মাটির মানুষের জীবন আঁকার চিত্রী
রাধামাধব মণ্ডল
‘হারিয়ে গেলে মনের মানুষ
খুঁজলে মেলে না...’
খুঁজলে মেলে না...’
ভরা গলায়, গুরুগম্ভীর রোদে দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে গাইতেন রামকিঙ্কর। শান্তিনিকেতনে সবার প্রাণের মানুষ, আত্মার আপনজন, এক রক্তিম প্রাণউচ্ছ্বাস মাখা কর্মনিপুণ ব্যক্তিত্বের অধিকারী। চিত্রী-ভাস্কর শিল্পী রামকিঙ্কর বেইজ। আশ্রমের ফাঁকা আকাশের নিচে, পাখির কাকলিতে গলা মিলিয়ে গাইতেন কখনো লালন, কখনো রবীন্দ্রনাথ। হাতে নরম মাটির তাল, কখনো বা সিমেন্টের মতো কিছু একটা। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মানুষের জন্য মানুষের জীবনযাত্রাকে ধরছেন। কেউ বললে হাসতেন — প্রাণখোলা ছিল তাঁর সেই অম্লান হাসি। সেদিনের আশ্রমিকরা সকলেই এত বড় মানুষটাকে কিঙ্করদা বলেই ডাকতেন। তাঁর চোখ ছিল মানুষের কাছাকাছি। তীক্ষ্ণ দৃষ্টির সৃজনাত্মক অনুভবে কেবল দেখে নিতেন, খুব কাছ থেকে। গরিব-গুর্ব পাড়ার সরল, আড়ম্বরহীন সাধারণ নারী-পুরুষ তাঁর সৃষ্টিজুড়ে।
প্রথমদিকের শান্তিনিকেতনকে যাঁরা দু’হাত দিয়ে ভরিয়ে গেছেন রামকিঙ্কর তাঁদের একজন। শিল্পী বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায়, শঙ্খ চৌধুরী, সোমনাথ হোড়— সঙ্গে ছিলেন গুরু নন্দলাল বসু। তখন বিশ্বভারতী এখনকার মতো এত যান্ত্রিক হয়ে ওঠেনি। প্রকৃতির কাছে ছিল পাঠ নেওয়ার খাস আসন। কচিকাঁচাদের বুক ভেজা হাসি। গুরু-শিষ্যদের নিবিড় সম্পর্ক। তখন ছাত্র থেকে ধীরে ধীরে শিল্পী রামকিঙ্কর হয়ে ওঠা। প্রকৃত বোধের জন্য জ্ঞান আরও চাই, চাই মানুষের সঙ্গে নিবিড়ভাবে সংযোগ রক্ষা। উপলব্ধির মধ্যে দাঁড়িয়ে প্রকৃতির নানা রঙ ব্যবহার করে, গরিব পাড়ার কথা এঁকেছেন মাটির শিল্পী।
‘আপনাতে আপনি চিনিনে’
লালনের গান খুব ভালোবাসতেন, গাইতেন ফাঁকা গলায়। তখনও ভাস্কর্যের কাজে তেমন জয়জয়কার শুরু হয়নি। তেলরঙ, জলরঙ ছাড়া স্কেচ করেছেন অজস্র। সবই মানুষের, মানুষের সঙ্গে থাকা নানা জীব-প্রাণীর।
‘এমনও মধুরও বয়স
কেটেছে একলা বেলা
তমশা বিপিনে মাতো
হৃদয়ে হৃদয়ে খেলা’।
হৃদয়ে হৃদয়ে খেলা’।
ভুবনডাঙার ফাঁকা মাঠ, মাঠের নিকটে দিনান্তের অস্তগামী রক্তিম সূর্য প্রায়ই দেখতে পাগলের মতো ছুটে আসতেন শিল্পী। এসে থাকতেন নিজের লিখে দেওয়া, ভুবনডাঙার রাধারানী দেবীর বাড়িতে। কাছ থেকে দেখে কত এঁকেছেন রাধারানীকে মডেলে, ছবিতে— এখনও কথা হয়ে ফেরে সেসব।
