Wednesday, August 1, 2012

মাটির মানুষের জীবন আঁকার চিত্রী


Image


   মাটির মানুষের জীবন আঁকার চিত্রী    

 রাধামাধব মণ্ডল 

                ‘হারিয়ে গেলে মনের মানুষ
                                 খুঁজলে মেলে না...’
       ভরা গলায়, গুরুগম্ভীর রোদে দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে গাইতেন রামকিঙ্কর। শান্তিনিকেতনে সবার প্রাণের মানুষ, আত্মার আপনজন, এক রক্তিম প্রাণউচ্ছ্বাস মাখা কর্মনিপুণ ব্যক্তিত্বের অধিকারী। চিত্রী-ভাস্কর শিল্পী রামকিঙ্কর বেইজ। আশ্রমের ফাঁকা আকাশের নিচে, পাখির কাকলিতে গলা মিলিয়ে গাইতেন কখনো লালন, কখনো রবীন্দ্রনাথ। হাতে নরম মাটির তাল, কখনো বা সিমেন্টের মতো কিছু একটা। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মানুষের জন্য মানুষের জীবনযাত্রাকে ধরছেন। কেউ বললে হাসতেন — প্রাণখোলা ছিল তাঁর সেই অম্লান হাসি। সেদিনের আশ্রমিকরা সকলেই এত বড় মানুষটাকে কিঙ্করদা বলেই ডাকতেন। তাঁর চোখ ছিল মানুষের কাছাকাছি। তীক্ষ্ণ দৃষ্টির সৃজনাত্মক অনুভবে কেবল দেখে নিতেন, খুব কাছ থেকে। গরিব-গুর্ব পাড়ার সরল, আড়ম্বরহীন সাধারণ নারী-পুরুষ তাঁর সৃষ্টিজুড়ে।
        প্রথমদিকের শান্তিনিকেতনকে যাঁরা দু’হাত দিয়ে ভরিয়ে গেছেন রামকিঙ্কর তাঁদের একজন। শিল্পী বি‍‌নোদবিহারী মুখোপাধ্যায়, শঙ্খ চৌধুরী, সোমনাথ হোড়— সঙ্গে ছিলেন গুরু নন্দলাল বসু। তখন বিশ্বভারতী এখনকার মতো এত যান্ত্রিক হয়ে ওঠেনি। প্রকৃতির কাছে ছিল পাঠ নেওয়ার খাস আসন। কচিকাঁচাদের বুক ভেজা হাসি। গুরু-শিষ্যদের নিবিড় সম্পর্ক। তখন ছাত্র থেকে ধীরে ধীরে শিল্পী রামকিঙ্কর হয়ে ওঠা। প্রকৃত বোধের জন্য জ্ঞান আরও চাই, চাই মানুষের সঙ্গে নিবিড়ভাবে সংযোগ রক্ষা। উপলব্ধির মধ্যে দাঁড়িয়ে প্রকৃতির নানা রঙ ব্যবহার করে, গরিব পাড়ার কথা এঁকেছেন মাটির শিল্পী।
                     ‘আপনাতে আপনি চিনিনে’
        লালনের গান খুব ভালোবাসতেন, গাইতেন ফাঁকা গলায়। তখনও ভাস্কর্যের কাজে তেমন জয়জয়কার শুরু হয়নি। তেলরঙ, জলরঙ ছাড়া স্কেচ করেছেন অজস্র। সবই মানুষের, মানুষের সঙ্গে থাকা নানা জীব-প্রাণীর। 
                  ‘এমনও মধুরও বয়স
                            কেটেছে একলা বেলা
                   তমশা বিপিনে মাতো
                            হৃদয়ে হৃদয়ে খেলা’।
       ভুবনডাঙার ফাঁকা মাঠ, মাঠের নিকটে দিনান্তের অস্তগামী রক্তিম সূর্য প্রায়ই দেখতে পাগলের মতো ছুটে আসতেন শিল্পী। এসে থাকতেন নিজের লিখে দেওয়া, ভুবনডাঙার রাধারানী দেবীর বাড়িতে। কাছ থেকে দেখে কত এঁকেছেন রাধারানীকে মডেলে, ছবিতে— এখনও কথা হয়ে ফেরে সেসব।
       কর্মজীবনের অনেকগুলি দিন রাধারানী দেবী কাটিয়েছেন শিল্পী রামকিঙ্করকে দেখভাল করার কাজে। কখনো ছেড়ে যাননি তাঁকে, সেদিন পর্যন্তও...।
                        ‘প্রাণের মানুষ আছে প্রাণে’…
       খুব ভালোবাসতেন রাধারানীকে। এনিয়ে অনেক গল্পের খোরাক, বিতর্কও যে হয়নি, তা নয়। হয়েছে যেমনটা হয়! এই ভালোবাসার মানুষটিকে জীবন ও শিল্পের বিভিন্ন কাজে, কংক্রিটে, তেলরঙে, জলরঙে, প্রতিকৃতির বিচিত্র কম্পোজিশনে, ভাস্কর্য শিল্পের কাজে ফুটিয়ে তুলেছেন। শত আঘাতেও কখনো ভাঙেননি তিনি। বীরের পরীক্ষা হয় যুদ্ধের ময়দানে, এটা মেনেই কখনো যুদ্ধ শুরু হলে একা-একা লড়াই করে, অবশেষে জয়ীই হয়েছেন রামকিঙ্কর। তবুও কাপুরুষের মতো যুদ্ধক্ষেত্র ত্যাগ, বা আত্মসমর্পণ করেননি তিনি। এরজন্য একচেটিয়া পুঁজিবাদের পক্ষাবলম্বীরা সর্বদা যন্ত্রণা দিয়ে গেছেন শিল্পীকে। দিনের শেষে শত যুদ্ধে জয়ী ক্লান্ত সৈনিক রামকিঙ্কর গুরুদেব রবীন্দ্রনাথের পদাবলী থেকে বলতেন,
                                    ‘মরণরে তুঁহু মম্‌ শ্যামও সমান...’
       সারা জীবন ধরে অজস্র যন্ত্রণাজয়ী, অক্লান্ত শরীরে বার বার পরাজিতের পথ ছেড়ে জীবনের সঙ্গে হেঁটেছেন হাঁটতে শিখিয়েছেন যাঁদের তাঁরা অনেকেই এখন নিজ গুণে গুরুর পথে চলছেন, জীবনের ছবি আঁকতে আঁকতে।
মানুষের চিত্রী, চিত্রীও মানুষের
        কাদের কাছে অবহেলার রামকিঙ্কর? কারা তাকে দেবতার মতো মাণ্যি করতো? এসব কিছুর উত্তরে সেদিনের অনেকের সাথে ভুবনডাঙা, রূপপুর, ধরলা, ফুলডাঙা, শ্যামবাটির আদিবাসী নারী-পুরুষের কথা তাঁর ছবিতে, ভাস্কর্য জুড়ে গাঁথা আছে। যেমন এঁকেছেন মানুষের চিত্রী রামকিঙ্কর রাধারানীকে তেমনভাবেই ১৯৩৫-এ ছাত্রী ‘জয়া’র চলন্ত মূর্তি বানিয়ে তার মাথার ভাঁড় চাপিয়ে, জগৎ বিখ্যাত ভাস্কর্য কংক্রিটের বুদ্ধর ‘সুজাতা’ হয়েছে। কলাভবনে এখনও খোলা আকা‍‌শের নিচে, কিঙ্করের ‘সুজাতা’, ‘বুদ্ধ’, ‘গান্ধী’, ‘হাতি’, ‘কলের বাঁশি’, পড়ে আছে অযত্নে। কোথাও কোথাও ভেঙেও যাচ্ছে রোদ বৃষ্টির জলের ধারায়। চেতনাহীন বিশ্বভারতী উদাসীন কলাভবন প্রাঙ্গণের এইসব ভাস্কর্য বাঁচাতে। অচেনা কেউ কেউ বিখ্যাত কয়েকটি ভাস্কর্যের মাথাও ভেঙে নিয়ে গেছে। মানুষের চিত্রী রামকিঙ্কর, সেই চিত্রীই মানুষের কাছাকাছি থেকে জীবনের আয়নায় গভীরভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন দারিদ্র্যের লড়াই-সংগ্রামের ছবি।
      কর্মপথের ক্লান্তিহীন দিশায় সেই অভিযানের শুরু। ভারতের প্রাচীন শিল্পকীর্তি দেখে চিত্রকলা, ভাস্কর্য, স্থাপত্যে ভরিয়ে তোলেন সেদিনের শান্তিনিকেতনকে। তারুণ্যের ক্লান্তিহীন কর্মময় জীবনে নালন্দা, রাজগীর, জয়পুর, চিতোর, উদয়পুর দেখে ফিরে এসে মাটির রামকিঙ্কর, রাধারানীকে সঙ্গে নিয়ে প্রথম গোবর-মাটি, আলকাতরায় শ্যামলীতে, পরে কালোবাড়ির দেওয়ালে রিলিফ, বুদ্ধের কাজ। তারপর প্রাধান্য পায় স্ব-আবিষ্কৃত সিমেন্ট-কংক্রিটে ভিন্নমুখী থ্রোইং পদ্ধতিতে ভাস্কর্যের কাজ, প্রকৃত মাটির মানুষের মূর্তি গড়ার কাজ। ভালোবাসার দেওয়ালে মাটির রঙ। 
