Sunday, August 25, 2013

Kobita

কথোপকথন -৪
------পুর্ণেন্দু পত্রী

- যে কোন একটা ফুলের নাম বল
- দুঃখ ।
- যে কোন একটা নদীর নাম বল
- বেদনা ।
- যে কোন একটা গাছের নাম বল
- দীর্ঘশ্বাস ।
- যে কোন একটা নক্ষত্রের নাম বল
- অশ্রু ।
- এবার আমি তোমার ভবিষ্যত বলে দিতে পারি ।
- বলো ।
- খুব সুখী হবে জীবনে ।
শ্বেত পাথরে পা ।
সোনার পালঙ্কে গা ।
এগুতে সাতমহল
পিছোতে সাতমহল ।
ঝর্ণার জলে স্নান
ফোয়ারার জলে কুলকুচি ।
তুমি বলবে, সাজবো ।
বাগানে মালিণীরা গাঁথবে মালা
ঘরে দাসিরা বাটবে চন্দন ।
তুমি বলবে, ঘুমবো ।
অমনি গাছে গাছে পাখোয়াজ তানপুরা,
অমনি জোৎস্নার ভিতরে এক লক্ষ নর্তকী ।
সুখের নাগর দোলায় এইভাবে অনেকদিন ।
তারপর
বুকের ডান পাঁজরে গর্ত খুঁড়ে খুঁড়ে
রক্তের রাঙ্গা মাটির পথে সুড়ঙ্গ কেটে কেটে
একটা সাপ
পায়ে বালুচরীর নকশা
নদীর বুকে ঝুঁকে-পড়া লাল গোধূলি তার চোখ
বিয়েবাড়ির ব্যাকুল নহবত তার হাসি,
দাঁতে মুক্তোর দানার মত বিষ,
পাকে পাকে জড়িয়ে ধরবে তোমাকে
যেন বটের শিকড়
মাটিকে ভেদ করে যার আলিঙ্গন ।
ধীরে ধীরে তোমার সমস্ত হাসির রং হলুদ
ধীরে ধীরে তোমার সমস্ত গয়নায় শ্যাওলা
ধীরে ধীরে তোমার মখমল বিছানা
ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টিতে, ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টিতে সাদা ।
- সেই সাপটা বুঝি তুমি ?
- না ।
- তবে ?
- স্মৃতি ।
বাসর ঘরে ঢুকার সময় যাকে ফেলে এসেছিলে
পোড়া ধুপের পাশে ।

Monday, July 15, 2013

একার সঙ্গে মুখোমুখি হলো একা

প্রবন্ধ...           
৩০ আষাঢ় ১৪২০ সোমবার ১৫ জুলাই ২০১৩

‘একার সঙ্গে মুখোমুখি হলো একা’
ক’দিন আগে এক বন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে তাদের আবাসনে ঢুকছি, গেটের প্রহরী আমাকে দাঁড় করিয়ে নাম-ঠিকানা লিখতে বললেন। বন্ধুর ফ্ল্যাটে ঢুকতেই তার প্রশ্ন: ‘সিকিয়োরিটি গার্ড কোনও অসভ্যতা করেনি তো?’ বললাম, ‘অসভ্যতা কেন হবে, প্রহরী তাঁর ডিউটি করেছেন, আমাকে দাঁড় করিয়ে নাম-ঠিকানা লিখিয়ে নিলেন।’ এ বারে বন্ধুটির রসিকতা: ‘থিয়েটারের স্টার বলে চিনতে পারেনি, রণবীর কপূর হলে ছেড়ে দিত।’
একমত হতে পারলাম না। রণবীর কপূরকেও কড়া প্রহরায় হাত তুলে দাঁড়াতে হয়, ভারতে যদি নাও-বা হয়, আমেরিকার কোনও বিমানবন্দরে তো বটেই। আমরা প্রত্যেকে যে পেশারই হই-না-কেন, যত উঁচুতেই উঠি-না-কেন, আমাদের কোথাও-না-কোথাও হাত তুলে দাঁড়াতেই হয়। এ কথাটাই আমাদের খেয়াল থাকে না দৌড়তে দৌড়তে। ঘোড়ার পিঠে চেপেছি তো আমরা, হুঁশ থাকে না কোথায় থামতে হবে। ভুলে যাই যে, যদি না থামতে চাই, নিজেদেরই ছোট্ট অথচ মারাত্মক কোনও ত্রুটিতে এক সময়ে ঠিক থেমে যেতে হয়। তখন হাত তুলেই দাঁড়াতে হয়, মাথা নোয়াতে হয় কোনও ব্যবস্থা বা রাষ্ট্রশক্তি, প্রতিষ্ঠান বা মিডিয়া-র রক্তচক্ষুর সামনে। নিজের কাছেই নিজেকে জবাবদিহি করতে হয়।
‘অলীক সুখ’-এর যে চরিত্রে আমি অভিনয় করেছি, তার ঠিক এমনই দশা! সে ডাক্তার, রীতিমত দায়িত্ববান, তার রোগীদের প্রতি, তার পরিবারেরও প্রতি। সে যেমন যত্ন করে রোগী দেখে, তেমনই যত্ন করে বাবা-মা-বউ-বাচ্চাকে। নিজের ডাক্তারির গুণেই সে ক্রমশ যশ-অর্থ পেতে শুরু করে। সেই পাওয়াটা বাড়তে-বাড়তে এমন এক জায়গায় এসে দাঁড়ায়, ক্ষণিকের জন্যে হলেও সে তার কর্তব্যের বোধ থেকে সরে যায়। ফলে অপরিমেয় ক্ষতি তার রোগীর তো হয়ই, সমপরিমাণ ক্ষতি তার নিজেরও হয়। নিজের কাছেও সে খুব ছোট হয়ে যায়। তার মাস্টারমশাই, তিনিও ডাক্তার, তাকে বলেন মানুষের শরীর যে যন্ত্র নয়, এটা তুমি ভুলে গেলে কী করে?
যে সব ডাক্তার দিনে প্রচুর অপারেশন আর একগাদা চেম্বার করেন, ক্রমাগত এক নার্সিংহোম থেকে অন্য নার্সিংহোমে ছুটে বেড়ান, এ-ছবিতে তাঁদের সম্পর্কে প্রশ্ন ওঠে এঁরা প্রত্যেক রোগীকে চার মিনিটের বেশি সময় দেন না, এঁরা রোগীর মন বুঝবেন না রোগ বুঝবেন?
কিন্তু এটা তো শুধু ডাক্তারি পেশার সমস্যা নয়, প্রতিটি পেশারই সমস্যা। এটা আদতে একটা মূল্যবোধের লড়াই কী ভাবে দেখব নিজের পেশাটাকে, নিজের জীবনটাকে? নিশ্চয়ই নিজের যোগ্যতা অনুযায়ী কাজ করে যাব, সে কাজের বিনিময়ে যা প্রাপ্য তা নেব। কিন্তু আমার প্রচেষ্টা আর প্রাপ্য এ দু’য়েরই যে একটা পরিসীমা আছে, সেটাও পাশাপাশি মনে রাখব। যদি না রাখি তাহলে নাম আর বিত্তের পিছনে ছুটতে-ছুটতে এমন কোনও বড় ভুল করে বসব যা অসংশোধনীয়।
এ সমস্যা আমারও হয়, যখন সকালে একটা শো করে ফের বিকেলে আর একটা শো করি। হয়তো দুটোই আমার প্রিয় নাট্যদল, দুটোই আমার প্রিয় চরিত্র, অভিনয়ের দিক থেকে অত্যন্ত চ্যালেঞ্জিং, এবং অভিনয়টা করেও আমি অসম্ভব একটা আনন্দ পাই, অনাবিল আনন্দ। কিন্তু ওই আনন্দ পাওয়ার মধ্যে কোনও বিপদ ঘনিয়ে ওঠে না তো? পাতা থাকে না তো কোনও ফাঁদ? শঙ্খ ঘোষের একটা কবিতায় আছে‘গভীর ঘুমের মধ্যে/ হাসিখুশি মুখে সর্বনাশ এসে দাঁড়ায়/ তার আদরে আদরে ভরে যেতে থাকে আমার অপাবৃত শরীর।/ ক্ষতগুলি চেনা যায় জেগে উঠবার বহু পরে।’ এই যে একটা শো থেকে আর একটা শো, একটা অভিনয় থেকে আর একটা অভিনয়, ক্রমাগত দৌড়ে চলেছি ওই দৌড়টাই আসলে ‘গভীর ঘুম’, আর তার মধ্যেই ‘সর্বনাশ এসে দাঁড়ায়’। যে অ্যাচিভমেন্ট বা সাফল্যের জন্যে এই দৌড়, সেটাই ‘অলীক সুখ’। তারপর যখন সম্বিত ফেরে, তখন বুঝতে পারি ‘ক্ষতগুলি চেনা যায় জেগে উঠবার বহু পরে’।
অথচ এটাকে কাজ মনে করেই আমি দৌড়চ্ছিলাম, নিজেকে পুরোদস্তুর পেশাদার প্রমাণ করার জন্যেই। কিন্তু আমার এই কর্মসচেতনতার তলায় অচেতনে কোথাও অহংকার লুকিয়ে থাকে না কি? প্রশ্নটা প্রায়ই আমাকে কুরে-কুরে খায়। হয়তো প্রতিটি পেশার প্রতিটি এগিয়ে-থাকা মানুষকেই। অথচ প্রশ্নটাকে আমরা এড়িয়ে যেতে থাকি। আসলে প্রশ্নটাকে নয়, এড়াচ্ছি নিজের সঙ্গে নিজের মুখোমুখি হওয়াটাকে। আয়নার সামনে চুলের মুঠি ধরে নিজেকে টেনে আনতে আমরা যে ভয় পাই। নিজের ভিতরের মানুষটাকে পুরো দেখে ফেললে ভারী অস্বস্তি হয়, সব রকমের গোলমাল আর অকিঞ্চিৎকর ব্যাপারস্যাপারগুলো ধরা পড়ে যায়। এখানেও শঙ্খ ঘোষ এসে পড়েন, ‘একার সঙ্গে মুখোমুখি হলো একা।’ সত্যিই যদি একার সঙ্গে মুখোমুখি হতে পারতাম একা, বোঝাপড়া করতে পারতাম, হয়তো বেঁচে যেতাম সর্বনাশের হাত থেকে।
বেঁচে থাকার এই বোধটা প্রখর ছিল শিশিরকুমার ভাদুড়ির। যখন তিনি তুমুল জনপ্রিয়, সাফল্য-খ্যাতির তুঙ্গে, তখনও তিনি অনায়াসে রুস্তমজি ধোতিওয়ালা’র ম্যাডান কোম্পানির নিশ্চিন্ত আশ্রয় ছেড়ে বেরিয়ে এসেছিলেন। আর বেরিয়ে আসার সময় দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের ‘সীতা’য় রামের সংলাপ উচ্চারিত হয়েছিল তাঁর কণ্ঠে: ‘এই অন্তঃসারশূন্য গৌরব/ এ পাপ, পরি শুধু পুণ্য ছদ্মবেশ’। মানুষটার সঙ্গে বসবাস করি তো এখন, ‘নিঃসঙ্গ সম্রাট’-এ শিশিরকুমারের চরিত্রটা আমাকে করতে হয়, ওঁর অভিনীত চরিত্রের সংলাপগুলো যেন নিজের সংলাপ বলে মনে হয়।
‘অলীক সুখ’-এর ডাক্তারের কথায় ফিরে আসি। সে তো আসলে সুখ চেয়েছিল, তার বাবা-মা-বউ-বাচ্চাকে সুখী করতে চেয়েছিল, বলেওছে তার স্ত্রীকে এ সব কার জন্যে করছি? তোমাদের সুখের জন্যেই তো! ‘আন্তিগোনে’ নাটকে আন্তিগোনেও ক্রেয়নকে জিজ্ঞেস করেছিল ‘সুখ কাকে বলে?’ ক্রেয়ন বলেছিল ‘যতটুকু সুখ তুমি জীবন থেকে আদায় করে নিতে পারো, ততটুকুই জীবন, তার বেশি কিছু নয়।’ ক্রেয়নের কথা মেনেই বোধহয় আমরা কিংবা ‘অলীক সুখ’-এর ডাক্তারটি সুখ আদায় করার জন্যে ছুটে চলেছি। যতটুকু সুখ ততটুকুই জীবন এমন এক অলীক তাড়নাই আমাদের ছুটিয়ে নিয়ে চলেছে।
এ ভাবে নিশ্চয়ই প্রতিষ্ঠা পাওয়া যায়, জীবনে লব্ধপ্রতিষ্ঠ হতে হবে এমন উপদেশ শুনতে-শুনতেই তো বড় হই আমরা। তাছাড়া, সমাজে সম্মাননীয় হয়ে ওঠায় আপত্তিই-বা কোথায়? আমি-আপনি সকলেই তো চাই এমন অভীষ্ট বা লক্ষ্যে পৌঁছতে। শুধু পৌঁছনোর পথটা নিয়ে যেন একটু সতর্ক থাকি, মানবিক বোধগুলিকে যেন ছেঁটে না ফেলি...
না হলে অভীষ্ট পূরণের পর কোনও এক দিন যখন একা-একা কথা বলব নিজের সঙ্গে, ফের শঙ্খ ঘোষের কবিতা এসে বিব্রত করবে: ‘সম্মানের অপমানে তুমি কি গিয়েছ খুব ঝুঁকে?’