কর্মজীবনের অনেকগুলি দিন রাধারানী দেবী কাটিয়েছেন শিল্পী রামকিঙ্করকে দেখভাল করার কাজে। কখনো ছেড়ে যাননি তাঁকে, সেদিন পর্যন্তও...।
‘প্রাণের মানুষ আছে প্রাণে’…
খুব ভালোবাসতেন রাধারানীকে। এনিয়ে অনেক গল্পের খোরাক, বিতর্কও যে হয়নি, তা নয়। হয়েছে যেমনটা হয়! এই ভালোবাসার মানুষটিকে জীবন ও শিল্পের বিভিন্ন কাজে, কংক্রিটে, তেলরঙে, জলরঙে, প্রতিকৃতির বিচিত্র কম্পোজিশনে, ভাস্কর্য শিল্পের কাজে ফুটিয়ে তুলেছেন। শত আঘাতেও কখনো ভাঙেননি তিনি। বীরের পরীক্ষা হয় যুদ্ধের ময়দানে, এটা মেনেই কখনো যুদ্ধ শুরু হলে একা-একা লড়াই করে, অবশেষে জয়ীই হয়েছেন রামকিঙ্কর। তবুও কাপুরুষের মতো যুদ্ধক্ষেত্র ত্যাগ, বা আত্মসমর্পণ করেননি তিনি। এরজন্য একচেটিয়া পুঁজিবাদের পক্ষাবলম্বীরা সর্বদা যন্ত্রণা দিয়ে গেছেন শিল্পীকে। দিনের শেষে শত যুদ্ধে জয়ী ক্লান্ত সৈনিক রামকিঙ্কর গুরুদেব রবীন্দ্রনাথের পদাবলী থেকে বলতেন,
‘মরণরে তুঁহু মম্ শ্যামও সমান...’
সারা জীবন ধরে অজস্র যন্ত্রণাজয়ী, অক্লান্ত শরীরে বার বার পরাজিতের পথ ছেড়ে জীবনের সঙ্গে হেঁটেছেন হাঁটতে শিখিয়েছেন যাঁদের তাঁরা অনেকেই এখন নিজ গুণে গুরুর পথে চলছেন, জীবনের ছবি আঁকতে আঁকতে।
মানুষের চিত্রী, চিত্রীও মানুষের
কাদের কাছে অবহেলার রামকিঙ্কর? কারা তাকে দেবতার মতো মাণ্যি করতো? এসব কিছুর উত্তরে সেদিনের অনেকের সাথে ভুবনডাঙা, রূপপুর, ধরলা, ফুলডাঙা, শ্যামবাটির আদিবাসী নারী-পুরুষের কথা তাঁর ছবিতে, ভাস্কর্য জুড়ে গাঁথা আছে। যেমন এঁকেছেন মানুষের চিত্রী রামকিঙ্কর রাধারানীকে তেমনভাবেই ১৯৩৫-এ ছাত্রী ‘জয়া’র চলন্ত মূর্তি বানিয়ে তার মাথার ভাঁড় চাপিয়ে, জগৎ বিখ্যাত ভাস্কর্য কংক্রিটের বুদ্ধর ‘সুজাতা’ হয়েছে। কলাভবনে এখনও খোলা আকাশের নিচে, কিঙ্করের ‘সুজাতা’, ‘বুদ্ধ’, ‘গান্ধী’, ‘হাতি’, ‘কলের বাঁশি’, পড়ে আছে অযত্নে। কোথাও কোথাও ভেঙেও যাচ্ছে রোদ বৃষ্টির জলের ধারায়। চেতনাহীন বিশ্বভারতী উদাসীন কলাভবন প্রাঙ্গণের এইসব ভাস্কর্য বাঁচাতে। অচেনা কেউ কেউ বিখ্যাত কয়েকটি ভাস্কর্যের মাথাও ভেঙে নিয়ে গেছে। মানুষের চিত্রী রামকিঙ্কর, সেই চিত্রীই মানুষের কাছাকাছি থেকে জীবনের আয়নায় গভীরভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন দারিদ্র্যের লড়াই-সংগ্রামের ছবি।