                 ‘...ওরে নবীন
                                ওরে আমার কাঁচা’ ...
       সেদিনের শান্তিনিকেতনের গ্রামীণ হাটে গোয়ালপাড়া, বাহাদুরপুর, রূপপুর, রায়পুর, রজতপুর, খোয়াই, বল্লভপুর, ডাঙাপাড়া থেকে মানুষজন আসতো বিকিকিনি করতে। হাটে যাওয়ার পথে, ক্যানেলের শাল মহুল বহেরা জঙ্গলের সরু সিঁথিআঁকা ধুলো লাল মোড়ামের পথ দিয়ে খেত থেকে ফেরা আদিবাসী পরিবার— তিনি তন্ময়তার দৃষ্টিতে গভীরে নিয়ে দেখতেন! দেখতেন গরিব মানুষগুলির জীবনযাত্রা। পরে সে সবই ফুটে উঠেছে তাঁর ক্যানভাসের রঙে। কর্মপথের ক্লান্তিহীন দিশা দেখানো প্রাঞ্জল সবুজ মানুষটির শিল্পকর্মজুড়ে শান্তিনিকেতনের সুন্দর আর সেই সুন্দরের মধ্যে গরবে কংক্রিটে ‘সাঁওতাল পরিবার’, ‘ধানঝাড়াই’, ‘বুদ্ধ’ ‘কলের বাঁশি’, ‘মৎস্য-মহিষ’, ‘গান্ধী’ ও ‘তিমি’। এছাড়াও ১৯৪০সালে নির্মাণ করেন ‘আলোর ঝাড়’। অন্তরের অপ্রকাশ্য বাণীতে ছড়িয়ে আছে তাঁর নাম। যিনি প্রত্যক্ষ সহযোগিতা করেন শিল্পকর্ম সৃষ্টির সময় শিল্পীকে তিনি ভুবনডাঙার রাধারানী দেবী। ‘আলোর ঝাড়’ কাজটির একটি গুরুত্ব আছে আমাদের দেশে। এটিই শিল্প ইতিহাসে প্রথম কাজ, অ্যাবস্ট্রাক্ট ভাস্কর্যের ইতিহাসে। সেসময়ই তাঁর ভুবনভাঙার বসতবাড়ি দানপত্র করেছেন রাধারানী দেবীর পালিত কন্যা অলকা অধিকারীর নামে। আমৃত্যু সেখানেই কাটিয়ে যান রাধারানী দেবী। সময় সুযোগ পেলেই সেখানে এসে থাকতেন, শিল্পকর্মে ব্যস্ত হয়ে উঠতেন শিল্পী রামকিঙ্কর। এ বাড়ির পাশেই কালীতলার ভুবনডাঙায় রামকিঙ্করের সহযোগী কৃষ্ণগোপাল রায়, কেষ্টার বাড়ি। জ্যোৎস্না মাখা চাঁদের আলোয় অনেক রাত পর্যন্ত চলতো শিল্পসৃষ্টির কাজ, আলোচনা।
       রামকিঙ্করের পেশাগত জীবনের ভবিষ্যৎ নির্ধারিত হয় ১৯৩৪সালে। তিনি কলাভবনের স্থায়ী শিক্ষক হিসাবে নিয়োজিত হন। ১৯৩৫ এবং ১৯৩৬সালে অনেকগুলি কাজ তিনি শেষ করেন। এই সময়ের গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলোর মধ্যে রয়েছে রিলিফ সাঁওতাল ও মেঝেন, সাঁওতাল দম্পতি, কৃষ্ণগোপিনী, সুজাতা। ১৯৩৭থেকে তিনি ছাত্রদের মডেলিং শেখানোর দায়িত্ব নেন। ওই বছরের মাঝামাঝি সময়টাকে রামকিঙ্করের তেলরঙ পর্বের শুরু ধরা যায়। ১৯৩৭ থেকে ১৯৪২ সালের মধ্যে তিনি অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ তেলরঙ চিত্রের কাজ শেষ করেন। একই সময়ের মধ্যে শেষ হয় তাঁর অনেকগুলি বিখ্যাত ভাস্কর্যের কাজও। তাঁর সৃষ্টিকর্মের কাল বিচারে এটিই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময় বলা যেতে পারে। এই পর্বে করা তাঁর বিখ্যাত ভাস্কর্যগুলির মধ্যে কংক্রিটে তৈরি সাঁওতাল পরিবার, প্লাস্টারে করা রবীন্দ্রনাথের প্রতিকৃতি ভাস্কর্য পোয়েটস্ হেড, সিমেন্ট দিয়ে হেড অব এ উওম্যান, বাতিদান অন্যতম।
       আজও সংস্কারহীন ঘরে বসে সেদিনের স্বপ্ন দেখেন অলকা অধিকারীরা। ঘর ভর্তি শিল্পীর বিভিন্ন শিল্পকর্ম। কোনোটা শেষ, কোনোটা শেষ হয়নি এখনও...! কেবল প্রতীক্ষা কবে আলো আসবে ভাঙা ঘরে! যে ঘরে জীবনের অনেকগুলি দিন কাটিয়ে গেছেন রামকিঙ্কর।
        রামকিঙ্করের কাজের একটি অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য গতিশীলতা । এটা তাঁর ছবি এবং ভাস্কর্য উভয়ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। তাঁর ছবি এবং ভাস্কর্যের প্রায় সকল আকৃতিই গতিশীল। কেউই থেমে নেই। তাঁর বড় ভাস্কর্যের বেশির ভাগই উন্মুক্ত জায়গায় করা। এটা তাঁর ভাস্কর্যের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। খোলা আকাশের নিচে রোদ-বৃষ্টি, আলো হাওয়া গায়ে মেখে প্রকৃতির সাথে মিলেমিশে ওগুলোর অবস্থান। রামকিঙ্করের গুরুত্বপূর্ণ ভাস্কর্যগুলোর অনেকগুলোই শান্তিনিকেতনে। ইউক্যালিপটাস গাছের সারির ভেতর ‘সুজাতা’ কিংবা কলাভবনের ‘সাঁওতাল পরিবার’, ‘বাতিদান’ পারিপাশ্বিকতার মধ্যে মিলেমিশে অন্যরকম এক দ্যোতনা সৃষ্টি করেছে। তবে শান্তিনিকেতনের এই ভাস্কর্যগুলি নির্মাণের সময় কিংবা নির্মাণ পরবর্তীকালে আশ্রমের সবাই যে এগুলোকে ভালোভাবে গ্রহণ করেছিলেন তা কিন্তু নয়। অনেক সময় তাঁর কাজ নিয়ে বিতর্কও উঠেছে।
        আলোর গন্ধের দৌড়ে, গ্রামের ছেলেটি বিশ্বভারতীতে প্রথম দিকে কাজ শুরু করেন প্রতিকৃতি নির্মাণ দিয়ে। সে সময়ের কাজে ধরা পরে উস্তাদ আলাউদ্দিন, গাঙ্গুলি মশাই, অবনীন্দ্রনাথরা। সেদিনের কাজে বেশকিছু রিলিফের কাজও করতে শুরু করেন। টুকরো টুকরো ছবি বুকে রামকিঙ্কর জন্মভিটে বাঁকুড়ার যুগিপাড়া থেকে ১৯২৫-এ শান্তিনিকেতনে চলে আসেন। ১৯০৬ সালে ২৬শে মে, বাবা চণ্ডীচরণ ও মা সম্পূর্ণা দেবীর কোলে রামকিঙ্করের জন্ম। বড় অভাবী পরিবার, ক্ষৌরকর্মই জীবিকা। মামার বাড়ি বিষ্ণুপুরের কাদাকুলি যাওয়ার পথে, সূত্রধরদের বাস। সেসময়ই অনন্ত সূত্রধর নামের এক মিস্ত্রির কাছে শিল্পী রামকিঙ্করের মূর্তি গড়ার প্রথম পাঠ। সেসময় বিষ্ণুপুরের মন্দিরের কাজও তাঁকে টেনেছে। মন্দিরের পোড়ামাটি আর পাথরের কাজের নকল করেই শিল্পীর পথ চলা শুরু।
       লেখাপড়া যতটুকু করেছেন তাতে সাধারণ প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়ার প্রতি তাঁর ঝোঁক ছিল না। ছবি আঁকা আর মূর্তি গড়াতে ছিল তাঁর আসল মনোযোগ। বাড়িতে লেখাপড়া করতে বসলে লেখাপড়ার কথা ভুলে শুরু করে দিতেন ছবি আঁকা। বাড়ির দেওয়ালে ঝোলানো দেবদেবীর ছবিগুলি দেখে দেখে আঁকতেন প্রায়শই। আর্থিক অনটনের কারণে কিশোর রামকিঙ্করের হাতে নরুন দিয়ে বসিয়ে দেওয়া হয় দোলতলার এক গাছতলায়; যদি কিছু আয় হয়। কিন্তু ক্ষৌরকর্ম বাদ দিয়ে নরুন দিয়ে গাছের গায়ে অনুবাদ করে চলেন তাঁর মনে তৈরি ছবি। ছেলেবেলাতে রামকিঙ্কর এঁকেছেন সাইনবোর্ড, নাটকের মঞ্চসজ্জার ছবি।
