Thursday, June 21, 2012

সংস্কৃতির দুর্দিন

সংস্কৃতির দুর্দিন

দেবু গোস্বামী

‘‘ক্ষয়িষ্ণু পুঁজিবাদই ফ্যাসিবাদের জন্ম দেয়। পুঁজিবাদী গণতন্ত্রের অবক্ষয়ের মধ্যে ফ্যাসিবাদের জন্ম।’’ এই মূল্যায়নের সঙ্গে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন রাজনীতিজ্ঞ রজনীপাম দত্ত আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে ঘোষণা করেছিলেন’, ‘‘ফ্যাসিবাদ সম্পর্কে যদি কোনো মোহ না থাকে এবং এবিষয়ে যদি পরিচ্ছন্ন ধারণা থাকে, তাহলেই তাকে প্রতিরোধ ও পরাভূত করা যায়।’’ বিশ্বব্যাপী ফ্যাসিবাদ-বিরোধী সংগ্রামের মূল দায়িত্ব শ্রমিকশ্রেণী ও কমিউনিস্ট পার্টিগুলোর ওপর ন্যস্ত হলেও এই অভূতপূর্ব দানবীয় শক্তির বিরুদ্ধে ১৯৩৫ সালে কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকের সপ্তম অধিবেশনে গৃহীত জর্জি ডিমিট্রভের ‘যুক্তফ্রন্ট থিসিস’ এবং ১৯৩৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে প্রকাশিত দত্ত ব্রাডলি দলিল যুক্ত হয়ে ‘‘সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী গণফ্রন্ট’’ গঠনের উদ্যোগ পৃথিবীময় শুরু হয়। কিন্তু ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে পরিচ্ছন্ন ধারণা সৃষ্টি সহজ কাজ ছিলো না বিশেষ করে প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর ভার্সাই চুক্তির পর। এই চুক্তির দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলির অভ্যন্তরে জাগ্রত উগ্রজাতীয়তাবাদ দূরবর্তী দেশের মানুষের কাছে কোনো কোনো ক্ষেত্রে সহানুভূতি আকর্ষণে সমর্থ হয়েছিলো। তাছাড়া প্রচারমাধ্যমগুলির ক্রমান্বয় শিবিরভুক্তি বিশ্বের প্রত্যন্তে ছড়িয়ে থাকা মানুষের মধ্যে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করেছিলো বেশি মাত্রায়।

ইতালিতে মুসোলিনীর নেতৃত্বে ফ্যাসিস্ত পার্টির ক্ষমতা দখলের মাধ্যমে যে ফ্যাসিবাদের সূচনা তার দৃঢ় ভিত্তি রচিত হয় ১৯৩৩ সালে জার্মানিতে। ইহুদি-বিরোধী, কমিউনিস্ট-বিরোধী, বিদেশী-বিরোধী ঘোষণার মধ্য দিয়ে হিটলারের ক্ষমতায় প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে। অন্যদিকে এই শিবিরে যুক্ত হলো স্পেনে জেনারেল ফ্রাঙ্কোর অভ্যুত্থান এবং জাপানের সমরবাদী শক্তি। সমগ্র ইউরোপে ছড়িয়ে পড়লো ফ্যাসিবাদের আতঙ্ক, আগ্রাসনের উদগ্র বাসনা এবং গণতন্ত্রের বহ্ন্যুৎসব। বিশ্ব দুটি অক্ষশক্তিতে বিভক্ত হয়ে গেল— বলাবাহুল্য বিপরীত শিবিরের প্রধান শক্তিরূপে মাথা তুলে রইল স্তালিনের নেতৃত্বে সোভিয়েত রাশিয়া।



।।দুই।।

কোনো অস্বচ্ছতা না রেখে কমিউনিস্টদেরই পয়লা নম্বরের শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করেছে ফ্যাসিস্তরা, সর্বদেশে সর্বকালে, আর বিপরীতটাও সমানভাবে সত্য। কাজেই এ প্রশ্নটা থেকেই যায় নিজেদের পয়লা নম্বর শত্রু সম্পর্কে ন্যূনতম সংজ্ঞাটি নির্ধারণ করতে এত দীর্ঘ সময় লাগলো কেন।



