Wednesday, March 27, 2013

চলতি হাওয়া | Anandabazar


 আমার আনন্দবাজার পত্রিকা থেকে সংগৃহীত 

ধরলে আজ তোমায় ছাড়ব না

অনির্বাণ চৌধুরী
কলকাতা, ২৬ মার্চ, ২০১৩

dol party songs
হুল্লুড়ে পার্টি করাই বিধেয়- শাস্ত্র এই বলছে, সামাজিকতাও। ছবি- অরণ্য সেন।
রাধা আর কৃষ্ণ নামে দুই ছোঁড়াছুঁড়ি নিয়ম করে রঙ নিয়ে যেই ধুম মাচিয়েছিল ইউপি মহল্লায়, তখন থেকেই সেটাই হয়ে দাঁড়াল দোল দিনের পার্টি করার সনাতনী প্রথা। তালিকায় বাকি ছিল কেবল বাঙালি কবিগুরুর অমোঘ ফরমান- 'আজ সবার রঙে রঙ মেশাতে হবে'! ভাবটা এই, না মেশালে আমার ঘেঁচু, তবে তোমার অনেক কিছু। অতএব, সব দিক মেপেজুপে সবাই যখন সাধছেই, তখন দোলের দিন প্রচুর রঙ দেওয়া, প্রচুর রঙ নেওয়া আর হুল্লুড়ে পার্টি করাই বিধেয়- শাস্ত্র এই বলছে, সামাজিকতাও। ওই ঠাকুরের লেখা ভাবুন, মনে পড়বে পুরনো কলকাতায় বিহারি দারোয়ানদের ঢোল বাজিয়ে নেচেগেয়ে রঙখেলার পার্টি। হুতোম প্যাঁচার নকশা বলছে জেলেপাড়ার সঙ-এর পার্টির পথে নামার কথা; যাদের ধেই নাচন দেখার জন্য ভিড় করেছে আমোদগেঁড়ে বাঙালি। ইতিহাস বলছে রাজা নবকৃষ্ণ দে-র বাড়ির দোলের সন্ধের বাঈনাচের কথা; সব দর্শক কনিয়াক হাতে সাহেবসুবো।সে দিন গেলেও ফূর্তি করার মনটা তো আর চলে যায়নি। সো, লেটস প্লে হোলি!তা, দোলের পার্টিতে গান হবে না- এ আবার কেমনধারা ব্যাপার? কী গান বাজাবেন, লিস্টি মিলিয়ে নিন।  পথে করে গমন। এই উদ্দামতা আসবে না মার্গসঙ্গীত বা ঠাকুরের গানে; তাই ডাইভ মারুন সিনেমাতেই। পার্টি পুরো জমে যাবে!
লাইসেন্সড অ্যাডালটারির গান : জানি, দোলের সকালের পার্টিতে না বললেও 'সিলসিলা' ছবির 'রঙ বরসে ভিগে চুনরওয়ালি' বাজবেই। শুধু দোহাই আপনাদের, এই গানটা দিয়ে পার্টি শুরু করবেন না- নিজেদের উচ্ছ্বাসই নিজেদের কাছে মেকি মনে হবে। আহা, পার্টি ওয়ার্মিং বলেও তো একটা ব্যাপার আছে; পার্টি করবেন আর তার নিয়ম মানবেন না- তা আবার হয় নাকি! এই গান হবে নেশা পুরো চড়ে গেলে; গেলাস গেলাস সনাতনী প্রথায় ভাঙ আর আধুনিকতায় ভদকা চড়িয়ে। তারপর শরীর-মন দুই যখন টলোমলো; নিজেকে সঁপে দিন ব্যারিটোন ভয়েসের কাছে। মাথায় থাকুক রাধা নামের পরের বউটাকে নিয়ে গিরিধারী নাগরের ঢলাঢলি; মাথায় থাকুক আয়ান ঘোষের অপ্রস্তুতের হাসিও। ভেবে নিন কেবল রেখা-অমিতাভ বচ্চন আর সঞ্জীব কুমার। ধর্মই যখন খোদ ছুঁকছঁকানির লাইসেন্স দিচ্ছে, প্রাণ খুলে রঙ মেখে অ্যাডালটারি করুন। তবে এই গানটা শুরুতে নয়। কোনটা তাহলে হতে পারে উদ্বোধনী সঙ্গীত?
অনুরোধের আসর : আমি বলি কী, কানু বিনে নয়, অমিতাভ বচ্চন বিনে ঠিক যেন দোলের পার্টির গানের নখরা জমে না। পার্টি শুরু করার জন্য তাই বেছে নিন ওই বুড়ো হাড়ের ভেলকি দেখানো 'ওয়াক্ত' নামের এক ছবির গান- 'ডু মি আ ফেভার, লেটস প্লে হোলি'। অমিতাভ বচ্চনের সঙ্গে অক্ষয় কুমার আর পিগি চপসও বহুত রঙঢং দেখিয়েছিলেন এই গানটায়। ভাবছেন নিশ্চয়ই, বুরবকটা শুরুতেই এই কম জনপ্রিয় গানটার কথা কেন বলল? তা আপনিই ভেবে দেখুন, সবাই কি আর পার্টি শুরু করার জন্য চেগে থাকবে? হোস্ট হিসেবে আপনাকেই তো জমিয়ে তুলতে হবে কেওড়াবাজি। আহা, শুরুটা করুনই না আলতোভাবে গলা ভেজাতে ভেজাতে; ধাপে ধাপে এগিয়ে যেতে তো আর কেউ বারণ করছে না।
