Saturday, March 23, 2013

ফেলে আসা স্বাদগুলো | Anandabazar


ফেলে আসা স্বাদগুলো

দামু মুখোপাধ্যায়

ভাইঝিকে টিকটিকি লজেন্সের কথা বলে এমন বিপদে পড়তে হবে, কস্মিন কালেও ভাবিনি। ফস্ করে আবদার ধরে বসল, খাওয়াতেই হবে। ভাবলাম, সস্তার ওপর দিয়েই পার পাওয়া গেল এ যাত্রায়। কিন্তু ঠাকুরঘরের দৈব সমাবেশে কে একজন খ্যাকখেকিয়ে হেসে উঠেছিলেন, তা ঠিক খেয়াল করিনি।
সত্যি বলতে কী, গত চার দশকে বস্তুটা যে অ্যান্টিকের খাতায় নাম লিখিয়েছে, তাও জানা ছিল না। কিন্তু পাড়ার মুদির দোকান থেকে শুরু করে আশেপাশের পান-সিগারেট-গুটখার দোকানিও যখন আকাশ থেকে পড়তে শুরু করলেন, বুঝলাম বেমক্কা চ্যালেঞ্জ নেওয়াটা বাড়াবাড়ি হয়ে গিয়েছে। কিন্তু ভবি এত সহজে ভোলার নয়! রোজই অফিস ফেরত তার সামনে পড়লে দস্তুর মতো জেরা সেশন চলতে থাকল। এ অবস্থা থেকে রক্ষা পেতে শেষে মরিয়া হয়ে হানা দিতে হল চার দশক আগে ছেড়ে আসা দক্ষিণ শহরতলির পাড়ায়।
গত বিয়াল্লিশ বছরে সাকুল্যে সাড়ে তিনবারও ওমুখো হইনি। শহরের সর্বত্র যা হয়েছে, তার ব্যতিক্রমী কিছু ঘটেনি এ পাড়াতেও। ফ্ল্যাটবাড়ির ভিড়ে হারিয়ে গিয়েছে এঁদো পুকুর, পোড়ো মাঠ, লালবাড়ির রোয়াক, ললিত মাস্টারের কোচিং সেন্টার। প্রায় সব গিয়ে পড়ে রয়েছে একটেরে ব্যায়াম সমিতি। তবে অ্যাসবেস্টসের ছাউনি ছেড়ে দোতলা পাকাবাড়ির ধরাচূড়ায় রীতিমতো ধোপদুরস্ত সেও।
আর রয়ে গিয়েছে পাড়ার সাবেক দর্জির দোকান। আদি মালিক নিতাইদা মারা যাওয়ায় যার দখল নিয়েছে তাঁর মেজো ছেলে শ্যামল। আমার আকুল জিজ্ঞাসা নিয়ে তার কাছেই অগত্যা ধর্ণা দিলাম। প্রথমে হতভম্ব, পরে চিন্তিত এবং সব শেষে গম্ভীর হয়ে সে জানাল, 'বাজারে টিকটিকি লজেন্স বলে এখন কিছু পাওয়া যায় না'।
মন খারাপ করে চলেই আসছিলাম, হঠাৎ মগজে খেলে গেল বিদ্যুৎতরঙ্গ। বাস স্ট্যান্ডের রাস্তা ছেড়ে হাঁটা লাগালাম গুমটির উল্টো দিকে রাস্তার মোড়ে দাঁড়ানো ‘সুশীলাকুমারী শিশু নিকেতনের’ উদ্দেশ্যে। হাতেখড়ির পর এখানেই শুরু হয় আমার প্রাথমিক মগজধোলাই। পাশে এখনও কদমগাছের গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে কাঠের খুঁটির ওপর আলকাতরা মাখা টিনের চালা। আর তাতে সে মুহূর্তেও কুঁজো হয়ে বসে পান সাজছে নটবরদা। একমাথা টাক বেড় দিয়ে চুলগুলো সাদা হয়ে গিয়েছে, এই যা।
দোকানের সামনে গিয়ে দাঁড়াই। গৌরচন্দ্রিকা না করে সটান জিজ্ঞেস করি, টিকটিকি লজেন্স আছে? কয়েক সেকেন্ডের অপলক চাউনি। পরক্ষণেই অভ্যস্ত ভঙ্গিতে আধো অন্ধকার হাতড়ে বেরিয়ে এল বয়াম। চার দশক আগের স্মৃতি উসকে দিয়ে কাগজের ঠোঙায় টাপুর-টুপুর ঝরে পড়তে থাকল লাল-হলুদ-কালো-সবুজ গুলির বৃষ্টি।