বিশ্বের আর পাঁচটা বিষয়ের মতই ফ্যাসিবাদের সংজ্ঞা এবং বিবরণ মতাদর্শগত বিতর্কে বিদীর্ণ। বিশেষত, সমাজতান্ত্রিক শিবিরের পতনের পর এই বিষয়টিকেও নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা হয়েছে সমাজতন্ত্র- বিরোধিতার জায়গায়। এই বিকৃতি দু’দিক থেকে করা হয়েছে। ঠাণ্ডাযুদ্ধের সময় থেকেই মার্কিন বিশ্ববিদ্যালয় এবং তাদের ‘বেস্ট সেলার’ লেখকরা হিটলার এবং স্তালিনকে এক পর্যায়ে দেখানোর চেষ্টা করেছেন। কিন্তু ১৮৮৯ সালের পর থেকে আক্রমণটা আরও তীব্র। এখন ফ্যাসিবাদ এবং সাম্যবাদকে একই ব্র্যাকেটভুক্ত করা হচ্ছে। যেন একদিকে বুর্জোয়া সংসদীয় গণতন্ত্র আর অন্যদিকে তার দুই শত্রু ফ্যাসিবাদ এবং সাম্যবাদ। আর ফ্যাসিবাদকে বর্ণনা করার গণতন্ত্র আর অন্যদিকে তার দুই শত্রু ফ্যাসিবাদ এবং সাম্যবাদকে। আর ফ্যাসিবাদকে বর্ণনা করার চেষ্টা হচ্ছে তার শ্রেণীউৎস থেকে বাদ দিয়ে, কেবল তার বাইরের লক্ষণ দিয়েই। এমন কি প্রচ্ছন্নভাবে ফ্যাসিবাদকে যথাসম্ভব সহনীয় করে উপস্থিত করার প্রচেষ্টাও বেশ চোখে পড়ার মতো। এর মুখ বন্ধ করা হয় ফ্যাসিবাদ সম্পর্কে তথাকথিত ‘নিরপেক্ষ’ বিচারের নাম করে। মানবতার চরমতম শত্রুর বিরুদ্ধাচরণকে বাদ দিয়ে, কোনো বিশ্লেষণ আসলে মানবতার বিরুদ্ধাচরণ করা, এ‍‌ই সামান্য নৈতিক অবস্থানটুকুও তারা নিতে রাজি নয়।

অনেকে মনে করেন ফ্যাসিবাদের চিরায়ত বাসস্থান হলো জার্মানি। কিন্তু তা নয়। ফ্যাসিবাদের জন্মস্থান ইতালিতে। অনেকের বিচারে ইতালিই হলো চিরায়ত ফ্যাসিবাদের জন্মস্থান। জার্মানিতে ফ্যাসিবাদ যখন মাথা তুলছে তখন জার্মানিতে পুঁজিবাদ শুধু প্রতিষ্ঠিত নয়, সে তার একচেটিয়া দশাও প্রাপ্ত হয়েছে। বিপরীতে ইতালিতে তখন বুর্জোয়ারা নির্বিবাদে ক্ষমতা ভাগ করে নিয়েছে সামন্ততন্ত্রের সঙ্গে। পুঁজিবাদের বিকাশ সীমাবদ্ধ উত্তর ইতালির মিলান-জেনোয়া— তুরিন এই ত্রিভুজে। বিস্তীর্ণ মধ্য এবং দক্ষিণ ইতালিতে রমরমিয়ে ক্ষমতাসীন প্রবল পরাক্রান্ত সামন্ততন্ত্র। উত্তর এবং মধ্য ইতালিতে সামন্ততন্ত্রের মধ্যে পুঁজিবাদী চরিত্রের প্রাথমিক লক্ষণ দেখা দিলেও দক্ষিণ ইতালিতে বর্গাদারির অনুরূপ ব্যবস্থা বহাল। এর ফলে হলো কি— আঞ্চলিক বৈষম্য, আঞ্চলিক রেষারেষি ইতালির রাজনৈতিক বৈশিষ্ট্য। এককথায় পুঁজিবাদ রাজনৈতিক ক্ষমতায় কিন্তু অনুপস্থিত বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব। ম্যাৎসিনি, গ্যারিবল্ডিদের নেতৃত্বে ইতালির ঐক্যসাধনকে বুর্জোয়া বিপ্লবের প্রথম পর্যায় বলা যায়, কিন্তু তা পরিপূর্ণভাবে সম্পন্ন হয়নি। কিন্তু এই অবস্থানের মধ্যেও পুঁজিবাদ তার প্রসার ঘটাচ্ছিল; এমন কি অসম্ভব দ্রুততার মধ্যে মাথা চাড়া দিচ্ছিল ফিয়াট, অলিভেট্টি পিরেল্লির মতো একচেটিয়া শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো। আর দক্ষিণ ইতালি জুড়ে রোজ চালাচ্ছিল মধ্যযুগীয় সামন্ততন্ত্র। আর যথারীতি রোম আর সংলগ্ন মধ্য ইতালির বিপুল অংশ পোপ এবং ভ্যাটিকানের দখলে। যা ইতালিতে পুঁজিবাদ বিকাশের পথে বাধার পাথর হয়ে দাঁড়িয়েছিলো।