বউদিবাজির দোল : পার্টি এবার খাতায়-কলমে যখন শুরু হয়েই গেছে, তখন তানানানা করে লাভ কি? ব্যাকগ্রাউন্ডে বাজান বলিউডের পেটেন্ট বউদিবাজির দোলের গান; 'শোলে' ছবির 'হোলি কে দিন দিল খিল যাতে হ্যায়'। বউদিবাজি এই গানের শব্দে-সুরে-চিত্রায়ণে সব জায়গায়। শুরুতেই তো এক মাতাল গ্রামের বউদির গায়ে ঢলে পড়ে বলেছে, 'ঠহের যা ভাবি'! বউদি অবশ্য বেশ কুলকাল, চাট্টি নথনাড়া দিয়ে সে 'আরে যা শরাবি' বলেই সটকে পড়েছে। আবার বীরু-বাসন্তী যখন নিজেদের রঙ মাখাতে ব্যস্ত, জয়ও তো তখন ঝাড়ি মেরেছে বিধবা বউদিকে। মন চাইলে আপনিও তার লাইসেন্স নিন; শুধু কবির মতো ঘরে খুঁজবেন না বাইরে- সে চিন্তা আপনার। বউদি অমিল হলেও ক্ষতি নেই, গানটার হুল্লোড় ঠিক টেনে নিয়ে যাবে রঙিন দুনিয়ায়। শুধু হ্যাঁ, মাঝে মাঝেই গলা ভেজাতে যেন ভুল না হয়।
ভয় পেও না, ভয় : আপনাদের হুল্লোড় দেখে কি কোনও অতিথি ভড়কে গেছেন? না ভড়কালেও মাত্তর দুটো গানে সবার আড় ভাঙবে- এটা আশা করা অন্যায়। তা বাদেও এমন কেউ পার্টিতে থাকতেই পারেন, রঙ যাঁর পছন্দ নয়। তাঁকে অভয় দিন; ব্যাকগ্রাউন্ডে বাজিয়ে দিন 'একান্ত আপন' ছবির 'খেলব হোলি রঙ দেব না '! নইলে আপনারই পার্টির একশো আট বার হল বলে; একদল নেশাড়ুর মধ্যে সাদা মাথার কেউ তো আসলে হংস মধ্যে বক যথাই। তাছাড়া, বাঙালির দোলে বাংলা গান বাজবে না, 'তাও কখনও হয়'? এই গান বাজিয়ে, সবার আড় কাটিয়ে তারপর চলে যান 'রঙ বরসে'-তে। এটাই শেষ বার নয়; এর পর থেকে ঘুরে ফিরে সারা পার্টিতেই বাজতে পারে এই গান। তারপরে কিম কর্তব্য?
দুলকি চালের ফিমেল ফিভার : ভেবে দেখলে, দোলের গানের সবকটাতেই বড্ড পুরুষের গা-জোয়ারি গন্ধ। সংবিধানে যখন সমান অধিকার, দোলের মতো একটা পার্টিতে থাকবে না? মেয়েরা একজোট হন, কয়েক পা পিছিয়ে ধাঁ করে চলে যান রেট্রোযুগে, সম্বল করুন 'বসন্ত বিলাপ' ছবির 'ও শ্যাম যখন তখন'। ‘খেলব হোলি’ গানটা দিয়েই শুরু হয়ে গেছে উইমেন এমপাওয়ারমেন্ট; এবারে মৃদু ভড়কি দিয়ে বোঝানোর পালা, 'যখন তখন, খেলো না খেলা এমন, ধরলে আজ তোমায় ছাড়ব না'। একজন মেয়েই দোলের দিনে মদির চাউনিতে শুইয়ে দিতে পারে একদল পুরুষকে, জোট বাঁধলে কার সাধ্য ঘাঁটিয়ে বিপদ আনে? তাছাড়া এতক্ষণের হইচই একটু শান্ত হবে এই দুলকি চালে; দোলের দিনে খরগোশ হওয়ার বদলে কচ্ছপ হওয়াই ভাল- সারা দিনটা পড়ে আছে যে!