Sunday, June 23, 2013

তোমার চোখে সেদিন আমি ভালবাসা দেখে ছিলাম

তোমার চোখে সেদিন আমি ভালবাসা দেখে ছিলাম


তোমাকে হারাবার ভয় আমি আজো অনুভব করি
যেমনটা করে ছিলাম সেই সন্ধ্যে বেলায়
পিচ ঢালা পথের ধারে বসে ।
ছিলনা অর্কিড কিংবা হাস্নাহেনার মাতাল গন্ধ
 
তোমাকে মনে হয়েছিল সেই দিন
 
স্ট্যাচু অব লিবার্টির মতো
 
নিশ্চুপ অথচ সংকল্প বদ্ধ ।

তোমাকে হারাবার সেই দিনগুলো আজো মনে পড়ে
 
কাঠ পাথরের এই শহুরে জীবনের পরতে পরতে
 
হারাবার বেদনায় ম্রিয়মান, এই ধূসর আমি

আজ শেষ দিনগুলোর প্রান্তে এসে
 
তোমার চোখে সেদিন আমি ভালবাসা দেখে ছিলাম
আমি কিছু বলতে চাই
অনেক কাল হতে মনের গভীরে
লুকিয়ে থাকা ব্যাথা গুলোর কথা ।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছদ্মনাম

 রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছদ্মনাম 

ভানুসিংহ ঠাকুর

অকপট চন্দ্র ভাস্কর
আন্নাকালী পাকড়াশী
দিকশূন্য ভট্টাচার্য
নবীন কিশোর শর্মন
ষষ্ঠীচরন দেবশর্মা
বানীবিনোদ বিদ্যাবিনোদ
শ্রীমতী কনিষ্ঠা
শ্রীমতী মধ্যমা

Tuesday, April 16, 2013

জন্মদিন - শুভ দাসগুপ্ত

জন্মদিন - শুভ দাসগুপ্ত
আজ পয়লা শ্রাবণ।
খোকনআজ তোর জন্মদিন।
তুই যখন জন্মেছিলিআমরা তখন যাদবপুরে
নতুন গড়ে ওঠা কলোনীর টালির ঘরে। 
তোর ইস্কুল মাস্টার বাবা 
সেই হ্যারিকেনের আলো জ্বলা ঘরেই 
আনন্দে আর খুশিতে ঝলমলে হয়ে উঠেছিলেন 
তুই আসার পর। তোর নাম রেখেছিলেন -     সুকল্যাণ। 
মানুষটার মনটা ছিল শিশুর মতন 
অভাবে অনটনেবেঁচে থাকার নানা দুর্বিপাকেও 
ভেঙ্গে পড়তেন না কখনও। সকলের ভাল চাইতেন মন থেকে। 
বলতেন দেখো একদিন এই দেশের মানুষ 
ঠিক খুঁজে পাবে মুক্তির পথ। শোষণ থেকে মুক্তি 
দারিদ্র থেকে মুক্তি অশিক্ষা থেকে মুক্তি...

আজ পয়লা শ্রাবণ 
খোকনআজ তোর জন্মদিন।
ছোটবেলায়তোর মনে আছেআমাদের ভাঙ্গা মেঝেতে 
বাক্স থেকে বার করা মেজো-মাসীর হাতে তৈরি আসনটা
পেতে দিতাম। সামনে রাখতাম ঠাকুরের আসনের প্রদীপখানা।
তুই বসতিস বাবু হয়ে চুপটি করে।
তোকে আমরা একে একে ধান দুব্বো মাথায় দিয়ে আশীর্বাদ করতাম।
বাবা বলতেন বড় হও মানুষ হও।
তোর বাবার সেই বন্ধু -ঘোষ কাকা তিনি বলতেন 
বেঁচে বর্তে থাকো। 
তুই জিগ্যেস করতিস -মাবর্তে মানে কি মা?
আমি শুধু তোর মাথায় ধান-দুব্বোই দিতাম। 
বলতাম না কিছুই। শুধু মনে মনে বলতাম 
ঠাকুরআমার খোকনকে মস্ত বড় মানুষ করে তোলো
আমার খোকন যেন সত্যিই মানুষ হয়।
ওর যেন কখনো কোনো বিপদ না হয় ঠাকুর।
অভাবের সংসারে ওই একটা দিন- পয়লা -    শ্রাবণ 
কষ্টের পয়সায় একটু বাড়তি দুধ নিতাম। 
পায়েস রান্না করে দিতাম তোকে।
তুই খুব ভালবাসতিস পায়েস খেতে।
তোর বাবা বাসস্টান্ডের দোকান থেকে নিয়ে আসতেন 
তোর প্রিয় মিষ্টি ছানার গজা।
সামান্য ইস্কুল মাস্টারিতে কীই বা আয় হত;
ঘরে বসে ছাত্র পড়িয়ে আসতো কিছু।
দাউ দাউ অভাবের আগুনে সে রসদ পুড়তে সময় লাগত না।
তোর বাবার জামা সেলাই করতাম আর বার বার বলতাম 
আসছে মাসে একটা জামা বানিয়ে নিও।
উনি হেসে উঠে বলতেনবাদ দাও তোখোকন বড় হচ্ছে।
ওর জন্য ভাবছি দুধ রাখতে হবে আরো আধসের-
দুধে শক্তি বাড়ে। বুদ্ধি বাড়ে। শক্তি আরে বুদ্ধি না হলে 
তোমার খোকন মস্ত বড় মানুষ হয়ে উঠবে কি করে?
ভাবছি আরো দুটো টিউশনি নেব।

ছাত্র পড়িয়ে পড়িয়ে মানুষটা দিনের শেষে ক্লান্ত হয়ে যেতেন।
বারান্দার ধার ঘেঁষে যখন রাতের অন্ধকারে জোনাকির ব্যস্ততা,
আর ঘরে তোর পড়া মুখস্থ করার একটানা সুর 
আমাদের কলোনীর ভাঙ্গাচূড়া বাড়িটাকে জীবন্ত করে রাখতো-
তখন বলতেন আমায়খাওয়া দাওয়া একটু করো - তোমার চেহারাটা 
বড় ভেঙ্গে পড়ছে দিন দিন... শাড়িটাও তো দেখছি বেশ ছিঁড়েছে- 
কালই আমি ফেরার পথে একটা শাড়ি নিয়ে আসব। ধারেই আনব। 
আমি বলতাম-ধুর। সামনে খোকনের উঁচু ক্লাস-
কত বই পত্তর কিনতে হবেকত খরচ। 
উনি দীর্ঘশ্বাস ফেলে চুপ করে যেতেন। 
জোনাকিরা নিঃশব্দ অদৃশ্য আলোর আলপনা আঁকত
উঠনের আগাছার ঝোপে।
আবহ সঙ্গীতের মত তুই ভেতরে বসে বসে পড়া মুখস্থ করতিস।
ইতিহাসভূগোলগ্রামার।

ঈশ্বর আমাদের নিরাশ করেননি।
তুই কত বড় হলি।
সব পরীক্ষায় কত ভাল ফল হল তোর।
বাবা বললেনআরও পড়। উচ্চ শিখাই উচ্চ সম্মানের 
এক মাত্র পথ। তুই আরও পড়লি।

তারপর...
তোর চাকরি হল কত বড় অফিসে 
মনে আছে খোকাপ্রথম মাসের মাইনে হাতে পেয়েই 
তুই কত কী কিনে এনেছিলি?
তখন তো আমরা উঠে এসেছি শ্যামবাজারে।
দু'কামরার বেশ সাজানো ঘোচানো গোছানো বড় ফ্লাট।
তোর অফিস থেকেই তো দিয়েছিল।
সেই বাড়ি সেই ঘর সেই বেলকনিকত স্মৃতিকত ছবি!
ঐ বাড়িতেই তো
আশ্বিনের ঝড়ো বিকেলে- -  তোর মনে আছে খোকন
তোর বাবা যেদিনটাতে চলে গেলেন মনে আছে?
তুই বাবার বুকের ওপর পড়ে যখন কাঁদছিলি হাপুস নয়নে 
সদ্য স্বামীহারাআমি সেদিন তোর সেই অসহায় মুখ দেখে 
আরো বেশি করে ভেঙ্গে পড়েছিলাম।
তোকে বুকে টেনে নিয়েছিলাম ছোটবেলার মত।
বলেছিলাম- 
কাঁদিস না খোকা। আমিতো আছি। 

আজ পয়লা শ্রাবণ 
কলকাতা থেকে অনেক দুরে মফস্বলের এই বৃদ্ধাশ্রমে 
আমি একেবারে একাখোকন। 
তোকে বড় দেখতে ইচ্ছে করছে রে। 
তোকেবৌমাকে আর ছোট্ট বিল্টুকে। 
তোরা এখন কত দুরে- 
সল্ট-লেকের মার্বেল বসানো ঝকঝকে বাড়িতে। 
আজ তোর জন্মদিনের নিশ্চয়ই খুব বড় পার্টি হচ্ছে-
তাই নারে খোকনলোকজনহৈচৈখাওয়া-দাওয়া।
খুব ভালখুব ভাল।
খোকনআজ পয়লা শ্রাবণ
আমার বড় মনে পড়ছে যাদবপুরের ভাঙ্গা ঘরে রাত্রে 
তুই আমার পাশে শুয়ে মাঝে মধ্যে হঠাৎ খুব ভয় পেয়ে 
জড়িয়ে ধরতিস আমাকে। আমি বলতামভয় কী রে?
আমি তো আছি। মা তো আছে খোকনের। যার মা থাকে 
তাকে কী ভুতে ধরে
তুই নিশ্চিন্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়তিস আমার বুক জুড়ে।
তোর আধুনিক সংসারে 
এই বুড়িটার একটু ঠাই হল নারে?
প্রতিমাও তো মা। ওরও তো আছে আমার খোকনেরই মত 
কোল আলোকরা এক চাঁদের টুকরো।
কিন্তু সময়ের কী আশ্চর্য পরিবর্তন!

