে আছেন, তাঁরা প্রেরণার গান গাইছেন, প্রতিজ্ঞার গান গাইছেন, একটির পর আর-একটি কবিতা আবৃত্তি করে যাচ্ছেন, রবীন্দ্রনাথের কবিতা, অথবা নজরুলের, দুই বাংলার ঘরে ঘরে যে-সব কবিতা প্রতিদিন মন্ত্রের মতো উচ্চারিত হয় সে-সমস্ত কবিতা। বিশেষ করে রবীন্দ্রনাথের গানের প্লাবনে প্রাঙ্গণ ভেসে যাচ্ছে, যাঁরা জড়ো হয়েছেন, হচ্ছেন, আগামী দিনেও হবেন তাঁরা অঙ্গীকারবদ্ধ যত ষড়যন্ত্রই হোক, যত নতুন নতুন বাধা পথ রোধ করে দাঁড়াক না কেন, যে মাতৃভাষার স্বপ্ন বুকে জড়িয়ে তাঁরা মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছিলেন, জয়লাভ করেছিলেন, গোটা পৃথিবীকে দেখিয়ে দিয়েছিলেন মাতৃভাষায় কী অমৃতের স্বাদ, সেই ভাষা তাঁদের জন্মগত অধিকার, কোনও দুশমনই ছিনিয়ে নিতে পারবে না। এ-পার বাংলায় আমরা যারা অধিষ্ঠান করছি তারা টেলিভিশনে-সংবাদপত্রে শাহবাগ প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত ঘটনাবলির প্রতিবেদন দেখে এবং পড়ে উজ্জীবিত হই, কারও কারও হয়তো সাধ জাগে ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটে গিয়ে সেই জমাট ভিড়ের শরীরে নিজেদের মিলিয়ে দিই।
এখানেই সমস্যা আমরা বঙ্গভাষী হতে পারি, কিন্তু একটি ভিন্ন দেশের নাগরিক। ওখানকার ঘটনাবলির ছবি টেলিভিশনের পর্দায় আমরা যেমন এখানে বসে দেখি, শাহবাগ প্রাঙ্গণে অবস্থানকারীদের অভিনন্দন জানিয়ে কলকাতায় যে-সব সভাসমিতি হচ্ছে, মিছিল শোভাযাত্রা বেরোচ্ছে, সে-সবের ছবিও বাংলাদেশ পৌঁছয়, শাহবাগ প্রাঙ্গণে অবস্থানরতদের যাঁরা ঘোর বৈরী, তাঁদের কাছেও পৌঁছয়, অপপ্রচারের দক্ষিণ দুয়ার উন্মোচিত হয়। হিন্দু ভারতবর্ষের সঙ্গে হাতে হাত মিলিয়ে কতিপয় দেশদ্রোহী ইসলামের বিরুদ্ধে, আরব ভাষার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছে, শাহবাগ প্রাঙ্গণে জমায়েত হওয়া কুচক্রীদের প্রেরণা জোগানো হচ্ছে হয় কলকাতা থেকে নয় নতুন দিল্লি থেকে, বাংলাদেশকে ভারতবষের্র সঙ্গে যুক্ত করে নেওয়ার অভিপ্রায়ে এটা অন্যতম প্রাথমিক উদ্যোগ।
একটু পুরনো বৃত্তান্তে প্রত্যাবর্তন করি। পাকিস্তাান প্রতিষ্ঠিত হওয়ার ছয় মাসের মধ্যেই মহম্মদ আলি জিন্না ঢাকা শহরে এলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলে সভা হল। ছাত্রদের ভিড়ে সভাগৃহ ঠাসা। জিন্না সাহেব চোস্ত ইংরেজিতে সুস্পষ্ট ঘোষণা করলেন, পাকিস্তানের জাতীয় ভাষা একমাত্র উর্দু, অন্য কোনও ভাষা নয়। সঙ্গে সঙ্গে সারা কার্জন হল কাঁপিয়ে উচ্চনিনাদে ছাত্রদের নম্র অথচ সুদৃঢ় প্রতিবাদ, ‘কায়েদে আজম