অভীষ্ট সিদ্ধি হতেই মাথায় নড়াচড়া শুরু করল গুবরে পোকারা। টিকটিকি লজেন্স পাওয়া গেলে অবশ্যই পাওয়া যাবে ‘দাঁতের লড়াই’, ‘চটচটে’, ‘কালো হজমি’, ‘চিনে কুল’, ‘কালো নুন’, ‘বুড়ির চুল’, ‘ডিম লজেন্স’ আর ‘মালাই বরফ’। পরের কয়েক দিন লেগে পড়লাম গুপ্তধনের সন্ধানে।
স্বীকার করতে বাধা নেই, অতি দুরূহ সে অন্বেষণ। শুরু করলাম দাঁতের লড়াই দিয়ে। স্কুলে নতুন ছেলে ভর্তি হলে এই অমোঘ চিজটি দিয়ে তাকে আপ্যায়ন করাই ছিল রেওয়াজ। সেলোফেন কাগজে মোড়া শক্ত হাল্কা বাদামি রঙের আপাত নিরীহ পিরামিড আকৃতির চিজটি যে কী মারাত্মক কাণ্ড ঘটাতে পারে তা আন্দাজই করতে পারত না বেচারা নবাগতরা। দোস্তি পাতানোর অছিলায় তাকে বাড়িয়ে দেওয়া হত তেকোনা বিভীষিকা। মুখে দিয়ে চুষলে 'নো চিন্তা'। কিন্তু ভুলেও যদি তাতে কামড় দেওয়া হয়েছে, তাহলেই চিত্তির! দাঁতের দু-পাটিকে ফেভিকুইকের কায়দায় জাপটে ধরবে আঠালো টফি। ওদিকে পাশে দাঁড়ানো মিচকে পটাশ অ্যাডভাইস দেবে, 'চেষ্টা কর জিভ দিয়ে ঠেলতে'। বলা বাহুল্য টোটকায় কাজ তো হবেই না, উলটে দাঁতের পাটিতে আরও লেপ্টে যাবে মিঠে দুশমন। যতক্ষণ না সে গলে যাবে, ততক্ষণ চুপটি করে মুখ বন্ধ করে গুডবয় হয়ে থাকো। কিন্তু বহু চেষ্টা করেও তার কোনও খোঁজ পেলাম না।
কলকাতার এমাথা থেকে ওমাথা চষে ফেললেও অধরাই থেকে গেল চটচটেও। না, চরিত্রগত খানিক মিল থাকলেও দাঁতের লড়াইয়ের তুলনায় এ বেশ নিরুপদ্রব। বিকেলে পাড়ায় পাড়ায় ঘুরত চটচটেওয়ালা। তার কাঁধে গোলপানা লম্বা কাঠের লাঠি। আর তাতে জড়ানো হরেক রঙের চিনির ফিতে। এক টাকায় মুঠোভরা পাঁচ-ছ রঙা মিষ্টি ফিতে পাওয়া যেত মনে আছে। কাঠির আগায় তা পেঁচিয়ে দিত ফেরিওয়ালা। অনেক সময় আবদারে সায় দিয়ে ঘড়ি, আংটি বানিয়ে হাতেই লেপটে দিত। ললিপপের কায়দায় অনন্তকাল ধরে তা চেটে যাওয়াতেই ছিল মজা।
কালো হজমির আড়তদার ছিল স্কুলের সামনে ঘাঁটি গাড়া ফেরিওয়ালারা। বড় যত্ন করে লাল আর কালো নুনের সঙ্গে বেড়ে দিত কুটকুটে কালো হজমিগুলি। ইদানিং নামী ব্র্যান্ডের বোতল, ফাইল বা স্যাশেজাত হজমির সাধ্য কি তার সঙ্গে পাল্লা দেয়! হজমির গায়ে কিন্তু সেঁটে থাকত না কোনও মশলা। হালের কায়দা অনুযায়ী জোয়ান-টোয়ানও ঠেসে দিত না কেউ। বিলিতি আমড়া আর কাঁচামিঠে আমের সঙ্গেও কালো নুন মাখিয়ে দিত। অনেক সময় ওই নুনের লোভেই দোকানে হাজিরা দিতাম। টক-মিষ্টি স্বাদের মাঝে কালো নুনের তীব্রতা আর লাল নুনের ঝাল-ঝাল অনবদ্য ব্যাপারটা সমসাময়িক অনেকেই মনে করতে পারবেন।
