Thursday, January 17, 2013

পুষ্টিই নিরাপদ মাতৃত্বের চাবিকাঠি





পুষ্টিই নিরাপদ মাতৃত্বের চাবিকাঠি

কেয়া পাল

স্বাস্থ্যই মানুষের গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ। যুগ যুগ ধরে মানুষ তাই উজ্জ্বল স্বাস্থ্য কামনা করে আসছে। সুস্থ, সবল স্বাস্থ্যের জন্য পুষ্টির প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। নিরাপদ মাতৃত্ব স্বাস্থ্য রক্ষার একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক। মোট কথা, পুষ্টির সঙ্গে স্বাস্থ্য এবং স্বাস্থ্যের সঙ্গে নিরাপদ মাতৃত্বের একটি নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। মানুষের অস্তিত্ব রক্ষায় মাতৃত্ব কতখানি গুরুত্বপূর্ণ আমরা জানি। এই মাতৃত্বের দু’টি দিক বর্তমান। একটি হলো মায়ের দেহে সন্তান আসা এবং দীর্ঘ দশ মাস ধরে ভ্রূণ অবস্থায় সন্তানের বৃদ্ধি এবং আর একটি দিক হলো শিশু ভুমিষ্ঠ হওয়ার পর তার যথাযথ প্রতিপালন ও পরিচর্যা। সন্তানসম্ভবা অবস্থায় গর্ভধারিনীর পুষ্টিগত মানের ওপর তাঁর দেহে বেড়ে ওঠা ভ্রূণের বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রিত হয়। গর্ভধারণকালে মায়ের মধ্যে অপুষ্টি দেখা দিলে ভ্রূণের ওপরও তার প্রভাব পড়ে। সন্তানধারণকালে এবং সর্বোপরি প্রসবকালে মা যদি উপযুক্ত পুষ্টিমানে না থাকেন তাহলে মা ও শিশু উভয়েই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। মা ও শিশু উভয়ের মধ্যে পুষ্টির অভাবজনিত রক্তাপ্লতা দেখা দেয়। অনেক সময় শিশুর, এমনকি মায়েরও মৃত্যু ঘটতে পারে।

নিরাপদ মাতৃত্ব লাভের ক্ষেত্রে পুষ্টি শিক্ষা বিশেষভাবে সাহায্য করে। পুষ্টি শিক্ষার মধ্যে দিয়েই জানা যায় সন্তানসম্ভবা নারীর অপুষ্টি রোধের জন্য কী জাতীয় খাদ্য গ্রহণ করা উচিত। স্থানীয়ভাবে প্রাপ্ত কোন কোন খাদ্য কত পরিমাণ গ্রহণ করলে সেগুলি মা ও ভ্রূণ উভয়েরই পুষ্টির সহায়ক হয় তা পুষ্টি শিক্ষা থেকে জানা যায়। পুষ্টি শিক্ষার একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো— অতি দামী খাদ্য মানেই অতি পুষ্টিমূল্যযুক্ত খাদ্য নয়। তা ছাড়া এও জানা যায় যে, কীভাবে বিভিন্ন ধরনের খাদ্য সঞ্চয় এবং সংরক্ষণ করা যায়। কীভাবে রান্না করলে পুষ্টিমূল্যের অপচয় রোধ করা যায়। এছাড়া খাদ্য পরিবেশন এবং খাদ্য গ্রহণ পুষ্টিশিক্ষার অঙ্গ হিসাবেই বিবেচিত হয়। স্থানীয়ভাবে পাওয়া সাধারণ খাদ্য সামগ্রী সর্বাধিক পুষ্টিমূল্য কত এবং তা সঠিকভবে সদ্ব্যবহার হচ্ছে কিনা। নিরাপদ মাতৃত্ব বজায় রাখতে হলে উপযুক্ত পুষ্টি শিক্ষার দ্বারা সন্তানসম্ভবা মা’কে এমন অবস্থায় নিয়ে যাওয়া, যাতে মহিলার এবং তাঁর দেহের ভ্রূণের কোন ক্ষতি না হয়।