।। তিন।।

বেনিতো মুসোলিনী তাঁর প্রথম রাজনৈতিক জীবনে সমাজতান্ত্রিক ছিলেন এটা তথ্য হিসেবে স্কুল পর্যায়ের সাধারণজ্ঞানের অন্তর্ভুক্ত হবার মতো। তিনি সমাজতান্ত্রিক পার্টির নেতা ছিলেন বললে কম বলা হয়, তিনি ছিলেন মুসোলিনীর বাবা আলেক্সান্দ্রো মুসোলিনী। রাজনৈতিক বিশ্বাসে ছিলেন সক্রিয় সমাজতান্ত্রিক।

মুসোলিনী সারা জীবনে সবচেয়ে বেশি ঘৃণা করেছেন যাকে সেই ভ্লাদিমির ‍‌ইলিচ লেনিনকে অনুকরণ করার চেষ্টা করেছেন। নিজেদের মধ্যে নিজেকে ইতালির ‘লেনিন’ বলে বর্ণনা করতেন। জেনিভাতে লেনিনের সাথে পরিচয় হয়েছিলো, দীর্ঘ আলোচনা হয়েছে— এরকম একটা নির্ভেজাল মিথ্যা অবলীলাক্রমে তাঁর জীবনীকারদের বলেছিলেন। শুধু এটা নয়, সারাজীবনে মিথ্যার সাথে আপস করেছেন, ব্যবহার করেছেন মিথ্যাকে, নিজের ভাবমূর্তি গড়ে তোলার জন্য। পৃথিবীর যে কোনো প্রান্তের ফ্যাসিবাদই এমন নেতাকেন্দ্রিক। এর ফলে তাদের ভাবমূর্তি গড়ে ফোলাটা ফ্যাসিস্তদের কাছে একটা প্রধান কাজ। এবং একাজে সত্যের প্রতি নীতিনিষ্ঠ থাকার সুযোগ কোনো ফ্যাসিস্ত নেতাই দেয় না। প্রায় বামপন্থী মুসোলিনী যে দ্রুততায় দক্ষিণের দিকে ঢলে পড়লেন, তাতে এটাই প্রমাণিত — তার কোনো দৃঢ় মতাদর্শ ছিলো না, ছিলো কেবল ক্ষমতালিপ্সা। মুসেলিনীর শুরুটা সমাজতন্ত্রে বা বামপন্থায়, গোড়ায় ফ্যাসিবাদও স্লোগানে বামপন্থী কেবল নয়, কখনও কখনও সমাজতান্ত্রিকদের থেকেও বেশি বামপন্থী। 

সমাজতান্ত্রিক পার্টি থেকে বহিষ্কৃত হবার পর মুসোলিনীর সাংগঠনিক উদ্যোগ মিলানে প্রথম ‘ফ্যাস্‌সি’ অর্থ গোষ্ঠী। লক্ষণীয়ভাবে পার্টি কথাটি ব্যবহৃত হয়নি। মিলান ইতালির অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক রাজধানী হিসাবে স্বীকৃত; সেই মিলানে ১৯১৯, ২৩শে মার্চ প্রথম সম্মেলন। সম্মেলনে অনেক লোকজন জড়ো হয়েছিলো তা না, মেরে কেটে জনা পঞ্চাশেক। যারা জড়ো হয়েছিলো তাদের রাজনৈতিক চরিত্র খুব গুরুত্বপূর্ণ, অন্তত ফ্যাসিবাদ গড়ে ওঠার ক্ষেত্রে। এক, মুসোলিনীর মতো সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধে যোগ দেবার পক্ষপাতী কিছু প্রাক্তন সমাজতান্ত্রিক, র‌্যাডিক্যাল সিন্ডিক্যালিস্ট এবং ফিউচারিস্টদের মতো ছোটো রাজনৈতিক ‍গোষ্ঠীর লোক। এবং কালো আধা সামরিক পোশাক পরা একদল প্রাক্তন সৈনিক (যার থেকে ব্ল্যাক শার্টস)।

