Thursday, January 17, 2013

বিবেকানন্দের বিজ্ঞানচিন্তা


Image

Ganashakti


বিবেকানন্দের বিজ্ঞানচিন্তা

জলধর মল্লিক

একটা শতকের উদয় হয়। তারপর তার নিজের সময়কাল পূর্ণ করে অস্ত যায়। শুরু হয় নতুন শতকের। কালের নিয়মে এমনি করে কত শত শতকের আবির্ভাব ঘটেছে এই পৃথিবীর বুকে। এদের মধ্যে কোনো কোনো শতক নিজস্বতার গুণে হয়ে ওঠে অনন্য, যেমনটি হয়েছে অবিভক্ত বাংলার বুকে উনিশ শতক। নানান ঐতিহাসিক কারণে এই শতকটি যে বাংলার শিক্ষিত মধ্যবিত্ত, উচ্চবিত্তের একাংশের ধ্যানধারণার জগতে বিপুল পরিবর্তন নিয়ে আসে সে বিষয়ে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। এই শতকে যেমন ভারতে ইংরেজদের ঔপনিবেশিক শাসনব্যবস্থা সারা ভারতে বিস্তার লাভ করেছে, তেমনি কচিকাঁচাদের জন্যে আধুনিক প্রাথমিক শিক্ষার প্রচলন হয়েছে, উচ্চস্তরের শিক্ষালাভের জন্যে কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হয়েছে, পাবলিক লাইব্রেরি গড়ে উঠেছে, রেলপথ স্থাপিত হয়েছে, বিজ্ঞান সাধনার দরজা খুলে গিয়েছে, দানা বেঁধেছে সমাজসংস্কারবাদী আন্দোলন। এসবের সঙ্গে সঙ্গে ইংরেজদের শোষণও বেড়েছে, বেড়েছে নিপীড়িতের সংখ্যা। পাশ্চাত্যের জ্ঞানবিজ্ঞানের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার সুযোগ লাভের পাশাপাশি স্বদেশচেতনা, স্বদেশী আন্দোলনও বিকশিত হতে শুরু করে একাংশ শিক্ষিত বঙ্গসন্তানসহ স্বল্প সংখ্যক ভারতীয়ের মধ্যে।

এই উনিশ শতকেই পাশ্চাত্যের জ্ঞানবিজ্ঞানের অভিঘাতে আর ভারতের প্রাচীন শাস্ত্র, সংস্কৃত সাহিত্যগুলি নতুন দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার বিবেচনা করার ফলে অবিভক্ত বাংলায়, বিশেষত কলকাতার মধ্যবিত্ত, উচ্চবিত্ত বুদ্ধিজীবী সমাজে আবির্ভাব ঘটে নতুন এক প্রগতিশীল দৃষ্টিভঙ্গির। এর ফলে বিগত কয়েক শতকব্যাপী জমে থাকা পাশ্চাদগামী ধ্যানধারণার মরুভূমিতে জেগে ওঠে আগুয়ান চিন্তাভাবনার মরুদ্যান। সমাজের বৃহত্তর অংশে না হলেও, স্বল্পসংখ্যক শিক্ষিত মধ্যবিত্ত, উচ্চবিত্ত বুদ্ধিজীবী-সমাজে দেখা দেয় যুক্তিবাদ, মানবতাবাদ, স্বাদেশিকতা, ভারতের প্রাচীন সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের প্রতি বিচারপ্রসূত শ্রদ্ধা, ইতিহাসচেতনা, বিজ্ঞানচেতনা। কেউ কেউ সেই জন্যে এই শতকটিকে ফরাসীদের অনুকরণে বাংলার নবজাগরণের যুগ বলে চিহ্নিতও করছেন বটে তবে এই ধরনের চিহ্নিতকরণের বিষ‌য়টি বিতর্কের ঊর্ধ্বে নয়। যাইহোক, এসবের ফলে উনিশ শতকে আবির্ভাব ঘটে বিদ্যাসাগর, মাইকেল মধুসূদন দত্ত, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, রবীন্দ্রনাথ, আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়, আচার্য জগদীশচন্দ্র বসুর মতো বেশ কয়েকজন আধুনিক মনের মানুষের। আঠারো শতকে জন্মালেও উনিশ শতকে যার কর্মজীবন তথাকথিত নবজাগরণের সূত্রপাত ঘটায় তিনি হলেন রাজা রামমোহন রায়। এই উনিশ শতকেরই ১৮৬৩ সালের ১২ই জানুয়ারি উত্তর কলকাতার সিমুলিয়া বা সিমলা অঞ্চলে জন্মগ্রহণ করেন নরেন্দ্রনাথ দত্ত, যাঁর ডাকনাম ছিল বিলে। বলার অপেক্ষা রাখে না যে, এই নরেন্দ্রনাথ ওরফে বিলেই পরবর্তীকালে রামকৃষ্ণের শিষ্য হিসেবে সন্ন্যাসজীবনে প্রবেশের পর স্বামী বিবেকানন্দ হিসেবে সারা বিশ্বে পরিচিত হন।



