পশ্চিমবঙ্গ কোন পথে?
'অতীত যাঁরা মনে রাখতে পারেন না, তাঁরা অতীতের পুনরাবৃত্তি করার দণ্ডে দণ্ডিত'৷ দার্শনিক জর্জ সান্তায়ানা-র এই উক্তিটি পশ্চিমবঙ্গে হঠাত্ ভারি প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে৷ এ রাজ্যে রাজনৈতিক ক্ষমতার হাত বদল চট করে ঘটে না৷ ইতিহাস তাই বলে৷ আবার অতীতে এও দেখা গেছে, রাজনৈতিক ক্ষমতা-পরিবর্তনের পর এক ধরণের হিংসাত্মক অরাজকতা সারা রাজ্যকে গ্রাস করেছে৷ ১৯৭৭ থেকে ২০১১ পর্যন্ত রাজ্যবাসীকে প্রথম ইতিহাসটির পুনরাবৃত্তি করতে দেখেছে সারা দুনিয়া৷ ১৯৪৭ থেকে ১৯৬৭ পর্যন্ত কুড়ি বছরের কংগ্রেস শাসনের পর চৌত্রিশ বছরের বামফ্রন্ট জমানা৷ প্রশ্ন হল, ১৯৬৭ থেকে ১৯৭৭ অবধি যে অস্থিরতা এ রাজ্যকে ক্রমাগত উত্তাল করে প্রায় সমস্ত ক্ষেত্রেই রাজ্যের উন্নয়নকে প্রশ্নচিহ্নের মুখে দাঁড় করিয়ে ছিল, পশ্চিমবঙ্গে সেই অতীতও ফিরে আসতে চলেছে কি না? বিগত কয়েক দিনের ঘটনা প্রবাহের নিরিখে বলতেই হয়, সে আশঙ্কা অমূলক নয়৷ বর্তমানে এ রাজ্য নজিরবিহীন অর্থনৈতিক সঙ্কটে আকীর্ণ৷ এই সময় রাজনৈতিক হিংসার আগুন বিধ্বংসী দাবানল হয়ে ওঠার আগেই যে তা নিভিয়ে ফেলা দরকার তা নিয়ে সংশয় থাকার কোনও কারণ নেই৷ এর মূল দায়িত্ব যে ক্ষমতাসীন তৃণমূল কংগ্রেস এবং প্রধান বিরোধী দল সি পি আই এম-এর তা নিয়েও বিতর্কের খুব বেশি অবকাশ নেই৷ কিন্ত্ত এ রাজ্যের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলির নেতৃবর্গের মধ্যে সে শুভবুদ্ধি ঠিক কবে জাগবে কিংবা আদৌ জাগবে কী না, আসল প্রশ্ন সেটাই৷ গণতন্ত্রে রাজনৈতিক দলগুলির মধ্যে প্রতিযোগিতা স্বাভাবিক৷ বস্ত্তত তা কাম্যও৷ প্রতিযোগিতাহীন একক ক্ষমতার দীর্ঘ শাসনের কী পরিণতি হতে পারে তা চৌত্রিশ বছরের বাম শাসনে দেখা গিয়েছে৷ দশকের পর দশক শাসক পরিবর্তন না করার ভুলের পুনরাবৃত্তি করে পশ্চিমবঙ্গবাসী কী পেয়েছেন? অনেকেই বলবেন, প্রায় প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের রন্ধ্রে রন্ধ্রে স্বজন-পোষণ, দুর্নীতি ও চরম আর্থিক দেউলিয়াপনা৷ অবশেষে ২০১১-র ১৩ মে রাজ্যের ভোটাররা বামফ্রন্টকে ক্ষমতা থেকে ছুড়ে ফেলার পর অনেকেই আশা করেছিলেন এই 'পরিবর্তন' রাজ্যকে আবার উন্নয়নমুখী করবে৷ যে উদ্যমে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দার্জিলিং থেকে জঙ্গলমহল ছুটে বেড়িয়ে শান্তি ও সুশাসনের আশ্বাস দিয়ে নতুন সরকারের সূচনা ঘটিয়েছিলেন তাতে রাজ্যবাসীর পক্ষে খানিকটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলা স্বাভাবিক ছিল৷ কিন্ত্ত কয়েক মাস যেতে না যেতেই প্রথমে স্কুল ও কলেজের বিভিন্ন নির্বাচন ও পরে সাধারণ ভাবে এলাকা দখলকে কেন্দ্র করে রাজ্যের বহু এলাকা থেকেই প্রতিনিয়ত ছোটো ছোটো হিংসার ঘটনার খবর প্রকাশিত হতে থাকে৷ ভাঙড়ের সাম্প্রতিক সংঘাত তাই কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়৷ বরং হয়তো আগামী দিনের পরিস্থিতির ইঙ্গিত৷ বিগত বিধানসভা নির্বাচনে পর্যুদস্ত হলেও সি পি আই এম রাজ্য-রাজনীতি থেকে উবে গেছে এমন ধরে নেওয়ার কোনও কারণ নেই৷ সাড়ে তিন দশক ধরে বিস্তৃত তার শিকড় প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের গভীরে৷ রাজ্যের প্রায় অর্ধেক পঞ্চায়েত এবং ১৪ টি জেলা পরিষদ এখনও বামফ্রন্টের দখলে৷ আগামী পঞ্চায়েত নির্বাচনে এগুলির দখল নিয়ে তৃণমূল কংগ্রেস এবং সি পি আই এম-এর মধ্যে রেষারেষি চরমে পৌঁছনই স্বাভাবিক৷ সামনেই একাধিক গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা৷ সার্বিক অর্থনৈতিক সংকট বেড়েই চলেছে৷ রাজ্যে বিনিয়োগের পরিস্থিতি নিয়ে বণিকমহলে এখনও গভীর সন্দেহ৷ এ অবস্থায় যদি পশ্চিমবঙ্গের প্রধান রাজনৈতিক শক্তি দুটি এই রাজনৈতিক প্রতিযোগিতাকে লাগামহীন হিংসায় পর্যবসিত করে তাহলে সে লড়াইয়ে কে জিতবে তা এখুনি বলা মুশকিল হলেও রাজ্যবাসী যে গভীরে পরাজিত হবেন তা নিশ্চিত৷ আগামী দিনের ক্ষমতার লোভে অতীত-বিস্মৃত নেতৃকুল কি রাজ্যের পায়ে ইতিহাসের পুনরাবৃত্তির বেড়ি পরিয়ে রাখবেনই? উত্তর জানা যাবে শীঘ্রই৷
No comments:
Post a Comment