স্বপ্নের ভিয়েতনাম
দীপক নাগ
ভিয়েতনামের স্বপ্ন এখনও বহু মানুষকে দোলা দেয়। সেই স্বপ্ন আর বাস্তব ফুটে উঠেছে তাঁর লেখায়।
‘‘তোমার নাম আমার নাম, ভিয়েতনাম — ভিয়েতনাম’’। গত শতাব্দীর ছয়-সাতের দশকে যাদের ছাত্র জীবন কেটেছে, তাদের পক্ষে এই স্লোগানটি একেবারে ভুলে যাওয়া সম্ভব নয়। ভিয়েতনামের স্বপ্ন এখনও তাদের মনে দোলা দেয়। ভিয়েতনামের শ্রমিক আন্দোলনের নেতা নগুয়েন ভিয়েত জুই-র সঙ্গে ইন্টারনেটের মাধ্যমে বছর খানেক ধরেই ভিয়েতনাম প্রসঙ্গে নানা পত্রালাপ চলছিল। সি আই টি ইউ-র নেতা প্রশান্ত নন্দীচৌধুরী মারফত জুই-র সঙ্গে যোগাযোগ। ভিয়েতনামীদের নামে সাধারণত তিনটি অংশ থাকে। আমরা যাকে পদবি বলি সেটা থাকে প্রথমে। তাকে ওরা বলে পারিবারিক নাম। মাঝের অংশ তার গোষ্ঠী। নাম থাকে সবার শেষে। ওঁর সাথে কথা বলেই স্ত্রী অঞ্জনাসহ ২৭শে মার্চ রওনা দিলাম হ্যানয়ের পথে।
আমরা বলি ভিয়েতনাম। আসলে ‘ভিয়েত’ এবং ‘নাম’ দুটো আলাদা শব্দ। ভিয়েত একটা জনগোষ্ঠী, যারা চীনেই বসবাস করতেন। নাম কথাটির অর্থাৎ দক্ষিণ। অর্থাৎ ভিয়েতগণ চীন থেকে সরে গিয়ে তার দক্ষিণ দিকের অঞ্চলে বসবাস শুরু করেন। আবার ‘হা’ এবং ‘নয়’ — এই দুটো আলাদা শব্দ থেকেই হ্যানয় কথাটি চালু হয়েছে। নামের ব্যাপারে ভিয়েতনামীদের একটা বিলাসিতা আছে। অন্তত ১৫ বার ভিয়েতনামের নাম পরিবর্তন হয়েছে। বিমানবন্দর থেকে বেরোতেই দেখি নামের প্ল্যাকার্ড হাতে গাইড বু চু দাঁড়িয়ে আছে। ২৬-২৭ বছরের যুবক। বিনয়ী এবং ভদ্র। ওর পরামর্শ মতোই বিমানবন্দরেই আমেরিকান ডলার ভাঙিয়ে ভিয়েতনামী মুদ্রা ডং নিয়ে নিলাম। ভিয়েনামী সব মুদ্রাতেই হো চি মিনের ছবি। মোটামুটিভাবে ২০০০০ ডং-এ এক ডলার। দু’শ থেকে পাঁচ লক্ষ পর্যন্ত ডংয়ের নোট আছে। ২০০ থেকে ৫০০০ পর্যন্ত কয়েন আছে, তবে সাধারণভাবে কোথাও ব্যবহার করতে দেখা যায় না। সরকারী সংস্থা ছাড়া হাটে-বাজারে সবখানেই ডলার চলে। রিকশাচালকও প্রয়োজনে ডলার ভাড়া নেয় এবং বাড়তি অংশ ফেরত দেয়।
দুপুরে একাই পায়ে হেঁটে বহু ঘটনার সাক্ষী বিখ্যাত হোয়ান কিয়েম লেকের পাশ দিয়ে ট্র্যাঙ টিয়েন স্ট্রিটের বই পাড়ায় গেলাম। ছোট ছোট গলির মতো রাস্তায় নাম লেখা সাইনবোর্ড। হোটেল থেকে একটা ম্যাপ দিয়ে দিয়েছিল। ভিয়েতনামী হরফ ল্যাটিন থেকে নেওয়া। আগে চীনা ভাষায় সব কিছু থাকলেও ১৫২৭সাল থেকে পর্তুগিজ ক্রিশ্চান মিশনারিরা এই হরফ শুরু করেন। রোমান হরফ থাকার ফলে লেখা দেখে আন্দাজ করা যায়। জিজ্ঞেস করতে করতে ঠিক জায়গায় পৌঁছে গেলাম। ভিয়েতনামীদের একটা বৈশিষ্ট্য হলো, প্রায় সবাই বেশ হাসিখুশি ও সহজ-সরল। বিনা বিরক্তিতে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়। আমাদের কলেজ স্ট্রিটের মতো অতো বড় না হলেও পুরো এলাকায় শুধু বইয়ের দোকান। তবে একেকটা দোকান আয়তনে বিশাল। কয়েকটা আবার দোতলা-তিনতলা বাড়ি। বইতে ঠাসা। কলকাতায় এত বড় বইয়ের দোকান দেখিনি। ইংরাজী ভাষায় ছাপানো বইগুলো আলাদাভাবে রাখা হয়েছে। হ্যানয়ের মতো হো চি মিন সিটিতেও বড় বড় বইয়ের দোকান। তবে ইংরাজীতে চিরায়ত মার্কসীয় বই খুব একটা চোখে পড়লো না।
হোয়ান কিয়েম (ফিরতি তরবারি) লেককে হ্যানয়ের কেন্দ্রভূমি বলা হয়। একে ঘিরেই প্রশাসনিক কেন্দ্র গড়ে উঠেছে। বিকেলে দেখলাম বহু মানুষ বেড়াতে এসেছেন। যুবক-যুবতীর সংখ্যাই বেশি। এঁরা খুব সৌন্দর্যপ্রিয়। সেজেগুজে থাকতে ভালবাসেন। হ্যানয়ের বিখ্যাত ফুলের বাজারে সারা রাত বেচাকেনা হয়। বইয়ের দোকানেও ফুল দিয়ে সাজিয়ে রেখেছে। লেকের পাশেই বিখ্যাত শহীদবেদী। নিচে খোদাই করা হো চি মিনের সেই বিখ্যাত আহ্বান — ‘‘পিতৃভূমিকে রক্ষা করতে সাহসী মৃত্যুর জন্য দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হও’’। রান্না করা এবং ছেলেমেয়ে সামলানো ছাড়াও ভিয়েতনামের মেয়েরাই মূলত হাটবাজার করার দায়িত্ব পালন করে থাকেন। দেখলাম মেয়েরাই বেশিরভাগ দোকান চালাচ্ছেন। বু জানালো, এখানে শারীরিক দিক থেকে খুব পরিশ্রমের বা ভারী কাজ ছেলেরা করেন। মেয়েরা তুলনামূলকভাবে কম পরিশ্রমের কাজ করেও যথেষ্ট উপার্জন করেন। তাই কোন কোন গোষ্ঠীর মধ্যে এমন প্রথা চালু আছে যে, ছেলের বাবা বিয়ের আগে মেয়ের বাবাকে মদ ও নগদ টাকা উপহার হিসেবে দেবেন। দর কষাকষি করে টাকার পরিমাণ ঠিক হয়। ওর বাবাও তাই করেছিলেন। ভিয়েতনামে এমন কথা চালু আছে, ‘একাধিক মেয়ের বাবা কখনও গরিব হয় না আর একাধিক ছেলের বাবা কখনও ধনী হয় না’। জুইয়ের কাছে জানলাম, সরকারী নিয়ম অনুসারে (তিন থেকে পাঁচ বছর অন্তর) দু’জন ছেলেমেয়ের মধ্যেই পরিবার সীমিত রাখতে হয়।