বিজ্ঞানচেতনার উন্মেষ

পারিবারিক প্রতিবেশ, সামাজিক পরিবেশ, শিক্ষাদীক্ষা, যুগের প্রভাব, সর্বোপরি নানা ধরনের অভিজ্ঞতা ব্যক্তি মানুষের মানসিক গড়নটি তৈরি করে দেয়। ব্যতিক্রম ঘটেনি বিবেকানন্দের ক্ষেত্রেও। বরং বলা যায়, সেটা প্রবলভাবে‍‌ই ঘটেছে। বিবেকানন্দের পিতা বিশ্বনাথ দত্ত আইনজীবীর পেশায় নিযুক্ত থাকলেও নানাদিকে ছিল তার আগ্রহ। পিতার কাছেই হয়েছিল বিজ্ঞানচেতনার প্রথম ও আবশ্যিক উপাদান হিসেবে চিহ্নিত যুক্তিবোধের হাতেখড়ি। কিশোর বিবেকানন্দকে তাঁর পিতাই বলেছিলেন—‘জগতে কোনো কিছুতে বিস্ময় প্রকাশ করিও না’ অর্থাৎ সব কিছুর পিছনে যে কার্যকারণ আছে‍ সেটা বিচার করে দেখার শিক্ষাই দিয়ে ছিলেন তিনি। পিতার প্রশ্রয়ে পাওয়া সঙ্গীতের প্রতি অনুরাগ তাঁর মধ্যে জন্ম দেয় এক সংবেদনশীল মনের, এছাড়াও বিবেকানন্দের বাড়িতে তাঁর পিতার আমন্ত্রণে অনেক বিদ্বান, বুদ্ধিমান ব্যক্তিরা আসতেন, নানা বিষয়ে আলোচনা করতেন। এইসব আলোচনা তাঁকে মননশীল করে তোলে।

বিবেকানন্দ কখনো আনুষ্ঠানিকভাবে বিজ্ঞানের পাঠ গ্রহণ না করলেও জীবন থেকেই বিজ্ঞান আর প্রযুক্তির প্রতি তাঁর আগ্রহের পরিচয় পাওয়া যায়। তখন তিনি বিদ্যাসাগরের মেট্রোপলিটান স্কুলের ছাত্র। কলকাতায় তখন সবেমাত্র গ্যাসের আলো আর সোডা ওয়াটার আমদানি হয়েছে। শোনা যায়, কিশোর নরেন্দ্রনাথ প্রযুক্তির প্রতি প্রবল আকর্ষণের সুবাদে তার খেলাঘরে ঐ দুটো জিনিস আর রেলগাড়ি বানিয়েছিলেন মাথা খাটিয়ে নিজে নিজেই।

কী স্কুল জীবনে, কী কলেজ জীবনে সরাসরি বৈজ্ঞানিক কোনো বিষয়ে পাঠ না গ্রহণ করলেও কৈশোর থেকেই তার গণিতবিদ্যার প্রতি বিশেষ আকর্ষণ ছিল। কলেজে পড়ার সময় গণিত, জ্যোতির্বিজ্ঞান নিয়ে রীতিমতো পড়াশোনা করেছেন নিজের আগ্রহে। পড়েছেন ভূতত্ত্ব, প্যাথলজি, উদ্ভিদবিদ্যার বইপত্র। এইভাবে জৈব, অজৈব বিজ্ঞানের রাজ্যে তিনি বিচরণ করেছেন। এমনকি রসায়ন, পদার্থবিদ্যা, উচ্চস্তরের গণিতেও তার বিশেষ দখল ছিল বলে জানা যায়। আগ্রহ আর মেধার জোরে বিজ্ঞানের নানান ক্ষেত্রের সঙ্গে সুপরিচিত হওয়ার সুবাদে তার মধ্যে বিজ্ঞানচেতনার উন্মেষ ঘটে।