জিন্দাবাদ, রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’। জিন্নার মুখমণ্ডল থমথমে, তিনি আর একটি কথাও উচ্চারণ না-করে সভা থেকে নিষ্ক্রান্ত হলেন। সেই তো শুরু, মাতৃভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য আন্দোলন সংহত থেকে সংহততর হল, ১৯৫২ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি হত্যালীলায় যুগান্তের সূচনা, ঘরে ঘরে মাতৃভাষা-বন্দনা, ছেলেমেয়েরা বাবামায়েদের বোঝায়, আত্মীস্বজনদের কাছে যুক্তি দাখিল করে, যে রবীন্দ্রসংগীত গাওয়া বা শোনা সাধারণ্যে নিষিদ্ধ, গোপন শিক্ষায়তন খুলে তার অদম্য তালিম চলে। তার পর প্রায় দু’দশক ধরে প্রশাসনের সঙ্গে জনগণের চোরাগোপ্তা লড়াই, যে লড়াই উপসংহারে পৌঁছেছে একাত্তর সালের ১৬ ডিসেম্বর তারিখে। জামাতপন্থী অতি সামান্য কিছু মানুষজনকে বাদ দিলে গোটা জাতি একটি স্বাধীন দেশের স্বাধীন নাগরিকদের মাতৃভাষায় শিক্ষিত হওয়ার, পারস্পরিক বিনিময়-প্রতিবিনিময়ের এবং জীবিকার্জনের প্রধান মধ্যবর্তিতা স্বতঃসিদ্ধ হিসাবে মেনে নিয়েছিলেন।
বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর সেই ধারা অব্যাহতই ছিল। অস্বীকার করে লাভ নেই, বাংলাভাষার উন্মেষ ও ইতিহাস নিয়ে যত তন্নিষ্ঠ চর্চা বাংলাদেশে গত কয়েক দশক ধরে হয়েছে, পশ্চিমবঙ্গে তার ছিঁটেফোটাও হয়নি। মাতৃভাষার ব্যাকরণ, বাক্য গঠন, ক্রিয়া প্রয়োগ ইত্যাদি বিষয় নিয়ে যে গবেষণার স্তূপ বাংলাদেশে গড়ে উঠেছে, পশ্চিমবঙ্গবাসী তা জেনে লজ্জা পাবেন। বাংলাদেশের মন্ত্রী বা আমলারা তাঁদের ভাষণে মাতৃভাষার যে বিশুদ্ধতা বজায় রাখেন, পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিবিদ ও প্রশাসকরা তা থেকে পর্যাপ্ত শিক্ষা গ্রহণ করতে পারেন। এমনকী ঘরোয়া কথোপকথন ও আলোচনায় যে পরিস্রুত বাংলা ঢাকা, রাজশাহী বা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশে শ্রুত হয়, এ বাংলায় আমরা বিস্ময়ে অভিভূত না-হয়ে পারি না।
এই বিবর্তন সবাই ঔদার্যের সঙ্গে মেনে নিয়েছিলেন, সেই সঙ্গে কিছু প্রচ্ছন্ন বা অপ্রচ্ছন্ন আত্মগরিমাবোধও ছিল। হঠাৎ ঈশান কোণে মেঘ দেখা দিয়েছে ঘরোয়া রাজনীতির সূত্র ধরে। মুক্তিযুদ্ধ পর্বে অনেক বর্বর নৃশংসতা ঘটেছে, যাঁর শেষ পর্যন্ত অখণ্ড পাকিস্তান তত্ত্বে বিশ্বাস করতেন, তাঁরা ১৯৭১ সালের পর কিছু দিন গা-ঢাকা দিয়েছিলেন, আস্তে আস্তে গর্ত থেকে বেরিয়ে এসেছেন। অভিযোগ, এঁদের কেউ কেউ পাকিস্তানি চর হিসেবে নিজেদের নিযুক্ত করে অনেক মুক্তিযোদ্ধাকে সে-সময় ধরিয়ে দিয়েছিলেন, সেই মুক্তিযোদ্ধাদের উপর বীভৎস অত্যাচার চালানো হয়েছিল, অনেককে নারকীয় কায়দায় খুন করা হয়েছিল পর্যন্ত। এই পর্বে যাঁরা শহিদ হয়েছিলেন, তাদের মধ্যে বেশ কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকবৃন্দ যেমন ছিলেন, সেই সঙ্গে একগুচ্ছ আইনজীবী, শ্রমিক বা কৃষক নেতার মতো মানুষজনও ছিলেন।