কর্মপথের ক্লান্তিহীন দিশায় সেই অভিযানের শুরু। ভারতের প্রাচীন শিল্পকীর্তি দেখে চিত্রকলা, ভাস্কর্য, স্থাপত্যে ভরিয়ে তোলেন সেদিনের শান্তিনিকেতনকে। তারুণ্যের ক্লান্তিহীন কর্মময় জীবনে নালন্দা, রাজগীর, জয়পুর, চিতোর, উদয়পুর দেখে ফিরে এসে মাটির রামকিঙ্কর, রাধারানীকে সঙ্গে নিয়ে প্রথম গোবর-মাটি, আলকাতরায় শ্যামলীতে, পরে কালোবাড়ির দেওয়ালে রিলিফ, বুদ্ধের কাজ। তারপর প্রাধান্য পায় স্ব-আবিষ্কৃত সিমেন্ট-কংক্রিটে ভিন্নমুখী থ্রোইং পদ্ধতিতে ভাস্কর্যের কাজ, প্রকৃত মাটির মানুষের মূর্তি গড়ার কাজ। ভালোবাসার দেওয়ালে মাটির রঙ।
‘...ওরে নবীন
ওরে আমার কাঁচা’ ...
ওরে আমার কাঁচা’ ...
সেদিনের শান্তিনিকেতনের গ্রামীণ হাটে গোয়ালপাড়া, বাহাদুরপুর, রূপপুর, রায়পুর, রজতপুর, খোয়াই, বল্লভপুর, ডাঙাপাড়া থেকে মানুষজন আসতো বিকিকিনি করতে। হাটে যাওয়ার পথে, ক্যানেলের শাল মহুল বহেরা জঙ্গলের সরু সিঁথিআঁকা ধুলো লাল মোড়ামের পথ দিয়ে খেত থেকে ফেরা আদিবাসী পরিবার— তিনি তন্ময়তার দৃষ্টিতে গভীরে নিয়ে দেখতেন! দেখতেন গরিব মানুষগুলির জীবনযাত্রা। পরে সে সবই ফুটে উঠেছে তাঁর ক্যানভাসের রঙে। কর্মপথের ক্লান্তিহীন দিশা দেখানো প্রাঞ্জল সবুজ মানুষটির শিল্পকর্মজুড়ে শান্তিনিকেতনের সুন্দর আর সেই সুন্দরের মধ্যে গরবে কংক্রিটে ‘সাঁওতাল পরিবার’, ‘ধানঝাড়াই’, ‘বুদ্ধ’ ‘কলের বাঁশি’, ‘মৎস্য-মহিষ’, ‘গান্ধী’ ও ‘তিমি’। এছাড়াও ১৯৪০সালে নির্মাণ করেন ‘আলোর ঝাড়’। অন্তরের অপ্রকাশ্য বাণীতে ছড়িয়ে আছে তাঁর নাম। যিনি প্রত্যক্ষ সহযোগিতা করেন শিল্পকর্ম সৃষ্টির সময় শিল্পীকে তিনি ভুবনডাঙার রাধারানী দেবী। ‘আলোর ঝাড়’ কাজটির একটি গুরুত্ব আছে আমাদের দেশে। এটিই শিল্প ইতিহাসে প্রথম কাজ, অ্যাবস্ট্রাক্ট ভাস্কর্যের ইতিহাসে। সেসময়ই তাঁর ভুবনভাঙার বসতবাড়ি দানপত্র করেছেন রাধারানী দেবীর পালিত কন্যা অলকা অধিকারীর নামে। আমৃত্যু সেখানেই কাটিয়ে যান রাধারানী দেবী। সময় সুযোগ পেলেই সেখানে এসে থাকতেন, শিল্পকর্মে ব্যস্ত হয়ে উঠতেন শিল্পী রামকিঙ্কর। এ বাড়ির পাশেই কালীতলার ভুবনডাঙায় রামকিঙ্করের সহযোগী কৃষ্ণগোপাল রায়, কেষ্টার বাড়ি। জ্যোৎস্না মাখা চাঁদের আলোয় অনেক রাত পর্যন্ত চলতো শিল্পসৃষ্টির কাজ, আলোচনা।