সেখান থেকে যে কর্মসূচী ঘোষিত হয় তাই ফ্যাসিস্তদের প্রথম ঘোষিত কর্মসূচী। তার প্রধান দাবিগুলো এইরকম:

(১) আইন করে শ্রমিকদের ৮ ঘণ্টা কাজের অধিকারের স্বীকৃতি।

(২) ন্যূনতম মজুরির স্বীকৃতি।

(৩) শিল্প প্রতিষ্ঠানের কারিগরি পরিচালনার ক্ষেত্রে শ্রমিকদের অংশগ্রহণ।

(৪) শিল্প পুঁজি ও শিল্পপতিদের মুনাফার ওপর ক্রমবর্ধমান হারে কর।

(৫) মেয়েদের সর্বজনীন ভোটাধিকার, পার্লামেন্টে সমানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব।

(৬) ১৮ বছরে ভোটাধিকারের স্বীকৃতি।

(৭) দরিদ্র এবং ভূমিহীন কৃষকদের জন্য জমি।

(৮) নতুন সংবিধানের জন্য ন্যাশনাল এসেম্বলি গঠন।

১৯১৯-এ দাঁড়িয়ে ইতালিতে এটি ‘বিপজ্জনকভাবে’ বামপন্থী এক‍‌টি কর্মসূচী। এর মধ্যে প্রধান দিক হলো এই কর্মসূচী শ্রমিক-কৃষকের অধিকারের পক্ষে। এই কর্মসূচী চার্চ ও পোপের বিরুদ্ধে। এই কর্মসূচী রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে। এটা সূত্রপাত মাত্র।

ইতিহাস প্রমাণ দেয় : কতটা অর্থহীন ছিলো এই কথাগুলো। বিশ্বযুদ্ধের পটভূমিকায় তৈরি হওয়া প্রথম ফ্যাস্‌সি শান্তিবাদী। তারা শুধু শহুরে বিলাসী শান্তিবাদের বিরোধী, তাদের শান্তিবাদ ‘টেঞ্চের শান্তিবাদ’। নিঃসন্দেহে প্রাক্তন সৈনিকদের আকর্ষণ করেছিলা এই স্লোগান। ১৯১৯ এর কর্মসূচীতে লিগ অব নেশনস্‌-কে সর্বোচ্চ সংস্থা হিসেবে মেনে নেবার কথা বলা হয়েছিলো।। আর ১৯২১-এ ফ্যাসিস্তদের চোখে লিগ অব নেশন্‌স হয়ে গেল ইতালির বিরুদ্ধে পক্ষপাতদুষ্ট। সংস্থার পরিচালনায় শ্রমিকদের অংশগ্রহণের কথা বেমালুম ভুলে যাওয়া হলো ক্ষমতায় এসে। লাভের উপর ক্রমবর্ধমান কর এবং যুদ্ধের লভ্যাংশ বাজেয়াপ্তের গরম বক্তৃতা, ক্ষমতায় গিয়ে হয়ে গেল ‘অর্থহীন বক্তৃতা, যা উৎপাদন বৃদ্ধির উদ্যোগকে ব্যাহত করবে।’ এই উৎপাদন বৃদ্ধির সর্বাত্মক স্লোগান বা প্রোডাকশনিজম যার তোড়ে একচেটিয়া পুঁজিকে নিয়ন্ত্রণ করে শ্রমিকদের অধিকার — সব কিছু ভেসে গেল। কারণ ‘জাতি’র প্রয়োজন আরও উৎপাদন। আর সব কিছুই জাতির জন্য। শ্রমিকদের অধিকারের পক্ষে গলা ফাটিয়েছে যে ফ্যাসিস্তরা ১৯১৯-এ, তারাই শ্রমিকদের ধর্মঘট করার, এমনকি আলাদা ট্রেড ইউনিয়ন করার অধিকার কেড়েছে ১৯২৭ সালে। একচেটিয়া পুঁজিপতিদের সবচেয়ে বিশ্বস্ত স্বার্থরক্ষাকারী। সর্বজনীন গণতন্ত্র যারা চেয়েছে তারাই ইতালিতে ভোটের পাট তুলে দিয়েছে ১৯২৬ সালে।