নিরাপদ মাতৃত্বের জন্য যে সব পুষ্টি উপাদান সন্তানসম্ভবা মাকে সরবরাহ করা উচিত, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো প্রোটিন স্নেহপদার্থ, ক্যালসিয়াম, লোহা, ভিটামিন-এ, ভিটামিন-বি কমপ্লেক্স, ভিটামিন-সি, ফলিক অ্যাসিড প্রভৃতি। মাতৃত্বকালে উপযুক্ত শক্তির চাহিদা পূরণ না করলে, একদিকে যেমন নারীর স্বাস্থ্য ভাঙতে শুরু করে, অন্যদিকে দেহের ভ্রূণ বা শিশুর ওপরেও তার প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ প্রভাব পড়ে। ভ্রূণ অবস্থাতেই যদি মায়ের স্বাস্থ্য ভাঙতে শুরু করে তাহলে জন্মের পরে শিশুর বৃদ্ধি ও বিকাশে তার প্রতিফলন হয়।

নিরাপদ মাতৃত্বের ক্ষেত্রে বিভিন্ন পুষ্টি উপাদানের প্রয়োজনীয়তা :—

(১) ক্যালোরি— গর্ভাবস্থায় মহিলাদের দেহে অতিরিক্ত পরিমাণ শক্তির প্রয়োজন হয়। এই চাহিদা পূরণ করার জন্য গ্রামাঞ্চলের মহিলাদের ক্ষেত্রে স্থানীয়ভাবে প্রাপ্ত স্বল্পমূল্যের দানাশস্য থেকেই ওই চাহিদা পূরণ করা যায়। পুষ্টিশিক্ষা এবিষয়ে সাহায্য করে। উপযুক্ত পুষ্টি শিক্ষার ব্যবস্থা থাকলে মহিলারা স্থানীয়ভাবে প্রাপ্ত খাদ্যসামগ্রীকে কাজে লাগিয়েই নিরাপদ মাতৃত্বলাভে সফল হতে পারেন।

(২) প্রোটিন— সন্তানসম্ভবা মায়ের দেহে প্রোটিন একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। দেহের মধ্যে ভ্রূণের বৃদ্ধির জন্য প্রোটিন বিশেষভাবে প্রয়োজন হয়। এই কারণে গর্ভাবস্থায় থাকাকালীন মহিলাকে প্রাণীজ প্রোটিন উপযুক্ত মাত্রায় সরবরাহ করতে হয়। প্রাণীজ প্রোটিনে সবকটি অপরিহার্য অ্যামাইনো অ্যাসিড থাকে। উদ্ভিদ প্রোটিনের উৎস হিসাবে দানাশস্যের মধ্যে ডালই সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ। যাঁরা উপযুক্ত পরিমাণ প্রাণীজ প্রোটিন জোগাড় করতে পারবেন না, তাঁরা বেশি পরিমাণে ডাল গ্রহণ করলেই ওই চাহিদা পূরণ হবে।

(৩) ফ্যাট— সন্তানসম্ভবা মায়েদের দেহে ফ্যাট বা স্নেহপদার্থের চাহিদাও স্বাভাবিক অবস্থার তুলনায় বৃদ্ধি পায়। শক্তির প্রয়োজনীয়তা বৃদ্ধি এর অন্যতম কারণ। দেহে অপরিহার্য ফ্যাটি অ্যাসিডের চাহিদা পূরণের জন্য মোট গ্রহণীয় ফ্যাটের এক চতুর্থাংশ উদ্ভিদ তেল থেকে পূরণ করা যেতে পারে। এছাড়া অপেক্ষাকৃত সস্তা মূল্যে তুষ থেকেও এই চাহিদা পূরণ করা যায়।

(৪) ক্যালসিয়াম— সন্তানসম্ভবা এবং স্তনদানকারী মায়ের দেহে ক্যালসিয়ামের চাহিদা বৃদ্ধি পায়। নিরাপদ মাতৃত্বের জন্য মায়ের দেহে এই চাহিদা পূরণ অনেক কম খরচে করা যেতে পারে। দানাশস্য, শাকসবজি, দুধ, খোলকমুক্ত মাছ, ডিম, কুঁচো চিংড়ি এবং ছোট মাছ থেকে অনায়াসে ক্যালসিয়াম পাওয়া যায়। এগুলির মধ্যে কিছু উপাদান গ্রামাঞ্চলে বিনা খরচে সংগ্রহ করা যায়।