        সময় পেলেই রামকিঙ্কর গল্প করতেন রাধারানীর পালিত কন্যা অলকার কাছে, ভুবনডাঙাতে থাকাকালীন। বর্তমানে ভুবনডাঙার সেই বাড়িতেই থাকেন রাধারানীর পালিত কন্যা অলকা আধিকারী ও তাঁর দুই পুত্র। বহু স্মৃতি বিজড়িত রামকিঙ্করের দান করা বাড়িতেই অভাবের সঙ্গে লড়াই করছেন শিল্পী সত্যকিঙ্কর অধিকারী। অলকার বড় পুত্র। তাঁদের বাড়িতেই বসে এঁকেছেন চিত্রী রামকিঙ্কর। সেই সব দুষ্প্রাপ্য ছবি এখনও বর্তমান তাঁদের কাছে। আছে বেশ কিছু ভাস্কর্যও।
                            ‘ফিরে চল মাটির টানে…’
প্রবাসী পত্রিকার সম্পাদক রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় তাঁকে চিঠিতে লিখেছিলেন শান্তিনিকেতনে যেতে। কিন্তু বাঁকুড়ার অজ গাঁয়ের উনিশ বছরের এই যুবক পথঘাট কিছুই চেনে না। পথ ভুল করে অনেক ঘুরতি পথ পেরিয়ে শেষ পর্যন্ত পৌঁছলেন তিনি শান্তিনিকেতনে। উনিশশো পঁচিশ সালের কথা সেটা। সেদিন তিনি সাথে করে নিয়ে এসেছিলেন তাঁর আঁকা কয়েকটা ছবি আর হয়ত অনির্দিষ্ট কোন স্বপ্ন। ছবিগুলো দেখে নন্দলাল বলেছিলেন ‘তুমি কি করতে এখানে এলে, এত সব করে ফেলেছ। আর কী শিখবে? যাহোক যখন এসেই গেছো এখানে, তখন থাকো কিছুদিন’। সেই সময় তাঁর আর্থিক অবস্থা খুবই খারাপ। শিল্পাচার্য নন্দলাল বসুর চেষ্টায় কিছু বই অলঙ্করণের কাজ পান তিনি। এতে করে তাঁর মোটামুটি চলে যায়। ওই সময় তাঁর কিছু ছবিও বিক্রি হয়েছিল প্রদর্শনীতে। শান্তিনিকেতনে প্রথম দু‘বছর কাজ করার পর তিনি ছাত্রদের শেখাতে শুরু করেন। এভাবেই রামকিঙ্করের শান্তিনিকেতনে আসা আর শান্তিনিকেতনের শিল্পী রামকিঙ্কর হয়ে যাওয়া। বাকী সারা জীবনে শান্তিনিকেতন ছেড়ে তেমন কোথাও যাননি। দিল্লি, বোম্বে এমনকি কলকাতায়ও গেছেন খুব কম। শুধুমাত্র একবার গেছেন নেপাল। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন দেশের আমন্ত্রণ পেলেও আর কখনো বিদেশ যাননি তিনি।
                  ‘হারিয়ে গেলে মনের মানুষ
                                   খুঁজলে মেলে না।’
        এ যুগের স্বনামধন্য শিল্পীরা বার বার ছুটে আসেন অভাবের সুযোগ নিয়ে, শিল্পী রামকিঙ্করের সেইসব অপ্রকাশিত ছবি ও কাজগুলো নিয়ে যাওয়ার জন্য। কিন্তু পেটে খিদে নিয়েও সেইসব কাজগুলোকে আঁকড়ে বেঁচে ভুবনডাঙার অলকা। বাড়িতে জল পড়ে ছাদ থেকে, বার বার জানিয়েও উদাসীন বিশ্বভারতী কর্মীপক্ষ। সত্যকিঙ্কর শিল্পী দিনকর কৌশিকের কাছে বেশ কিছু দিন কাজ করলেও তাঁর কোনো স্থায়িত্ব হয়নি। তাঁদের ভুবনডাঙার এই বাড়িতেই জীবনাবসান হয় রাধারানীর। এই বাড়িতেই বসে রাধারানীর মডেল, ভুবনডাঙার খুদুর মডেল বিশ্বে প্রচারিত, সুনাম কিনেছে। আবার এই ভুবনডাঙার বাড়িতেই জীবনের শেষ কটা দিন কাটিয়ে যান শিল্পী রামকিঙ্কর বেইজ। ১৯৭০সালে তিনি গুরুতর অসুস্থ হলে আলিপুরের এক বেসরকারী হাসপাতালে ভর্তি করা হয় তাঁকে, এখান থেকেই। সেবার সুস্থ হয়ে ফিরলেও দ্বিতীয় বার আর এক কঠিন ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে পশ্চিমবঙ্গের বামফ্রন্ট সরকারের ব্যবস্থায় ১৯৮০সালের ২০শে মার্চ কলকাতার এস এস কে এম হাসপাতালের উডবার্ন ওয়ার্ডে ভর্তি করা হয়। এই সময় বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষ বাঁকুড়ায় শিল্পীর ভাইপো দিবাকর বেইজের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। ইস্ট ইন্ডিয়া ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানি বিনা ব্যয়ে সেদিন ওষুধ সরবারাহ করে, ২৬শে জুলাই তাঁর অস্ত্রোপচার হয়। কলাভবন থেকে শেষবারের জন্য কাঞ্চনবাবু, রাধারানী ও তাঁর জামাতা অবনী অধিকারী দেখা করতে এসে কিছুক্ষণ ছিলেন। ১৯৮০-২রা আগস্ট মধ্যরাতে বিংশ শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ শিল্পীর জীবনাবসান হয়। সত্যকিঙ্কর অধিকারী অভিযোগ করেন ‘‘শিল্পীর মৃত্যুর পর দিদাকে কোনো গুরুত্ব দিত না বিশ্বভারতী। মার অসুখে বাবার মৃত্যুর সময়ও বিশ্বভারতীর হাসপাতালে চিকিৎসাও করতে দেয়নি কর্তৃপক্ষ। কেবল লোভ দেখাচ্ছে রামকিঙ্করের হাতের কাজগুলো যাতে দিয়ে দিই। খুব অভাব, মাঝে মাঝে মনে হয় কী হবে। বেচেই দিই। ভাতের চাল জুটবে ক’মাসের!’’ তবুও বিক্রি করতে পারেন না তিনি, এই স্মৃতিটুকুই তাঁদের সম্পদ। 
  রামকিঙ্করের আরও কিছু সৃষ্টি :- 
   প্লাস্টারে করা মা ও ছেলে (১৯২৮), কচ ও দেবযানী (১৯২৯), মিথুন-১ (১৯৩১), মিথুন-২(১৯৩১), মিথুন-৩(১৯৩১), সাঁওতাল-সাঁওতাল রমণী(১৯৩৫), সাঁওতাল দম্পতি (১৯৩৫), আলাউদ্দিন খাঁ(১৯৩৫), কংক্রীটে করা সাঁওতাল পরিবার(১৯৩৮), প্লাস্টারে করা রবীন্দ্রনাথের বিমূর্ত ভাস্কর্য (১৯৩৮), সিমেন্টে করা রবীন্দ্রনাথের আরও একটি ভাস্কর্য (১৯৪১), হার্ভেস্টার (১৯৪২), ফেমিন (১৯৪৩), সাঁওতাল নাচ (১৯৪৩), অবনীন্দ্রনাথ (১৯৪৩), সিমেন্টে করা কুলি মাদার (১৯৪৩-৪৪), বিনোদিনী (১৯৪৫), বুদ্ধ (১৯৪৬-৫০), সিমেন্টের দ্য মার্চ (১৯৪৮), ডাণ্ডি মার্চ (১৯৪৮), লেবার মেমরি (১৯৪৮), মা ও ছেলে (১৯৪৯), স্পিড অ্যান্ড গ্রাভিটি (১৯৪৯), শূকর (১৯৫২), পিতা-পুত্র ( ১৯৫২), মিলকল (১৯৫৬), গান্ধী (১৯৫৭), শার্পেনার (১৯৫৮), ম্যান অ্যান্ড হর্স ( ১৯৬০), সুভাষচন্দ্র বসু (১৯৬০-৬১), হর্স হেড (১৯৬২), মহিষ-১ (১৯৬২) কাক ও কোয়েল (১৯৬২), আগুনের জন্ম (১৯৬৩), যক্ষী-১১ (১৯৬৩) মহিষ ও ফোয়ারা (১৯৬৩), মাছ (১৯৬৪), তিমি মাছ (১৯৬৫), নৃত্যরতা নারী (১৯৬৫), লালন ফকির (১৯৬৫), যক্ষ যক্ষী (১৯৬৬), প্রেগন্যান্ট লেডি (১৯৬৭-৬৯), বলিদান (১৯৭৬), রাজপথ (১৯৭৭), রেখা, কলেজ গার্ল, গণেশ, সিটেড লেডি, মা ও শিশু, কুকুর, মা, সেপারেশন, রাহুপ্রেম, প্যাশন, ত্রিভুজ, দ্য ফ্রুট অব হেভেন, হাসি, বন্ধু।
সৌজন্যেঃ- গণশক্তি (সম​য়ের সাথে)