২৯তারিখ সকালে বু প্রথমে নিয়ে গেল হো চি মিন মসোলিয়াম দেখতে। ছোট ছোট অনেক ছেলেমেয়েসহ স্কুলের শিক্ষিকা এবং গ্রাম থেকে আসা বহু সাধারণ মানুষের লম্বা লাইন। জিজ্ঞাসা করে জানা গেল প্রতিদিন গড়ে প্রায় পাঁচ হাজার দর্শক বাক (আস্কল) হো-কে শ্রদ্ধা জানানোর জন্য আসেন। প্রত্যেক ভিয়েতনামী জীবনে অন্তত একবার এখানে আসার চেষ্টা করেন। মসোলিয়ামে হো চি মিনের সেই বিখ্যাত উক্তিটি চোখে পড়লো — ‘‘স্বাধীনতা ও মুক্তির চাইতে মূল্যবান আর কিছু নেই।’’ নিঃশব্দে সবাই ঢুকছে। চলতে চলতেই দেখলাম চিরনিদ্রায় শায়িত সেই মহাসংগ্রামী। মিউজিয়াম ও রাষ্ট্রপতির বাড়ি (বাক বো প্যালেস) পাশাপাশি। ফরাসি শাসকদের জন্য তৈরি সেই বাড়িতে হো চি মিন বাস করেননি। তিনি ফরাসী শাসকদের সাধারণ কর্মচারীদের থাকার জন্য ছোট্ট একটা দোতলায় বছর চারেক বাস করেছেন। তারপর ১৯৫৮থেকে তার পাশেই আর একটা দু’কামরাওয়ালা ছোট্ট কাঠের দোতলা বাড়িতে আজীবন থেকেছেন। নিচতলাটা ফাঁকা। অনেকটা আমাদের উত্তর বাংলার চা বাগান, বনাঞ্চল ও পাহাড়ী এলাকার কাঠের বাড়ির মতো। ওরা বলে ‘প্ল্যাম্বিং ঘর’। ভিয়েতনামের প্রায় সব গ্রামীণ এলাকাতেই এই ধরনের বাড়ি দেখা যায়। লাল রঙ এদের খুব পছন্দ। এমনকি শহরের আধুনিক তিন-চারতলা বাড়ির ছাদগুলোও লাল রঙের সিমেন্টের টালি দিয়ে তৈরি। সামনের দিকটা প্যাগোডার মতো তিনকোণা কাঠামো। কাঠের বাড়িটির সামনেই বিরাট একটা পুকুর। খুব ছেলেবেলায় নিজের গ্রামে হো চি মিন নাকি পুকুরে মাছ ধরা দেখতে খুব ভালবাসতেন। পুকুরঘাটে দেখলাম প্রচুর মাছ খাবার জন্য এসে জড়ো হয়েছে। বাচ্চারা সব ভিড় করে মাছ দেখছে। একটা সাইনবোর্ড দেখিয়ে গাইড বললো, এখানে বসেই প্রতিদিন নিয়ম করে আঙ্কল হো মাছকে খাবার দিতেন। আর দুটো জিনিস তাঁর প্রিয় ছিল — ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের সাথে সময় কাটানো এবং অফিসের পর বাগান পরিচর্যা করা।
হা লঙ বে
২৯তারিখ বিকেলে গেলাম ‘হা লঙ বে’ দেখতে। হা লঙ বে ভিয়েতনামের গর্ব। রাতে হোটেলের বারান্দায় বসে জলের ওপর ভেসে থাকা নৌকোর আলোগুলোকে কেমন যেন দূর আকাশের তারার মতো অসীম মনে হচ্ছিল। হা লঙ সিটি হ্যানয় থেকে দেড়শো কিলোমিটারের মতো দূরে। ‘ন্যাচারাল হেরিটেজ’ হিসেবে ইউনেস্কো বে-কে স্বীকৃতি দিয়েছে। আমাদের সুন্দরবন এলাকার নৌকো (ভটভটি)-র মতো মোটরচালিত সুন্দর ছোট্ট নৌকোতে ঘণ্টাখানেকের মতো সময় ধরে জলের মধ্যে পাহাড়ের চারপাশে ঘোরায়। নৌকোগুলোকে ওরা বলে থুয়েন বা জুয়েন। ছোট ছোট অসংখ্য টিলা। স্থানীয় মানুষেরা নানা নামে ওদের চিহ্নিত করে। তার মধ্যে ‘কিসিং ককস’-র ছবি তো হা লঙের প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে। হা লঙ বে যেন সৌন্দর্যের ডালি নিয়ে বসে আছে। জলের মধ্যেই জেলেদের চারটি ভাসমান গ্রাম আছে। নৌকোতেই ওদের বসবাস। ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা নৌকোতে করে এসে নানা ধরনের ফল বিক্রি করে। নৌকোতেই বাজার। তবে ওভাবে বসবাস করলেও ওদের চেহারায় বা জামাকাপড়ে দারিদ্র্যের ছাপ চোখে পড়লো না। একটা পাহাড়ের মধ্যেই হাঙ দাও গো নামক গুহা। এটা যেন আলিবাবার সেই গুহা। চুনা পাথরের ওপর আলো পড়ে মণিমানিক্যের দ্যুতি যেন চারদিকে ঠিকরে বেরোচ্ছে।
হ্যানয় থেকে হা লঙ যাতায়াতের পথে বেশ কয়েকটি হস্তশিল্পের কারখানা দেখলাম। ৫০-৬০জন করে মহিলা শ্রমিক কাজ করছেন। আমাদের এখানে জরি শিল্পে যেমন ‘থাডা’ বানিয়ে কাজ করা হয়, অনেকটা সেরকম জিনিসের মধ্যে কাপড় রেখে নানারকম কাজ করা হচ্ছে। জুইয়ের দেওয়া তথ্য থেকে জানতে পারলাম বিভিন্ন ক্ষেত্র মিলিয়ে ভিয়েতনামে শ্রমিকের সংখ্যা প্রায় ৮২লক্ষের মতো। তার মধ্যে ৪৩শতাংশই নারী। মজুরির ক্ষেত্রে নারী ও পুরুষ শ্রমিকের মধ্যে কোন ফারাক নেই। কোথাও শিশু শ্রমিক চোখে পড়েনি। ১৯৮৬সাল থেকে ভিয়েতনামে অর্থনৈতিক সংস্কারের কাজ শুরু হয়েছে। ওদের ভাষায় বলা হয় ‘দই মই’। সেখানে সমাজতান্ত্রিক ধাঁচের বাজার অর্থনীতি গড়ে উঠেছে। সারা ভিয়েতনামে প্রায় দু’লক্ষ বেসরকারী মালিকানায় পরিচালিত ব্যবসা বা কারখানা গড়ে উঠেছে। প্রত্যক্ষ বিদেশী বিনিয়োগ ভিয়েতনামে স্বীকৃতি পেয়েছে। কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যরাও ব্যক্তিগত উদ্যোগে ব্যবসা-বাণিজ্য করতে পারেন। দশম পার্টি কংগ্রেসের (২০০৬) আগে পার্টি সদস্যদের ব্যবসার ক্ষেত্রে ‘শোষণ ছাড়া’—কথাটি ছিল। এই কংগ্রেসে কমিউনিস্ট পার্টির গঠনতন্ত্র সংশোধন করে এই শব্দটি তুলে দেওয়া হয়েছে। দীর্ঘদিন ফরাসী ও পরে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের আক্রমণে বিধ্বস্ত, ৯কোটির কিছু বেশি মানুষের অনেক পিছিয়ে পড়া, আয়তনে পশ্চিমবঙ্গের চাইতে কিছুটা বড় এই ছোট্ট দেশটি সব দিক থেকেই নিজের পায়ে দাঁড়াতে চেষ্টা করছে। ভিয়েতনামের উন্নতি ঘটেছে। কিন্তু কিছু কুফল যেন উঁকি মারতে চাইছে। বিভিন্ন মানুষের সঙ্গে কথা এবং নিজের অভিজ্ঞতার মাধ্যমে এরকম মনে হয়েছে। বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে হয়তো ভুল বোঝার জন্য কিছু অসন্তোষ তৈরি হয়েছে। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী ষড়যন্ত্রমূলক অপপ্রচার এর জন্য অনেকটাই দায়ী বলে মনে হলো। ইন্টারনেট বা ফেসবুকের মাধ্যমে মার্কিনীরা সমাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে এই ষড়যন্ত্র করছে। হো চি মিন সিটির গাইড লক নিজেই একথা স্বীকার করলো। এমনকি হো চি মিন সম্বন্ধেও অশ্রদ্ধা জন্মানোর জন্য মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ নতুন প্রজন্মের কাছে মিথ্যা তথ্য প্রচার করে। তবে ভিয়েতনাম কমিউনিস্ট পার্টি এবিষয়ে যথেষ্ট ওয়াকিবহাল। নবম ও দশম পার্টি কংগ্রেসের সময়কালে দুর্নীতি বা অন্যান্য কারণে প্রায় ৪০০০০পার্টি সদস্যের বিরুদ্ধে কড়া ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
সোনালি পদ্ম
হো চি মিন আজও ভিয়েতনামবাসীদের কত প্রিয়, তা বোঝা গেল এই অবিসংবাদী নেতার জন্মভিটায় গিয়ে। হ্যানয় থেকে দক্ষিণ দিকে ৩১০ কিলোমিটার দূরে ন্ঘে অ্যান প্রভিন্সে হোয়াঙ ট্রু গ্রাম। এখানেই মার বাবার বাড়িতে ১৮৯০সালে তিনি জন্মগ্রহণ করেন।
একটা প্রায় ধ্বংসস্তূপ থেকে গড়ে ওঠা দেশ সমাজতান্ত্রিক কাঠামোতে কত তাড়াতাড়ি গড়ে উঠতে পারে, হ্যানয় থেকে কিম লিয়েন যাতায়াতের পথে ভিয়েতনামের গ্রামগুলো দেখে তার প্রমাণ মেলে। গরিব মানুষ আছেন। তবে ৬০০কিলোমিটার পথ চলার পথে প্রকট দারিদ্র্যের চিহ্ন কোথাও চোখে পড়লো না। পথের দু’ধারে দোকান। সংসার সামলে বাড়ির মেয়েরাই দোকান চালান। মাঝে মাঝে কারখানা থাকলেও চওড়া ও মসৃণ পথের দু’ধারেই সবুজ ধানের খেত। হাতে গ্লাভস ও পায়ে গামবুট পরে কেউ মোষ চড়াচ্ছেন। গোটা দেশে ২কোটি টনের মতো ধান হয়। ৫০লক্ষ টন ধান বিদেশে রপ্তানি করা হয়। সরকারী হিসেব অনুযায়ী ভিয়েতনাম রপ্তানি বাণিজ্যের ক্ষেত্রে কফি ও কাজুবাদামে দ্বিতীয়, রাবারে চতুর্থ এবং গোলমরিচে প্রথম স্থানের অধিকারী।
বিকেলের দিকে হোয়াঙ ট্রু গ্রামে পৌঁছলাম। প্রতিদিনই বহু দেশী-বিদেশী পর্যটক এখানে আসেন তালপাতার ছাউনি আর বাঁশ ও কাঠ দিয়ে তৈরি মাটির মেঝের ওপর দু’কামরাওয়ালা বাড়িটি দেখতে। রাষ্ট্রপতি হওয়ার পরও দু’বার হো চি মিন তাঁর গ্রামে এসে ছেলেবেলার স্মৃতি রোমন্থন করেছেন। চারদিকে গাছপালা দিয়ে ঘেরা বাড়িটি এখনও একইরকম রাখার চেষ্টা করা হয়। এর কাছেই হো চি মিনের মা হোয়াঙ থি লোন (১৮৬৪-১৯০১)-এর স্মৃতিসৌধ। হোয়াঙ ট্রু থেকে মাত্র তিন কিলোমিটার দূরে কিম লিয়েন। কিম লিয়েন কথাটির অর্থ ‘সোনালি পদ্ম’। মামার বাড়িতে জন্ম হলেও মার মৃত্যুর পর হো চি মিন কয়েক বছর এই গ্রামে এসে থেকেছেন। সোনালি পদ্ম এখন আর দেখা না গেলেও এলাকায় এখনও অনেক পুকুর রয়ে গেছে।
হো চি মিন সিটি
৩রা এপ্রিল রাতে হো চি মিন সিটি (সায়গন) পৌঁছলাম। রাতের হো চি মিন সিটি দেখে চমকে যেতে হয়। মনে হলো চারুচিক্যের দিক থেকে হ্যানয় যদি উত্তর কলকাতা হয়, তাহলে হো চি মিন সিটি নিউ টাউন বা রাজারহাট। দক্ষিণ ভিয়েতনাম মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধে জয়লাভ করেছে ১৯৭৫ সালে। ৪০বছরেরও কম সময়ে উন্নয়নের কোন পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া যায়, এই শহর তার অন্যতম প্রমাণ। পরদিন সকালেই রওনা দিলাম বিখ্যাত কু চি টানেলের দিকে। শহর থেকে ৩৫কিলোমিটার দূরে চারদিকে রবার গাছ ও অন্যান্য গাছের জঙ্গল দিয়ে ঘেরা কু চি। গাড়িতে যেতে যেতে নানা কথাবার্তার মধ্যে ভিয়েতনামের শিক্ষাব্যবস্থা সম্বন্ধে কিছু জানার চেষ্টা করলাম। এদেশে ক্লাস নাইন পর্যন্ত শিক্ষা বাধ্যতামূলক। সাধারণভাবে শিক্ষা অবৈতনিক নয়। তবে গরিব ছাত্রছাত্রীদের বিনা পয়সায় পড়ার ব্যবস্থা আছে। প্রথম থেকেই ইংরাজী পড়ানো হয়। ১৫বছরের ওপরে দেশবাসীর সাক্ষরতার হার ৯৪শতাংশ। এর মধ্যে পুরুষের হার শতকরা ৯৭ আর মেয়েদের হার একটু কম— শতকরা ৯২। কু চি টানেল পৃথিবীর সবচাইতে যুদ্ধবাজ দেশ আমেরিকাকে বিস্মিত করেছে। ওপরে ছোট্ট একটা গর্ত। অনেকটা রাস্তার ম্যানহোলের মতো। কিন্তু গর্তে নামার পরই নয়-দশ ফুট গভীরে বিভিন্ন সুড়ঙ্গ আঁকাবাঁকা নানা গলি দিয়ে কোথায় যেন চলে গেছে! হাত ওপরের দিকে তুলে নামতে হয়। একটু মোটা মানুষের পক্ষে ঢোকা খুব কঠিন। নামতে চাওয়ায় একজন পুলিস টর্চ হাতে আমাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে চললো। একটু লম্বা মানুষকে প্রায় হামাগুড়ি দিয়ে এগোতে হয়। দম প্রায় বন্ধ হয়ে আসে। ভাবলাম কী পরিমাণ সাহস ও দেশপ্রেম থাকলে দেখতে ছোটখাট মানুষগুলো একনাগাড়ে কয়েকদিন এভাবে টানেলে থেকে মার্কিনী শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াই করে জয়ী হতে পেরেছে!