রামকিঙ্করের পেশাগত জীবনের ভবিষ্যৎ নির্ধারিত হয় ১৯৩৪সালে। তিনি কলাভবনের স্থায়ী শিক্ষক হিসাবে নিয়োজিত হন। ১৯৩৫ এবং ১৯৩৬সালে অনেকগুলি কাজ তিনি শেষ করেন। এই সময়ের গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলোর মধ্যে রয়েছে রিলিফ সাঁওতাল ও মেঝেন, সাঁওতাল দম্পতি, কৃষ্ণগোপিনী, সুজাতা। ১৯৩৭থেকে তিনি ছাত্রদের মডেলিং শেখানোর দায়িত্ব নেন। ওই বছরের মাঝামাঝি সময়টাকে রামকিঙ্করের তেলরঙ পর্বের শুরু ধরা যায়। ১৯৩৭ থেকে ১৯৪২ সালের মধ্যে তিনি অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ তেলরঙ চিত্রের কাজ শেষ করেন। একই সময়ের মধ্যে শেষ হয় তাঁর অনেকগুলি বিখ্যাত ভাস্কর্যের কাজও। তাঁর সৃষ্টিকর্মের কাল বিচারে এটিই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময় বলা যেতে পারে। এই পর্বে করা তাঁর বিখ্যাত ভাস্কর্যগুলির মধ্যে কংক্রিটে তৈরি সাঁওতাল পরিবার, প্লাস্টারে করা রবীন্দ্রনাথের প্রতিকৃতি ভাস্কর্য পোয়েটস্ হেড, সিমেন্ট দিয়ে হেড অব এ উওম্যান, বাতিদান অন্যতম।
আজও সংস্কারহীন ঘরে বসে সেদিনের স্বপ্ন দেখেন অলকা অধিকারীরা। ঘর ভর্তি শিল্পীর বিভিন্ন শিল্পকর্ম। কোনোটা শেষ, কোনোটা শেষ হয়নি এখনও...! কেবল প্রতীক্ষা কবে আলো আসবে ভাঙা ঘরে! যে ঘরে জীবনের অনেকগুলি দিন কাটিয়ে গেছেন রামকিঙ্কর।
রামকিঙ্করের কাজের একটি অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য গতিশীলতা । এটা তাঁর ছবি এবং ভাস্কর্য উভয়ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। তাঁর ছবি এবং ভাস্কর্যের প্রায় সকল আকৃতিই গতিশীল। কেউই থেমে নেই। তাঁর বড় ভাস্কর্যের বেশির ভাগই উন্মুক্ত জায়গায় করা। এটা তাঁর ভাস্কর্যের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। খোলা আকাশের নিচে রোদ-বৃষ্টি, আলো হাওয়া গায়ে মেখে প্রকৃতির সাথে মিলেমিশে ওগুলোর অবস্থান। রামকিঙ্করের গুরুত্বপূর্ণ ভাস্কর্যগুলোর অনেকগুলোই শান্তিনিকেতনে। ইউক্যালিপটাস গাছের সারির ভেতর ‘সুজাতা’ কিংবা কলাভবনের ‘সাঁওতাল পরিবার’, ‘বাতিদান’ পারিপাশ্বিকতার মধ্যে মিলেমিশে অন্যরকম এক দ্যোতনা সৃষ্টি করেছে। তবে শান্তিনিকেতনের এই ভাস্কর্যগুলি নির্মাণের সময় কিংবা নির্মাণ পরবর্তীকালে আশ্রমের সবাই যে এগুলোকে ভালোভাবে গ্রহণ করেছিলেন তা কিন্তু নয়। অনেক সময় তাঁর কাজ নিয়ে বিতর্কও উঠেছে।