আর যে ভ্যাটিকান এবং ভ্যাটিকানই হাতে ধরে মুসোলিনীকে ক্ষমতায় এনে বসিয়েছিলো। ফ্যাসিস্তদের রোম অভিযান যখন ইতালির সেনাবাহিনীর সামনে লেজ গুটিয়ে পালানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে রোমের গেট থেকে, তখন মিলানের হোটেল থেকে মুসোলিনীকে তুলে এনে প্রধানমন্ত্রী করেছিলেন রাজা তৃতীয় ভিক্টর এমানুয়েল।

প্রথম ফ্যাসিস্ত ম্যানিফেস্টো ১৯১৯-র পরিপূর্ণ সমাজতান্ত্রিক বা সমতুল্য প্রতিশ্রুতি না থাকলেও পুঁজিবাদ সম্পর্কে একটি শ্রেণীসংগ্রামের মনোভাব প্রস্ফুটিত ছিল। এর তেরো বছর পর ১৯৩২-এ ইতালিয়ান এনসাইক্লোপিডিয়ায়, তখন ক্ষমতায় সুপ্রতিষ্ঠিত ফ্যাসিস্তদের পক্ষ থেকে Doctrine of Faccism (ফ্যাসিবাদের তত্ত্ব) প্রকাশিত হয়। এর প্রাথমিক লেখক ছিলেন ফ্যাসিস্ত পার্টির তাত্ত্বিক মুখপত্রে এবং দার্শনিক জিওভান্নি জেস্টিলে। তাঁর করা মক্‌শটি দেখতে দেওয়া হয় মুসোলিনীকে। সংশোধন করার চেষ্টার ফল এই হয়, গোটাটি মুসোলিনী নিজে লেখেন। এই ডকট্রিন অব ফ্যাসিজম মুসোলিনীর জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ লেখা। ১৯১৯-এর ফ্যাসিস্ত কর্মসূচী যদি মু‍খোশ হয় তবে ১৯৩২-এর ডকট্রিন অব ফ্যাসিজম ফ্যাসিস্তদের তাত্ত্বিক মেক-আপ করা মুখ। ফ্যাসিবাদ মনে করে জীবন আসলে একটি ভাববাদী অস্তিত্ব। আর প্রতিটি মানুষের জীবনের লক্ষ্য হওয়া উচিত উন্নততর সত্তা যা রাষ্ট্রের স্বার্থে কাজে না লাগে। স্বাধীনতা বা গণতন্ত্র ও রাষ্ট্রের সামগ্রিক স্বার্থের বাইরে অস্তিত্বহীন এবং ফ্যাসিবাদ তার বিরোধিতা করে। রাষ্ট্রই চূড়ান্ত, স্বার্থের বাইরে কোনো কিছুর অস্তিত্ব নেই।

বেনিতো মুসোলিনী বলেছেন, ‘‘আমরা আমাদের মিথ তৈরি করেছি। মিথ একটি বিশ্বাস, মিথ একটি আবেগ, তা সত্য নাই হতে পারে, বাস্তবে মিথ মানুষকে উদ্দীপ্ত করে, মিথ আসলে একটি আশা, মিথ আসলে সাহস। আমাদের মিথ আমাদের জাতি, আমাদের জাতির মহত্ত্ব, এই মিথ, এই মহত্ত্ব একে বাস্তবায়িত করাই আমাদের একমাত্র কাজ, বাকি সবই গুরুত্বহীন’’। তাঁর যুগে উত্তেজনক বক্তা হিসেবে তাঁর ধারেকাছে কেউ আসে না। ফ্যাসিস্ত মিথের এর থেকে ভালো বিবরণ আর কেউ দিতে পারে না। আর এ বক্তৃতা এক ঐতিহাসিক মুহূর্তে, ফ্যাসিস্তদের ক্ষমতা দখলের জন্য রোম অভিযান শুরু হওয়ার ঠিক তিনদিন আগে ফ্যাসিস্ত পার্টির নেপল্‌স কংগ্রেসে।