স্বপ্নের ভিয়েতনাম

  স্বপ্নের ভিয়েতনাম  

দীপক নাগ

ভিয়েতনামের স্বপ্ন এখনও বহু মানুষকে দোলা দেয়। সেই স্বপ্ন আর বাস্তব ফুটে উঠেছে তাঁর লেখায়।

‘‘তোমার নাম আমার নাম, ভিয়েতনাম — ভিয়েতনাম’’। গত শতাব্দীর ছয়-সাতের দশকে যাদের ছাত্র জীবন কেটেছে, তাদের পক্ষে এই স্লোগানটি একেবারে ভুলে যাওয়া সম্ভব নয়। ভিয়েতনামের স্বপ্ন এখনও তাদের মনে দোলা দেয়। ভিয়েতনামের শ্রমিক আন্দোলনের নেতা নগুয়েন ভিয়েত জুই-র সঙ্গে ইন্টারনেটের মাধ্যমে বছর খানেক ধরেই ভিয়েতনাম প্রসঙ্গে নানা পত্রালাপ চলছিল। সি আই টি ইউ-র নেতা প্রশান্ত নন্দীচৌধুরী মারফত জুই-র সঙ্গে যোগাযোগ। ভিয়েতনামীদের নামে সাধারণত তিনটি অংশ থাকে। আমরা যাকে পদবি বলি সেটা থাকে প্রথমে। তাকে ওরা বলে পারিবারিক নাম। মাঝের অংশ তার গোষ্ঠী। নাম থাকে সবার শেষে। ওঁর সাথে কথা বলেই স্ত্রী অঞ্জনাসহ ২৭শে মার্চ রওনা দিলাম হ্যানয়ের পথে। 