মাটির নিচে হাসপাতাল, সভাঘর, অস্ত্র বানানোর কারখানা ও রান্নাঘর ইত্যাদি সবই আছে। দেখলাম রান্নাঘরের এককোনে উনুনে আগুন জ্বলছে। লক একটু দূরের দিকে আঙুল দেখিয়ে বলে, ‘‘ঐ দেখুন।’’ দেখলাম উনুন থেকে বেশ কিছুটা দূরে ধোঁয়া বেরুচ্ছে। ধোঁয়া দেখে মার্কিনী হানাদারেরা বোমা না ফেলতে পারে, তার জন্যই এই ব্যবস্থা। লক বললো, আমার মা ছোটবেলাতে আমাদের বলতেন, ‘‘রান্নার সময় যাতে ধোঁয়া না বেরোয়’’। ভিয়েতনামের মেয়েরা নাকি এখনও ঐ নিয়ম মেনে চলার চেষ্টা করেন। মূলত ছোট ছোট ছেলেমেয়ে ও মহিলারাই টানেলগুলো তৈরি করেছেন। কারণ পূর্ণবয়স্ক পুরুষের পক্ষে একটা ছোট্ট কোদাল ও ঝুড়ি নিয়ে ন-দশ ফুট গভীরে গিয়ে অতো ছোট গর্তের মাটি কাটা খুব কঠিন। টানেলের চার পাশের পাতা ফাঁদে আটকানো মার্কিনী ট্যাঙ্ক প্রদর্শনীর জন্য রেখে দেওয়া হয়েছে। ভিয়েতনামের বিখ্যাত রাইস পেপার তৈরির বিষয়টাও এখানে পর্যটকদের দেখানো হয়। চালের গুড়ো দিয়ে রুমালি রুটির চাইতেও পাতলা করে উনুনের ওপর উলটো কড়াইয়ে সেঁকে রোদ্দুরে শুকিয়ে নেওয়া হয়। একসময় এটা লেখা ও খাওয়া দুটো কাজেই ব্যবহার করা হতো। এখন রোলের মতো খাবারের সঙ্গে মুড়িয়ে দেওয়া হয়। শহরের ওয়ার মিউজিয়ামটিতে মার্কিন বর্বরতার সাক্ষী হিসেবে কয়েকটি ধ্বংসপ্রাপ্ত বিমান রাখা আছে। তাছাড়া দেশ-বিদেশ থেকে মার্কিনী যুদ্ধের বিরোধিতা করে ভিয়েতনামের মানুষকে যারা অভিনন্দন জানিয়েছেন, সেগুলোও প্রদর্শনীতে রাখা হয়েছে। গর্বে বুক ভরে গেলো যখন দেখলাম বাংলায় লেখা ‘‘বিজয়ী ভিয়েতনাম লাল সেলাম, হো চি মিন লাল সেলাম’’। সি পি আই (এম)-এর রাজ্য কমিটির তরফ থেকে সংহতি জানানোর জন্য এটা স্মারক হিসেবে দেওয়া হয়েছিল।
মেকঙ ডেল্টা
মনে পড়ে এক সময় বাংলার গঙ্গা আর ভিয়েতনামের মেকঙ যেন এক হয়ে গিয়েছিল। ভিয়েতনামের একেবারে দক্ষিণপ্রান্ত দিয়ে বয়ে চলেছে মেকঙ। উর্বরতার জন্য মেকঙ ডেল্টার আশপাশের জমিতে বছরে তিনবার ধান ছাড়াও প্রচুর ফলের চাষ হয়। আর জলে আছে নানারকমের মাছ। হো চি মিন সিটি থেকে মাই থো সিটির দূরত্ব ৭০ কিলোমিটারের মতো। মাই থো থেকেই থুয়েনে (আমরা যাকে ভটভটি বলি) করে মেকঙ ডেল্টা ঘুরতে হয়। থুয়েনে প্রায় ঘণ্টাখানেক মেকঙের বুক বেয়ে এগোনোর পর পৌঁছলাম থই সন দ্বীপে। বুঝলাম একটা প্রত্যন্ত দ্বীপাঞ্চলকেও চেষ্টা করলে কতো সুন্দর ও আকর্ষণীয় করে তোলা যায়। লকের কথামতো এই দ্বীপটি সুন্দরী মহিলা ও সুস্বাদু ফলের জন্য বিখ্যাত। দেখলাম সত্যিই তাই। দ্বীপের মানুষগুলো দেখতে যেমন সুন্দর, ওদের ব্যবহারও তেমন। পর্যটকদের সামনে দাঁড়িয়ে খালি গলায় ওঁরা ভিয়েতনামী পল্লীগীতি গাইলেন।
পর্যটন শিল্প ও কুটির শিল্পকে পাশাপাশি রেখেই ভিয়েতনাম এগোচ্ছে। এর ফলে দূরদূরান্তের গরিব মানুষেরাও রোজগারের পথ খুঁজে পান। এই অঞ্চলে প্রচুর নারকেল হয়। আর তা দিয়েই রাইস পেপারে মোড়া চকলেট, সাবান, বাটি বা রান্না ঘরের নানা সামগ্রী এমনকি মেয়েদের ভ্যানিটি ব্যাগ পর্যন্ত তৈরি হয়। নারকেলের ছোবরাকেই জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করা হয়। বিক্রিও হয় ওখানেই। অনেক ফলের চাষ হয় বলে মৌমাছি পালনের মাধ্যমে মধু সংগ্রহ করা হয়। নানা ধরনের মধু। সবাইকেই মধু দিয়ে চা খাওয়ানো হলো। প্রায় ৪০-৫০জন পুরুষ-মহিলা এসব কাজে যুক্ত। থন সন দ্বীপ থেকে চার-পাঁচজন বসতে পারে এমন একটা ডিঙি করে একটা খুবই কম চওড়া ক্যানেল দিয়ে এসে আমাদের নৌকোতে পৌঁছে দিলো। ক্যানেলের দু’পাশে ছোট ছোট গাছের ঘন জঙ্গল। মিনিট পনেরো লাগলো। একজন মহিলা নন লা মাথায় দিয়ে হাতে গ্লাভস পরে ডিঙি বাইলেন। ডিঙিগুলিকে ওঁরা বলেন—ডু কেউ। মেকঙের মধ্যেই বেন ট্রি প্রভিন্সের অন্তর্গত আর একটি দ্বীপে দুপুরের খাওয়ার ব্যবস্থা। রেস্তোরাঁর নাম দিয়েম ফুয়োঙ। এখানকার বিখ্যাত মাছের নাম এলিফ্যান্ট ইয়ার ফিশ। রাইস পেপার দিয়ে মুড়িয়ে খায়।
ফেরার আগে একদিন তন্দুর নামে একটা ভারতীয় হোটেলে খেতে বসেছি। হঠাৎ শুনি স্পষ্ট বাংলা ভাষায় কে যেন বললেন, ‘কী দাদা, কলকাতা থেকে?’ এই অভ্যর্থনার জন্য তৈরি ছিলাম না। যুবকের নাম তাজ মহম্মদ। পার্ক সার্কাস এলাকার বাসিন্দা। মৌলানা আজাদ কলেজ থেকে পড়াশোনা করে এখানে হোটেলের ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন। হ্যানয়েও তন্দুরের শাখা আছে। সেই চমক নিয়েই ৬ তারিখ বিকেলে ভিয়েতনাম ছাড়লাম।