ফরাসী র‌্যাডিক্যাল সিন্ডিকালিস্ট দার্শনিক জর্জ সোরেল বলেছিলেন সমাজতন্ত্র, যুক্তির দ্বারা প্রতিষ্ঠিত কোনো ধারণা নয়। সমাজতন্ত্র একটি ধর্ম বিশ্বাসের মতো, তা আবেগের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত। জনগণের মধ্যে এই আবেগ সৃষ্টি করেই একমাত্র সমাজতন্ত্র অর্জন করা সম্ভব। সোরেল এই মিথ সৃষ্টিতে বিশ্বাস করতেন। সোরেলের সবচেয়ে বিখ্যাত/কুখ্যাত ছাত্র মুসোলিনী এই মিথ সৃষ্টিতে বিশ্বাসী ছিলেন। তাঁর ফ্যাসিবাদ প্রতিষ্ঠিত ‘জাতি’ এই মিথের উপর। ইতালিকে ফিরে পেতে হবে পুরানো পৃথিবীতে রোম সাম্রাজ্যের যে মর্যাদা ছিল সেই মর্যাদা। একইভাবে জার্মান জাতির শ্রেষ্ঠত্বকে মিথ হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করে নাৎসিদের বিকাশ।

ফ্যাসিবাদ জানে জনগণের মধ্যে ‘মিথ’ তৈরি করতে হবে। সেই মিথ অর্জনের জন্য অলৌকিক ক্ষমতাসম্পন্ন একজন নেতা তৈরি করতে হবে। লাগামহীন মিথ্যাচার ছাড়া এ কাজ করা যায় না। ফ্যাসিবাদ জানে কারোর বিরুদ্ধে অন্ধ ঘৃণা তৈরি করতে হবে, এরজন্যও প্রয়োজন লাগামহীন যুক্তিহীন মিথ্যা। সব মিলিয়ে, এরজন্যই হিংসার মতোই মিথ্যাও একটি স্তম্ভ যাকে বাদ দিয়ে ফ্যাসিবাদ প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না।



শিশুকাল পার হয়ে হিটলার চিত্রকর হতে চেষ্টা করেছিলেন। শুধু তাই নয়, তঁর সঙ্গীত-প্রীতিও নাকি বিস্ময়কর। সুরকার ভাগ্‌নরের রেকর্ড শুনতে শুনতে তিনি ঘুমিয়ে পড়েন, সুরতরঙ্গের মধ্যে সমাধিস্থ হয়ে যান। নারীর বিলোল কটাক্ষ তাঁকে বশ করতে পারেনি। নেশা বা লোভ তাঁর ব্যক্তিগত জীবনকে কখনও স্পর্শ করেনি। তিনি অতি সহজেই সুরের ও রঙের অপরূপ সৌন্দর্যে মুগ্ধ হন, আত্মবিস্মৃত হন। শাসক ‍‌ও শিল্পীর এমন অদ্ভুত সমন্বয় হিটলার ভিন্ন আর অন্য কোনো রাষ্ট্রনেতার মধ্যে নাকি দেখা যায় না। তাই তাঁর গুণমুগ্ধ ভক্তবৃন্দ বলেন, হিটলারের দেশপ্রেম ও জাতিপ্রেম স্বার্থগন্ধ শূন্য। জাতির কল্যাণই তাঁর জীবনের একমাত্র স্বপ্ন! তাঁর ‘হাইনকেল’ ও ‘উৎকার’ মৃত্যুর দূত নয়, সৌন্দর্যের এঞ্জেল, আকাশ থেকে তারা নেমে আসে মাটির বুকে। হিটলার সাধক, উপাসক, সংযমের, সৌন্দর্যের ও স্বাধীনতার। আমাদের দেশের কোনো জনপ্রিয় ‘দেশপ্রেমিকে’র নিজের মুখ থেকে একথা একবার স্বকর্ণে শোনার সৌভাগ্য হয়েছিল অনেকের। আজ তিনি স্বাধীনতার সাধনায় বানপ্রস্থে।