আমরা বলি ভিয়েতনাম। আসলে ‘ভিয়েত’ এবং ‘নাম’ দুটো আলাদা শব্দ। ভিয়েত একটা জনগোষ্ঠী, যারা চীনেই বসবাস করতেন। নাম কথাটির অর্থাৎ দক্ষিণ। অর্থাৎ ভিয়েতগণ চীন থেকে সরে গিয়ে তার দক্ষিণ দিকের অঞ্চলে বসবাস শুরু করেন। আবার ‘হা’ এবং ‘নয়’ — এই দুটো আলাদা শব্দ থেকেই হ্যানয় কথাটি চালু হয়েছে। নামের ব্যাপারে ভিয়েতনামীদের একটা বিলাসিতা আছে। অন্তত ১৫ বার ভিয়েতনামের নাম পরিবর্তন হয়েছে। বিমানবন্দর থেকে বেরোতেই দেখি নামের প্ল্যাকার্ড হাতে গাইড বু চু দাঁড়িয়ে আছে। ২৬-২৭ বছরের যুবক। বিনয়ী এবং ভদ্র। ওর পরামর্শ মতোই বিমানবন্দরেই আমেরিকান ডলার ভাঙিয়ে ভিয়েতনামী মুদ্রা ডং নিয়ে নিলাম। ভিয়েনামী সব মুদ্রাতেই হো চি মিনের ছবি। মোটামুটিভাবে ২০০০০ ডং-এ এক ডলার। দু’শ থেকে পাঁচ লক্ষ পর্যন্ত ডংয়ের নোট আছে। ২০০ থেকে ৫০০০ পর্যন্ত কয়েন আছে, তবে সাধারণভাবে কোথাও ব্যবহার করতে দেখা যায় না। সরকারী সংস্থা ছাড়া হাটে-বাজারে সবখানেই ডলার চলে। রিকশাচালকও প্রয়োজনে ডলার ভাড়া নেয় এবং বাড়তি অংশ ফেরত দেয়। 

দুপুরে একাই পায়ে হেঁটে বহু ঘটনার সাক্ষী বিখ্যাত হোয়ান কিয়েম লেকের পাশ দিয়ে ট্র্যাঙ টিয়েন স্ট্রিটের বই পাড়ায় গেলাম। ছোট ছোট গলির মতো রাস্তায় নাম লেখা সাইনবোর্ড। হোটেল থেকে একটা ম্যাপ দিয়ে দিয়েছিল। ভিয়েতনামী হরফ ল্যাটিন থেকে নেওয়া। আগে চীনা ভাষায় সব কিছু থাকলেও ১৫২৭সাল থেকে পর্তুগিজ ক্রিশ্চান মিশনারিরা এই হরফ শুরু করেন। রোমান হরফ থাকার ফলে লেখা দেখে আন্দাজ করা যায়। জিজ্ঞেস করতে করতে ঠিক জায়গায় পৌঁছে গেলাম। ভিয়েতনামীদের একটা বৈশিষ্ট্য হলো, প্রায় সবাই বেশ হাসিখুশি ও সহজ-সরল। বিনা বিরক্তিতে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়। আমাদের কলেজ স্ট্রিটের মতো অতো বড় না হলেও পুরো এলাকায় শুধু বইয়ের দোকান। তবে একেকটা দোকান আয়তনে বিশাল। কয়েকটা আবার দোতলা-তিনতলা বাড়ি। বইতে ঠাসা। কলকাতায় এত বড় বইয়ের দোকান দেখিনি। ইংরাজী ভাষায় ছাপানো বইগুলো আলাদাভাবে রাখা হয়েছে। হ্যানয়ের মতো হো চি মিন সিটিতেও বড় বড় বইয়ের দোকান। তবে ইংরাজীতে চিরায়ত মার্কসীয় বই খুব একটা চোখে পড়লো না। 

হোয়ান কিয়েম (ফিরতি তরবারি) লেককে হ্যানয়ের কেন্দ্রভূমি বলা হয়। একে ঘিরেই প্রশাসনিক কেন্দ্র গড়ে উঠেছে। বিকেলে দেখলাম বহু মানুষ বেড়াতে এসেছেন। যুবক-যুবতীর সংখ্যাই বেশি। এঁরা খুব সৌন্দর্যপ্রিয়। সেজেগুজে থাকতে ভালবাসেন। হ্যানয়ের বিখ্যাত ফুলের বাজারে সারা রাত বেচাকেনা হয়। বইয়ের দোকানেও ফুল দিয়ে সাজিয়ে রেখেছে। লেকের পাশেই বিখ্যাত শহীদবেদী। নিচে খোদাই করা হো চি মিনের সেই বিখ্যাত আহ্বান — ‘‘পিতৃভূমিকে রক্ষা করতে সাহসী মৃত্যুর জন্য দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হও’’। রান্না করা এবং ছেলেমেয়ে সামলানো ছাড়াও ভিয়েতনামের মেয়েরাই মূলত হাটবাজার করার দায়িত্ব পালন করে থাকেন। দেখলাম মেয়েরাই বেশিরভাগ দোকান চালাচ্ছেন। বু জানালো, এখানে শারীরিক দিক থেকে খুব পরিশ্রমের বা ভারী কাজ ‍ছেলেরা করেন। মেয়েরা তুলনামূলকভাবে কম পরিশ্রমের কাজ করেও যথেষ্ট উপার্জন করেন। তাই কোন কোন গোষ্ঠীর মধ্যে এমন প্রথা চালু আছে যে, ছেলের বাবা বিয়ের আগে মেয়ের বাবাকে মদ ও নগদ টাকা উপহার হিসেবে দেবেন। দর কষাকষি করে টাকার পরিমাণ ঠিক হয়। ওর বাবাও তাই করেছিলেন। ভিয়েতনামে এমন কথা চালু আছে, ‘একাধিক মেয়ের বাবা কখনও গরিব হয় না আর একাধিক ছেলের বাবা কখনও ধনী হয় না’। জুইয়ের কাছে জানলাম, সরকারী নিয়ম অনুসারে (তিন থেকে পাঁচ বছর অন্তর) দু’জন ছেলেমেয়ের মধ্যেই পরিবার সীমিত রাখতে হয়।