(৫) লোহার চাহিদা পূরণ— গর্ভাবস্থায় মায়েদের দেহে বিশেষভাবে লোহার চাহিদাও বৃদ্ধি পায়। লোহার অভাবে ওই সময় মায়েদের দেহে অ্যানিমিয়া দেখা দেয়। এই অ্যানিমিয়া শিশুর বৃদ্ধি এবং মায়ের স্বাস্থ্যের পক্ষের ক্ষতিকারক। অনেক সময় লোহার অভাবজনিত কারণে অ্যানিমিয়া থেকে মায়ের মৃত্যুও হতে পারে। পুষ্টি শিক্ষা এবিষয়ে মানুষকে সচেতন করতে পারে। পাশাপাশি কোন্‌ কোন্‌ খাদ্য থেকে সহজে অল্প খরচে লোহার চাহিদা পূরণ করা যায় সে সম্পর্কে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত। তবে সবুজ শাকসবজি, মেটলি, মাংস, মাছ দেহে লোহার চাহিদা পূরণ করে।

(৬) ভিটামিন এ— গর্ভাবস্থায় ভ্রূণের বৃদ্ধিতে বিশেষ করে দৃষ্টিশক্তি তৈরিতে ভিটামিন-এ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এই ভিটামিন স্থানীয়ভাবে প্রাপ্ত শাকসবজি, হলুদ এবং কমলালেবু বা বিভিন্ন ফল থেকে পাওয়া যায়। উপযুক্ত পুষ্টি চাহিদা পূরণের জন্য স্থানীয়ভাবে প্রাপ্ত স্বপ্লমূল্যের খাদ্য সামগ্রী গ্রহণ করা যেতে পারে। বাস্তবে দেখা গেছে যাঁদের পুষ্টি শিক্ষার জ্ঞান রয়েছে তারা অল্প খরচে বিভিন্ন ভিটামিনের চাহিদা পূরণে সমর্থ হন।

(৭) ভিটামিন সি— স্তনদানকালীন সময়ে মায়ের শরীরে ভিটামিন সি-র চাহিদা বেড়ে যায়। এই চাহিদা পূরণের জন্য স্থানীয়ভাবে প্রাপ্ত বিভিন্ন ধরনের ফল অর্থাৎ আমলকি, পেয়ারা, লেবু প্রভৃতি থেকে পাওয়া যেতে পারে। তাছাড়া দুপুরে খাওয়ার শেষে চাটনি বা টক জাতীয় তরকারী বা টক দই খেলে এই চাহিদা অনেকখানি পূরণ হয়।

(৮) ফলিক অ্যাসিড— সন্তানসম্ভবা মহিলার দেহে ফলিক অ্যাসিডের চাহিদা স্বাভাবিক অবস্থার তুলনায় প্রায় চারগুণ বৃদ্ধি পায়। এই চাহিদা পূরণ কোনো তরকারি থেকে পাওয়া সম্ভব নয়। তাই এর চাহিদা পূরণের জন্য ফলিক অ্যাসিড সমৃদ্ধ ট্যাবলেট নিয়মিত খাওয়া প্রয়োজন। কারণ এর অভাবে অ্যানিমিয়া দেখা দিতে পারে।

(৯) ভিটামিন বি ১২— গর্ভাবস্থায় মায়ের এবং ভ্রূণের স্বাস্থ্যের জন্য ভিটামিন বি ১২সমৃদ্ধ খাদ্য বিশেষভাবে প্রয়োজন। এই খাদ্যের অভাবে গর্ভাবস্থায় মহিলারা অ্যানিমিয়ায় ভুগতে শুরু করেন। ভিটামিন বি ১২সম্পর্কে মহিলাদের বিশেষভাবে সচেতন থাকা প্রয়োজন।

এছাড়া নিরাপদ মাতৃত্বের জন্য উপযুক্ত পরিমাণে ঘুম এবং বিশ্রামের প্রয়োজন। তার সঙ্গে প্রতিদিন নিয়ম করে কিছু ব্যায়াম করাও দরকার।

পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশে অপুষ্টিজনিত কারণে বহু মা বিভিন্ন রোগের শিকার হন এবং দীর্ঘদিন অপুষ্টিজনিত রোগে ভুগতে ভুগতে শেষ পর্যন্ত মারা যান। একমাত্র পুষ্টিশিক্ষাই এই জাতীয় অপুষ্টিজনিত ব্যাধিগুলি সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করতে পারে। তাই নিরাপদ মাতৃত্বের জন্য প্রত্যেক মহিলার পুষ্টি শিক্ষার জ্ঞান অপরিহার্য।

No comments:

Post a Comment