যে কোনো একজন রাষ্ট্রনেতা কর্পোরাল যে কবি বা শিল্পী পারেন না তা নয়। রাষ্ট্রনেতার সকলের জীবনী আমাদের জানা নেই। শোনা যায় রুজভেল্ট ডলারের স্কাইস্ক্রেপার গড়তেই ভা‍‌লোবাসেন, চার্চিল সাহিত্যরসিক, চিয়াং-কাই-সেক যোদ্ধা, মুসোলিনী বক্তা, তোজো কি জানা নেই, স্তালিন কৈশোরে কবি ও গায়ক ছিলেন। এ যুগের সাম্প্রতিক ইতিহাস থেকে আরও অনেক দৃষ্টান্ত দেওয়া যেতে পারে। র‌্যালফ ফক্স, কডওয়েল কর্নফোডের মতো সাহিত্যিক ও শিল্পীরা যোদ্ধাও ছিলেন। টম উইন্ট্রিয়ম রণনীতি বিশারদ হলেও কবি। টি ই লরেন্স-এর ‘Seven Piller of Wisdom’এ ও কবি আর্নস্ট টলার ব্যাভেরিয়ান রিপাবলিকের প্রেসিডেন্ট ছি‍‌লেন, বিপ্লবের নেতা ছিলেন ‍‌এবং শেষ পর্যন্ত তাকে ‘শিল্পী-শাসক হিটলারের’ ফ্যাসিস্ত অমরাবতীর বন্দী শিবিরেই প্রাণত্যাগ করতে হয়েছে। এরকম আরও অনেক শিল্পী ও সাহিত্যিক আছেন যাঁরা যোদ্ধা ও দেশকর্মী। অনেক বীর যোদ্ধা, কর্পোরাল ও ক্যাপ্টেন আছেন যাঁরা যোদ্ধা ও দেশকর্মী। শিল্পীর প্রাণ যে ধ্বংসের মধ্যেও কাতর হয় না, কবির হাত যে কামান ও টমিগানও শক্ত করে ধরতে পারে, কুৎসিত ধ্বংসলীলার মধ্যে যে সৌন্দর্যের সাধনা করা যায়, কবিতা লেখা যায় স্পেনের গৃহযু‍‌দ্ধে, সোভিয়েত ও হেমিংওয়ে (Ea

est Hemingway) স্পেনে এসেছিলেন তাঁর সাহিত্যের প্রেরণার সন্ধানে। স্পেনের গেরিলাদের সঙ্গে তিনি ফ্যাসিস্ত শত্রুদের পেছনে পেছনে বহুদিন ঘুরেছিলেন। তাই তাঁর পক্ষে লেখা সম্ভব হয়েছে ‘For Whom The Bell Tolls’-এর মতো সুন্দর উপন্যাস। আঁদ্রে মালরোর (Andre Malrous) বিশ্ববিখ্যাত উপন্যাস ‘Days of Hope’ স্পেনের গৃহযুদ্ধেরই অবদান। রিপাবলিকানদের পক্ষে মালরো বৈমানিক হয়েও যুদ্ধ করেছিলেন। এছাড়াও আরও অনেক শিল্পীর প্রতিভার বিকাশ হয়েছে স্পেনের রণক্ষেত্রে, অনেক তরুণ শিল্পী তাঁদের প্রতিভার সামান্য পরিচয় রেখে যুদ্ধক্ষেত্রে প্রাণ বিসর্জন দিয়েছেন।

কিন্তু রণক্ষেত্রের একদিকে যখন দেখতে পাই কামান গর্জন ও বোমা-বিস্ফোরণের মধ্যেকারের স্ফূরণ হয় না, শিল্প ও সাহিত্যের বিকাশ হয় না, আর একদিকে কামান ও কালি-কলম, রাইফেল ‍‌ও তুলি, এক হাতে সৃষ্টি করে, ধ্বংস করে সৃষ্টির জন্যে, তখন মনে প্রশ্ন জাগে ভাগ্‌নরের ভক্ত হিটলারের সঙ্গীত-প্রীতি ও সৌন্দর্য-পিপাসা আর শত শত শিল্পী ও রূপকারের সৌন্দর্যসাধনা কি একই? ফ্যাসিস্ত ‘শিল্পী’ হিটলার যেখানে সৌন্দর্যসাধনায় ধ্যানস্থ সেখানে দেখতে পাই অনুর্বর প্রান্তরের উপর অসংখ্য নরকঙ্কাল, কুশকাঠ ও শুকনো সকাল, মৃত্যুর পৈশাচিক উল্লাস। সেখানে প্রতিভার বিকাশ নেই, মানবতার নিষ্ঠুর অগ্নিপরীক্ষায় শিল্পীর আত্মত্যাগ নেই। আর একদিকে, ফ্যাসিস্তদের এই শব-সাধকদের তপোভঙ্গের জন্য যেদিকে অসংখ্য মানুষ বজ্রমুষ্টি তুলে রয়েছে, সেখানে মৃত্যু ‍‌ও ধ্বংসের মধ্যেও দেখা যায় নতুন জীবন, নতুন সৃষ্টির কাজ নিয়ত চলছে। শিল্পী সেখানে সৃষ্টি করেছেন একহাতে, ধ্বংস করছেন আর এক হাতে। ধ্বংস করছেন কি? মৃত্যুর ও নৈরাশ্যের কালো দিন। সৃষ্টি করছেন কি? ‘Days of Hope’, আঁদ্রে মাল‍‌রোর মতো তিনি ‘AVIATOR’ ও ‘ARTIST’ দুই-ই। আজ তাই একদিকে হিটলার হামলার, গোয়েরিং-গোয়েবলস, টোজো-মুসোলিনী, সুরশিল্পী ভাগ্‌নরের বিকারগ্রস্ত শিষ্য ‍‌ও বুদ্ধের ভক্তের দল, আর একদিকে বিশ্বের মানবজাতির সঙ্গে একছন্দে, একতালে আগুয়ান পৃথিবীর সকল শ্রেণীর প্রবীণ ও নবীন শিল্পী ও মনীষী। একদিকে মৃত্যুর বীক্ষণাগারে বন্দী রাসায়নিক ও পদার্থবিদ, আর একদিকে বিশ্বমানবের কল্যাণের পথে যাত্রী বৈজ্ঞানিক। ভাগ্‌নরের সুরে একদিকে হয়েছে অসুরের আবির্ভাব আর একদিকে মানুষের, জীবনের ও নব-মানবতার শিল্পীর ‍‌ও কবির, স্বাধীনতার ও মুক্তির শহীদ।