আলোর গন্ধের দৌড়ে, গ্রামের ছেলেটি বিশ্বভারতীতে প্রথম দিকে কাজ শুরু করেন প্রতিকৃতি নির্মাণ দিয়ে। সে সময়ের কাজে ধরা পরে উস্তাদ আলাউদ্দিন, গাঙ্গুলি মশাই, অবনীন্দ্রনাথরা। সেদিনের কাজে বেশকিছু রিলিফের কাজও করতে শুরু করেন। টুকরো টুকরো ছবি বুকে রামকিঙ্কর জন্মভিটে বাঁকুড়ার যুগিপাড়া থেকে ১৯২৫-এ শান্তিনিকেতনে চলে আসেন। ১৯০৬ সালে ২৬শে মে, বাবা চণ্ডীচরণ ও মা সম্পূর্ণা দেবীর কোলে রামকিঙ্করের জন্ম। বড় অভাবী পরিবার, ক্ষৌরকর্মই জীবিকা। মামার বাড়ি বিষ্ণুপুরের কাদাকুলি যাওয়ার পথে, সূত্রধরদের বাস। সেসময়ই অনন্ত সূত্রধর নামের এক মিস্ত্রির কাছে শিল্পী রামকিঙ্করের মূর্তি গড়ার প্রথম পাঠ। সেসময় বিষ্ণুপুরের মন্দিরের কাজও তাঁকে টেনেছে। মন্দিরের পোড়ামাটি আর পাথরের কাজের নকল করেই শিল্পীর পথ চলা শুরু।
লেখাপড়া যতটুকু করেছেন তাতে সাধারণ প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়ার প্রতি তাঁর ঝোঁক ছিল না। ছবি আঁকা আর মূর্তি গড়াতে ছিল তাঁর আসল মনোযোগ। বাড়িতে লেখাপড়া করতে বসলে লেখাপড়ার কথা ভুলে শুরু করে দিতেন ছবি আঁকা। বাড়ির দেওয়ালে ঝোলানো দেবদেবীর ছবিগুলি দেখে দেখে আঁকতেন প্রায়শই। আর্থিক অনটনের কারণে কিশোর রামকিঙ্করের হাতে নরুন দিয়ে বসিয়ে দেওয়া হয় দোলতলার এক গাছতলায়; যদি কিছু আয় হয়। কিন্তু ক্ষৌরকর্ম বাদ দিয়ে নরুন দিয়ে গাছের গায়ে অনুবাদ করে চলেন তাঁর মনে তৈরি ছবি। ছেলেবেলাতে রামকিঙ্কর এঁকেছেন সাইনবোর্ড, নাটকের মঞ্চসজ্জার ছবি।
সময় পেলেই রামকিঙ্কর গল্প করতেন রাধারানীর পালিত কন্যা অলকার কাছে, ভুবনডাঙাতে থাকাকালীন। বর্তমানে ভুবনডাঙার সেই বাড়িতেই থাকেন রাধারানীর পালিত কন্যা অলকা আধিকারী ও তাঁর দুই পুত্র। বহু স্মৃতি বিজড়িত রামকিঙ্করের দান করা বাড়িতেই অভাবের সঙ্গে লড়াই করছেন শিল্পী সত্যকিঙ্কর অধিকারী। অলকার বড় পুত্র। তাঁদের বাড়িতেই বসে এঁকেছেন চিত্রী রামকিঙ্কর। সেই সব দুষ্প্রাপ্য ছবি এখনও বর্তমান তাঁদের কাছে। আছে বেশ কিছু ভাস্কর্যও।
‘ফিরে চল মাটির টানে…’