খোকন!
তুই বোধহয় আর এখন পায়েস খাস নাতাই নারে?
তুই জানিস না খোকন 
আজ আমি সকালে পায়েস রান্না করেছি। হ্যাঁ 
তোরই পাঠানো টাকায়।
সারাদিন সেই পায়েসের বাটি সামনে নিয়ে বসে আছি রে।
এখানে এই বৃদ্ধাশ্রমে 
আমার একলা ঘরে 
আর কেউ নেই।
তুই একবার আসবি খোকন। 
একবার.... 
শুধু একবার...

বাতাসে লাশের গন্ধ - রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ


বাতাসে লাশের গন্ধ

রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ 

আজো আমি বাতাসে লাশের গন্ধ পাই
আজো আমি মাটিতে মৃত্যূর নগ্ননৃত্য দেখি,ধর্ষিতার কাতর চিৎকার শুনি আজো আমি তন্দ্রার ভেতরেএ দেশ কি ভুলে গেছে সেই দু:স্বপ্নের রাতসেই রক্তাক্ত সময় ?বাতাসে লাশের গন্ধ ভাসে
মাটিতে লেগে আছে রক্তের দাগ।
এই রক্তমাখা মটির ললাট ছুঁয়ে একদিন যারা বুক বেঁধেছিলো-
জীর্ণ জীবনের পুঁজে তারা খুঁজে নেয় নিষিদ্ধ আঁধার,আজ তারা আলোহীন খাঁচা ভালোবেসে জেগে থাকে রাত্রির গুহায়।
এ যেন নষ্ট জন্মের লজ্জায় আড়ষ্ট কুমারী জননী, 
স্বাধীনতা - একি তবে নষ্ট জন্ম ?একি তবে পিতাহীন জননীর লজ্জার ফসল ?জাতির পতাকা খামচে ধরেছে আজ পুরোনো শকুন। 
বাতাসে লাশের গন্ধ
নিয়ন আলোয় তবু নর্তকীর দেহে দুলে মাংসের তুফান।
মাটিতে রক্তের দাগ -
চালের গুদামে তবু জমা হয় অনাহারী মানুষের হাড়
এ চোখে ঘুম আসেনা। সারারাত আমার ঘুম আসেনা-
তন্দ্রার ভেতরে আমি শুনি ধর্ষিতার করুণ চিৎকারনদীতে পানার মতো ভেসে থাকা মানুষের পচা লাশ
মুন্ডহীন বালিকার কুকুরে খাওয়া বিভৎস্য শরীর
ভেসে ওঠে চোখের ভেতরে। আমি ঘুমুতে পারিনাআমি
ঘুমুতে পারিনারক্তের কাফনে মোড়া - কুকুরে খেয়েছে যারেশকুনে খেয়েছে যারে
সে আমার ভাইসে আমার মাসে আমার প্রিয়তম পিতা।
স্বাধীনতাসে আমার স্বজন হারিয়ে পাওয়া একমাত্র স্বজন -
স্বাধীনতা - আমার প্রিয় মানুষের রক্তে কেনা অমূল্য ফসল।
ধর্ষিতা বোনের শাড়ী ওই আমার রক্তাক্ত জাতির পতাকা।

Sunday, April 7, 2013

প্রবন্ধ | Anandabazar


আমরা মাতামাতি না করলেই ওঁদের মঙ্গল

দোহাই, শাহবাগ প্রাঙ্গণে ভিড় জমানো জনগণের প্রতি একাত্ম হওয়ার আগ্রহে এমন কিছু যেন আমরা করে না ফেলি, যা শেষ পর্যন্ত তাঁদেরই মস্ত ক্ষতি করে বসবে।