‘‘তোমার নাম আমার নাম, ভিয়েতনাম — ভিয়েতনাম’’। গত শতাব্দীর ছয়-সাতের দশকে যাদের ছাত্র জীবন কেটেছে, তাদের পক্ষে এই স্লোগানটি একেবারে ভুলে যাওয়া সম্ভব নয়। ভিয়েতনামের স্বপ্ন এখনও তাদের মনে দোলা দেয়। ভিয়েতনামের শ্রমিক আন্দোলনের নেতা নগুয়েন ভিয়েত জুই-র সঙ্গে ইন্টারনেটের মাধ্যমে বছর খানেক ধরেই ভিয়েতনাম প্রসঙ্গে নানা পত্রালাপ চলছিল। সি আই টি ইউ-র নেতা প্রশান্ত নন্দীচৌধুরী মারফত জুই-র সঙ্গে যোগাযোগ। ভিয়েতনামীদের নামে সাধারণত তিনটি অংশ থাকে। আমরা যাকে পদবি বলি সেটা থাকে প্রথমে। তাকে ওরা বলে পারিবারিক নাম। মাঝের অংশ তার গোষ্ঠী। নাম থাকে সবার শেষে। ওঁর সাথে কথা বলেই স্ত্রী অঞ্জনাসহ ২৭শে মার্চ রওনা দিলাম হ্যানয়ের পথে।
আমরা বলি ভিয়েতনাম। আসলে ‘ভিয়েত’ এবং ‘নাম’ দুটো আলাদা শব্দ। ভিয়েত একটা জনগোষ্ঠী, যারা চীনেই বসবাস করতেন। নাম কথাটির অর্থাৎ দক্ষিণ। অর্থাৎ ভিয়েতগণ চীন থেকে সরে গিয়ে তার দক্ষিণ দিকের অঞ্চলে বসবাস শুরু করেন। আবার ‘হা’ এবং ‘নয়’ — এই দুটো আলাদা শব্দ থেকেই হ্যানয় কথাটি চালু হয়েছে। নামের ব্যাপারে ভিয়েতনামীদের একটা বিলাসিতা আছে। অন্তত ১৫ বার ভিয়েতনামের নাম পরিবর্তন হয়েছে। বিমানবন্দর থেকে বেরোতেই দেখি নামের প্ল্যাকার্ড হাতে গাইড বু চু দাঁড়িয়ে আছে। ২৬-২৭ বছরের যুবক। বিনয়ী এবং ভদ্র। ওর পরামর্শ মতোই বিমানবন্দরেই আমেরিকান ডলার ভাঙিয়ে ভিয়েতনামী মুদ্রা ডং নিয়ে নিলাম। ভিয়েনামী সব মুদ্রাতেই হো চি মিনের ছবি। মোটামুটিভাবে ২০০০০ ডং-এ এক ডলার। দু’শ থেকে পাঁচ লক্ষ পর্যন্ত ডংয়ের নোট আছে। ২০০ থেকে ৫০০০ পর্যন্ত কয়েন আছে, তবে সাধারণভাবে কোথাও ব্যবহার করতে দেখা যায় না। সরকারী সংস্থা ছাড়া হাটে-বাজারে সবখানেই ডলার চলে। রিকশাচালকও প্রয়োজনে ডলার ভাড়া নেয় এবং বাড়তি অংশ ফেরত দেয়।
দুপুরে একাই পায়ে হেঁটে বহু ঘটনার সাক্ষী বিখ্যাত হোয়ান কিয়েম লেকের পাশ দিয়ে ট্র্যাঙ টিয়েন স্ট্রিটের বই পাড়ায় গেলাম। ছোট ছোট গলির মতো রাস্তায় নাম লেখা সাইনবোর্ড। হোটেল থেকে একটা ম্যাপ দিয়ে দিয়েছিল। ভিয়েতনামী হরফ ল্যাটিন থেকে নেওয়া। আগে চীনা ভাষায় সব কিছু থাকলেও ১৫২৭সাল থেকে পর্তুগিজ ক্রিশ্চান মিশনারিরা এই হরফ শুরু করেন। রোমান হরফ থাকার ফলে লেখা দেখে আন্দাজ করা যায়। জিজ্ঞেস করতে করতে ঠিক জায়গায় পৌঁছে গেলাম। ভিয়েতনামীদের একটা বৈশিষ্ট্য হলো, প্রায় সবাই বেশ হাসিখুশি ও সহজ-সরল। বিনা বিরক্তিতে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়। আমাদের কলেজ স্ট্রিটের মতো অতো বড় না হলেও পুরো এলাকায় শুধু বইয়ের দোকান। তবে একেকটা দোকান আয়তনে বিশাল। কয়েকটা আবার দোতলা-তিনতলা বাড়ি। বইতে ঠাসা। কলকাতায় এত বড় বইয়ের দোকান দেখিনি। ইংরাজী ভাষায় ছাপানো বইগুলো আলাদাভাবে রাখা হয়েছে। হ্যানয়ের মতো হো চি মিন সিটিতেও বড় বড় বইয়ের দোকান। তবে ইংরাজীতে চিরায়ত মার্কসীয় বই খুব একটা চোখে পড়লো না।
হোয়ান কিয়েম (ফিরতি তরবারি) লেককে হ্যানয়ের কেন্দ্রভূমি বলা হয়। একে ঘিরেই প্রশাসনিক কেন্দ্র গড়ে উঠেছে। বিকেলে দেখলাম বহু মানুষ বেড়াতে এসেছেন। যুবক-যুবতীর সংখ্যাই বেশি। এঁরা খুব সৌন্দর্যপ্রিয়। সেজেগুজে থাকতে ভালবাসেন। হ্যানয়ের বিখ্যাত ফুলের বাজারে সারা রাত বেচাকেনা হয়। বইয়ের দোকানেও ফুল দিয়ে সাজিয়ে রেখেছে। লেকের পাশেই বিখ্যাত শহীদবেদী। নিচে খোদাই করা হো চি মিনের সেই বিখ্যাত আহ্বান — ‘‘পিতৃভূমিকে রক্ষা করতে সাহসী মৃত্যুর জন্য দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হও’’। রান্না করা এবং ছেলেমেয়ে সামলানো ছাড়াও ভিয়েতনামের মেয়েরাই মূলত হাটবাজার করার দায়িত্ব পালন করে থাকেন। দেখলাম মেয়েরাই বেশিরভাগ দোকান চালাচ্ছেন। বু জানালো, এখানে শারীরিক দিক থেকে খুব পরিশ্রমের বা ভারী কাজ ছেলেরা করেন। মেয়েরা তুলনামূলকভাবে কম পরিশ্রমের কাজ করেও যথেষ্ট উপার্জন করেন। তাই কোন কোন গোষ্ঠীর মধ্যে এমন প্রথা চালু আছে যে, ছেলের বাবা বিয়ের আগে মেয়ের বাবাকে মদ ও নগদ টাকা উপহার হিসেবে দেবেন। দর কষাকষি করে টাকার পরিমাণ ঠিক হয়। ওর বাবাও তাই করেছিলেন। ভিয়েতনামে এমন কথা চালু আছে, ‘একাধিক মেয়ের বাবা কখনও গরিব হয় না আর একাধিক ছেলের বাবা কখনও ধনী হয় না’। জুইয়ের কাছে জানলাম, সরকারী নিয়ম অনুসারে (তিন থেকে পাঁচ বছর অন্তর) দু’জন ছেলেমেয়ের মধ্যেই পরিবার সীমিত রাখতে হয়।