আরেকটা বসন্ত বিলাপ : 'অ্যাকশন রিপ্লে' ছবিতে নিদারুণ বসন্তে দারুণ বিলাপ করতে করতে একটা দোলের গানে নেচেছিলেন ঐশ্বর্য রাই বচ্চন আর নেহা ধুপিয়া, 'জ্বলি তো বুঝি না কসম সে কোয়লা হো গয়ি'! মনসই ছেলে না পেয়েই এই হাহাকার। সেটুকু ছেঁটে হুল্লোড়টুকু নিয়ে উদ্দামতার ট্র্যাকে ফিরে আসুন এই গানটা দিয়েই, বেশ একচোট ধেইধেই করতে এ গানের কোনও জুড়ি নেই। ছেলেরা অবিশ্যি দারুণ ফ্রাস্টু খাবেই এ গান বাজালে- সারা বছর যখন তাদের মুর্গি করেন মেয়েরা, দোলের দিনেই বা ছেড়ে দেবেন কেন?
ব্যাক টু বচ্চন : দোলের লুচি-মালপোয়ার মতো না ফুলে পাত্তা আদায় করার জন্য আর পার্টি আরও জমাবার জন্য বচ্চন সাহেবের গানেই যাওয়া ভাল। বেছে নিন তাই 'বাগবান' ছবির 'হোলি খেলে রঘুবীরা অবধ মে'। শাহি হোলিতে তো শুধুই রাধাকৃষ্ণ কথা; রামসীতার দোলের উদ্দামতাও সঙ্গে থাকুক না। অপশন যখন আছে, সুযোগ কেউ ছাড়ে? তাছাড়া পার্টির এই পর্যায়ে এসে হুল্লোড় বাড়ানোর জন্য ব্যারিটোন ভয়েসের কোনও বিকল্প হয় না। আর বচ্চন হয়েই সোজা চলে যান বলিউডের বাদশার শাহি দোলে; শিফট করুন আদরে, ব্যাকগ্রাউন্ডে বাজান 'ডর' ছবির 'অঙ্গ সে অঙ্গ লগানা/সাজন হমে অ্যায়সে রঙ লগানা'। বাউল-ফকিররা যে কামে-প্রেমের রঙে রঙিন হয়ে মশগুল, আপনিও সেই রঙের আলতো ছোঁওয়ায় রাঙিয়ে দিয়ে যান মনের মানুষটিকে। এবার তার নেশা দিনান্তেও নামবে কিনা, সেটা আমার পক্ষে বলা মুশকিল!
গান ভালবেসে গান : পা থেকে মাথা পর্যন্ত আপনি যখন রঙিন আর টলোমলো এবং পার্টির দশা হেই সামালো, তখন সঙ্গত করবে কোন গান? এ বড় দ্বন্দ্বের সময়। আপনি হয়তো বলবেন, 'হোলি আয়ি হ্যায়, আয়ি হ্যায়, হোলি আয়ি হ্যায়' গানটা বাজানোর কথা আর বাকিরা বলবেন, ওটা হোলি নয়, চিটঠি হবে ইত্যাদি প্রভৃতি, তখন কি হাতে থাকবে কেবল রঙের দাগ আর গেলাস? কে বলেছে এ কথা? সে বড় সুখের সময়ে সঙ্গে থাক 'মহব্বতে' ছবির 'হম তেরে দিওয়ানে হ্যায়'- নেশাগ্রস্ত মানুষমাত্রই জানেন প্রলাপের মূল্য। তারপর চলুক 'মঙ্গল পাণ্ডে' ছবির 'হোলি রে'; আহা, আবার একটানা ধুমে ছেদ পড়ে কেন? বেশ করে নেচেকুঁদে এক এক করে চান করতে যাওয়ার সময়ে বিশ্রামের মাঝে শুনতে পারেন 'নমক হারাম' 'নদিয়া সে দরিয়া' গানটাও; শুধু কাকার ভক্তদের বলি, বেশি সেন্টি না হওয়াই ভাল- ভাঙ খেলে কান্না থামার লক্ষণ কম। তারপর খেয়েদেয়ে একটু গড়িয়ে তৈরি হন সান্ধ্য মোচ্ছবের জন্য; আকাশ জুড়ে চাঁদ উঠবে যখন, তখন আপনি তার রঙে রঙ মেশাবেন না?
নিধুবাবু আর বাঙালিয়ানা : দোলের আসল পার্টি রঙ মাখায় নয়, বরং রঙিন হয়ে মজলিশি হওয়ায়- এই কেতাই বরাবর রপ্ত করে এসেছে শহর কলকাতা। দোলের দিন সকালে তাই যা খুশি করে নিয়ে সন্ধেবেলায় ফরাস পেতে ছাদে, বাগানে বা বারান্দায় বসুন দলবলের সঙ্গে আরেক প্রস্থ পানীয় নিয়ে। সঙ্গে থাকুক গড়গড়া। বৃথা হামাগুড়ি দিয়ে বাড়ি পৌঁছাতে চাওয়ায় কী বা লাভ! আর থাকুক রামকুমার মুখোপাধ্যায়-এর সুরে নিধুবাবুর টপ্পার বোলচাল। মন চাইলে আসুক ভানুসিংহের পদাবলী, দ্বিজেন্দ্রগীতি বা অতুলপ্রসাদের সুর। বসন্তের এই মাতাল সমীরণে সবার রঙে রঙ না মেশালে যে গুরুজনের কথার খেলাপ হবে!

No comments:

Post a Comment