অশোক মিত্র
কলকাতা, ৩ এপ্রিল ২০১৩

probondho
আমাদেরও? অ্যাকাডেমি অব ফাইন আর্টস-এর সামনে। কলকাতা, মার্চ ২০১৩। ছবি- প্রদীপ আদক।
ঢাকা শহরের উত্তর উপকণ্ঠে শাহবাগ প্রাঙ্গণে অহোরাত্র মাতৃভাষা-প্রেমিকরা জড়ো হয়ে আছেন, তাঁরা প্রেরণার গান গাইছেন, প্রতিজ্ঞার গান গাইছেন, একটির পর আর-একটি কবিতা আবৃত্তি করে যাচ্ছেন, রবীন্দ্রনাথের কবিতা, অথবা নজরুলের, দুই বাংলার ঘরে ঘরে যে-সব কবিতা প্রতিদিন মন্ত্রের মতো উচ্চারিত হয় সে-সমস্ত কবিতা। বিশেষ করে রবীন্দ্রনাথের গানের প্লাবনে প্রাঙ্গণ ভেসে যাচ্ছে, যাঁরা জড়ো হয়েছেন, হচ্ছেন, আগামী দিনেও হবেন তাঁরা অঙ্গীকারবদ্ধ যত ষড়যন্ত্রই হোক, যত নতুন নতুন বাধা পথ রোধ করে দাঁড়াক না কেন, যে মাতৃভাষার স্বপ্ন বুকে জড়িয়ে তাঁরা মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছিলেন, জয়লাভ করেছিলেন, গোটা পৃথিবীকে দেখিয়ে দিয়েছিলেন মাতৃভাষায় কী অমৃতের স্বাদ, সেই ভাষা তাঁদের জন্মগত অধিকার, কোনও দুশমনই ছিনিয়ে নিতে পারবে না। এ-পার বাংলায় আমরা যারা অধিষ্ঠান করছি তারা টেলিভিশনে-সংবাদপত্রে শাহবাগ প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত ঘটনাবলির প্রতিবেদন দেখে এবং পড়ে উজ্জীবিত হই, কারও কারও হয়তো সাধ জাগে ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটে গিয়ে সেই জমাট ভিড়ের শরীরে নিজেদের মিলিয়ে দিই।
এখানেই সমস্যা আমরা বঙ্গভাষী হতে পারি, কিন্তু একটি ভিন্ন দেশের নাগরিক। ওখানকার ঘটনাবলির ছবি টেলিভিশনের পর্দায় আমরা যেমন এখানে বসে দেখি, শাহবাগ প্রাঙ্গণে অবস্থানকারীদের অভিনন্দন জানিয়ে কলকাতায় যে-সব সভাসমিতি হচ্ছে, মিছিল শোভাযাত্রা বেরোচ্ছে, সে-সবের ছবিও বাংলাদেশ পৌঁছয়, শাহবাগ প্রাঙ্গণে অবস্থানরতদের যাঁরা ঘোর বৈরী, তাঁদের কাছেও পৌঁছয়, অপপ্রচারের দক্ষিণ দুয়ার উন্মোচিত হয়। হিন্দু ভারতবর্ষের সঙ্গে হাতে হাত মিলিয়ে কতিপয় দেশদ্রোহী ইসলামের বিরুদ্ধে, আরব ভাষার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছে, শাহবাগ প্রাঙ্গণে জমায়েত হওয়া কুচক্রীদের প্রেরণা জোগানো হচ্ছে হয় কলকাতা থেকে নয় নতুন দিল্লি থেকে, বাংলাদেশকে ভারতবষের্র সঙ্গে যুক্ত করে নেওয়ার অভিপ্রায়ে এটা অন্যতম প্রাথমিক উদ্যোগ।
একটু পুরনো বৃত্তান্তে প্রত্যাবর্তন করি। পাকিস্তাান প্রতিষ্ঠিত হওয়ার ছয় মাসের মধ্যেই মহম্মদ আলি জিন্না ঢাকা শহরে এলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলে সভা হল। ছাত্রদের ভিড়ে সভাগৃহ ঠাসা। জিন্না সাহেব চোস্ত ইংরেজিতে সুস্পষ্ট ঘোষণা করলেন, পাকিস্তানের জাতীয় ভাষা একমাত্র উর্দু, অন্য কোনও ভাষা নয়। সঙ্গে সঙ্গে সারা কার্জন হল কাঁপিয়ে উচ্চনিনাদে ছাত্রদের নম্র অথচ সুদৃঢ় প্রতিবাদ, ‘কায়েদে আজম জিন্দাবাদ, রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’। জিন্নার মুখমণ্ডল থমথমে, তিনি আর একটি কথাও উচ্চারণ না-করে সভা থেকে নিষ্ক্রান্ত হলেন। সেই তো শুরু, মাতৃভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য আন্দোলন সংহত থেকে সংহততর হল, ১৯৫২ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি হত্যালীলায় যুগান্তের সূচনা, ঘরে ঘরে মাতৃভাষা-বন্দনা, ছেলেমেয়েরা বাবামায়েদের বোঝায়, আত্মীস্বজনদের কাছে যুক্তি দাখিল করে, যে রবীন্দ্রসংগীত গাওয়া বা শোনা সাধারণ্যে নিষিদ্ধ, গোপন শিক্ষায়তন খুলে তার অদম্য তালিম চলে। তার পর প্রায় দু’দশক ধরে প্রশাসনের সঙ্গে জনগণের চোরাগোপ্তা লড়াই, যে লড়াই উপসংহারে পৌঁছেছে একাত্তর সালের ১৬ ডিসেম্বর তারিখে। জামাতপন্থী অতি সামান্য কিছু মানুষজনকে বাদ দিলে গোটা জাতি একটি স্বাধীন দেশের স্বাধীন নাগরিকদের মাতৃভাষায় শিক্ষিত হওয়ার, পারস্পরিক বিনিময়-প্রতিবিনিময়ের এবং জীবিকার্জনের প্রধান মধ্যবর্তিতা স্বতঃসিদ্ধ হিসাবে মেনে নিয়েছিলেন।
বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর সেই ধারা অব্যাহতই ছিল। অস্বীকার করে লাভ নেই, বাংলাভাষার উন্মেষ ও ইতিহাস নিয়ে যত তন্নিষ্ঠ চর্চা বাংলাদেশে গত কয়েক দশক ধরে হয়েছে, পশ্চিমবঙ্গে তার ছিঁটেফোটাও হয়নি। মাতৃভাষার ব্যাকরণ, বাক্য গঠন, ক্রিয়া প্রয়োগ ইত্যাদি বিষয় নিয়ে যে গবেষণার স্তূপ বাংলাদেশে গড়ে উঠেছে, পশ্চিমবঙ্গবাসী তা জেনে লজ্জা পাবেন। বাংলাদেশের মন্ত্রী বা আমলারা তাঁদের ভাষণে মাতৃভাষার যে বিশুদ্ধতা বজায় রাখেন, পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিবিদ ও প্রশাসকরা তা থেকে পর্যাপ্ত শিক্ষা গ্রহণ করতে পারেন। এমনকী ঘরোয়া কথোপকথন ও আলোচনায় যে পরিস্রুত বাংলা ঢাকা, রাজশাহী বা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশে শ্রুত হয়, এ বাংলায় আমরা বিস্ময়ে অভিভূত না-হয়ে পারি না।
এই বিবর্তন সবাই ঔদার্যের সঙ্গে মেনে নিয়েছিলেন, সেই সঙ্গে কিছু প্রচ্ছন্ন বা অপ্রচ্ছন্ন আত্মগরিমাবোধও ছিল। হঠাৎ ঈশান কোণে মেঘ দেখা দিয়েছে ঘরোয়া রাজনীতির সূত্র ধরে। মুক্তিযুদ্ধ পর্বে অনেক বর্বর নৃশংসতা ঘটেছে, যাঁর শেষ পর্যন্ত অখণ্ড পাকিস্তান তত্ত্বে বিশ্বাস করতেন, তাঁরা ১৯৭১ সালের পর কিছু দিন গা-ঢাকা দিয়েছিলেন, আস্তে আস্তে গর্ত থেকে বেরিয়ে এসেছেন। অভিযোগ, এঁদের কেউ কেউ পাকিস্তানি চর হিসেবে নিজেদের নিযুক্ত করে অনেক মুক্তিযোদ্ধাকে সে-সময় ধরিয়ে দিয়েছিলেন, সেই মুক্তিযোদ্ধাদের উপর বীভৎস অত্যাচার চালানো হয়েছিল, অনেককে নারকীয় কায়দায় খুন করা হয়েছিল পর্যন্ত। এই পর্বে যাঁরা শহিদ হয়েছিলেন, তাদের মধ্যে বেশ কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকবৃন্দ যেমন ছিলেন, সেই সঙ্গে একগুচ্ছ আইনজীবী, শ্রমিক বা কৃষক নেতার মতো মানুষজনও ছিলেন।
চার দশক গড়িয়ে গেছে। কিন্তু প্রিয়জনদের অমনধারা নিধন যাঁরা মেনে নিতে পারেননি, তাঁরা এতগুলি বছর ধরে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ছিলেন, তাঁদের আত্মজনদের নিধনে যারা প্রত্যক্ষ বা অপ্রত্যক্ষ ভাবে অংশীদার ছিল, তাদের খুঁজে বের করে বিচারের ব্যবস্থা করবেন, ফাঁসিতে লটকাবেন পর্যন্ত। তাঁদের অধ্যবসায় এত দিনে এক অর্থে সার্থক। এ-রকম কিছু অপরাধীকে চিহ্নিত করা গেছে, একটি বিশেষ আইন প্রয়োগ করে তাদের বিচারের ব্যবস্থা করা হয়েছে, অপরাধ প্রমাণিত হওয়ায় সম্প্রতি কয়েক জনের ফাঁসির আদেশ দেওয়া হয়েছে পর্যন্ত। এখানেই বিপত্তির উদ্ভব। বিশেষ আইনটি প্রয়োগ করার প্রশ্নে বাংলাদেশ যেন দু’ভাগ হয়ে গিয়েছে। চল্লিশ বিয়াল্লিশ বছর আগে সংগঠিত অপরাধের জন্য এখন প্রাণদণ্ডের বিধান কতটা যুক্তিযুক্ত তথা ন্যয়সঙ্গত তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে, দু’দিকেই যুক্তি-প্রয়োগে আবেগের সংমিশ্রণ। যুদ্ধকালীন অপরাধের জন্য প্রাণদণ্ড ঘোষণার এই নিদান প্রধান বিরোধী বাংলাদেশ ন্যাশনাল পার্টির আদৌ পছন্দ নয়। তাঁদের সন্দেহ, এই আইনের অপপ্রয়োগ ঘটতে পারে এবং শাসকগোষ্ঠীর না-পসন্দ অনেককেই হয়তো এই অপপ্রয়োগ-বলে পদে-পদে জেরবার হতে হবে। গোলমেলে রাজনৈতিক পরিস্থিতি, এরই মধ্যে বাংলাদেশ ন্যাশনাল পার্টির নেত্রী আইনটির প্রতিবাদে দেশ জুড়ে হরতালের ডাক দিলেন। হঠাৎ ভারত সরকারের একটি অবিবেচনার জন্য বিদেশ নীতির ঘোলা জল আর অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক কোন্দল একাকার হয়ে গেল। বাংলাদেশ জুড়ে তর্কবিতর্ক চলছে, সুযোগ বুঝে জামাতপন্থীরা বাংলাদেশ ন্যাশনাল পার্টির সঙ্গে আলতো গাঁটছড়া বাঁধছেন বা বাঁধার চেষ্টা করছেন এমন অবস্থায় কোনও কৌশলে ভারতের রাষ্ট্রপতি বাংলাদেশ সফর স্থগিত রাখতে পারতেন, তা করা হল না। জামাতপন্থীদের ফের মাথা তুলে দাঁড়াবার প্রচেষ্টার প্রতিবাদে শাহবাগ প্রাঙ্গণে মাতৃভাষা-অনুরাগীরা জড়ো হতে থাকলেন। অতি পবিত্র তাঁদের উচ্চারণ, ধর্মান্ধদের রোষ থেকে তাঁরা মাতৃভাষাকে সর্বপ্রহর রক্ষা করবেন, প্রতিজ্ঞার বহু বর্ণিল দীপ্তিতে শাহবাগের আকাশ রঞ্জিত। কিন্তু তা হলেও একটি শূন্যতাবোধ: বেগম জিয়ার সমর্থকরা এখানে গরহাজির, জাতির একটি অতুচ্ছনীয় অংশের প্রতিনিধিরা অনুপস্থিত।
এটা ভাবনার কথা। এর সঙ্গে যা যোগ করতে হয় মাতৃভাষার জন্য এই যে নতুন সংগ্রাম তা কিন্তু তাঁদেরই একান্ত। একষট্টি বছর আগে ছাত্রদের রক্তে যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাঙ্গণ প্লাবিত হয়, তখন ভারতবর্ষীয় আমরা কেউ ধারেকাছে ছিলাম না। ধীরে ধীরে সেই ছাত্র অভ্যুত্থান জাতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনের আদল পেয়েছে, সেই আন্দোলনের একেবারে শেষ মুহূর্তে ভারতবর্ষ থেকে খানিকটা সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। শাহবাগ প্রাঙ্গণে যে নতুন একটি আবেগের স্ফূরণ, তা-ও কিন্তু ও-পার বাংলার মানুষদের সত্তার গভীর থেকে উৎসারিত। গত পঞ্চাশ ষাট বছরে বার্তা বিনিময় প্রতিবিনিময়ে অনেক প্রগতি ঘটেছে। আগের সন্ধ্যায় শাহবাগ প্রাঙ্গণে কে কী বললেন, কে কী গাইলেন, যূথবদ্ধ কী অঙ্গীকার করা হল, সমস্ত খবরই পর দিন সকালে কলকাতায় বসে আমরা পুঙ্খানুপুঙ্খ জানতে পারি। বাঙালি আবেগের আমরাও তো অংশভুক, আমাদের অনেকেরই মধ্যে বাসনা জাগতে পারে শাহবাগ প্রাঙ্গণের সম্মিলিত উচ্চারণের সঙ্গে আমাদের উচ্চারণ মিলে যাক, আমরাও যেন অ্যাকাডেমির বাইরের প্রাঙ্গণে দ্রুত-ছায়া-নেমে-আসা অপরাহ্ণে শাহবাগ প্রাঙ্গণের অঙ্গীকৃত প্রতিশ্রুতির সঙ্গে গলা মেলাই। কিন্তু ভারতবর্ষের রাষ্ট্রপতি তাঁর সফরেরে তারিখ না-পাল্টে যে ভুল করেছেন, আবেগের বশে মুহ্যমান হলে তারই আর এক দফা মাসুল গুনতে হবে। শাহবাগ প্রাঙ্গণে জড়ো হওয়া বন্ধুদের যাঁরা রাজনৈতিক শত্রু, তাঁরা গলা ফাটিয়ে প্রমাণ করতে চাইবেন, বাংলাদেশের আকাশে যে গৃহযুদ্ধের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে, গোপনে ও প্রকাশ্যে তার ইন্ধন জোগাচ্ছে দুশমন ভারতীয়রা।
দোহাই, শাহবাগ প্রাঙ্গণে ভিড় জমানো জনগণের প্রতি একাত্ম হওয়ার আগ্রহে এমন কিছু যেন আমরা না-করে ফেলি, যা শেষ পর্যন্ত তাঁদেরই মস্ত ক্ষতি করে বসবে, বাংলাদেশের লড়াইটা বাংলাদেশিদেরই লড়তে দিন না কেন!
ভয়ে-ভয়ে অন্য একটি অনুরোধ কি করতে পারি? আপনি যদি যে-কোনও প্রতিবাদের সঙ্গে যুক্ত হতে আঁকুপাঁকু বোধ করছেন, একটা কাজ করুন না কেন। সম্ভ্রান্ত সচ্ছল ঘরের যে বাঙালি বাবা-মায়েরা তাঁদের সন্তানদের যাতে এমনকী মাধ্যমিক স্তরেও ওই বিতিকিচ্ছিরি বাংলা ভাষায় তালিম দিতে না হয়, তার জন্য কলকাতা জুড়ে নানা প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নামুন না!
 আনন্দবাজার পত্রিকা 
 

বিতর্ক - সিপিএমের 'এই চেহারা' তৃণমূলের দীর্ঘ ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করবে।


Share on emailMore Sharing Servic

buddha and bimanসিপিএমের 'এই চেহারা' তৃণমূলের দীর্ঘ ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করবে।