প্রবাসী পত্রিকার সম্পাদক রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় তাঁকে চিঠিতে লিখেছিলেন শান্তিনিকেতনে যেতে। কিন্তু বাঁকুড়ার অজ গাঁয়ের উনিশ বছরের এই যুবক পথঘাট কিছুই চেনে না। পথ ভুল করে অনেক ঘুরতি পথ পেরিয়ে শেষ পর্যন্ত পৌঁছলেন তিনি শান্তিনিকেতনে। উনিশশো পঁচিশ সালের কথা সেটা। সেদিন তিনি সাথে করে নিয়ে এসেছিলেন তাঁর আঁকা কয়েকটা ছবি আর হয়ত অনির্দিষ্ট কোন স্বপ্ন। ছবিগুলো দেখে নন্দলাল বলেছিলেন ‘তুমি কি করতে এখানে এলে, এত সব করে ফেলেছ। আর কী শিখবে? যাহোক যখন এসেই গেছো এখানে, তখন থাকো কিছুদিন’। সেই সময় তাঁর আর্থিক অবস্থা খুবই খারাপ। শিল্পাচার্য নন্দলাল বসুর চেষ্টায় কিছু বই অলঙ্করণের কাজ পান তিনি। এতে করে তাঁর মোটামুটি চলে যায়। ওই সময় তাঁর কিছু ছবিও বিক্রি হয়েছিল প্রদর্শনীতে। শান্তিনিকেতনে প্রথম দু‘বছর কাজ করার পর তিনি ছাত্রদের শেখাতে শুরু করেন। এভাবেই রামকিঙ্করের শান্তিনিকেতনে আসা আর শান্তিনিকেতনের শিল্পী রামকিঙ্কর হয়ে যাওয়া। বাকী সারা জীবনে শান্তিনিকেতন ছেড়ে তেমন কোথাও যাননি। দিল্লি, বোম্বে এমনকি কলকাতায়ও গেছেন খুব কম। শুধুমাত্র একবার গেছেন নেপাল। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন দেশের আমন্ত্রণ পেলেও আর কখনো বিদেশ যাননি তিনি।
‘হারিয়ে গেলে মনের মানুষ
খুঁজলে মেলে না।’
এ যুগের স্বনামধন্য শিল্পীরা বার বার ছুটে আসেন অভাবের সুযোগ নিয়ে, শিল্পী রামকিঙ্করের সেইসব অপ্রকাশিত ছবি ও কাজগুলো নিয়ে যাওয়ার জন্য। কিন্তু পেটে খিদে নিয়েও সেইসব কাজগুলোকে আঁকড়ে বেঁচে ভুবনডাঙার অলকা। বাড়িতে জল পড়ে ছাদ থেকে, বার বার জানিয়েও উদাসীন বিশ্বভারতী কর্মীপক্ষ। সত্যকিঙ্কর শিল্পী দিনকর কৌশিকের কাছে বেশ কিছু দিন কাজ করলেও তাঁর কোনো স্থায়িত্ব হয়নি। তাঁদের ভুবনডাঙার এই বাড়িতেই জীবনাবসান হয় রাধারানীর। এই বাড়িতেই বসে রাধারানীর মডেল, ভুবনডাঙার খুদুর মডেল বিশ্বে প্রচারিত, সুনাম কিনেছে। আবার এই ভুবনডাঙার বাড়িতেই জীবনের শেষ কটা দিন কাটিয়ে যান শিল্পী রামকিঙ্কর বেইজ। ১৯৭০সালে তিনি গুরুতর অসুস্থ হলে আলিপুরের এক বেসরকারী হাসপাতালে ভর্তি করা হয় তাঁকে, এখান থেকেই। সেবার সুস্থ হয়ে ফিরলেও দ্বিতীয় বার আর এক কঠিন ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে পশ্চিমবঙ্গের বামফ্রন্ট সরকারের ব্যবস্থায় ১৯৮০সালের ২০শে মার্চ কলকাতার এস এস কে এম হাসপাতালের উডবার্ন ওয়ার্ডে ভর্তি করা হয়। এই সময় বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষ বাঁকুড়ায় শিল্পীর ভাইপো দিবাকর