মেয়েরা কী না করতে পারে! ঘর সামলাচ্ছেন, অফিসে ডেডলাইন সামলাচ্ছেন, বাচ্চা সামলাচ্ছেন, শ্বশুরবাড়ির লোকলৌকিকতা সামলাচ্ছেন৷ এক কথায় আজকের নারী স্বনির্ভর এবং অবশ্যই স্বাধীন৷ কিন্তু
তথাকথিত মর্ডান সমাজে আজও কেন মেয়েদেরকেই দোষারোপ করা হয় ঘটে যাওয়া অঘটনের জন্যে! কেনই বা তাঁদের দেখা হয় ভোগ্যপণ্য হিসেবে? উত্তরের খোঁজে নিবেদিতা দাঁ |
এই সবের মাঝে আজও কোথাও যেন নিরাপত্তার অভাবে ভোগেন তাঁরা৷ অটোয় বসে পাশের লোককে আপনি-আজ্ঞে করে বলতে হয়, 'দাদা হাতটা একটু ঠিক করে রাখুন৷' ভিড় মেট্রোতে দিনে-দুপুরে চমকে উঠতে হয়, কামিজের চেনটা নেমে গিয়েছে অনেকটাই বা ব্লাউজ পরা খোলা পিঠে অবলীলায় হাত রেখেছেন একজন৷ প্রতিবাদে সরব হলে শুনতে হয়, আরে দিদি, এতই যখন অসুবিধে ট্যাক্সি করে গেলেই তো পারেন! এত ভিড়ে ওরম তো হতেই পারে! 'হতেই পারে'? এটাই কী স্বাভাবিক?
তারপর আস্তে আস্তে বড় হয়েছি, বুঝতে শিখেছি আশপাশের জগতটাকে৷ মাঝে মাধ্যে নিজের অজান্তেই আওড়েছি-'যা নেই ভারতে, তা নেই ভারতে৷' আওড়েছি, কিন্তু আমরা কতজনই বা খেয়াল করে দেখেছি, মেলানোর চেষ্টা করেছি আমাদের আজকের জীবনকে সেই মহাকাব্যের সঙ্গে?
আজকে আমাদের সমাজে নারীদের উপর যে অন্যায়, অত্যাচার হচ্ছে তার বীজ বপন তো কয়েক হাজার যুগ আগেই হয়ে গিয়েছিল৷ অবাক লাগছে? মনে হচ্ছে হাতে কলম পেয়ে মেয়েটি যা ইচ্ছে তাই লিখছে! না, যা ইচ্ছে (যাচ্ছেতাই) লিখছি না৷
শ্রীকৃষ্ণের লীলাখেলার বৃত্তান্ত তো ভক্তিভরে শোনেন! কিন্তু কখনও কি প্রশ্ন করেছেন শ্রীকৃষ্ণ কেন স্নানরতা গোপিনীদের গাছের আড়ালে লুকিয়ে দেখেছিলেন? কেনই বা তাঁদের পোশাক সরিয়ে রেখেছিলেন? এর মধ্যে কী একবারও 'ভয়ারিজম' বা শ্লীলতাহানি নজরে পড়েনি কারও!