চার দশক গড়িয়ে গেছে। কিন্তু প্রিয়জনদের অমনধারা নিধন যাঁরা মেনে নিতে পারেননি, তাঁরা এতগুলি বছর ধরে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ছিলেন, তাঁদের আত্মজনদের নিধনে যারা প্রত্যক্ষ বা অপ্রত্যক্ষ ভাবে অংশীদার ছিল, তাদের খুঁজে বের করে বিচারের ব্যবস্থা করবেন, ফাঁসিতে লটকাবেন পর্যন্ত। তাঁদের অধ্যবসায় এত দিনে এক অর্থে সার্থক। এ-রকম কিছু অপরাধীকে চিহ্নিত করা গেছে, একটি বিশেষ আইন প্রয়োগ করে তাদের বিচারের ব্যবস্থা করা হয়েছে, অপরাধ প্রমাণিত হওয়ায় সম্প্রতি কয়েক জনের ফাঁসির আদেশ দেওয়া হয়েছে পর্যন্ত। এখানেই বিপত্তির উদ্ভব। বিশেষ আইনটি প্রয়োগ করার প্রশ্নে বাংলাদেশ যেন দু’ভাগ হয়ে গিয়েছে। চল্লিশ বিয়াল্লিশ বছর আগে সংগঠিত অপরাধের জন্য এখন প্রাণদণ্ডের বিধান কতটা যুক্তিযুক্ত তথা ন্যয়সঙ্গত তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে, দু’দিকেই যুক্তি-প্রয়োগে আবেগের সংমিশ্রণ। যুদ্ধকালীন অপরাধের জন্য প্রাণদণ্ড ঘোষণার এই নিদান প্রধান বিরোধী বাংলাদেশ ন্যাশনাল পার্টির আদৌ পছন্দ নয়। তাঁদের সন্দেহ, এই আইনের অপপ্রয়োগ ঘটতে পারে এবং শাসকগোষ্ঠীর না-পসন্দ অনেককেই হয়তো এই অপপ্রয়োগ-বলে পদে-পদে জেরবার হতে হবে। গোলমেলে রাজনৈতিক পরিস্থিতি, এরই মধ্যে বাংলাদেশ ন্যাশনাল পার্টির নেত্রী আইনটির প্রতিবাদে দেশ জুড়ে হরতালের ডাক দিলেন। হঠাৎ ভারত সরকারের একটি অবিবেচনার জন্য বিদেশ নীতির ঘোলা জল আর অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক কোন্দল একাকার হয়ে গেল। বাংলাদেশ জুড়ে তর্কবিতর্ক চলছে, সুযোগ বুঝে জামাতপন্থীরা বাংলাদেশ ন্যাশনাল পার্টির সঙ্গে আলতো গাঁটছড়া বাঁধছেন বা বাঁধার চেষ্টা করছেন এমন অবস্থায় কোনও কৌশলে ভারতের রাষ্ট্রপতি বাংলাদেশ সফর স্থগিত রাখতে পারতেন, তা করা হল না। জামাতপন্থীদের ফের মাথা তুলে দাঁড়াবার প্রচেষ্টার প্রতিবাদে শাহবাগ প্রাঙ্গণে মাতৃভাষা-অনুরাগীরা জড়ো হতে থাকলেন। অতি পবিত্র তাঁদের উচ্চারণ, ধর্মান্ধদের রোষ থেকে তাঁরা মাতৃভাষাকে সর্বপ্রহর রক্ষা করবেন, প্রতিজ্ঞার বহু বর্ণিল দীপ্তিতে শাহবাগের আকাশ রঞ্জিত। কিন্তু তা হলেও একটি শূন্যতাবোধ: বেগম জিয়ার সমর্থকরা এখানে গরহাজির, জাতির একটি অতুচ্ছনীয় অংশের প্রতিনিধিরা অনুপস্থিত।