পড়াশোনা ছাড়াও বহু বিজ্ঞানী ও প্রগতিশীল চিন্তায় ঋদ্ধ মনীষীদের সঙ্গলাভ বিবেকানন্দের সন্ন্যাসপূর্ব জীবনকাল থেকেই যুক্তিবাদী মন গড়ে তুলতে সাহায্য করেছে। কলেজে বিবেকানন্দের সমসাময়িক ছিলেন “The Positive Science of the Ancient Hindus’ শীর্ষক গ্রন্থটির রচয়িতা বিখ্যাত দার্শনিক কিন্তু বৈজ্ঞা‍‌নিক মনোভাবের অধিকারী আচার্য ব্রজেন্দ্রনাথ শীল। বহু সময়ে বিবেকানন্দ আচার্য শীলের সঙ্গে নানা বিষয়ের বৈজ্ঞানিক ও দার্শনিক ব্যাখ্যা নিয়ে আলোচনা করেছেন। বিবেকানন্দ তখনও তরুণ নরেন্দ্রনাথ নামেই পরিচিত। সেই সময় কলকাতার শিক্ষিত সমাজের বিখ্যাত ‘তত্ত্ববোধিনী সভা’-র যুক্তিবাদী, বিজ্ঞাননিষ্ঠ সভ্যদের সঙ্গে, বিজ্ঞান ও ইতিহাসসম্মত আলোচনার পথিকৃৎ ‘তত্ত্ববোধিনী’ পত্রিকার সম্পাদক অক্ষয়কুমার দত্তের সংস্পর্শে এসেছিলেন। Indian Association for Cultivation of Science- এর প্রতিষ্ঠাতা ডাঃ মহেন্দ্রলাল সরকারের সঙ্গেও নানা বিষয়ে আলোচনা করতেন বলে শোনা যায়। বিজ্ঞানের প্রতি বিপুল শ্রদ্ধা আর স্বদেশচেতনার দরুন পরবর্তীকালে তিনি হয়ে ওঠেন আচার্য জগদীশ বসুর একনিষ্ঠ গুণগ্রাহী। বিবেকানন্দের আগ্রহে, উৎসাহেই সিস্টার নিবেদিতা আচার্য জগদীশচন্দ্রের প্রতি সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন অবারিতভাবে।

বিজ্ঞানমনস্ক এক সন্ন্যাসীর আবির্ভাব

পরবর্তীকালে বিবেকানন্দ হিসেবে বিশ্বপরিচিত লাভের পর শুধু দেশেই নয়, বিদেশেও তড়িৎবিজ্ঞানী লর্ড কেলভিন ও নিকোলা টেসলা, কামানের আবিষ্কর্তা হিরাম স্টিভেনস ম্যাক্সিম, পদার্থবিদ্যা ও শারীরবিদ্যার খ্যাতনামা বিজ্ঞানী অধ্যাপক হেরম্যান হেলম্‌হোল্টজের মতো আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন বিজ্ঞানীদের সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়। মতামতও বিনিময় ঘটে। বিবেকানন্দের বক্তৃতায় প্রভাবিত হয়ে টেসলা তাঁকে একসময় বলেছিলেন, তিনি গণিতের সাহায্যে দেখিয়ে দিতে পারেন যে জড় ও শক্তি উভয়কে অব্যক্ত শক্তিতে পরিণত করা যেতে পারে। মহাবি‍‌শ্বের সৃষ্টিরহস্য নিয়ে বর্তমান বিশ্বে যে আলোড়ন চলছে, বিবেকানন্দ-প্রভাবিত টেসলার বক্তব্যে যেন তারই প্রতিধ্বনি শোনা যায়। কম কথা নয়!

প্রবল আগ্রহ আর অবিচল নিষ্ঠায় স্বাধীনভাবে অধ্যয়নের ফলশ্রুতিতে আর দেশ-বিদেশের বিজ্ঞান, বিজ্ঞানমনস্ক মনীষীদের সংস্পর্শে এসে, তাদের সঙ্গে আলোচনার সুবাদে বিবেকানন্দ পাশ্চাত্য বিজ্ঞান সম্বন্ধে বিশেষভাবে ওয়াকিবহাল হয়ে ওঠেন। তার বিজ্ঞানচেতনার সমৃদ্ধি ঘটায়, সম্প্রসারিত হয়। এটা যেমন সত্য, তেমনি এটাও সত্য যে তিনি তার বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের ভিত্তি স্বাধীনভাবে স্বপ্রচেষ্টায় গড়ে তুলেছিলেন।