২৯তারিখ সকালে বু প্রথমে নিয়ে গেল হো চি মিন মসোলিয়াম দেখতে। ছোট ছোট অনেক ছেলেমেয়েসহ স্কুলের শিক্ষিকা এবং গ্রাম থেকে আসা বহু সাধারণ মানুষের লম্বা লাইন। জিজ্ঞাসা করে জানা গেল প্রতিদিন গড়ে প্রায় পাঁচ হাজার দর্শক বাক (আস্কল) হো-কে শ্রদ্ধা জানা‍‌নোর জন্য আসেন। প্রত্যেক ভিয়েতনামী জীবনে অন্তত একবার এখানে আসার চেষ্টা করেন। মসোলিয়ামে হো চি মিনের সেই বিখ্যাত উক্তিটি চোখে পড়লো — ‘‘স্বাধীনতা ও মুক্তির চাইতে মূল্যবান আর কিছু নেই।’’ নিঃশব্দে সবাই ঢুকছে। চলতে চলতেই দেখলাম চিরনিদ্রায় শায়িত সেই মহাসংগ্রামী। মিউজিয়াম ও রাষ্ট্রপতির বাড়ি (বাক বো প্যালেস) পাশাপাশি। ফরাসি শাসকদের জন্য তৈরি সেই বাড়িতে হো চি মিন বাস করেননি। তিনি ফরাসী শাসকদের সাধারণ কর্মচারীদের থাকার জন্য ছোট্ট একটা দোতলায় বছর চারেক বাস করেছেন। তারপর ১৯৫৮থেকে তার পাশেই আর একটা দু’কামরাওয়ালা ছোট্ট কাঠের দোতলা বাড়িতে আজীবন থেকেছেন। নিচতলাটা ফাঁকা। অনেকটা আমাদের উত্তর বাংলার চা বাগান, বনাঞ্চল ও পাহাড়ী এলাকার কাঠের বাড়ির মতো। ওরা বলে ‘প্ল্যাম্বিং ঘর’। ভিয়েতনামের প্রায় সব গ্রামীণ এলাকাতেই এই ধরনের বাড়ি দেখা যায়। লাল রঙ এদের খুব পছন্দ। এমনকি শহরের আধুনিক তিন-চারতলা বাড়ির ছাদগুলোও লাল রঙের সিমেন্টের টালি দিয়ে তৈরি। সামনের দিকটা প্যাগোডার মতো তিনকোণা কাঠামো। কাঠের বাড়িটির সামনেই বিরাট একটা পুকুর। খুব ছেলেবেলায় নিজের গ্রামে হো চি মিন নাকি পুকুরে মাছ ধরা দেখতে খুব ভালবাসতেন। পুকুরঘাটে দেখলাম প্রচুর মাছ খাবার জন্য এসে জড়ো হয়েছে। বাচ্চারা সব ভিড় করে মাছ দেখছে। একটা সাইনবোর্ড দেখিয়ে গাইড বললো, এখানে বসেই প্রতিদিন নিয়ম করে আঙ্কল হো মাছকে খাবার দিতেন। আর দুটো জিনিস তাঁর প্রিয় ছিল — ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের সাথে সময় কাটানো এবং অফিসের পর বাগান পরিচর্যা করা।

হা লঙ বে

২৯তারিখ বিকেলে গেলাম ‘হা লঙ বে’ দেখতে। হা লঙ বে ভিয়েতনামের গর্ব। রাতে হোটেলের বারান্দায় বসে জলের ওপর ভেসে থাকা নৌকোর আলোগুলোকে কেমন যেন দূর আকাশের তারার মতো অসীম মনে হচ্ছিল। হা লঙ সিটি হ্যানয় থেকে দেড়শো কিলোমিটারের মতো দূরে। ‘ন্যাচারাল হেরিটেজ’ হিসেবে ইউনেস্কো বে-কে স্বীকৃতি দিয়েছে। আমাদের সুন্দরবন এলাকার নৌকো (ভটভটি)-র মতো মোটরচালিত সুন্দর ছোট্ট নৌকোতে ঘণ্টাখানেকের মতো সময় ধরে জলের মধ্যে পাহাড়ের চারপাশে ঘোরায়। নৌকোগুলোকে ওরা বলে থুয়েন বা জুয়েন। ছোট ছোট অসংখ্য টিলা। স্থানীয় মানুষেরা নানা নামে ওদের চিহ্নিত করে। তার মধ্যে ‘কিসিং ককস’-র ছবি‍‌ তো হা লঙের প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে। হা লঙ বে যেন সৌন্দর্যের ডালি নিয়ে বসে আছে। জলের মধ্যেই জেলেদের চারটি ভাসমান গ্রাম আছে। নৌকোতেই ওদের বসবাস। ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা নৌকোতে করে এসে নানা ধরনের ফল বিক্রি করে। নৌকোতেই বাজার। তবে ওভাবে বসবাস করলে‍‌ও ওদের চেহারায় বা জামাকাপড়ে দারিদ্র্যের ছাপ চোখে পড়লো না। একটা পাহাড়ের মধ্যেই হাঙ দাও গো নামক গুহা। এটা যেন আলিবাবার সেই গুহা। চুনা পাথরের ওপর আলো পড়ে মণিমানিক্যের দ্যুতি যেন চারদিকে ঠিকরে বেরোচ্ছে। 

হ্যানয় থেকে হা লঙ যাতায়াতের পথে বেশ কয়েকটি হস্তশিল্পের কারখানা দেখলাম। ৫০-৬০জন করে মহিলা শ্রমিক কাজ করছেন। আমাদের এখানে জরি শিল্পে যেমন ‘থাডা’ বানিয়ে কাজ করা হয়, অনেকটা সেরকম জিনিসের মধ্যে কাপড় রেখে নানারকম কাজ করা হচ্ছে। জুইয়ের দেওয়া তথ্য থেকে জানতে পারলাম বিভিন্ন ক্ষেত্র মিলিয়ে ভিয়েতনামে শ্রমিকের সংখ্যা প্রায় ৮২লক্ষের মতো। তার মধ্যে ৪৩শতাংশই নারী। মজুরির ক্ষেত্রে নারী ও পুরুষ শ্রমিকের মধ্যে কোন ফারাক নেই। কোথাও শিশু শ্রমিক চোখে পড়েনি। ১৯৮৬সাল থেকে ভিয়েতনামে অর্থনৈতিক সংস্কারের কাজ শুরু হয়েছে। ওদের ভাষায় বলা হয় ‘দই মই’। সেখানে সমাজতান্ত্রিক ধাঁচের বাজার অর্থনীতি গড়ে উঠেছে। সারা ভিয়েতনামে প্রায় দু’লক্ষ বেসরকারী মালিকানায় পরিচালিত ব্যবসা বা কারখানা গড়ে উঠেছে। প্রত্যক্ষ বিদেশী বিনিয়োগ ভিয়েতনামে স্বীকৃতি পেয়েছে। কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যরাও ব্যক্তিগত উদ্যোগে ব্যবসা-বাণিজ্য করতে পারেন। দশম পার্টি কংগ্রেসের (২০০৬) আগে পার্টি সদস্যদের ব্যবসার ক্ষেত্রে ‘শোষণ ছাড়া’—কথাটি ছিল। এই কংগ্রেসে কমিউনিস্ট পার্টির গঠনতন্ত্র সংশোধন করে এই শব্দটি তুলে দেওয়া হয়েছে। দীর্ঘদিন ফরাসী ও পরে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের আক্রমণে বিধ্বস্ত, ৯কোটির কিছু বেশি মানুষের অনেক পিছিয়ে পড়া, আয়তনে পশ্চিমবঙ্গের চাইতে কিছুটা বড় এই ছোট্ট দেশটি সব দিক থেকেই নিজের পায়ে দাঁড়াতে চেষ্টা করছে। ভিয়েতনামের উন্নতি ঘটেছে। কিন্তু কিছু কুফল যেন উঁকি মারতে চাইছে। বিভিন্ন মানুষের সঙ্গে কথা এবং নিজের অভিজ্ঞতার মাধ্যমে এরকম মনে হয়েছে। বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে হয়তো ভুল বোঝার জন্য কিছু অসন্তোষ তৈরি হয়েছে। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী ষড়যন্ত্রমূলক অপপ্রচার এর জন্য অনেকটাই দায়ী বলে মনে হলো। ইন্টারনেট বা ফেসবুকের মাধ্যমে মার্কিনীরা সমাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে এই ষড়যন্ত্র করছে। হো চি মিন সিটির গাইড লক নিজেই একথা স্বীকার করলো। এমনকি হো চি মিন সম্বন্ধেও অশ্রদ্ধা জন্মানোর জন্য মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ নতুন প্রজন্মের কাছে মিথ্যা তথ্য প্রচার করে। তবে ভিয়েতনাম কমিউনিস্ট পার্টি এবিষয়ে যথেষ্ট ওয়াকিবহাল। নবম ও দশম পার্টি কংগ্রেসের সময়কালে দুর্নীতি বা অন্যান্য কারণে প্রায় ৪০০০০পার্টি সদস্যের বিরুদ্ধে কড়া ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।