২৯তারিখ সকালে বু প্রথমে নিয়ে গেল হো চি মিন মসোলিয়াম দেখতে। ছোট ছোট অনেক ছেলেমেয়েসহ স্কুলের শিক্ষিকা এবং গ্রাম থেকে আসা বহু সাধারণ মানুষের লম্বা লাইন। জিজ্ঞাসা করে জানা গেল প্রতিদিন গড়ে প্রায় পাঁচ হাজার দর্শক বাক (আস্কল) হো-কে শ্রদ্ধা জানানোর জন্য আসেন। প্রত্যেক ভিয়েতনামী জীবনে অন্তত একবার এখানে আসার চেষ্টা করেন। মসোলিয়ামে হো চি মিনের সেই বিখ্যাত উক্তিটি চোখে পড়লো — ‘‘স্বাধীনতা ও মুক্তির চাইতে মূল্যবান আর কিছু নেই।’’ নিঃশব্দে সবাই ঢুকছে। চলতে চলতেই দেখলাম চিরনিদ্রায় শায়িত সেই মহাসংগ্রামী। মিউজিয়াম ও রাষ্ট্রপতির বাড়ি (বাক বো প্যালেস) পাশাপাশি। ফরাসি শাসকদের জন্য তৈরি সেই বাড়িতে হো চি মিন বাস করেননি। তিনি ফরাসী শাসকদের সাধারণ কর্মচারীদের থাকার জন্য ছোট্ট একটা দোতলায় বছর চারেক বাস করেছেন। তারপর ১৯৫৮থেকে তার পাশেই আর একটা দু’কামরাওয়ালা ছোট্ট কাঠের দোতলা বাড়িতে আজীবন থেকেছেন। নিচতলাটা ফাঁকা। অনেকটা আমাদের উত্তর বাংলার চা বাগান, বনাঞ্চল ও পাহাড়ী এলাকার কাঠের বাড়ির মতো। ওরা বলে ‘প্ল্যাম্বিং ঘর’। ভিয়েতনামের প্রায় সব গ্রামীণ এলাকাতেই এই ধরনের বাড়ি দেখা যায়। লাল রঙ এদের খুব পছন্দ। এমনকি শহরের আধুনিক তিন-চারতলা বাড়ির ছাদগুলোও লাল রঙের সিমেন্টের টালি দিয়ে তৈরি। সামনের দিকটা প্যাগোডার মতো তিনকোণা কাঠামো। কাঠের বাড়িটির সামনেই বিরাট একটা পুকুর। খুব ছেলেবেলায় নিজের গ্রামে হো চি মিন নাকি পুকুরে মাছ ধরা দেখতে খুব ভালবাসতেন। পুকুরঘাটে দেখলাম প্রচুর মাছ খাবার জন্য এসে জড়ো হয়েছে। বাচ্চারা সব ভিড় করে মাছ দেখছে। একটা সাইনবোর্ড দেখিয়ে গাইড বললো, এখানে বসেই প্রতিদিন নিয়ম করে আঙ্কল হো মাছকে খাবার দিতেন। আর দুটো জিনিস তাঁর প্রিয় ছিল — ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের সাথে সময় কাটানো এবং অফিসের পর বাগান পরিচর্যা করা।
হা লঙ বে
২৯তারিখ বিকেলে গেলাম ‘হা লঙ বে’ দেখতে। হা লঙ বে ভিয়েতনামের গর্ব। রাতে হোটেলের বারান্দায় বসে জলের ওপর ভেসে থাকা নৌকোর আলোগুলোকে কেমন যেন দূর আকাশের তারার মতো অসীম মনে হচ্ছিল। হা লঙ সিটি হ্যানয় থেকে দেড়শো কিলোমিটারের মতো দূরে। ‘ন্যাচারাল হেরিটেজ’ হিসেবে ইউনেস্কো বে-কে স্বীকৃতি দিয়েছে। আমাদের সুন্দরবন এলাকার নৌকো (ভটভটি)-র মতো মোটরচালিত সুন্দর ছোট্ট নৌকোতে ঘণ্টাখানেকের মতো সময় ধরে জলের মধ্যে পাহাড়ের চারপাশে ঘোরায়। নৌকোগুলোকে ওরা বলে থুয়েন বা জুয়েন। ছোট ছোট অসংখ্য টিলা। স্থানীয় মানুষেরা নানা নামে ওদের চিহ্নিত করে। তার মধ্যে ‘কিসিং ককস’-র ছবি তো হা লঙের প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে। হা লঙ বে যেন সৌন্দর্যের ডালি নিয়ে বসে আছে। জলের মধ্যেই জেলেদের চারটি ভাসমান গ্রাম আছে। নৌকোতেই ওদের বসবাস। ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা নৌকোতে করে এসে নানা ধরনের ফল বিক্রি করে। নৌকোতেই বাজার। তবে ওভাবে বসবাস করলেও ওদের চেহারায় বা জামাকাপড়ে দারিদ্র্যের ছাপ চোখে পড়লো না। একটা পাহাড়ের মধ্যেই হাঙ দাও গো নামক গুহা। এটা যেন আলিবাবার সেই গুহা। চুনা পাথরের ওপর আলো পড়ে মণিমানিক্যের দ্যুতি যেন চারদিকে ঠিকরে বেরোচ্ছে।
হ্যানয় থেকে হা লঙ যাতায়াতের পথে বেশ কয়েকটি হস্তশিল্পের কারখানা দেখলাম। ৫০-৬০জন করে মহিলা শ্রমিক কাজ করছেন। আমাদের এখানে জরি শিল্পে যেমন ‘থাডা’ বানিয়ে কাজ করা হয়, অনেকটা সেরকম জিনিসের মধ্যে কাপড় রেখে নানারকম কাজ করা হচ্ছে। জুইয়ের দেওয়া তথ্য থেকে জানতে পারলাম বিভিন্ন ক্ষেত্র মিলিয়ে ভিয়েতনামে শ্রমিকের সংখ্যা প্রায় ৮২লক্ষের মতো। তার মধ্যে ৪৩শতাংশই নারী। মজুরির ক্ষেত্রে নারী ও পুরুষ শ্রমিকের মধ্যে কোন ফারাক নেই। কোথাও শিশু শ্রমিক চোখে পড়েনি। ১৯৮৬সাল থেকে ভিয়েতনামে অর্থনৈতিক সংস্কারের কাজ শুরু হয়েছে। ওদের ভাষায় বলা হয় ‘দই মই’। সেখানে সমাজতান্ত্রিক ধাঁচের বাজার অর্থনীতি গড়ে উঠেছে। সারা ভিয়েতনামে প্রায় দু’লক্ষ বেসরকারী মালিকানায় পরিচালিত ব্যবসা বা কারখানা গড়ে উঠেছে। প্রত্যক্ষ বিদেশী বিনিয়োগ ভিয়েতনামে স্বীকৃতি পেয়েছে। কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যরাও ব্যক্তিগত উদ্যোগে ব্যবসা-বাণিজ্য করতে পারেন। দশম পার্টি কংগ্রেসের (২০০৬) আগে পার্টি সদস্যদের ব্যবসার ক্ষেত্রে ‘শোষণ ছাড়া’—কথাটি ছিল। এই কংগ্রেসে কমিউনিস্ট পার্টির গঠনতন্ত্র সংশোধন করে এই শব্দটি তুলে দেওয়া হয়েছে। দীর্ঘদিন ফরাসী ও পরে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের আক্রমণে বিধ্বস্ত, ৯কোটির কিছু বেশি মানুষের অনেক পিছিয়ে পড়া, আয়তনে পশ্চিমবঙ্গের চাইতে কিছুটা বড় এই ছোট্ট দেশটি সব দিক থেকেই নিজের পায়ে দাঁড়াতে চেষ্টা করছে। ভিয়েতনামের উন্নতি ঘটেছে। কিন্তু কিছু কুফল যেন উঁকি মারতে চাইছে। বিভিন্ন মানুষের সঙ্গে কথা এবং নিজের অভিজ্ঞতার মাধ্যমে এরকম মনে হয়েছে। বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে হয়তো ভুল বোঝার জন্য কিছু অসন্তোষ তৈরি হয়েছে। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী ষড়যন্ত্রমূলক অপপ্রচার এর জন্য অনেকটাই দায়ী বলে মনে হলো। ইন্টারনেট বা ফেসবুকের মাধ্যমে মার্কিনীরা সমাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে এই ষড়যন্ত্র করছে। হো চি মিন সিটির গাইড লক নিজেই একথা স্বীকার করলো। এমনকি হো চি মিন সম্বন্ধেও অশ্রদ্ধা জন্মানোর জন্য মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ নতুন প্রজন্মের কাছে মিথ্যা তথ্য প্রচার করে। তবে ভিয়েতনাম কমিউনিস্ট পার্টি এবিষয়ে যথেষ্ট ওয়াকিবহাল। নবম ও দশম পার্টি কংগ্রেসের সময়কালে দুর্নীতি বা অন্যান্য কারণে প্রায় ৪০০০০পার্টি সদস্যের বিরুদ্ধে কড়া ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
সোনালি পদ্ম
হো চি মিন আজও ভিয়েতনামবাসীদের কত প্রিয়, তা বোঝা গেল এই অবিসংবাদী নেতার জন্মভিটায় গিয়ে। হ্যানয় থেকে দক্ষিণ দিকে ৩১০ কিলোমিটার দূরে ন্ঘে অ্যান প্রভিন্সে হোয়াঙ ট্রু গ্রাম। এখানেই মার বাবার বাড়িতে ১৮৯০সালে তিনি জন্মগ্রহণ করেন।
একটা প্রায় ধ্বংসস্তূপ থেকে গড়ে ওঠা দেশ সমাজতান্ত্রিক কাঠামোতে কত তাড়াতাড়ি গড়ে উঠতে পারে, হ্যানয় থেকে কিম লিয়েন যাতায়াতের পথে ভিয়েতনামের গ্রামগুলো দেখে তার প্রমাণ মেলে। গরিব মানুষ আছেন। তবে ৬০০কিলোমিটার পথ চলার পথে প্রকট দারিদ্র্যের চিহ্ন কোথাও চোখে পড়লো না। পথের দু’ধারে দোকান। সংসার সামলে বাড়ির মেয়েরাই দোকান চালান। মাঝে মাঝে কারখানা থাকলেও চওড়া ও মসৃণ পথের দু’ধারেই সবুজ ধানের খেত। হাতে গ্লাভস ও পায়ে গামবুট পরে কেউ মোষ চড়াচ্ছেন। গোটা দেশে ২কোটি টনের মতো ধান হয়। ৫০লক্ষ টন ধান বিদেশে রপ্তানি করা হয়। সরকারী হিসেব অনুযায়ী ভিয়েতনাম রপ্তানি বাণিজ্যের ক্ষেত্রে কফি ও কাজুবাদামে দ্বিতীয়, রাবারে চতুর্থ এবং গোলমরিচে প্রথম স্থানের অধিকারী।
বিকেলের দিকে হোয়াঙ ট্রু গ্রামে পৌঁছলাম। প্রতিদিনই বহু দেশী-বিদেশী পর্যটক এখানে আসেন তালপাতার ছাউনি আর বাঁশ ও কাঠ দিয়ে তৈরি মাটির মেঝের ওপর দু’কামরাওয়ালা বাড়িটি দেখতে। রাষ্ট্রপতি হওয়ার পরও দু’বার হো চি মিন তাঁর গ্রামে এসে ছেলেবেলার স্মৃতি রোমন্থন করেছেন। চারদিকে গাছপালা দিয়ে ঘেরা বাড়িটি এখনও একইরকম রাখার চেষ্টা করা হয়। এর কাছেই হো চি মিনের মা হোয়াঙ থি লোন (১৮৬৪-১৯০১)-এর স্মৃতিসৌধ। হোয়াঙ ট্রু থেকে মাত্র তিন কিলোমিটার দূরে কিম লিয়েন। কিম লিয়েন কথাটির অর্থ ‘সোনালি পদ্ম’। মামার বাড়িতে জন্ম হলেও মার মৃত্যুর পর হো চি মিন কয়েক বছর এই গ্রামে এসে থেকেছেন। সোনালি পদ্ম এখন আর দেখা না গেলেও এলাকায় এখনও অনেক পুকুর রয়ে গেছে।
হো চি মিন সিটি
৩রা এপ্রিল রাতে হো চি মিন সিটি (সায়গন) পৌঁছলাম। রাতের হো চি মিন সিটি দেখে চমকে যেতে হয়। মনে হলো চারুচিক্যের দিক থেকে হ্যানয় যদি উত্তর কলকাতা হয়, তাহলে হো চি মিন সিটি নিউ টাউন বা রাজারহাট। দক্ষিণ ভিয়েতনাম মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধে জয়লাভ করেছে ১৯৭৫ সালে। ৪০বছরেরও কম সময়ে উন্নয়নের কোন পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া যায়, এই শহর তার অন্যতম প্রমাণ। পরদিন সকালেই রওনা দিলাম বিখ্যাত কু চি টানেলের দিকে। শহর থেকে ৩৫কিলোমিটার দূরে চারদিকে রবার গাছ ও অন্যান্য গাছের জঙ্গল দিয়ে ঘেরা কু চি। গাড়িতে যেতে যেতে নানা কথাবার্তার মধ্যে ভিয়েতনামের শিক্ষাব্যবস্থা সম্বন্ধে কিছু জানার চেষ্টা করলাম। এদেশে ক্লাস নাইন পর্যন্ত শিক্ষা বাধ্যতামূলক। সাধারণভাবে শিক্ষা অবৈতনিক নয়। তবে গরিব ছাত্রছাত্রীদের বিনা পয়সায় পড়ার ব্যবস্থা আছে। প্রথম থেকেই ইংরাজী পড়ানো হয়। ১৫বছরের ওপরে দেশবাসীর সাক্ষরতার হার ৯৪শতাংশ। এর মধ্যে পুরুষের হার শতকরা ৯৭ আর মেয়েদের হার একটু কম— শতকরা ৯২। কু চি টানেল পৃথিবীর সবচাইতে যুদ্ধবাজ দেশ আমেরিকাকে বিস্মিত করেছে। ওপরে ছোট্ট একটা গর্ত। অনেকটা রাস্তার ম্যানহোলের মতো। কিন্তু গর্তে নামার পরই নয়-দশ ফুট গভীরে বিভিন্ন সুড়ঙ্গ আঁকাবাঁকা নানা গলি দিয়ে কোথায় যেন চলে গেছে! হাত ওপরের দিকে তুলে নামতে হয়। একটু মোটা মানুষের পক্ষে ঢোকা খুব কঠিন। নামতে চাওয়ায় একজন পুলিস টর্চ হাতে আমাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে চললো। একটু লম্বা মানুষকে প্রায় হামাগুড়ি দিয়ে এগোতে হয়। দম প্রায় বন্ধ হয়ে আসে। ভাবলাম কী পরিমাণ সাহস ও দেশপ্রেম থাকলে দেখতে ছোটখাট মানুষগুলো একনাগাড়ে কয়েকদিন এভাবে টানেলে থেকে মার্কিনী শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াই করে জয়ী হতে পেরেছে!