পক্ষে: কথাটা ১০০ শতাংশ সত্যি। মুখ্যমন্ত্রী ও রাজ্য সরকার অনেক ক্ষেত্রেই চূড়ান্ত ব্যর্থ। পরিবর্তন এখন অভিশপ্ত। রাজ্য জুড়ে নানা বিশৃঙ্খলা। কিন্তু বিকল্প হিসেবে যাদের দিকে তাকাই, সেই ব্যক্তিদের আর কিছুই দেওয়ার নেই। বিমান বসু, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য, নিরুপম সেনরা রাজনৈতিক বিশ্বাসযোগ্যতা হারিয়েছেন। তাঁদের এখন বনবাসে যাওয়ার সময়। সিপিএম পার্টি দেউলিয়া। অন্য বামদলগুলি তার পরগাছা। বৃদ্ধ অশোক ঘোষ থেকে বাকি বাম নেতারাও অচল আধুলি। বাম দলগুলিতে কোনও তাজা রক্ত নেই। কসবার নবীন কমরেড শতরূপ ঘোষ থেকে ঋতব্রত বন্দ্যোপাধ্যায় কোনও তাজা রক্তকেই 'উঠতে' দেওয়া হচ্ছে না। বাঙালি কাঁকড়ার মতো ক্ষমতা দখল করে পার্টির উপর ছড়ি ঘোরাচ্ছেন পলিটব্যুরোর 'পলিটিক্যালি বুড়োরা'। নেই কোনও ভাল মহিলা নেত্রীও। রেজিমেন্টেড পার্টির হাইকমান্ড হয়ে উঠেছেন প্রকাশ কারাট। প্রকাশ-বৃন্দার ইচ্ছেতেই চলে পার্টি। পার্টিতে বাঙালি নেতাদের কদরই নেই। বুদ্ধ-বিমান-নিরুপম-সেলিমের মতো তিন দশকের পুরনো মুখ আর তাঁদের মুখ নিঃসৃত শূন্যগর্ভ বাণীগুলি শুনে রাজ্যবাসী ক্লান্ত, হতাশ। তাই বিপথগামী ও ব্যর্থ তৃণমূলের 'দীর্ঘ' ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করছে এই দিশাহীন ভগ্ন, ন্যুব্জ চেহারার সিপিএমই।

বিপক্ষে: সিপিএম এই চেহারা নিয়েই ঘুরে দাঁড়াবে। কারণ সিপিএমের পায়ে শক্ত জমি দিচ্ছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় স্বয়ং। তাঁর মন্তব্য, প্রতিক্রিয়া, কাজকর্ম এমনই ভুলে ভরা যে এই দিশাহীন, ভগ্ন, ন্যুব্জ সিপিএমকেই দিশা ও শক্তি দেবে সেগুলি। ধর্ষণ, খুন, দুর্ঘটনা সবেই সিপিএমের চক্রান্তের ভূত দেখেন মুখ্যমন্ত্রী। তার উপর সিপিএম সুলভ রেজিমেন্টেড কায়দায় 'দল চালাচ্ছে' এবং ভোটের সময় 'ভোট করাচ্ছে' তৃণমূল। যা ভালভাবে নিচ্ছে না মানুষ। দাদাগিরি দেখে দু বছরেই পরিবর্তন নিয়ে স্বপ্নভঙ্গ হয়েছে রাজ্যবাসীর। তাই বৃদ্ধাশ্রম হয়ে যাওয়া আলিমুদ্দিন স্ট্রিট ধীরে ধীরে শক্তি ও জমি ফিরে পাচ্ছে। এভাবে চললে পরের বিধানসভাতেই ক্ষমতাচ্যুত হতে পারে তৃণমূল। তার আগে লোকসভা বা পঞ্চায়েতেও অগ্নিপরীক্ষার মুখে 'কংগ্রেস বিহীন' তৃণমূল। তাই দীর্ঘ ক্ষমতায়ন হবে না। কারণ দলটার নাম তৃণমূল।

Wednesday, March 27, 2013

চলতি হাওয়া | Anandabazar


 আমার আনন্দবাজার পত্রিকা থেকে সংগৃহীত 

ধরলে আজ তোমায় ছাড়ব না

অনির্বাণ চৌধুরী
কলকাতা, ২৬ মার্চ, ২০১৩

dol party songs
হুল্লুড়ে পার্টি করাই বিধেয়- শাস্ত্র এই বলছে, সামাজিকতাও। ছবি- অরণ্য সেন।
রাধা আর কৃষ্ণ নামে দুই ছোঁড়াছুঁড়ি নিয়ম করে রঙ নিয়ে যেই ধুম মাচিয়েছিল ইউপি মহল্লায়, তখন থেকেই সেটাই হয়ে দাঁড়াল দোল দিনের পার্টি করার সনাতনী প্রথা। তালিকায় বাকি ছিল কেবল বাঙালি কবিগুরুর অমোঘ ফরমান- 'আজ সবার রঙে রঙ মেশাতে হবে'! ভাবটা এই, না মেশালে আমার ঘেঁচু, তবে তোমার অনেক কিছু। অতএব, সব দিক মেপেজুপে সবাই যখন সাধছেই, তখন দোলের দিন প্রচুর রঙ দেওয়া, প্রচুর রঙ নেওয়া আর হুল্লুড়ে পার্টি করাই বিধেয়- শাস্ত্র এই বলছে, সামাজিকতাও। ওই ঠাকুরের লেখা ভাবুন, মনে পড়বে পুরনো কলকাতায় বিহারি দারোয়ানদের ঢোল বাজিয়ে নেচেগেয়ে রঙখেলার পার্টি। হুতোম প্যাঁচার নকশা বলছে জেলেপাড়ার সঙ-এর পার্টির পথে নামার কথা; যাদের ধেই নাচন দেখার জন্য ভিড় করেছে আমোদগেঁড়ে বাঙালি। ইতিহাস বলছে রাজা নবকৃষ্ণ দে-র বাড়ির দোলের সন্ধের বাঈনাচের কথা; সব দর্শক কনিয়াক হাতে সাহেবসুবো।সে দিন গেলেও ফূর্তি করার মনটা তো আর চলে যায়নি। সো, লেটস প্লে হোলি!তা, দোলের পার্টিতে গান হবে না- এ আবার কেমনধারা ব্যাপার? কী গান বাজাবেন, লিস্টি মিলিয়ে নিন।  পথে করে গমন। এই উদ্দামতা আসবে না মার্গসঙ্গীত বা ঠাকুরের গানে; তাই ডাইভ মারুন সিনেমাতেই। পার্টি পুরো জমে যাবে!
লাইসেন্সড অ্যাডালটারির গান : জানি, দোলের সকালের পার্টিতে না বললেও 'সিলসিলা' ছবির 'রঙ বরসে ভিগে চুনরওয়ালি' বাজবেই। শুধু দোহাই আপনাদের, এই গানটা দিয়ে পার্টি শুরু করবেন না- নিজেদের উচ্ছ্বাসই নিজেদের কাছে মেকি মনে হবে। আহা, পার্টি ওয়ার্মিং বলেও তো একটা ব্যাপার আছে; পার্টি করবেন আর তার নিয়ম মানবেন না- তা আবার হয় নাকি! এই গান হবে নেশা পুরো চড়ে গেলে; গেলাস গেলাস সনাতনী প্রথায় ভাঙ আর আধুনিকতায় ভদকা চড়িয়ে। তারপর শরীর-মন দুই যখন টলোমলো; নিজেকে সঁপে দিন ব্যারিটোন ভয়েসের কাছে। মাথায় থাকুক রাধা নামের পরের বউটাকে নিয়ে গিরিধারী নাগরের ঢলাঢলি; মাথায় থাকুক আয়ান ঘোষের অপ্রস্তুতের হাসিও। ভেবে নিন কেবল রেখা-অমিতাভ বচ্চন আর সঞ্জীব কুমার। ধর্মই যখন খোদ ছুঁকছঁকানির লাইসেন্স দিচ্ছে, প্রাণ খুলে রঙ মেখে অ্যাডালটারি করুন। তবে এই গানটা শুরুতে নয়। কোনটা তাহলে হতে পারে উদ্বোধনী সঙ্গীত?
অনুরোধের আসর : আমি বলি কী, কানু বিনে নয়, অমিতাভ বচ্চন বিনে ঠিক যেন দোলের পার্টির গানের নখরা জমে না। পার্টি শুরু করার জন্য তাই বেছে নিন ওই বুড়ো হাড়ের ভেলকি দেখানো 'ওয়াক্ত' নামের এক ছবির গান- 'ডু মি আ ফেভার, লেটস প্লে হোলি'। অমিতাভ বচ্চনের সঙ্গে অক্ষয় কুমার আর পিগি চপসও বহুত রঙঢং দেখিয়েছিলেন এই গানটায়। ভাবছেন নিশ্চয়ই, বুরবকটা শুরুতেই এই কম জনপ্রিয় গানটার কথা কেন বলল? তা আপনিই ভেবে দেখুন, সবাই কি আর পার্টি শুরু করার জন্য চেগে থাকবে? হোস্ট হিসেবে আপনাকেই তো জমিয়ে তুলতে হবে কেওড়াবাজি। আহা, শুরুটা করুনই না আলতোভাবে গলা ভেজাতে ভেজাতে; ধাপে ধাপে এগিয়ে যেতে তো আর কেউ বারণ করছে না।
বউদিবাজির দোল : পার্টি এবার খাতায়-কলমে যখন শুরু হয়েই গেছে, তখন তানানানা করে লাভ কি? ব্যাকগ্রাউন্ডে বাজান বলিউডের পেটেন্ট বউদিবাজির দোলের গান; 'শোলে' ছবির 'হোলি কে দিন দিল খিল যাতে হ্যায়'। বউদিবাজি এই গানের শব্দে-সুরে-চিত্রায়ণে সব জায়গায়। শুরুতেই তো এক মাতাল গ্রামের বউদির গায়ে ঢলে পড়ে বলেছে, 'ঠহের যা ভাবি'! বউদি অবশ্য বেশ কুলকাল, চাট্টি নথনাড়া দিয়ে সে 'আরে যা শরাবি' বলেই সটকে পড়েছে। আবার বীরু-বাসন্তী যখন নিজেদের রঙ মাখাতে ব্যস্ত, জয়ও তো তখন ঝাড়ি মেরেছে বিধবা বউদিকে। মন চাইলে আপনিও তার লাইসেন্স নিন; শুধু কবির মতো ঘরে খুঁজবেন না বাইরে- সে চিন্তা আপনার। বউদি অমিল হলেও ক্ষতি নেই, গানটার হুল্লোড় ঠিক টেনে নিয়ে যাবে রঙিন দুনিয়ায়। শুধু হ্যাঁ, মাঝে মাঝেই গলা ভেজাতে যেন ভুল না হয়।
ভয় পেও না, ভয় : আপনাদের হুল্লোড় দেখে কি কোনও অতিথি ভড়কে গেছেন? না ভড়কালেও মাত্তর দুটো গানে সবার আড় ভাঙবে- এটা আশা করা অন্যায়। তা বাদেও এমন কেউ পার্টিতে থাকতেই পারেন, রঙ যাঁর পছন্দ নয়। তাঁকে অভয় দিন; ব্যাকগ্রাউন্ডে বাজিয়ে দিন 'একান্ত আপন' ছবির 'খেলব হোলি রঙ দেব না '! নইলে আপনারই পার্টির একশো আট বার হল বলে; একদল নেশাড়ুর মধ্যে সাদা মাথার কেউ তো আসলে হংস মধ্যে বক যথাই। তাছাড়া, বাঙালির দোলে বাংলা গান বাজবে না, 'তাও কখনও হয়'? এই গান বাজিয়ে, সবার আড় কাটিয়ে তারপর চলে যান 'রঙ বরসে'-তে। এটাই শেষ বার নয়; এর পর থেকে ঘুরে ফিরে সারা পার্টিতেই বাজতে পারে এই গান। তারপরে কিম কর্তব্য?
দুলকি চালের ফিমেল ফিভার : ভেবে দেখলে, দোলের গানের সবকটাতেই বড্ড পুরুষের গা-জোয়ারি গন্ধ। সংবিধানে যখন সমান অধিকার, দোলের মতো একটা পার্টিতে থাকবে না? মেয়েরা একজোট হন, কয়েক পা পিছিয়ে ধাঁ করে চলে যান রেট্রোযুগে, সম্বল করুন 'বসন্ত বিলাপ' ছবির 'ও শ্যাম যখন তখন'। ‘খেলব হোলি’ গানটা দিয়েই শুরু হয়ে গেছে উইমেন এমপাওয়ারমেন্ট; এবারে মৃদু ভড়কি দিয়ে বোঝানোর পালা, 'যখন তখন, খেলো না খেলা এমন, ধরলে আজ তোমায় ছাড়ব না'। একজন মেয়েই দোলের দিনে মদির চাউনিতে শুইয়ে দিতে পারে একদল পুরুষকে, জোট বাঁধলে কার সাধ্য ঘাঁটিয়ে বিপদ আনে? তাছাড়া এতক্ষণের হইচই একটু শান্ত হবে এই দুলকি চালে; দোলের দিনে খরগোশ হওয়ার বদলে কচ্ছপ হওয়াই ভাল- সারা দিনটা পড়ে আছে যে!
আরেকটা বসন্ত বিলাপ : 'অ্যাকশন রিপ্লে' ছবিতে নিদারুণ বসন্তে দারুণ বিলাপ করতে করতে একটা দোলের গানে নেচেছিলেন ঐশ্বর্য রাই বচ্চন আর নেহা ধুপিয়া, 'জ্বলি তো বুঝি না কসম সে কোয়লা হো গয়ি'! মনসই ছেলে না পেয়েই এই হাহাকার। সেটুকু ছেঁটে হুল্লোড়টুকু নিয়ে উদ্দামতার ট্র্যাকে ফিরে আসুন এই গানটা দিয়েই, বেশ একচোট ধেইধেই করতে এ গানের কোনও জুড়ি নেই। ছেলেরা অবিশ্যি দারুণ ফ্রাস্টু খাবেই এ গান বাজালে- সারা বছর যখন তাদের মুর্গি করেন মেয়েরা, দোলের দিনেই বা ছেড়ে দেবেন কেন?
ব্যাক টু বচ্চন : দোলের লুচি-মালপোয়ার মতো না ফুলে পাত্তা আদায় করার জন্য আর পার্টি আরও জমাবার জন্য বচ্চন সাহেবের গানেই যাওয়া ভাল। বেছে নিন তাই 'বাগবান' ছবির 'হোলি খেলে রঘুবীরা অবধ মে'। শাহি হোলিতে তো শুধুই রাধাকৃষ্ণ কথা; রামসীতার দোলের উদ্দামতাও সঙ্গে থাকুক না। অপশন যখন আছে, সুযোগ কেউ ছাড়ে? তাছাড়া পার্টির এই পর্যায়ে এসে হুল্লোড় বাড়ানোর জন্য ব্যারিটোন ভয়েসের কোনও বিকল্প হয় না। আর বচ্চন হয়েই সোজা চলে যান বলিউডের বাদশার শাহি দোলে; শিফট করুন আদরে, ব্যাকগ্রাউন্ডে বাজান 'ডর' ছবির 'অঙ্গ সে অঙ্গ লগানা/সাজন হমে অ্যায়সে রঙ লগানা'। বাউল-ফকিররা যে কামে-প্রেমের রঙে রঙিন হয়ে মশগুল, আপনিও সেই রঙের আলতো ছোঁওয়ায় রাঙিয়ে দিয়ে যান মনের মানুষটিকে। এবার তার নেশা দিনান্তেও নামবে কিনা, সেটা আমার পক্ষে বলা মুশকিল!
গান ভালবেসে গান : পা থেকে মাথা পর্যন্ত আপনি যখন রঙিন আর টলোমলো এবং পার্টির দশা হেই সামালো, তখন সঙ্গত করবে কোন গান? এ বড় দ্বন্দ্বের সময়। আপনি হয়তো বলবেন, 'হোলি আয়ি হ্যায়, আয়ি হ্যায়, হোলি আয়ি হ্যায়' গানটা বাজানোর কথা আর বাকিরা বলবেন, ওটা হোলি নয়, চিটঠি হবে ইত্যাদি প্রভৃতি, তখন কি হাতে থাকবে কেবল রঙের দাগ আর গেলাস? কে বলেছে এ কথা? সে বড় সুখের সময়ে সঙ্গে থাক 'মহব্বতে' ছবির 'হম তেরে দিওয়ানে হ্যায়'- নেশাগ্রস্ত মানুষমাত্রই জানেন প্রলাপের মূল্য। তারপর চলুক 'মঙ্গল পাণ্ডে' ছবির 'হোলি রে'; আহা, আবার একটানা ধুমে ছেদ পড়ে কেন? বেশ করে নেচেকুঁদে এক এক করে চান করতে যাওয়ার সময়ে বিশ্রামের মাঝে শুনতে পারেন 'নমক হারাম' 'নদিয়া সে দরিয়া' গানটাও; শুধু কাকার ভক্তদের বলি, বেশি সেন্টি না হওয়াই ভাল- ভাঙ খেলে কান্না থামার লক্ষণ কম। তারপর খেয়েদেয়ে একটু গড়িয়ে তৈরি হন সান্ধ্য মোচ্ছবের জন্য; আকাশ জুড়ে চাঁদ উঠবে যখন, তখন আপনি তার রঙে রঙ মেশাবেন না?
নিধুবাবু আর বাঙালিয়ানা : দোলের আসল পার্টি রঙ মাখায় নয়, বরং রঙিন হয়ে মজলিশি হওয়ায়- এই কেতাই বরাবর রপ্ত করে এসেছে শহর কলকাতা। দোলের দিন সকালে তাই যা খুশি করে নিয়ে সন্ধেবেলায় ফরাস পেতে ছাদে, বাগানে বা বারান্দায় বসুন দলবলের সঙ্গে আরেক প্রস্থ পানীয় নিয়ে। সঙ্গে থাকুক গড়গড়া। বৃথা হামাগুড়ি দিয়ে বাড়ি পৌঁছাতে চাওয়ায় কী বা লাভ! আর থাকুক রামকুমার মুখোপাধ্যায়-এর সুরে নিধুবাবুর টপ্পার বোলচাল। মন চাইলে আসুক ভানুসিংহের পদাবলী, দ্বিজেন্দ্রগীতি বা অতুলপ্রসাদের সুর। বসন্তের এই মাতাল সমীরণে সবার রঙে রঙ না মেশালে যে গুরুজনের কথার খেলাপ হবে!