ভাগ্‌নরের সুর যিনি অসুরের কান দিয়ে শুনেছেন তিনি ধ্বংসের দুঃস্বপ্নই দেখবেন, ‍‌যিনি মানুষের কান দিয়ে শুনেছেন তিনি দেখবেন নতুন জীবন ও সৃষ্টির স্বপ্ন। কানের পার্থক্য এখানে দৃষ্টির, অনুভূতির ও আদর্শের পার্থক্য। ভাগ্‌নরের বিখ্যাত Nibelung’s Ring রচনার মধ্যে ফ্যাসিস্ত সর্দার তাঁর নিজের প্রেরণা পাবেন, কারণ এই সুরকাব্যের নায়ক-নায়িকারা হত্যা করছে, ধ্বংস করছে, খুন হচ্ছে, আত্মহত্যা করছে। Hunding হত্যা করছে, Siegmund’কে Siegfried বধ করছে ড্রাগন, Brunhilde আগুনের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ছে। ফ্যাসিজমের খোরাক আছে এরমধ্যে, কিন্তু ভাগ্‌নরের সুরকাব্যে এই পাশবিক মৃত্যুর ও ধ্বংসের ঝংকারই কি আসল? ভাগ্‌নর ১৮৪৮ সালের বৈপ্লবিক আন্দোলনে নিজে যোগ দিয়েছিলেন। তিনি ঊনবিংশ শতাব্দীর জার্মানির বিপ্লবী সুরকার। তাঁর Ring-এর প্রধান সুর হচ্ছে ‘অর্থ’ ও ‘অন্তরের দ্বন্দ্ব’, ‘জড় ও জীবনের’ সংঘর্ষ, শক্তির শৃঙ্খল ও মুক্তির স্ফূর্তির মধ্যে বিরোধ। এই বিরোধ ও সংঘর্ষ বিপ্লবউত্তীর্ণ হয়ে মুক্তির নির্মল প্রভাতের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। Brunhilde তাই যখন ‘আগুনের উপর ঝাঁপ দিচ্ছে তখন গান গাইছে:

Not goods nor gold nor glory of gods

Not house nor hall lordly pomp

Not guileful bargain’s treacherous bonds

Nor figning custom’s hard decrees,

Blessing in well or woe Love alone bring…..

Ring এর ধ্বংস ‍‌ও হত্যার রণঝংকার পৌঁছেছে ফ্যাসিজমের কানে, আর সজীব ও সুন্দর মানুষের কানে পৌঁছেছে ব্রুনহিল্ডের গান। শুধু কানে নয়, কানের ভেতর দিয়ে মর্মে। বেশ কিছুকাল আগে কলকাতায় গ্লোব থিয়েটারের হলঘরে বসে রাত দশটার সময় ভাগ্‌নরের এই ‘Siegfried Idyll’ তন্ময় হয়ে অনেকে শুনেছিলেন।
সৌজন্যেঃ- গণশক্তি (সম​য়ের সাথে)

No comments:

Post a Comment