সুখী গৃহকোণ, শোভে গ্রামোফোন :-
অশোক দাস
বিগত শতকের তিন-চারের দশকে ‘বিচিত্রা’ ‘ভারতবর্ষ’ ‘বঙ্গশ্রী’ ‘সাহানা’ ‘দুন্দুভি’ ‘খেয়ালী’ ‘ছন্দা’ ‘দীপালি’ ‘প্রবাসী’ ইত্যাদি মাসিক বা সাপ্তাহিক পত্রিকাগুলি খুললেই চোখে পড়তো একটি বিশেষ বিজ্ঞাপন ‘সুখী গৃহকোণ, শোভে গ্রামোফোন।’ এছাড়াও তখন হিজ মাস্টার্স ভয়েস, টুইন, হিন্দুস্থান রেকর্ডস, রিগ্যাল, মেগাফোন, সেনোলা, পাইওনিয়ার ইত্যাদি গ্রামোফোন কোম্পানিগুলি থেকে যে নিয়মিত ক্যাটালগ প্রকাশিত হতো তাতে এই বিজ্ঞাপনটি থাকতো, সাথে থাকতো একটি বক্স গ্রামোফোনের ছবি। হিজ মাস্টার্স ভয়েস-এর ক্যাটালগে একাধিক মডেলের গ্রামোফোনের ছবি থাকতো। বক্স গ্রামোফোন, চোঙাওলা গ্রামোফোন এবং নানা মাপের টেবিল গ্রামোফোনের ছবি ও তাদের দাম লেখা থাকতো এই সমস্ত বিজ্ঞাপনে। আমাদের বাড়িতে যখন এইসব পত্রিকা আর ক্যাটালগ আসতো, তখন আমি পৃথিবীর আলো দেখিনি। (বাবা নিত্যানন্দ কলকাতায় গ্রামোফোন কোম্পানিতে গান বাঁধতেন, সুর দিতেন, নিজেও গাইতেন। শচীন সেনগুপ্ত’র মতো নাট্যকারদের নাটকের জন্যেও গান লিখতেন। ছোট বড় পত্রিকায় তাঁর লেখা গানও ছাপা হতো।)
আমাদের ছোট গ্রামটিতে আমাদের ছাড়া ডাক্তারবাবুদেরও একটি চোঙাওলা গ্রামোফোন ছিল! মহিম ডাক্তারবাবুর বড় ছেলে চারুবাবু কিনেছিলেন সেটি। বাজতো, ‘কাদের কূলের বৌ গো তুমি, কাদের কূলের বৌ’ অথবা কানা কেষ্ট অর্থাৎ কৃষ্ণচ্ন্দ্র দে-র গান ‘ছুঁয়ো না ছুঁয়ো না বধূ ঐখানে থাকো’, অথবা ইন্দুবালার গাওয়া কাজীর গান ‘মোর ঘুমঘোরে এলে মনোহর।’ সে সুরের সাথে আজকের সুর মেলে না! চারুবাবুর সেজভাই ডাক্তার ছিলেন। তিনি অবশ্য গ্রামোফোন কেনেননি। পরে অনেক পরে চারুবাবুর ছোটছেলে বাদলকাকু কিনলেন বক্স গ্রামোফোন—সিঙ্গল স্প্রিং-এর। কুকুরের ছাপওয়ালা হিজ মাস্টার্স ভয়েস অথবা যমজ শিশুর ছবিওয়ালা টুইন পিনের বাক্স থেকে পিন বের করে তা সাউন্ড বক্সে ফিট করে স্প্রিং-এ দম দিয়ে রেকর্ডটি একটি প্লেটে চাপিয়ে দিয়ে ‘অন’ করলেই রেকর্ডটি ঘুরতে থাকতো এবং যত্ন করে রেকর্ডের কোণায় পিনটি লাগিয়ে দিলেই বেজে উঠতো মিউজিক, ভেসে আসতো ধনঞ্জয় ভট্টাচার্যের গলা ‘শোনা শোনো, কথাটি শোনো’ আমরা পুলকে শিউরে উঠতাম এই আজব কুদরতি দেখে।
মনে পড়ে, প্রতিমা রঙ করা হয়ে গেছে, বীরভূমের হজরতপুরের ত্রিভঙ্গ মিস্ত্রিমশাই তাঁর ছেলে গোপালকে নিয়ে প্রতিমায় বার্নিশ লাগাচ্ছেন, আমরা বলতাম ঘামতেল লাগানো হচ্ছে। ষষ্ঠীর দিন ইটাপাড়া থেকে ডাকসাজ নিয়ে আসবে থানাদার শুক্র সোনা। বাবা কলকাতা থেকে এলেন পুজোর কাপড়ের বাজার নিয়ে, সঙ্গে কয়েকটি শারদ সংখ্যার পত্রিকা, কয়েকটি গানের ক্যাটালগ এবং বেশ কয়েকটি গ্রামোফোন রেকর্ড। বাদলকাকুরা তার আগেই আসানসোল থেকে কিনে এনেছেন জগন্ময় মিত্র, ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য, সুপ্রীতি ঘোষ, সুপ্রভা সরকার, উৎপলা সেন, হেমন্ত মুখার্জির গানের রেকর্ড। বাবাও এনেছেন শচীন দেববর্মণ, সত্য চৌধুরী, সুবীরলাল চক্রবর্তী, শীলা সরকার, দীপালী তালুকদার, কাননবালা, কমলা ঝরিয়ার গানের রেকর্ড।