বেইজের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। ইস্ট ইন্ডিয়া ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানি বিনা ব্যয়ে সেদিন ওষুধ সরবারাহ করে, ২৬শে জুলাই তাঁর অস্ত্রোপচার হয়। কলাভবন থেকে শেষবারের জন্য কাঞ্চনবাবু, রাধারানী ও তাঁর জামাতা অবনী অধিকারী দেখা করতে এসে কিছুক্ষণ ছিলেন। ১৯৮০-২রা আগস্ট মধ্যরাতে বিংশ শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ শিল্পীর জীবনাবসান হয়। সত্যকিঙ্কর অধিকারী অভিযোগ করেন ‘‘শিল্পীর মৃত্যুর পর দিদাকে কোনো গুরুত্ব দিত না বিশ্বভারতী। মার অসুখে বাবার মৃত্যুর সময়ও বিশ্বভারতীর হাসপাতালে চিকিৎসাও করতে দেয়নি কর্তৃপক্ষ। কেবল লোভ দেখাচ্ছে রামকিঙ্করের হাতের কাজগুলো যাতে দিয়ে দিই। খুব অভাব, মাঝে মাঝে মনে হয় কী হবে। বেচেই দিই। ভাতের চাল জুটবে ক’মাসের!’’ তবুও বিক্রি করতে পারেন না তিনি, এই স্মৃতিটুকুই তাঁদের সম্পদ।
রামকিঙ্করের আরও কিছু সৃষ্টি :-
প্লাস্টারে করা মা ও ছেলে (১৯২৮), কচ ও দেবযানী (১৯২৯), মিথুন-১ (১৯৩১), মিথুন-২(১৯৩১), মিথুন-৩(১৯৩১), সাঁওতাল-সাঁওতাল রমণী(১৯৩৫), সাঁওতাল দম্পতি (১৯৩৫), আলাউদ্দিন খাঁ(১৯৩৫), কংক্রীটে করা সাঁওতাল পরিবার(১৯৩৮), প্লাস্টারে করা রবীন্দ্রনাথের বিমূর্ত ভাস্কর্য (১৯৩৮), সিমেন্টে করা রবীন্দ্রনাথের আরও একটি ভাস্কর্য (১৯৪১), হার্ভেস্টার (১৯৪২), ফেমিন (১৯৪৩), সাঁওতাল নাচ (১৯৪৩), অবনীন্দ্রনাথ (১৯৪৩), সিমেন্টে করা কুলি মাদার (১৯৪৩-৪৪), বিনোদিনী (১৯৪৫), বুদ্ধ (১৯৪৬-৫০), সিমেন্টের দ্য মার্চ (১৯৪৮), ডাণ্ডি মার্চ (১৯৪৮), লেবার মেমরি (১৯৪৮), মা ও ছেলে (১৯৪৯), স্পিড অ্যান্ড গ্রাভিটি (১৯৪৯), শূকর (১৯৫২), পিতা-পুত্র ( ১৯৫২), মিলকল (১৯৫৬), গান্ধী (১৯৫৭), শার্পেনার (১৯৫৮), ম্যান অ্যান্ড হর্স ( ১৯৬০), সুভাষচন্দ্র বসু (১৯৬০-৬১), হর্স হেড (১৯৬২), মহিষ-১ (১৯৬২) কাক ও কোয়েল (১৯৬২), আগুনের জন্ম (১৯৬৩), যক্ষী-১১ (১৯৬৩) মহিষ ও ফোয়ারা (১৯৬৩), মাছ (১৯৬৪), তিমি মাছ (১৯৬৫), নৃত্যরতা নারী (১৯৬৫), লালন ফকির (১৯৬৫), যক্ষ যক্ষী (১৯৬৬), প্রেগন্যান্ট লেডি (১৯৬৭-৬৯), বলিদান (১৯৭৬), রাজপথ (১৯৭৭), রেখা, কলেজ গার্ল, গণেশ, সিটেড লেডি, মা ও শিশু, কুকুর, মা, সেপারেশন, রাহুপ্রেম, প্যাশন, ত্রিভুজ, দ্য ফ্রুট অব হেভেন, হাসি, বন্ধু।
No comments:
Post a Comment