Saturday, March 23, 2013

নিবন্ধ:- মেয়েমানুষদের এত বাড়তে নেই! - নিবেদিতা দাঁ

মেয়েরা কী না করতে পারে! ঘর সামলাচ্ছেন, অফিসে ডেডলাইন সামলাচ্ছেন, বাচ্চা সামলাচ্ছেন, শ্বশুরবাড়ির লোকলৌকিকতা সামলাচ্ছেন৷ এক কথায় আজকের নারী স্বনির্ভর এবং অবশ্যই স্বাধীন৷ কিন্তু 

তথাকথিত মর্ডান সমাজে আজও কেন
মেয়েদেরকেই দোষারোপ করা হয় ঘটে
যাওয়া অঘটনের জন্যে! কেনই বা
 তাঁদের দেখা হয় ভোগ্যপণ্য হিসেবে?
উত্তরের খোঁজে নিবেদিতা দাঁ

এই সবের মাঝে আজও কোথাও যেন নিরাপত্তার অভাবে ভোগেন তাঁরা৷ অটোয় বসে পাশের লোককে আপনি-আজ্ঞে করে বলতে হয়, 'দাদা হাতটা একটু ঠিক করে রাখুন৷' ভিড় মেট্রোতে দিনে-দুপুরে চমকে উঠতে হয়, কামিজের চেনটা নেমে গিয়েছে অনেকটাই বা ব্লাউজ পরা খোলা পিঠে অবলীলায় হাত রেখেছেন একজন৷ প্রতিবাদে সরব হলে শুনতে হয়, আরে দিদি, এতই যখন অসুবিধে ট্যাক্সি করে গেলেই তো পারেন! এত ভিড়ে ওরম তো হতেই পারে! 'হতেই পারে'? এটাই কী স্বাভাবিক?