সোনালি পদ্ম

হো‍ চি মিন আজও ভিয়েতনামবাসীদের কত প্রিয়, তা বোঝা গেল এই অবিসংবাদী নেতার জন্মভিটায় গিয়ে। হ্যানয় থেকে দক্ষিণ দিকে ৩১০ কিলোমিটার দূরে ন্‌ঘে অ্যান প্রভিন্সে হোয়াঙ ট্রু গ্রাম। এখানেই মার বাবার বাড়িতে ১৮৯০সালে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। 

একটা প্রায় ধ্বংসস্তূপ থেকে গড়ে ওঠা দেশ সমাজতান্ত্রিক কাঠামোতে কত তাড়াতাড়ি গড়ে উঠতে পারে, হ্যানয় থেকে কিম লিয়েন যাতায়াতের পথে ভিয়েতনামের গ্রামগুলো দেখে তার প্রমাণ মেলে। গরিব মানুষ আছেন। তবে ৬০০কিলোমিটার পথ চলার পথে প্রকট দারিদ্র্যের চিহ্ন কোথাও চোখে পড়লো না। পথের দু’ধারে দোকান। সংসার সামলে বাড়ির মেয়েরাই দোকান চালান। মাঝে মাঝে কারখানা থাকলেও চওড়া ও মসৃণ পথের দু’ধারেই সবুজ ধানের খেত। হাতে গ্লাভস ও পায়ে গামবুট পরে কেউ মোষ চড়াচ্ছেন। গোটা দেশে ২কোটি টনের মতো ধান হয়। ৫০লক্ষ টন ধান বিদেশে রপ্তানি করা হয়। সরকারী হিসেব অনুযায়ী ভিয়েতনাম রপ্তানি বা‍‌ণিজ্যের ক্ষেত্রে কফি ও কাজুবাদামে দ্বিতীয়, রাবারে চতুর্থ এবং গোলমরিচে প্রথম স্থানের অধিকারী।

বিকেলের দিকে হোয়াঙ ট্রু গ্রামে পৌঁছলাম। প্রতিদিনই বহু দেশী-বিদেশী পর্যটক এখানে আসেন তালপাতার ছাউনি আর বাঁশ ও কাঠ দিয়ে তৈরি মাটির মেঝের ওপর দু’কামরাওয়ালা বাড়িটি দেখতে। রাষ্ট্রপতি হওয়ার পরও দু’বার হো চি মিন তাঁর গ্রামে এসে ছেলেবেলার স্মৃতি রোমন্থন করেছেন। চারদিকে গাছপালা দিয়ে ঘেরা বাড়িটি এখনও একইরকম রাখার চেষ্টা করা হয়। এর কাছেই হো চি মিনের মা হোয়াঙ থি লোন (১৮৬৪-১৯০১)-এর স্মৃতিসৌধ। হোয়াঙ ট্রু থেকে মাত্র তিন কিলোমিটার দূরে কিম লিয়েন। কিম লিয়েন কথাটির অর্থ ‘সোনালি পদ্ম’। মামার বাড়িতে জন্ম হলেও মার মৃত্যুর পর হো চি মিন কয়েক বছর এই গ্রামে এসে থেকেছেন। সোনালি পদ্ম এখন আর দেখা না গেলেও এলাকায় এখনও অনেক পুকুর রয়ে গেছে। 

হো চি মিন সিটি

৩রা এপ্রিল রাতে হো চি মিন সিটি (সায়গন) পৌঁছলাম। রাতের হো চি মিন সিটি দেখে চমকে যেতে হয়। মনে হলো চারুচিক্যের দিক থেকে হ্যানয় যদি উত্তর কলকাতা হয়, তাহলে হো চি মিন সিটি নিউ টাউন বা রাজারহাট। দক্ষিণ ভিয়েতনাম মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধে জয়লাভ করেছে ১৯৭৫ সালে। ৪০বছরেরও কম সময়ে উন্নয়নের কোন পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া যায়, এই শহর তার অন্যতম প্রমাণ। পরদিন সকালেই রওনা দিলাম বিখ্যাত কু চি টানেলের দিকে। শহর থেকে ৩৫কিলোমিটার দূরে চারদিকে রবার গাছ ও অন্যান্য গাছের জঙ্গল দিয়ে ঘেরা কু চি। গাড়িতে যেতে যেতে নানা কথাবার্তার মধ্যে ভিয়েতনামের শিক্ষাব্যবস্থা সম্বন্ধে কিছু জানার চেষ্টা করলাম। এদেশে ক্লাস নাইন পর্যন্ত শিক্ষা বাধ্যতামূলক। সাধারণভাবে শিক্ষা অবৈতনিক নয়। তবে গরিব ছাত্রছাত্রীদের বিনা পয়সায় পড়ার ব্যবস্থা আছে। প্রথম থেকেই ইংরাজী পড়ানো হয়। ১৫বছরের ওপরে দেশবাসীর সাক্ষরতার হার ৯৪শতাংশ। এর মধ্যে পুরুষের হার শতকরা ৯৭ আর মেয়েদের হার একটু কম— শতকরা ৯২। কু চি টানেল পৃথিবীর সবচাইতে যুদ্ধবাজ দেশ আমেরিকাকে বিস্মিত করেছে। ওপরে ছোট্ট একটা গর্ত। অনেকটা রাস্তার ম্যানহোলের মতো। কিন্তু গর্তে নামার পরই নয়-দশ ফুট গভীরে বিভিন্ন সুড়ঙ্গ আঁকাবাঁকা নানা গলি দিয়ে কোথায় যেন চলে গেছে! হাত ওপরের দিকে তুলে নামতে হয়। একটু মোটা মানুষের পক্ষে ঢোকা খুব কঠিন। নামতে চাওয়ায় একজন পুলিস টর্চ হাতে আমাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে চললো। একটু লম্বা মানুষকে প্রায় হামাগুড়ি দিয়ে এগোতে হয়। দম প্রায় বন্ধ হয়ে আসে। ভাবলাম কী পরিমাণ সাহস ও দেশপ্রেম থাকলে দেখতে ছোটখাট মানুষগুলো একনাগাড়ে কয়েকদিন এভাবে টানেলে থেকে মার্কিনী শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াই করে জয়ী হতে পেরেছে!