বাংলা সিনেমার গানের দু'কলি ধার করেই বলতে ইচ্ছে করে, 'কৃষ্ণ করলে লীলা, আমরা করলে বিলা!' হ্যাঁ, আজকের দিনে এমন ঘটনা ঘটলে নিন্দুকেরা বলবেন বেলেল্লাপনা বা চরিত্রহীনতা৷ একশ ভাগ হক কথা৷ কিন্তু এই ঘটনা তো দলছুট, সৃষ্টিছাড়া নয়৷ তথাকথিত সৃষ্টিকর্তাই তো মেয়েদের সঙ্গে লীলা খেলায় মেতে থেকেছেন৷ রতিক্রিয়া করেছেন রাধার সঙ্গে, বিয়ে করেছেন অন্য নারীকে৷ সেই প্রেমলীলা আবার বর্ণিত হয়েছে কাব্যে! তখনও তো এক নারীকেই ব্যবহার করা হয়েছিল ভালবাসার নামে! সেদিন অর্জুন যখন সুভদ্রাকে অপহরণ করেছিলেন, তখন তো কারও আপত্তি জানানোর কথা মনে হয়নি। উল্টে অর্জুনকে সাহায্য করেছিলেন স্বয়ং কৃষ্ণ। জবাব অবশ্য তৈরি ছিল--- এটাই যে বিধির বিধান! ব্যস ইচ্ছে হোক না হোক সুভদ্রাকে দোজবর অর্জুনকে বিয়ে করতে হয়েছিল। তাও আবার হাসিমুখে! আজও সেই ট্র্যাডিশন বিদ্যমান! হ্যাঁ, যুগের দোষ, তবে এ যুগের নয়, হাজার যুগ আগে থেকেই মেয়েদের উপর জোর করাটাকে স্বাভাবিক হিসেবেই স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছিল। ওই 'বিধির বিধান' গোছের জিনিস৷
আজ 'নির্ভয়া' বা 'দুর্গা'-কে নিয়ে প্রতিবাদে সারা দেশ উত্তাল৷ কিন্তু একি একেবারেই নতুন কোনও ঘটনা ভারতবাসীর কাছে? যাঁরা নাক সিঁটকে, ভ্রু কুঁচকে বলছেন যে, দেশটা দিন দিন রসাতলে যাচ্ছে, তাঁদের একটা কথা মনে করিয়ে দিতে বড্ড ইচ্ছে করছে... যে মহাকাব্যকে লাল শালুতে মুড়ে রেখে দিয়েছেন, তার আত্মজা দ্রৌপদীর কথা কি ভুলেই গেলেন? ভুলে গেলেন হাজার লোকের মাঝে, মহারথী পাঁচ স্বামীর সামনে কীভাবে বেআব্রু করা হয়েছিল তাঁকে? আজকের মতো সেদিনও সবাই নীরব দর্শকেরই ভূমিকা পালন করেছিলেন৷
আজ 'নির্ভয়া' বা 'দুর্গা'-কে নিয়ে প্রতিবাদে সারা দেশ উত্তাল৷ কিন্তু একি একেবারেই নতুন কোনও ঘটনা ভারতবাসীর কাছে? যাঁরা নাক সিঁটকে, ভ্রু কুঁচকে বলছেন যে, দেশটা দিন দিন রসাতলে যাচ্ছে, তাঁদের একটা কথা মনে করিয়ে দিতে বড্ড ইচ্ছে করছে... যে মহাকাব্যকে লাল শালুতে মুড়ে রেখে দিয়েছেন, তার আত্মজা দ্রৌপদীর কথা কি ভুলেই গেলেন? ভুলে গেলেন হাজার লোকের মাঝে, মহারথী পাঁচ স্বামীর সামনে কীভাবে বেআব্রু করা হয়েছিল তাঁকে? আজকের মতো সেদিনও সবাই নীরব দর্শকেরই ভূমিকা পালন করেছিলেন৷