তারপর আস্তে আস্তে বড় হয়েছি, বুঝতে শিখেছি আশপাশের জগতটাকে৷ মাঝে মাধ্যে নিজের অজান্তেই আওড়েছি-'যা নেই ভারতে, তা নেই ভারতে৷' আওড়েছি, কিন্তু আমরা কতজনই বা খেয়াল করে দেখেছি, মেলানোর চেষ্টা করেছি আমাদের আজকের জীবনকে সেই মহাকাব্যের সঙ্গে?
আজকে আমাদের সমাজে নারীদের উপর যে অন্যায়, অত্যাচার হচ্ছে তার বীজ বপন তো কয়েক হাজার যুগ আগেই হয়ে গিয়েছিল৷ অবাক লাগছে? মনে হচ্ছে হাতে কলম পেয়ে মেয়েটি যা ইচ্ছে তাই লিখছে! না, যা ইচ্ছে (যাচ্ছেতাই) লিখছি না৷
শ্রীকৃষ্ণের লীলাখেলার বৃত্তান্ত তো ভক্তিভরে শোনেন! কিন্তু কখনও কি প্রশ্ন করেছেন শ্রীকৃষ্ণ কেন স্নানরতা গোপিনীদের গাছের আড়ালে লুকিয়ে দেখেছিলেন? কেনই বা তাঁদের পোশাক সরিয়ে রেখেছিলেন? এর মধ্যে কী একবারও 'ভয়ারিজম' বা শ্লীলতাহানি নজরে পড়েনি কারও!
বাংলা সিনেমার গানের দু'কলি ধার করেই বলতে ইচ্ছে করে, 'কৃষ্ণ করলে লীলা, আমরা করলে বিলা!' হ্যাঁ, আজকের দিনে এমন ঘটনা ঘটলে নিন্দুকেরা বলবেন বেলেল্লাপনা বা চরিত্রহীনতা৷ একশ ভাগ হক কথা৷ কিন্তু এই ঘটনা তো দলছুট, সৃষ্টিছাড়া নয়৷ তথাকথিত সৃষ্টিকর্তাই তো মেয়েদের সঙ্গে লীলা খেলায় মেতে থেকেছেন৷ রতিক্রিয়া করেছেন রাধার সঙ্গে, বিয়ে করেছেন অন্য নারীকে৷ সেই প্রেমলীলা আবার বর্ণিত হয়েছে কাব্যে! তখনও তো এক নারীকেই ব্যবহার করা হয়েছিল ভালবাসার নামে! সেদিন অর্জুন যখন সুভদ্রাকে অপহরণ করেছিলেন, তখন তো কারও আপত্তি জানানোর কথা মনে হয়নি। উল্টে অর্জুনকে সাহায্য করেছিলেন স্বয়ং কৃষ্ণ। জবাব অবশ্য তৈরি ছিল--- এটাই যে বিধির বিধান! ব্যস ইচ্ছে হোক না হোক সুভদ্রাকে দোজবর অর্জুনকে বিয়ে করতে হয়েছিল। তাও আবার হাসিমুখে! আজও সেই ট্র্যাডিশন বিদ্যমান! হ্যাঁ, যুগের দোষ, তবে এ যুগের নয়, হাজার যুগ আগে থেকেই মেয়েদের উপর জোর করাটাকে স্বাভাবিক হিসেবেই স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছিল। ওই 'বিধির বিধান' গোছের জিনিস৷
আজ 'নির্ভয়া' বা 'দুর্গা'-কে নিয়ে প্রতিবাদে সারা দেশ উত্তাল৷ কিন্তু একি একেবারেই নতুন কোনও ঘটনা ভারতবাসীর কাছে? যাঁরা নাক সিঁটকে, ভ্রু কুঁচকে বলছেন যে, দেশটা দিন দিন রসাতলে যাচ্ছে, তাঁদের একটা কথা মনে করিয়ে দিতে বড্ড ইচ্ছে করছে... যে মহাকাব্যকে লাল শালুতে মুড়ে রেখে দিয়েছেন, তার আত্মজা দ্রৌপদীর কথা কি ভুলেই গেলেন? ভুলে গেলেন হাজার লোকের মাঝে, মহারথী পাঁচ স্বামীর সামনে কীভাবে বেআব্রু করা হয়েছিল তাঁকে? আজকের মতো সেদিনও সবাই নীরব দর্শকেরই ভূমিকা পালন করেছিলেন৷
আজ 'নির্ভয়া' বা 'দুর্গা'-কে নিয়ে প্রতিবাদে সারা দেশ উত্তাল৷ কিন্তু একি একেবারেই নতুন কোনও ঘটনা ভারতবাসীর কাছে? যাঁরা নাক সিঁটকে, ভ্রু কুঁচকে বলছেন যে, দেশটা দিন দিন রসাতলে যাচ্ছে, তাঁদের একটা কথা মনে করিয়ে দিতে বড্ড ইচ্ছে করছে... যে মহাকাব্যকে লাল শালুতে মুড়ে রেখে দিয়েছেন, তার আত্মজা দ্রৌপদীর কথা কি ভুলেই গেলেন? ভুলে গেলেন হাজার লোকের মাঝে, মহারথী পাঁচ স্বামীর সামনে কীভাবে বেআব্রু করা হয়েছিল তাঁকে? আজকের মতো সেদিনও সবাই নীরব দর্শকেরই ভূমিকা পালন করেছিলেন৷
না মহাভারতের মতো কোনও মহাকাব্যকে বা কোনও ঐশ্বরিক চরিত্রকে অপমান করার বিন্দুমাত্র উদ্দেশ্য আমার নেই৷ শুধু এইটুকুই বলতে চাইছি যে আজ বলে নয়, যুগ যুগ ধরে লাঞ্ছিতা হয়ে এসেছেন নারীরা৷ বেআব্রু করা হয়েছে তাঁদের৷ ভোগ্যপণ্য হিসেবে দেখা হয়েছে তাঁদের সব সময়৷ মানুষ নয়, বস্তু হিসেবেই সমাজ মেয়েদের দেখতে অভ্যস্ত৷ তাই তো দ্রৌপদী ভিক্ষাসামগ্রী হিসেবে ভাগ হয়ে যান পাঁচ স্বামীর মধ্যে৷ প্রতিবাদ করেন পাঞ্চালী, কিন্তু ধোপে টেঁকে না৷
আজও সমাজ এতটুকু পাল্টায়নি৷ আজকের তথাকথিত স্বাধীন নারীরা ততটাই নিরাপত্তাহীন৷ মধ্যযুগীয় বর্বরতার শিকার হচ্ছেন বারবার৷ আজও প্রতিপদে তাঁদের কন্ঠরোধ করা হয়৷ ধর্ষিতা হলে কখনও ফিসফিস করে আবার কখনও উচ্চস্বরে বলা হয়, 'দোষ বাবা মেয়েটারই ছিল৷ কী দরকার রাতবিরেতে বাড়ি ফেরার!' ঠিক ‌যেমন শুনতে হয়েছিল দ্রৌপদীকে৷ তাঁর অহংকারই নাকি তিলেতিলে তঁকে সেই লজ্জাজনক ঘটনার দিকে ঠেলে দিয়েছিল৷ 'কী দরকার ছিল বাপু কথায় কথায় দুর্যোধন-দুঃশাসন বা কর্ণকে নিয়ে ঠাট্টা তামাসা করার! মেয়েমানুষের এত বাড়তে নেই৷'
৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস৷ দেশ-বিদেশ সর্বত্র মহিলাদের নিয়ে হাজারটা অনুষ্ঠান, ক্যাম্পেন, বিদ্বজ্জনেদের নানা রাশভারী বক্তৃতার ছড়াছড়ি৷ কিন্তু তাতে লাভটা কী! একদিকে যখন এমন সব অনুষ্ঠানে নারীদের গুণ গাওয়া হবে, তাঁদের মহিমাণ্বিত করার চূড়ান্ত প্রয়াস চলবে, তখনই পৃথিবীর কোনও এক প্রান্তে গণধর্ষিতা হবেন কোনও অজ্ঞাতপরিচয় এক নারী, অজানা অপরাধে পুড়ে মরতে হবে কাউকে!
তাই বলি কি, অনেক তো হল এই দ্যাখনেপনা৷ একটা দিনের জন্যে 'নারী মহান' স্লোগান দিয়ে লাভটা কী? একটা বিশেষ দিন কেন? এই একটা দিন নারীকে সোনার সুতোয় বোনা বেনারসি শাড়ি বা ভার্সাচের কোটি টাকার গাউনের মতো ট্রিট নাই বা করলেন! বরং আটপৌরে নারীকে মন থেকে তাঁর অধিকারের প্রাপ্য সম্মানটুকু দিন, ব্যাস, তাহলেই হবে!


ছোটবেলায় রবিবার সকাল মানেই টিভির পর্দায় মহাভারত৷ উফ! কী উত্তেজনা৷ এই অর্জুন তির ছুড়ে মারল তো পরক্ষণেই কৃষ্ণের হাতে সাঁই সাঁই করে ঘুরতে থাকা সুদর্শন চক্র ঘচাং করে কেটে ফেলল কারও মাথা! কিংবা খপ করে সুভদ্রার হাত ধরে অর্জুন টেনে নিয়ে তুলল রথে৷ ডিডি ১ ডিডি২-র যুগে স্পেশাল এফেক্টে ভরপুর মহাভারত দেখতে দেখতে যেন পাড়ি দিতাম ছোট্ট অপুর মতোই এক ভিন জগতে৷ মনের মধ্যে উঁকি মারত হাজারটা প্রশ্ন৷ গুটি গুটি পায়ে দিদার কাছে গিয়ে ঝাঁপি খুলে বসতাম৷ সেই সময়ে মাঝে মাঝেই দিদা একটা কথা বলতেন, 'যা নেই ভারতে, তা নেই ভারতে'৷ সহজে বলতে গেলে, মহাভারতে যা নেই, ভারতবর্ষে তা নেই! তখন মাথার উপর দিয়ে কথাটা ট্যান হয়ে বেরিয়ে যেত৷












প্রবন্ধ | Anandabazar


কেবল পাশে থাকব? প্রশ্ন তুলব না?

মৌলবাদের বিরুদ্ধে এক দল তরুণ প্রাণশক্তি, সৎ আবেগ, দেশাত্মবোধ সম্বল করে রাস্তায় নেমেছেন। তাঁদের পাশে দাঁড়ানো অবশ্যই আমাদের দায়িত্ব। কিন্তু তাঁদের দাবিগুলিকে যুক্তি দিয়ে যাচাই করাও কম দায়িত্ব নয়।