এটা ভাবনার কথা। এর সঙ্গে যা যোগ করতে হয় মাতৃভাষার জন্য এই যে নতুন সংগ্রাম তা কিন্তু তাঁদেরই একান্ত। একষট্টি বছর আগে ছাত্রদের রক্তে যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাঙ্গণ প্লাবিত হয়, তখন ভারতবর্ষীয় আমরা কেউ ধারেকাছে ছিলাম না। ধীরে ধীরে সেই ছাত্র অভ্যুত্থান জাতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনের আদল পেয়েছে, সেই আন্দোলনের একেবারে শেষ মুহূর্তে ভারতবর্ষ থেকে খানিকটা সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। শাহবাগ প্রাঙ্গণে যে নতুন একটি আবেগের স্ফূরণ, তা-ও কিন্তু ও-পার বাংলার মানুষদের সত্তার গভীর থেকে উৎসারিত। গত পঞ্চাশ ষাট বছরে বার্তা বিনিময় প্রতিবিনিময়ে অনেক প্রগতি ঘটেছে। আগের সন্ধ্যায় শাহবাগ প্রাঙ্গণে কে কী বললেন, কে কী গাইলেন, যূথবদ্ধ কী অঙ্গীকার করা হল, সমস্ত খবরই পর দিন সকালে কলকাতায় বসে আমরা পুঙ্খানুপুঙ্খ জানতে পারি। বাঙালি আবেগের আমরাও তো অংশভুক, আমাদের অনেকেরই মধ্যে বাসনা জাগতে পারে শাহবাগ প্রাঙ্গণের সম্মিলিত উচ্চারণের সঙ্গে আমাদের উচ্চারণ মিলে যাক, আমরাও যেন অ্যাকাডেমির বাইরের প্রাঙ্গণে দ্রুত-ছায়া-নেমে-আসা অপরাহ্ণে শাহবাগ প্রাঙ্গণের অঙ্গীকৃত প্রতিশ্রুতির সঙ্গে গলা মেলাই। কিন্তু ভারতবর্ষের রাষ্ট্রপতি তাঁর সফরেরে তারিখ না-পাল্টে যে ভুল করেছেন, আবেগের বশে মুহ্যমান হলে তারই আর এক দফা মাসুল গুনতে হবে। শাহবাগ প্রাঙ্গণে জড়ো হওয়া বন্ধুদের যাঁরা রাজনৈতিক শত্রু, তাঁরা গলা ফাটিয়ে প্রমাণ করতে চাইবেন, বাংলাদেশের আকাশে যে গৃহযুদ্ধের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে, গোপনে ও প্রকাশ্যে তার ইন্ধন জোগাচ্ছে দুশমন ভারতীয়রা।
দোহাই, শাহবাগ প্রাঙ্গণে ভিড় জমানো জনগণের প্রতি একাত্ম হওয়ার আগ্রহে এমন কিছু যেন আমরা না-করে ফেলি, যা শেষ পর্যন্ত তাঁদেরই মস্ত ক্ষতি করে বসবে, বাংলাদেশের লড়াইটা বাংলাদেশিদেরই লড়তে দিন না কেন!
ভয়ে-ভয়ে অন্য একটি অনুরোধ কি করতে পারি? আপনি যদি যে-কোনও প্রতিবাদের সঙ্গে যুক্ত হতে আঁকুপাঁকু বোধ করছেন, একটা কাজ করুন না কেন। সম্ভ্রান্ত সচ্ছল ঘরের যে বাঙালি বাবা-মায়েরা তাঁদের সন্তানদের যাতে এমনকী মাধ্যমিক স্তরেও ওই বিতিকিচ্ছিরি বাংলা ভাষায় তালিম দিতে না হয়, তার জন্য কলকাতা জুড়ে নানা প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নামুন না!