হজমি ছাড়াও রবারের লাল-সবুজ ছিপি আঁটা কাচের ছোট শিশিতে মিলত স্পেশ্যাল কালো নুন। সে যুগে 'মাঙ্কি ব্র্যান্ড'-এর মাজন পাওয়া যেত, হুবহু তার মতোই চেহারা। কিন্তু 'কহাঁ রাজা ভোজ, কহাঁ গঙ্গু তেলি'! কোনও তুলনাই চলে না। এক খাবলা কালো নুন জিভের মাঝ-মধ্যিখানে রেখে দিলে ডবল মজা! জিভে কাঁটা দেওয়া বেদম টক মিলিয়ে যেতে যেতে পাওয়া যেত মধুরতার আভাস। আর নুনের প্রকোপে কালচে জিভ বের করে পরস্পরকে ভেংচি কাটা ছিল বনেদি ব্যাপার-স্যাপার। সুখের কথা, পার্ক সার্কাসের ডন বস্কো স্কুলের সামনেই ফের দেখা হয়ে গেল তার সঙ্গে।
বিরল হয়ে এলেও পাওয়া গেল চিনে কুলের হদিশও। বারো মাস কোন মুলুক থেকে যে এদের আমাদানি করেন হজমিওয়ালারা, তা ঈশ্বরই জানেন। রসিকজন মাত্রই মানবেন, মিষ্টি কুলের গায়ে আলতো জড়ানো লঙ্কার গুঁড়ো মেশানো নুন সমেত পেশ করাই রিয়াসত।
স্কুলের সামনে সারি দিয়ে দাঁড়ানো ফেরিওয়ালাদের প্রায় সবার সামনেই পাটকাঠির লম্বা মোড়ার ওপর বসানো থাকত কাঠের ফ্রেমযুক্ত কাচের বাক্স। তাতে জিভে-জল-আনা রকমারি পদের সমাহার। আমসি, চুরন, হজমির সঙ্গেই ছোট বয়াম ঠাসা তিন-চার কিসিমের আচার। এদের মধ্যে সেরা তেঁতুলের আচার। একফালি কাগজের ওপর কমলা রঙা পাতলা সেই ঝোলের ওপর ছড়িয়ে দেওয়া হত ঝাল নুন, বিটনুনের অমোঘ স্প্রেড। আহা! কতদিন যে ঝোল চাটতে গিয়ে কাগজের কালিও পেটে চালান হয়ে গিয়েছে তার হিসেব কে রেখেছে!
টংটং ঘন্টির আওয়াজ পেলে আজও মনে পড়ে ‘বুড়ির চুল’ওয়ালাকে। ছোট ছোট গোলাপি আর সাদা নরম তুলোর মিষ্টি গোল্লা নিয়ে আসত সে। এক বারে একখানা সোজা মুখে দিলেই গলে ফুস্। এরাই হচ্ছে আজকের ক্যান্ডিফ্লসের আদি পুরুষ। তবে হালের ওই ঢাউস বস্তুগুলির প্রতি আমি মোটেও সদয় নই। বুড়ির চুল পেলে আজও খেতে রাজি আছি, কিন্তু ক্যান্ডিফ্লস, নৈব নৈব চ। কাচের বাক্স ছেড়ে প্লাস্টিক প্যাকেট করা ‘বুড়ির চুল’ নিয়ে আজও মাঝেসাঝে চোখে পড়ে দু-একজন ফেরিওয়ালা।
কাচের বাক্স থাকত না শুধু মালাই বরফওয়ালার কাছে। সে আসত চাকাওয়ালা হাতগাড়ি ঠেলতে ঠেলতে। অ্যালুমিনিয়ামের পাতে ঢাকা তার গাড়ির মাথায় কারুকাজ করা কাঠের কেয়ারি। বাক্স আকৃতির গাড়ির মাথায় ফুটখানেক ব্যাসের হাতল সাঁটা ঢাকনা। মাটির একরত্তি খুরিতে স্টিলের চামচ দিয়ে ঠেসেঠুসে মাখনরঙা মালাই ভরে দিত দোকানি। আর গার্নিশিং হিসেবে ফেলত দু’ফোঁটা লাল সিরাপ। অসাধারণ সেই মালাইয়ের স্বাদে বিভোর হয়ে কখন যে পেরিয়ে আসতাম স্কুল থেকে বাড়ি ফেরার পথটুকু, তা টেরই পেতাম না।
ঝাপসা হয়ে আসা শৈশব স্মৃতি হাঁটকে অতীতের অমৃত কুম্ভের সন্ধান করা হয়তো বাতুলতা। সুইস চকোলেটস, হরেক স্বাদের ওয়েফার আর বহুজাতিকের দুর্দান্ত প্যাকেজিং করা নানান পণ্য সম্ভারের ধাঁধায় হারিয়ে গিয়েছে কালো হজমি, চটচটে, দাঁতের লড়াই বা মালাই বরফের সাবেক সাকিন। সাইবার কেতায় দুরস্ত শিশুদের কাছে প্রজন্ম ফারাকের পসরা সাজাতে গেলে নিজের নাক কাটা যাওয়ার সমূহ সম্ভাবনা। তাই সাধু সাবধান!

No comments:

Post a Comment