তমোঘ্ন হালদার
কলকাতা, ২০ মার্চ ২০১৩

dhaka
ফাঁসি চাই? কেন? প্রশ্নটা কিন্তু আছে, থাকা দরকার। ঢাকা, ফেব্রুয়ারি ২০১৩। ছবি- এএফপি।
২৪ আষাঢ়, ১৩৭৪
সরকারের এক বিশেষ নির্দেশে রেডিয়ো পাকিস্তান, ঢাকা থেকে রবীন্দ্রসঙ্গীত প্রচার বন্ধ হয়ে গেছে। আজ এরা রবীন্দ্রসঙ্গীত বাদ দিচ্ছে, কাল এরাই বলবে রবীন্দ্রসঙ্গীত মুসলিম ঐতিহ্যের অনুকূলে নয়। এদের এই বহুল ব্যবহৃত মুসলিম ঐতিহ্যের দোহাই দিয়ে এরা আরও কত কী যে করবে, তা ‘খোদাই মালুম’ না বলে, বলতে হয়, ‘মুজিবই মালুম’...
ডায়েরির মালকিন লুৎফান্নাহার হেলেন। মাত্র কুড়ি বছর বয়সে যখন লিখতে পেরেছেন এই লাইনগুলো, তখন কয়েক বছরের মধ্যে শুরু হওয়া মুক্তিযুদ্ধেও তিনি ঝাঁপিয়ে পড়বেন, তাতে আর আশ্চর্য কী? এবং ধরাও পড়লেন, রাজাকারদের মদতে। হেলেন ইতিমধ্যে ২ বছর ৫ মাসের ফুটফুটে ছেলের (দিলীর) মা। ধরা পড়ার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই আনা হল পাক বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মীদের কাছে, জিজ্ঞাসাবাদের জন্য। ক’দিন বাদে তাঁর ছেলেকে পাঠিয়ে দেওয়া হল মামাবাড়িতে। তার পর? অত্যাচারে, উপর্যুপরি ধর্ষণে ক্ষতবিক্ষত মৃতদেহটি জিপের পিছনে দড়ি দিয়ে বেঁধে ছেঁচড়ে নিয়ে যাওয়া হল শহরের রাস্তা দিয়ে, ফেলে আসা হল নবগঙ্গার ডাইভারশন ক্যানালে। তখনও ২৪ পেরোননি হেলেন।
হেলেন উদাহরণমাত্র। রাজাকার, আল-বদ্র, আল-শামস্-দের অত্যাচারে প্রাণ হারানো আরও অনেক অনেক হেলেনের আত্মীয়রা কোনও দিন কি ক্ষমা করতে পারবেন এই রাজাকারদের? তাই শাহবাগের ‘প্রজন্ম চত্বর’ থেকে যখন স্লোগান ওঠে যুদ্ধাপরাধী রাজাকারদের ফাঁসির দাবিতে, মৌলবাদী সংগঠনগুলি নিষিদ্ধ করার দাবিতে, অনুমান করা যায়, মুক্তিযুদ্ধের শহিদদের আত্মীয়রা আশ্বস্ত হন ইনসাফ হবে।
শাহবাগকে অভিবাদন। শাহবাগ আন্দোলনের পাশে দাঁড়ানো এ পার বাংলার মানুষ, আর প্রকাশ্যে সরব হওয়া ‘বুদ্ধিজীবী’দেরও। নিজেদের কোনও রাজনৈতিক শিবিরে ভাগ না করে, একই প্রশ্নে একই সঙ্গে সবাই একই সুরে গলা মেলাচ্ছেন শেষ কবে এমনটা হয়েছে, মনে পড়ে না।
কিন্তু প্রাথমিক বাহবা-প্রদান-পর্ব মিটলে পর, একটু তলিয়ে ভাবলে, তিনটে ব্যাপারে খটকা লাগতে বাধ্য। প্রথম খটকা, আজমল কসাব কিংবা আফজল গুরুর ফাঁসির ক্ষেত্রে যাঁরা যুক্তি দিয়েছিলেন যে, মৃত্যুদণ্ড কোনও অপরাধকে নির্মূল করতে পারে না, তাঁরা অনেকে শাহবাগের ‘রাজাকারের ফাঁসি চাই’ স্লোগানকে প্রশ্নহীন সমর্থন জোগাচ্ছেন? যদি মেনে নিতে হয় যে, দুই ক্ষেত্রেই তাঁদের অবস্থান যুক্তিযুক্ত, অর্থাৎ কাদের মোল্লা সহ অন্যান্য রাজাকারদের সঙ্গে আফজল গুরু বা কসাবের অপরাধের গুণগত ফারাক আছে, তাই মৃত্যুদণ্ড ‘প্রেক্ষিত’নির্ভর, তা হলে তো সর্বনাশ! কারণ এই যুক্তির লাইনে খানিক আপ-ডাউন করলে অমোঘ স্টেশন: মাওবাদীদের জ্ঞানেশ্বরী এক্সপ্রেসে হামলা আর লস্করের ২৬/১১ হামলার প্রেক্ষিত যেহেতু ভিন্ন, তাই একটা ঘটনা আর একটার চেয়ে কম নিন্দনীয়! ঘটনা হল, মৃত্যুদণ্ড যে প্রেক্ষিতে, যে অপরাধেই দেওয়া হোক না কেন সমর্থনযোগ্য নয়। আর তাই যত লক্ষ মানুষই স্লোগান তুলুক না কেন, রাজাকারদের ফাঁসির দাবি সমর্থন করা যায় না।
শাহবাগের দ্বিতীয় দাবি: মৌলবাদী সন্ত্রাস ছড়ানো সংগঠনগুলিকে নিষিদ্ধ করা। অধিকাংশ বুদ্ধিজীবীই এ দাবিও সমর্থন করছেন। এবং দ্বিতীয় খটকা। এই তো সে দিন সলমন রুশদিকে ঢুকত না দেওয়া নিয়ে মিডিয়ায় খানিক হইচই, অনেকেরই হালকা গাঁইগুঁই, বাক্-স্বাধীনতার পক্ষে প্রাথমিক সওয়াল, কিন্তু সংখ্যালঘু ভোটব্যাঙ্কের কথা মাথায় রেখে কোনও পক্ষই তেমন ভাবে মাঠে নামলেন না, কেউ-বা বললেন, “লেখকেরও তো একটা দায়িত্ব থাকে, না কী? যদি কেউ প্রোভোক্ড হয়?” তা, এহেন বুদ্ধিজীবীরা হঠাৎ শাহবাগ আন্দোলনের ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞার পাশে কেন? সীমান্ত পেরিয়ে অ্যাসিড বোমা এসে গায়ে লাগবে না, তাই জামাত-এর বিরুদ্ধে মুখ খোলা নিরাপদ? বহু কট্টরপন্থী, হিন্দুত্ববাদী দল, যারা প্রতিনিয়ত নানা প্রশ্নে ধর্মীয় জিগির তুলে লোক খেপাচ্ছে, তাদের বিরুদ্ধে এঁরা কিন্তু পথে নামছেন না। অর্থাৎ মোদ্দা কথা: ‘সেফ ডিসট্যান্স’-এর সুবাদে বিদেশ-নীতি যতই খাপখোলা হোক, স্বরাষ্ট্র-খাতে সেই মশারি।
তৃতীয় খটকা, যাঁরা বছর কয়েক আগেও মাওবাদী ও অন্যান্য অতি-বাম সংগঠনকে নিষিদ্ধ করার বিরুদ্ধে মুখ খুলেছিলেন, তাঁরাই সহমত পোষণ করছেন জামাতকে নিষিদ্ধ করার দাবির সঙ্গে। কেন? মাওবাদীদের ক্ষেত্রে যুক্তি ছিল: “সন্ত্রাসের পথ বা রাষ্ট্রের সঙ্গে সরাসরি সংঘাতের পথে যাঁরা হাঁটছেন, তাঁদের এই পথ থেকে সরাতে গেলে, আগে বোঝা দরকার এই পথে হাঁটার কারণটা কী।” তা হলে, জামাতের ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম কেন হবে? বস্তুত, যে কোনও মৌলবাদী সংগঠন মনে করে তারা যা ভাবছে তা ঠিক, সেই ‘ঠিক’টা তারা তাদের নিজস্ব পন্থায় পৌঁছে দিতে চায় আমজনতার কাছে। তা হলে রাষ্ট্র কী করবে? বাক্-স্বাধীনতার মানে কিন্তু ভুল বক্তব্য বলারও সমান স্বাধীনতা। যুক্তিহীনকেও তার কথা বলার সুযোগ দেওয়া। যদি কেউ বাক্-স্বাধীনতার অপব্যবহার করে প্ররোচনা বা উস্কানি দেয়, ত্রিগুণ প্রাবল্যে রাষ্ট্রকে ঝাঁপিয়ে পড়ে পাল্টা যুক্তি সাজিয়ে পৌঁছতে হবে মানুষের কাছে। সংঘাত হোক যুক্তির। পেশির নয়। বুদ্ধিজীবীরা এ সবই জানেন, বোঝেন, কিন্তু ঘরোয়া আলোচনায়। মিডিয়া সভা ডাকলে সেখানে দলে পড়ে সক্কলে মিলে বলে ওঠেন, ‘পাশে আছি, শাহবাগ’। দাবির গভীরতা নিয়ে মুখে কুলুপ এঁটে নিজেদেরই হাস্যকর করে তোলেন।
দ্বিগুণ হাস্যকর কমিউনিস্ট পার্টির অবস্থান। তাদেরই শাসনকালে রাজ্য-ছাড়া হতে হয় তসলিমা নাসরিনকে। তিনি ভয় পাননি, রাজ্য সরকারই ভয় পেয়েছিল মৌলবাদীদের। আর আজ তাঁরাই বিবৃতি দিয়ে মৌলবাদ-বিরোধী আন্দোলনের পাশে থাকার ডাক দিচ্ছেন। তাঁরাও জানেন দূরত্ব বুঝে নিয়ে প্রতিবাদ করতে হয়। আমেরিকা তাই বরাবর সবচেয়ে সহজ টার্গেট।
এ লেখা একটি বারের জন্যও শাহবাগ আন্দোলনের বিপক্ষে কথা বলছে না। মৌলবাদের মতো সমস্যাকে উপড়ে ফেলতে এক দল তরুণ তাঁদের উদ্দাম প্রাণশক্তি, সৎ আবেগ, দেশাত্মবোধকে সম্বল করে রাস্তায় নেমেছেন। তাঁদের মাথার ওপর তেমন কোনও রাজনৈতিক নেতৃত্ব নেই। এঁরা আওয়ামি লিগের একচেটিয়া হয়ে যাওয়া ‘জয় বাংলা’ স্লোগানে ফিরিয়ে এনেছেন মুক্তিযুদ্ধের সময়ের প্যাশন, এঁদের পাশে না দাঁড়ানো মূর্খামি। কিন্তু শাহবাগের সবচেয়ে বড় মূলধন আবেগ। আর আবেগ বলেই, পদে পদে যুক্তির পথ থেকে বিচ্যুতির ভয়। যাঁরা এই মুহূর্তে শাহবাগে, এ-রকম অনেক ভুল তাঁদের চোখে পড়বে না। সেটাই স্বাভাবিক। এবং ঠিক সেখানেই বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের মেরুদণ্ডের প্রয়োজন। ‘পাশে আছি’ বলে কাব্য করলে, গান বাঁধলে যতখানি পাশে থাকা হয়, আন্দোলনকারীদের কাছে যুক্তির মাধ্যমে আত্মবিশ্লেষণের বার্তা পৌঁছে দিলে তা অনেক বেশি দায়িত্বশীল ভাবে পাশে থাকার নমুনা হয়ে ওঠে। এ পার বাংলায় থেকে ও পারের আন্দোলনে আন্তরিক ভাবে শামিল হতে গেলে প্রয়োজনে শাহবাগ থেকে ওঠা দাবিকে প্রশ্ন করতে হবে। না হলে পৃথিবীর ইতিহাসে যা অতি গুরুত্বপূর্ণ আন্দোলন হয়ে উঠতে পারে, তা পর্যবসিত হবে আর পাঁচটা দারুণ শুরু করেও ভুস করে নিভে যাওয়া তুবড়ি গোত্রের আন্দোলনে।
তবে তার আগে নিজেদের প্রশ্ন করার সময় হয়েছে। আর কত দিন আমরা মৌলবাদী সংগঠন বলতে লস্কর-ই-তইবা বা যাবতীয় মুসলিম মৌলবাদীদের কথা মনে করব? হিন্দুত্বের শিবিরেও মৌলবাদীরা আছে, তারাও সমান নিন্দনীয়। আর আমার দেশে এই দ্বিতীয় সংখ্যাটাই বেশি। তাই মৌলবাদ-বিরোধিতার নামে স্রেফ বর্ডার পারের মৌলবাদকে ইঙ্গিত করা বন্ধ হোক। তসলিমা নাসরিনকে ফিরিয়ে আনতে পথে নামা হোক। খোলা মঞ্চে বক্তব্য রাখতে দেওয়া হোক সলমন রুশদিকে। প্রয়োজনে আমরা দেব নিরাপত্তা।
আর বুদ্ধিজীবীরা অনুগ্রহ করে মশারি ছেড়ে বেরোন। দেখবেন চেনা ছকের বাইরে, অ্যাঙ্করের নাটকীয় সংলাপ, ক্যামেরা, বুম-এর বাইরে একটা বিশাল জগৎ অপেক্ষা করছে আপনাদের জন্য। যা বদলাতে পারেন আপনারাই। এখনও সময় আছে, সেই সিপাহি বিদ্রোহের সময় থেকে বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের গায়ে লেগে থাকা ‘হিপোক্রিট’ তকমাটা ঝেড়ে ফেলার।