যে-কোনো মানুষের চেতনার গুণগত, পরিমাণগত মানের প্রকাশ ঘটে তার দৃষ্টিভঙ্গিতে, তার আচার-আচরণে। বিবেকানন্দের উন্নত মানের বিজ্ঞানচেতনার বারে বারে প্রকাশ ঘটেছে তার নানা বিষয়ের বক্তব্যে, আচার-আচরণে। তার লেখা ‘প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য’ গ্রন্থে ভারতীয়দের দৈনন্দিন জীবনে বৈজ্ঞানিক পদক্ষেপ গ্রহণের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে বহু বিষয়ের উল্লেখ আছে। দেশ ও দশের স্বার্থে যাবতীয় কুসংস্কার বর্জনের আবেদন জানিয়েছেন। শরীর সুস্থ থাকলে মনটাও সুস্থ থাকে। এই কথাটি মনে রেখে বিবেকানন্দ সকলকে শারীরিক পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার ওপর নজর দেওয়ার কথা বলেছেন। মহামারীর হাত থেকে বাঁচার জন্যে ঠাকুর-দেবতার স্মরণ নেওয়ার বদলে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার আশ্রয় নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। নিরামিষ ও আমিষ আহারের বিষয় নিয়েও গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য রেখেছেন বইটিতে, যা আজও সমান প্রাসঙ্গিক। দুগ্ধপান সম্পর্কে তার বক্তব্য রীতিমতো আধুনিক, প্রণিধানযোগ্য তো বটেই।

আহার ও পানীয় সম্পর্কে যেমন, তেমনি দেশের আবহাওয়া, প্রাকৃতিক ও সামাজিক পরিবেশের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে পোশাক-পরিচ্ছদের সপক্ষে সওয়াল করেছেন বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে। এই একই দৃষ্টিভঙ্গি থেকে স্বদেশীয় ও বিদেশীদের আচার-আচরণ নিয়ে বিবেকানন্দ তুলনামূলক আলোচনা করে মঙ্গলকর বিষয়গুলিকে গ্রহণ করার সুপারিশ করেছেন। যে-কোনো অধ্যাত্ম পথের যাত্রীর মধ্যে সম্ভবত বিবেকানন্দই প্রথম যিনি কোনো দেবদেবীর স্মরণ না নিয়ে ব্যবহারিক জীবনকে বৈজ্ঞানিক মনোভাব নিয়ে পরিচালনা করার কথা বলেছেন। এসবই বিবেকানন্দের সংস্কারমুক্ত বিজ্ঞানমনস্কতার পরিচয়।

কেবল ব্যবহারিক জীবনযাত্রাকে কেন্দ্র করেই বিবেকানন্দের বিজ্ঞানচেতনার প্রকাশ ঘটেছে, এমন নয়। বিজ্ঞানের নানান শাখার তাত্ত্বিক বিষয়গুলি সম্পর্কে এ‌মন সব মন্তব্য করেছেন, যেগুলি শুধু বিস্ময়করই নয়, অত্যন্ত আধুনিকও বটে। সন্ন্যাসী হয়েও গভীরভাবে নৃবিদ্যা অধ্যয়ন করে ইংরেজ নৃবিজ্ঞানীরা ঔপনিবেশিক মানসিকতার বশে ভারতের জাতিগত পরিচয়কে যেভাবে এবং যে পদ্ধতিতে আর্য-অনার্যে বিভক্ত করেছেন সেটি অবৈজ্ঞানিক বলে তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছেন। ‘আর্য ও তামিল’ প্রবন্ধে এবং ‘প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য’ গ্রন্থে তিনি যে বিকল্প প্রস্তাব রেখেছিলেন সেটি বরং পরবর্তীকালে নৃবিজ্ঞানীরা গ্রহণ করেছেন। ডারউইনের ক্রমবিবর্তনবাদ সম্পর্কে তার বক্তব্যগুলিতে মৌলিক চিন্তাশক্তির পরিচয় পাওয়া যায়। বিবেকানন্দের কাছে—‘Science is nothing but finding of unity.’ এই চেতনার বলে বলীয়ান হয়েই তিনি অকুণ্ঠচিত্তে বলেন—‘প্রথমে তাপ, আলো ও তড়িৎ (heat, light and electricity) বিভিন্ন জিনিস বলিয়া জানিত। এখন প্রমাণ হইয়াছে, ঐগুলি সব এক, এক শক্তিরই অবস্থান্তর মাত্র’। সেই উনিশ শতকে বিবেকানন্দের এই উপলব্ধির প্রতিফলন পাওয়া যায় বর্তমানের এই একুশ শতকে ‘ঈশ্বরকণা’ কিংবা ড্যাস্ট পার্টিকেলের সন্ধানে পদার্থবিজ্ঞানীদের গবেষণার মধ্যে।