মাটির নিচে হাসপাতাল, সভাঘর, অস্ত্র বানানোর কারখানা ও রান্নাঘর ইত্যাদি সবই আছে। দেখলাম রান্নাঘরের এককোনে উনুনে আগুন জ্বলছে। লক একটু দূরের দিকে আঙুল দেখিয়ে বলে, ‘‘ঐ দেখুন।’’ দেখলাম উনুন থেকে বেশ কিছুটা দূরে ধোঁয়া বেরুচ্ছে। ধোঁয়া দেখে মার্কিনী হানাদারেরা বোমা না ফেলতে পারে, তার জন্যই এই ব্যবস্থা। লক বললো, আমার মা ছোটবেলাতে আমাদের বলতেন, ‘‘রান্নার সময় যাতে ধোঁয়া না বেরোয়’’। ভিয়েতনামের মেয়েরা নাকি এখনও ঐ নিয়ম মেনে চলার চেষ্টা করেন। মূলত ছোট ছোট ছেলেমেয়ে ও মহিলারাই টানেলগুলো তৈরি করেছেন। কারণ পূর্ণবয়স্ক পুরুষের পক্ষে একটা ছোট্ট কোদাল ও ঝুড়ি নিয়ে ন-দশ ফুট গভীরে গিয়ে অতো ছোট গর্তের মাটি কাটা খুব কঠিন। টানেলের চার পাশের পাতা ফাঁদে আটকানো মার্কিনী ট্যাঙ্ক প্রদর্শনীর জন্য রেখে দেওয়া হয়েছে। ভিয়েতনামের বিখ্যাত রাইস পেপার তৈরির বিষয়টাও এখানে পর্যটকদের দেখানো হয়। চালের গুড়ো দিয়ে রুমালি রুটির চাইতেও পাতলা করে উনুনের ওপর উলটো কড়াইয়ে সেঁকে রোদ্দুরে শুকিয়ে নেওয়া হয়। একসময় এটা লেখা ও খাওয়া দুটো কাজেই ব্যবহার করা হতো। এখন রোলের মতো খাবারের সঙ্গে মুড়িয়ে দেওয়া হয়। শহরের ওয়ার মিউজিয়ামটিতে মার্কিন বর্বরতার সাক্ষী হিসেবে কয়েকটি ধ্বংসপ্রাপ্ত বিমান রাখা আছে। তাছাড়া দেশ-বিদেশ থেকে মার্কিনী যুদ্ধের বিরোধিতা করে ভিয়েতনামের মানুষকে যারা অভিনন্দন জানিয়েছেন, সেগুলোও প্রদর্শনীতে রাখা হয়েছে। গর্বে বুক ভরে গেলো যখন দেখলাম বাংলায় লেখা ‘‘বিজয়ী ভিয়েতনাম লাল সেলাম, হো চি মিন লাল সেলাম’’। সি পি আই (এম)-এর রাজ্য কমিটির তরফ থেকে সংহতি জানানোর জন্য এটা স্মারক হিসেবে দেওয়া হয়েছিল।

মেকঙ ডেল্টা

মনে পড়ে এক সময় বাংলার গঙ্গা আর ভিয়েতনামের মেকঙ যেন এক হয়ে গিয়েছিল। ভিয়েতনামের একেবারে দক্ষিণপ্রান্ত দিয়ে বয়ে চলেছে মেকঙ। উর্বরতার জন্য মেকঙ ডেল্টার আশপাশের জমিতে বছরে তিনবার ধান ছাড়াও প্রচুর ফলের চাষ হয়। আর জলে আছে নানারকমের মাছ। হো চি মিন সিটি থেকে মাই থো সিটির দূরত্ব ৭০ কিলোমিটারের মতো। মাই থো থেকেই থুয়েনে (আমরা যাকে ভটভটি বলি) করে মেকঙ ডেল্টা ঘুরতে হয়। থুয়েনে প্রায় ঘণ্টাখানেক মেকঙের বুক বেয়ে এগোনোর পর পৌঁছলাম থই সন দ্বীপে। বুঝলাম একটা প্রত্যন্ত দ্বীপাঞ্চলকেও চেষ্টা করলে কতো সুন্দর ও আকর্ষণীয় করে তোলা যায়। লকের কথামতো এই দ্বীপটি সুন্দরী মহিলা ও সুস্বাদু ফলের জন্য বিখ্যাত। দেখলাম সত্যিই তাই। দ্বীপের মানুষগুলো দেখতে যেমন সুন্দর, ওদের ব্যবহারও তেমন। পর্যটকদের সামনে দাঁড়িয়ে খালি গলায় ওঁরা ভিয়েতনামী পল্লীগীতি গাইলেন। 

পর্যটন শিল্প ও কুটির শিল্পকে পাশাপাশি রেখেই ভিয়েতনাম এগোচ্ছে। এর ফলে দূরদূরান্তের গরিব মানুষেরাও রোজগারের পথ খুঁজে পান। এই অঞ্চলে প্রচুর নারকেল হয়। আর তা দিয়েই রাইস পেপারে মোড়া চকলেট, সাবান, বাটি বা রান্না ঘরের নানা সামগ্রী এমনকি মেয়েদের ভ্যানিটি ব্যাগ পর্যন্ত তৈরি হয়। নারকেলের ছোবরাকেই জ্বালানি হি‍সেবে ব্যবহার করা হয়। বিক্রিও হয় ওখানেই। অনেক ফলের চাষ হয় বলে মৌমাছি পালনের মাধ্যমে মধু সংগ্রহ করা হয়। নানা ধরনের মধু। সবাইকেই মধু দিয়ে চা খাওয়ানো হলো। প্রায় ৪০-৫০জন পুরুষ-মহিলা এসব কাজে যুক্ত। থন সন দ্বীপ থেকে চার-পাঁচজন বসতে পারে এমন একটা ডিঙি করে একটা খুবই কম চওড়া ক্যানেল দিয়ে এসে আমাদের নৌকোতে পৌঁছে দিলো। ক্যানেলের দু’পাশে ছোট ছোট গাছের ঘন জঙ্গল। মিনিট পনেরো লাগলো। একজন মহিলা নন লা মাথায় দিয়ে হাতে গ্লাভস পরে ডিঙি বাইলেন। ডিঙিগুলিকে ওঁরা বলেন—ডু কেউ। মেকঙের মধ্যেই বেন ট্রি প্রভিন্সের অন্তর্গত আর একটি দ্বীপে দুপুরের খাওয়ার ব্যবস্থা। রেস্তোরাঁর নাম দিয়েম ফুয়োঙ। এখানকার বিখ্যাত মাছের নাম এলিফ্যান্ট ইয়ার ফিশ। রাইস পেপার দিয়ে মুড়িয়ে খায়। 

ফেরার আগে একদিন তন্দুর নামে একটা ভারতীয় হোটেলে খেতে বসেছি। হঠাৎ শুনি স্পষ্ট বাংলা ভাষায় কে যেন বললেন, ‘কী দাদা, কলকাতা থেকে?’ এই অভ্যর্থনার জন্য তৈরি ছিলাম না। যুবকের নাম তাজ মহম্মদ। পার্ক সার্কাস এলাকার বাসিন্দা। মৌলানা আজাদ কলেজ থেকে পড়াশোনা করে এখানে হোটেলের ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন। হ্যানয়েও তন্দুরের শাখা আছে। সেই চমক নিয়েই ৬ তারিখ বিকেলে ভিয়েতনাম ছাড়লাম।
সৌজন্যেঃ- গণশক্তি (সম​য়ের সাথে)