তিতাস আজও কথা কয় গৌতমকুমার দাস
সুবলা বাসন্তী কিশোরের মালো জীবনের গাথা ভরা তিতাস আজও বয়, বয়ে যায়। চোখে পড়ে তিতাসের জলে স্নান করছে মা ও ছেলে, ঠিক যেন অনন্তের মা, আর দামাল শিশু অনন্ত উদোম গায়ে মায়ের সাথে দস্যিপনা করেই চলেছে। অথবা দেখা যায় অদ্বৈত মল্লবর্মণের ‘‘তিতাস একটি নদীর নাম’’ এর বাসন্তী যেন নদী পাড় থেকে দুপুর শেষে বাসন কাঁখে বাড়িমুখো হয় আজও। তিতাস বিখ্যাত হওয়ার পরে অর্ধশতক কেটে গেলেও দারিদ্র্যের চিহ্ন মুছে যায়নি এঁদের। তবে তিতাস বদলেছে। বাংলাদেশের ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় তিতাসের বুকে পাল তোলা নৌকার সাথে সঙ্গী হয়েছে দ্রুত জলযান ভটভটিও। গাছগুলো ঝুঁকে পড়েছে নদীর দিকে। কচুরিপানা ইতস্তত ভেসে রয়েছে। তিতাসে কোনো স্রোত নেই। ছোট্ট ডিঙিতে তাই স্থির হয়ে বসে ছিপ ফেলে মাছ ধরে চলেছে দুইজন সওয়ারি। মালো কিনা কে জানে! একমনে তাকিয়ে রয়েছে ছিপের ফাতনার দিকে।আকারে আয়তনে তিতাস পাড়ের ছোটখাটো ব্রাহ্মণবাড়িয়া এখন বাংলাদেশের আস্ত এক জেলা। বাংলাদেশের ৬৪টি জেলার অন্যতম। ঢাকা থেকে দূরত্ব মাত্র ৬৫ কিমি। এই জেলা ভারতের ত্রিপুরা রাজ্য সংলগ্ন। রাত কাটানোর জন্য এখানে বেশ কয়েকটি আবাসিক হোটেল রয়েছে। আর আছে সরকারী ডাকবাংলো। তিতাসের তীরে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার গঞ্জ হিসাবে বেড়ে ওঠা। সপ্তদশ শতকে পুজো পাঠ করার ব্রাহ্মণের অভাব হওয়ায় এই এলাকায় ব্রাহ্মণের আগমন হেতু তিতাস পাড়ের এই অংশের নাম হয় ব্রাহ্মণাড়িয়া।
ঢাকা থেকে মাত্র আড়াই ঘণ্টার পথের গন্তব্য দক্ষিণ পূর্বের তিতাস আরও সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি কারণে সম্প্রতিকালে খ্যাত, আর তা হলো তিতাসের বুক ফুঁড়ে যেখানে সেখানে প্রাকৃতিক গ্যাসের উদ্গীরণ। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার দুই তীরে প্রায় ১৯ কিমি জুড়ে এই গ্যাস ক্ষেত্রের অবস্থান। গ্যাস বেরোনো শুরু হয় ১৯৬২ সালে। এখনও বেরোয় এবং নদীবক্ষে জ্বলে, জ্বলেই যায়। তিতাস গ্যাস ক্ষেত্র সারা বাংলাদেশের মোট গ্যাসের চাহিদার শতকরা ২০ ভাগ জোগান দিয়ে চলেছে পঞ্চাশ বছর ধরে।
তিতাস পাড়ের ব্রাহ্মণবাড়িয়া সুদীর্ঘ দিন ধরে সাহিত্য শিল্পকলা ও সঙ্গীতের পীঠস্থান। অপরূপ নিসর্গ শোভিত তিতাসের দুই পাড়ের উর্বর মাটি সুফলা শস্য শ্যামলা। তিতাস এখানে প্রকৃতির আদরের দুলাল। মেঘনার সন্তান।
ইচ্ছে হলে ঢাকা থেকে এসে তিতাসকে দেখে দিনের দিন ফিরে যাওয়া যায়। ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের অদূরে গোকর্ণ ঘাটে তিতাস একটু বেশি কর্মব্যস্ত। এবং প্রাকৃতিক। এখানে বট, শিরিষ নুয়ে পড়েছে তিতাসের বুকে। পাড়ের ইটভাটার চিমনি থেকে ধোঁয়া বেরোচ্ছে অনবরত। দূর থেকে দেখা যায় গির্জার গম্বুজ। পাড়ে শিবমন্দির এখনও। পুজো হয় নিয়মিত। আবার ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কিছু পুবে সরাইলের কাছে তিতাস বড্ড ক্ষীণকায়া। তিতাসের চর বেদখল হয়ে চলছে ধান ও সরষের চাষ। পাশ দিয়ে এঁকে বেঁকে চলে গেছে পিচ রাস্তা। তার ওপর দিয়ে এ যুগের সুবলা কিশোররা বাইক চালাচ্ছে তীব্রগতিতে। পেছনে অন্তরঙ্গভাবে বসে একালের বাসন্তীরা। কানে ধরা মোবাইল ফোন। তিতাসের নদীচরে কোথাও আবার ফাঁকা জায়গাটুকুকে ছোটরা বানিয়ে ফেলেছে ক্রিকেট মাঠ। সেখানে ব্যাট বল খেলছে আজকের অনন্তরা।
তিতাসের বুকে মালোরা এখনও মাছ ধরে কিনা জানা নেই, তবে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় খাবার হোটেলে বাইল্যা, সরপুঁটি ও নল মাছ দিয়ে দুপুরে মধ্যাহ্ন ভোজন সারার সময় হোটেলের ম্যানেজারের থেকে জানা গেল এ সব মাছ তিতাসের জল থেকে ধরা।
তিতাস বাস সার্ভিসে অথবা ট্রেনে ঢাকা থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া আসার পথে তিন তিনটি বড় নদী পেরোতে হয়। প্রথমে শীতলক্ষ্যা, পরে ভৈরব এবং শেষে পুরাতন ব্রহ্মপুত্র। এই তিন নদী আকারে তিতাসের থেকে অনেক অনেক বড়। তিতাসের গতিপথ ইংরাজী ‘বি’ অক্ষরের মতো কিছুটা। মেঘনা থেকে বেরিয়ে আবার মেঘনাতে তার মিলন। মেঘনা মায়ের সন্তান তিতাস। আর তার বিস্তৃতি ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা জুড়ে। সদা চঞ্চল তিতাসের বুক জুড়ে কর্মব্যস্ত মাঝি মাল্লা মা শিশু, নৌকায় যাত্রীদের দেখলে মনেহয় অদ্বৈত মল্লবর্মণের তিতাস আজও যেন কথা কয়। তবু ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ এর সুবলা বাসন্তী অনন্তের মায়েদের কথা মনে হলে তিতাসের পাড়ে দীর্ঘশ্বাস ঘনীভূত হয়। বুক ভারী হয়ে আসে। মনে পড়ে ‘‘তিতাস একটি নদীর নামে মালো জীবন ধরা, এই জীবনে ক্লান্তি আছে, আছে অভাব খরা। তিতাস নদী বয়ে গেছে, আজও বয়ে যায়, মালো জীবন থমকে আছে, সুবলা সেথায় নাই।’’
No comments:
Post a Comment