বিবেকানন্দের বিজ্ঞানচেতনার প্রতিফলন ঘটেছে দেশের জন্যে শিক্ষাচিন্তায়, কৃষিভাবনায়, নারী জাগরণের প্রশ্নে। কণ্ঠ বা বাদ্যসঙ্গীত সাধনা করেই তিনি তাঁর প্রচেষ্টায় ইতি টানেননি। তাঁর বিজ্ঞানমনস্কতাই তাঁকে আকর্ষিত করে সঙ্গীততত্ত্ব নিয়ে বৈজ্ঞানিক আলোচনায়। ফলস্বরূপ রচনা করেন—সঙ্গীত কল্পতরু। পুস্তকটি যখন প্রকাশিত হয়, তখন তার বয়স ছিল মাত্র তেইশ বছর। শুধু সঙ্গীতই নয়, শিল্প ও স্থাপত্যের বিষয়ে বিবেকানন্দের মূল্যবান মন্তব্যগুলি তার উন্নতমানের বিজ্ঞানচেতনার নিদর্শন। বিবেকানন্দই তাঁর সময়ের প্রথম ব্যক্তি যিনি সব থেকে বেশি ভারত ও বিশ্বের শিল্পসৃষ্টিগুলি স্বচক্ষে দেখেছেন। দেখেছেন বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে। আলোচনা করেছেন ধর্মের সঙ্গে ভারতীয় প্রাচীন শিল্পের সম্পর্ক নিয়ে, তুলনামূলক আলোচনা করেছেন প্রাচ্য ও প্রাশ্চাত্য শিল্প নিয়ে, হিন্দু ও গ্রিক শিল্পের বিষয়ে। ভারতের শিল্পের পতনের কারণগুলি চিহ্নিত করেছেন, শিল্পের প্রাণধর্ম নিয়ে বক্তব্য রেখেছেন একজন অতি অভিজ্ঞ শিল্পবেত্তার মতো। এই প্রসঙ্গে উল্লেখ্য যে, বিবেকানন্দ আন্তরিকভাবে চেয়েছিলেন লোকশিল্পের পুনরুজ্জীবন, কারণ এর মধ্যে পাওয়া যায় মানব-মিছিলের বৈচিত্র্য আর ধারাবাহিকতা। এই বিজ্ঞানচেতনার বশেই তিনি মুখের ভাষাকে কলমের ভাষা করে তুলতে উদ্যোগী হয়েছিলেন। কলকাতার কথ্যভাষা থেকে সংস্কৃত-প্রধান সাধু গদ্য—সবই ব্যবহার করেছেন ভাবের মান অনুযায়ী। কারণ তার কাছে—‘ভাষা ভাবের বাহক’।



সম্ভবত বিবেকানন্দই হলেন প্রথম ভারতীয় সন্ন্যাসী যিনি বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে যুক্তিবাদের ভিত্তিতে আধ্যাত্মিকতাকে বিশ্লেষণ করার, ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছেন। আর এই জন্যে বিজ্ঞানের নানান শাখায় বিচরণ করার পাশাপাশি প্রাচীন, আধুনিক মনোবিজ্ঞানকে গভীরভাবে অধ্যয়ন করেছেন। ভারতবাসীর দুর্দশার জন্যে ইংরেজদের উপনিবেশবাদী শোষণ, পুঁজিবাদী বঞ্চনা, সামন্ততান্ত্রিক সমাজব্যবস্থাকে চিহ্নিত করেছেন। শ্রেণীসংগ্রামের বদলে সকল মানুষের আধ্যাত্মিক চেতনার বিকাশের মধ্যে দিয়ে জাতিভেদ প্রথারহিত, বঞ্চনাহীন সমাজ গড়ে তোলা সম্ভব বলে মনে করতেন আর এই কাজে তিনি নিজেকে আজীবন নিয়োজিত করেছিলেন। এই প্রত্যয়ের বশেই তিনি বলেন—‘জীবে প্রেম করে যেই জন, সেই জন সেবিছে ঈশ্বর’। তাইতো তিনি 
একজন  সত্যিকারের​ প্রকৄত অসাম্প্রদায়িক, পরধর্ম ও পরমত সহিষ্ণু, যুক্তিপ্রবণ এক বিশ্বমানবতাবাদী সন্ন্যাসী।

No comments:

Post a Comment