মাটির নিচে হাসপাতাল, সভাঘর, অস্ত্র বানানোর কারখানা ও রান্নাঘর ইত্যাদি সবই আছে। দেখলাম রান্নাঘরের এককোনে উনুনে আগুন জ্বলছে। লক একটু দূরের দিকে আঙুল দেখিয়ে বলে, ‘‘ঐ দেখুন।’’ দেখলাম উনুন থেকে বেশ কিছুটা দূরে ধোঁয়া বেরুচ্ছে। ধোঁয়া দেখে মার্কিনী হানাদারেরা বোমা না ফেলতে পারে, তার জন্যই এই ব্যবস্থা। লক বললো, আমার মা ছোটবেলাতে আমাদের বলতেন, ‘‘রান্নার সময় যাতে ধোঁয়া না বেরোয়’’। ভিয়েতনামের মেয়েরা নাকি এখনও ঐ নিয়ম মেনে চলার চেষ্টা করেন। মূলত ছোট ছোট ছেলেমেয়ে ও মহিলারাই টানেলগুলো তৈরি করেছেন। কারণ পূর্ণবয়স্ক পুরুষের পক্ষে একটা ছোট্ট কোদাল ও ঝুড়ি নিয়ে ন-দশ ফুট গভীরে গিয়ে অতো ছোট গর্তের মাটি কাটা খুব কঠিন। টানেলের চার পাশের পাতা ফাঁদে আটকানো মার্কিনী ট্যাঙ্ক প্রদর্শনীর জন্য রেখে দেওয়া হয়েছে। ভিয়েতনামের বিখ্যাত রাইস পেপার তৈরির বিষয়টাও এখানে পর্যটকদের দেখানো হয়। চালের গুড়ো দিয়ে রুমালি রুটির চাইতেও পাতলা করে উনুনের ওপর উলটো কড়াইয়ে সেঁকে রোদ্দুরে শুকিয়ে নেওয়া হয়। একসময় এটা লেখা ও খাওয়া দুটো কাজেই ব্যবহার করা হতো। এখন রোলের মতো খাবারের সঙ্গে মুড়িয়ে দেওয়া হয়। শহরের ওয়ার মিউজিয়ামটিতে মার্কিন বর্বরতার সাক্ষী হিসেবে কয়েকটি ধ্বংসপ্রাপ্ত বিমান রাখা আছে। তাছাড়া দেশ-বিদেশ থেকে মার্কিনী যুদ্ধের বিরোধিতা করে ভিয়েতনামের মানুষকে যারা অভিনন্দন জানিয়েছেন, সেগুলোও প্রদর্শনীতে রাখা হয়েছে। গর্বে বুক ভরে গেলো যখন দেখলাম বাংলায় লেখা ‘‘বিজয়ী ভিয়েতনাম লাল সেলাম, হো চি মিন লাল সেলাম’’। সি পি আই (এম)-এর রাজ্য কমিটির তরফ থেকে সংহতি জানানোর জন্য এটা স্মারক হিসেবে দেওয়া হয়েছিল।
মেকঙ ডেল্টা
মনে পড়ে এক সময় বাংলার গঙ্গা আর ভিয়েতনামের মেকঙ যেন এক হয়ে গিয়েছিল। ভিয়েতনামের একেবারে দক্ষিণপ্রান্ত দিয়ে বয়ে চলেছে মেকঙ। উর্বরতার জন্য মেকঙ ডেল্টার আশপাশের জমিতে বছরে তিনবার ধান ছাড়াও প্রচুর ফলের চাষ হয়। আর জলে আছে নানারকমের মাছ। হো চি মিন সিটি থেকে মাই থো সিটির দূরত্ব ৭০ কিলোমিটারের মতো। মাই থো থেকেই থুয়েনে (আমরা যাকে ভটভটি বলি) করে মেকঙ ডেল্টা ঘুরতে হয়। থুয়েনে প্রায় ঘণ্টাখানেক মেকঙের বুক বেয়ে এগোনোর পর পৌঁছলাম থই সন দ্বীপে। বুঝলাম একটা প্রত্যন্ত দ্বীপাঞ্চলকেও চেষ্টা করলে কতো সুন্দর ও আকর্ষণীয় করে তোলা যায়। লকের কথামতো এই দ্বীপটি সুন্দরী মহিলা ও সুস্বাদু ফলের জন্য বিখ্যাত। দেখলাম সত্যিই তাই। দ্বীপের মানুষগুলো দেখতে যেমন সুন্দর, ওদের ব্যবহারও তেমন। পর্যটকদের সামনে দাঁড়িয়ে খালি গলায় ওঁরা ভিয়েতনামী পল্লীগীতি গাইলেন।
পর্যটন শিল্প ও কুটির শিল্পকে পাশাপাশি রেখেই ভিয়েতনাম এগোচ্ছে। এর ফলে দূরদূরান্তের গরিব মানুষেরাও রোজগারের পথ খুঁজে পান। এই অঞ্চলে প্রচুর নারকেল হয়। আর তা দিয়েই রাইস পেপারে মোড়া চকলেট, সাবান, বাটি বা রান্না ঘরের নানা সামগ্রী এমনকি মেয়েদের ভ্যানিটি ব্যাগ পর্যন্ত তৈরি হয়। নারকেলের ছোবরাকেই জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করা হয়। বিক্রিও হয় ওখানেই। অনেক ফলের চাষ হয় বলে মৌমাছি পালনের মাধ্যমে মধু সংগ্রহ করা হয়। নানা ধরনের মধু। সবাইকেই মধু দিয়ে চা খাওয়ানো হলো। প্রায় ৪০-৫০জন পুরুষ-মহিলা এসব কাজে যুক্ত। থন সন দ্বীপ থেকে চার-পাঁচজন বসতে পারে এমন একটা ডিঙি করে একটা খুবই কম চওড়া ক্যানেল দিয়ে এসে আমাদের নৌকোতে পৌঁছে দিলো। ক্যানেলের দু’পাশে ছোট ছোট গাছের ঘন জঙ্গল। মিনিট পনেরো লাগলো। একজন মহিলা নন লা মাথায় দিয়ে হাতে গ্লাভস পরে ডিঙি বাইলেন। ডিঙিগুলিকে ওঁরা বলেন—ডু কেউ। মেকঙের মধ্যেই বেন ট্রি প্রভিন্সের অন্তর্গত আর একটি দ্বীপে দুপুরের খাওয়ার ব্যবস্থা। রেস্তোরাঁর নাম দিয়েম ফুয়োঙ। এখানকার বিখ্যাত মাছের নাম এলিফ্যান্ট ইয়ার ফিশ। রাইস পেপার দিয়ে মুড়িয়ে খায়।
ফেরার আগে একদিন তন্দুর নামে একটা ভারতীয় হোটেলে খেতে বসেছি। হঠাৎ শুনি স্পষ্ট বাংলা ভাষায় কে যেন বললেন, ‘কী দাদা, কলকাতা থেকে?’ এই অভ্যর্থনার জন্য তৈরি ছিলাম না। যুবকের নাম তাজ মহম্মদ। পার্ক সার্কাস এলাকার বাসিন্দা। মৌলানা আজাদ কলেজ থেকে পড়াশোনা করে এখানে হোটেলের ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন। হ্যানয়েও তন্দুরের শাখা আছে। সেই চমক নিয়েই ৬ তারিখ বিকেলে ভিয়েতনাম ছাড়লাম।
No comments:
Post a Comment