 আনন্দবাজার পত্রিকা 
 

বিতর্ক - সিপিএমের 'এই চেহারা' তৃণমূলের দীর্ঘ ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করবে।


Share on emailMore Sharing Servic

buddha and bimanসিপিএমের 'এই চেহারা' তৃণমূলের দীর্ঘ ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করবে।


পক্ষে: কথাটা ১০০ শতাংশ সত্যি। মুখ্যমন্ত্রী ও রাজ্য সরকার অনেক ক্ষেত্রেই চূড়ান্ত ব্যর্থ। পরিবর্তন এখন অভিশপ্ত। রাজ্য জুড়ে নানা বিশৃঙ্খলা। কিন্তু বিকল্প হিসেবে যাদের দিকে তাকাই, সেই ব্যক্তিদের আর কিছুই দেওয়ার নেই। বিমান বসু, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য, নিরুপম সেনরা রাজনৈতিক বিশ্বাসযোগ্যতা হারিয়েছেন। তাঁদের এখন বনবাসে যাওয়ার সময়। সিপিএম পার্টি দেউলিয়া। অন্য বামদলগুলি তার পরগাছা। বৃদ্ধ অশোক ঘোষ থেকে বাকি বাম নেতারাও অচল আধুলি। বাম দলগুলিতে কোনও তাজা রক্ত নেই। কসবার নবীন কমরেড শতরূপ ঘোষ থেকে ঋতব্রত বন্দ্যোপাধ্যায় কোনও তাজা রক্তকেই 'উঠতে' দেওয়া হচ্ছে না। বাঙালি কাঁকড়ার মতো ক্ষমতা দখল করে পার্টির উপর ছড়ি ঘোরাচ্ছেন পলিটব্যুরোর 'পলিটিক্যালি বুড়োরা'। নেই কোনও ভাল মহিলা নেত্রীও। রেজিমেন্টেড পার্টির হাইকমান্ড হয়ে উঠেছেন প্রকাশ কারাট। প্রকাশ-বৃন্দার ইচ্ছেতেই চলে পার্টি। পার্টিতে বাঙালি নেতাদের কদরই নেই। বুদ্ধ-বিমান-নিরুপম-সেলিমের মতো তিন দশকের পুরনো মুখ আর তাঁদের মুখ নিঃসৃত শূন্যগর্ভ বাণীগুলি শুনে রাজ্যবাসী ক্লান্ত, হতাশ। তাই বিপথগামী ও ব্যর্থ তৃণমূলের 'দীর্ঘ' ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করছে এই দিশাহীন ভগ্ন, ন্যুব্জ চেহারার সিপিএমই।

বিপক্ষে: সিপিএম এই চেহারা নিয়েই ঘুরে দাঁড়াবে। কারণ সিপিএমের পায়ে শক্ত জমি দিচ্ছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় স্বয়ং। তাঁর মন্তব্য, প্রতিক্রিয়া, কাজকর্ম এমনই ভুলে ভরা যে এই দিশাহীন, ভগ্ন, ন্যুব্জ সিপিএমকেই দিশা ও শক্তি দেবে সেগুলি। ধর্ষণ, খুন, দুর্ঘটনা সবেই সিপিএমের চক্রান্তের ভূত দেখেন মুখ্যমন্ত্রী। তার উপর সিপিএম সুলভ রেজিমেন্টেড কায়দায় 'দল চালাচ্ছে' এবং ভোটের সময় 'ভোট করাচ্ছে' তৃণমূল। যা ভালভাবে নিচ্ছে না মানুষ। দাদাগিরি দেখে দু বছরেই পরিবর্তন নিয়ে স্বপ্নভঙ্গ হয়েছে রাজ্যবাসীর। তাই বৃদ্ধাশ্রম হয়ে যাওয়া আলিমুদ্দিন স্ট্রিট ধীরে ধীরে শক্তি ও জমি ফিরে পাচ্ছে। এভাবে চললে পরের বিধানসভাতেই ক্ষমতাচ্যুত হতে পারে তৃণমূল। তার আগে লোকসভা বা পঞ্চায়েতেও অগ্নিপরীক্ষার মুখে 'কংগ্রেস বিহীন' তৃণমূল। তাই দীর্ঘ ক্ষমতায়ন হবে না। কারণ দলটার নাম তৃণমূল।