না মহাভারতের মতো কোনও মহাকাব্যকে বা কোনও ঐশ্বরিক চরিত্রকে অপমান করার বিন্দুমাত্র উদ্দেশ্য আমার নেই৷ শুধু এইটুকুই বলতে চাইছি যে আজ বলে নয়, যুগ যুগ ধরে লাঞ্ছিতা হয়ে এসেছেন নারীরা৷ বেআব্রু করা হয়েছে তাঁদের৷ ভোগ্যপণ্য হিসেবে দেখা হয়েছে তাঁদের সব সময়৷ মানুষ নয়, বস্তু হিসেবেই সমাজ মেয়েদের দেখতে অভ্যস্ত৷ তাই তো দ্রৌপদী ভিক্ষাসামগ্রী হিসেবে ভাগ হয়ে যান পাঁচ স্বামীর মধ্যে৷ প্রতিবাদ করেন পাঞ্চালী, কিন্তু ধোপে টেঁকে না৷
আজও সমাজ এতটুকু পাল্টায়নি৷ আজকের তথাকথিত স্বাধীন নারীরা ততটাই নিরাপত্তাহীন৷ মধ্যযুগীয় বর্বরতার শিকার হচ্ছেন বারবার৷ আজও প্রতিপদে তাঁদের কন্ঠরোধ করা হয়৷ ধর্ষিতা হলে কখনও ফিসফিস করে আবার কখনও উচ্চস্বরে বলা হয়, 'দোষ বাবা মেয়েটারই ছিল৷ কী দরকার রাতবিরেতে বাড়ি ফেরার!' ঠিক যেমন শুনতে হয়েছিল দ্রৌপদীকে৷ তাঁর অহংকারই নাকি তিলেতিলে তঁকে সেই লজ্জাজনক ঘটনার দিকে ঠেলে দিয়েছিল৷ 'কী দরকার ছিল বাপু কথায় কথায় দুর্যোধন-দুঃশাসন বা কর্ণকে নিয়ে ঠাট্টা তামাসা করার! মেয়েমানুষের এত বাড়তে নেই৷'
৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস৷ দেশ-বিদেশ সর্বত্র মহিলাদের নিয়ে হাজারটা অনুষ্ঠান, ক্যাম্পেন, বিদ্বজ্জনেদের নানা রাশভারী বক্তৃতার ছড়াছড়ি৷ কিন্তু তাতে লাভটা কী! একদিকে যখন এমন সব অনুষ্ঠানে নারীদের গুণ গাওয়া হবে, তাঁদের মহিমাণ্বিত করার চূড়ান্ত প্রয়াস চলবে, তখনই পৃথিবীর কোনও এক প্রান্তে গণধর্ষিতা হবেন কোনও অজ্ঞাতপরিচয় এক নারী, অজানা অপরাধে পুড়ে মরতে হবে কাউকে!
তাই বলি কি, অনেক তো হল এই দ্যাখনেপনা৷ একটা দিনের জন্যে 'নারী মহান' স্লোগান দিয়ে লাভটা কী? একটা বিশেষ দিন কেন? এই একটা দিন নারীকে সোনার সুতোয় বোনা বেনারসি শাড়ি বা ভার্সাচের কোটি টাকার গাউনের মতো ট্রিট নাই বা করলেন! বরং আটপৌরে নারীকে মন থেকে তাঁর অধিকারের প্রাপ্য সম্মানটুকু দিন, ব্যাস, তাহলেই হবে!
ছোটবেলায় রবিবার সকাল মানেই টিভির পর্দায় মহাভারত৷ উফ! কী উত্তেজনা৷ এই অর্জুন তির ছুড়ে মারল তো পরক্ষণেই কৃষ্ণের হাতে সাঁই সাঁই করে ঘুরতে থাকা সুদর্শন চক্র ঘচাং করে কেটে ফেলল কারও মাথা! কিংবা খপ করে সুভদ্রার হাত ধরে অর্জুন টেনে নিয়ে তুলল রথে৷ ডিডি ১ ডিডি২-র যুগে স্পেশাল এফেক্টে ভরপুর মহাভারত দেখতে দেখতে যেন পাড়ি দিতাম ছোট্ট অপুর মতোই এক ভিন জগতে৷ মনের মধ্যে উঁকি মারত হাজারটা প্রশ্ন৷ গুটি গুটি পায়ে দিদার কাছে গিয়ে ঝাঁপি খুলে বসতাম৷ সেই সময়ে মাঝে মাঝেই দিদা একটা কথা বলতেন, 'যা নেই ভারতে, তা নেই ভারতে'৷ সহজে বলতে গেলে, মহাভারতে যা নেই, ভারতবর্ষে তা নেই! তখন মাথার উপর দিয়ে কথাটা ট্যান হয়ে বেরিয়ে যেত৷
No comments:
Post a Comment