বাবার কাছে কেনা রেকর্ড ছাড়াও কিছু স্যাম্পল রেকর্ড ছিল। ফাইনাল রেকর্ডিং হওয়ার আগে স্যাম্পল রেকর্ড বের করা হতো। সাদা কাগজের লেবেলে ফাউন্টেন পেনে গানের প্রথম লাইন, গীতিকার ও সুরকারের নাম লেখা থাকতো। এইরকম একটা স্যাম্পল রেকর্ডে ছিল কাজী নজরুলের লেখা কে মল্লিকের গাওয়া একটি আগমনী গান। এই কে মল্লিকের নাম কাশেম মল্লিক, বাড়ি বর্ধমানে, অনেক বয়সে একথা জেনেছিলাম। আমাদের বৈঠকখানায় গ্রামোফোন বাজলেই ছোটোছোটো ছেলেরা ছাড়াও রজনী বাউড়ির ছেলে হরেন্দ্র, যুগল বাউড়ি, চমন সওদাগর, রমজান চাচা, পাড়ার যুবক ভুতুদা, মণীন্দ্রদা, তারাপদকাকু, প্রহ্লাদ ঘোষ এরাও এসে গান শুনতো। পুজোর আগে কাজী নজরুল লিখছেন আগমনী গান, গাইছেন কাশেম মল্লিক, শুনছেন রমজান চাচা। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এর চেয়ে প্রকৃষ্ট উদাহরণ আর কী হতে পারে? এছাড়াও বাজতো জ্ঞানেন্দ্রপ্রসাদ গোস্বামীর গাওয়া কাজী নজরুলের ‘আমার শ্যামা মায়ের কোলে চড়ে’ আর ‘শ্মশানে জাগিছে শ্যামা মা’ গান দুটি। ম্যাজেন্টা রঙের লেবেলে ‘চোঙাওয়ালা গ্রামোফোনে গান শুনছে একটি প্রভুভক্ত কুকুর। এই ছাপা ছিল হিজ মাস্টার্স-এর ট্রেড মার্ক। গ্রামোফোন কোম্পানি থেকে ‘হিজ মাস্টার্স ভয়েস’ ছাড়াও ‘কলম্বিয়া’ রেকর্ড প্রকাশিত হতো। কলম্বিয়াতে গাইতেন হেমন্ত মুখার্জি, ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য, সন্ধ্যা মুখার্জি, আর হিজ মাস্টার্স ভয়েস’- এ গাইতেন শ্যামল মিত্র, সতীনাথ মুখার্জি, তরুণ বন্দ্যোপাধ্যায়। প্রথমে ভায়োলেট রঙের পরে নীল রঙের লেবেলে বাঘের ছবি আঁকা থাকতো কলম্বিয়া রেকর্ডে। ১৯৩৯সালে বাবা হিজ মাস্টার্সে রেকর্ড করেছিলেন ‘ব্রজের কানাইয়া জাদুকর’ আর ‘রূপে মায়ের ত্রিভুবন আলা’ ঝুমুর গান দুটি। সেই সিরিজেই দীপালী তালুকদার রেকর্ড করেছিলেন তাঁর প্রথম গান ‘মেঘ মেদুর বরষায়’ আর ‘রুমঝুম রুমঝুম নূপুর বোলে’ জয়জয়ন্তী আর নটবেহাগ রাগে নিবদ্ধ কাজী নজরুলের লেখা বাংলা খেয়াল দুটি। বাবাকে তিনি এই রেকর্ডটি প্রেজেন্ট করেছিলেন, কভারে তাঁর সই ছিল। সেই রেকর্ডটি এবং কভারটি কালের গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। হিজ মাস্টার্সের রেকর্ডের নম্বরের আগে ‘এন’ এবং কলম্বিয়ার নম্বরের আগে জি ই লেখা থাকতো, আরেকটি জনপ্রিয় রেকর্ড কোম্পানি থেকে টুইন রেকর্ড প্রকাশিত হতো। এই রেকর্ড কোম্পানির সাথে প্রখ্যাত সুরকার গিরীন চক্রবর্তী যুক্ত ছিলেন। হলুদ রঙের লেবেলে কালো কালিতে যমজ শিশুর ছবির নিচে গানের লাইন, গীতিকার ও সুরকারের নাম লেখা থাকতো। রেকর্ডের নম্বরের আগে একটি লেখা থাকতো। টুইন কোম্পানি থেকেও নজরুলের বহু গান প্রকাশিত হয়েছিল। গিরীন চক্রবর্তী নজরুলের বেশ কিছু গানে সুর দিয়েছিলেন। টুইন রেকর্ডে নজরুলের কিছু ইসলামী গান প্রকাশিত হয়েছিল, গাইতেন চিত্ত রায়, ধীরেন দাসেরা। নজরুল চিত্ত রায়ের গানকে ইসলামী সমাজে গ্রহণযোগ্য করতে তাঁর নাম দিয়েছিলেন দেলওয়ার হোসেন। নজরুল যেমন গান লেখা ও সুর দেওয়ায় দক্ষ ছিলেন তেমনি রেকর্ডের বাণিজ্য কীভাবে হবে সেটাও ভালো বুঝতেন।
টুইন রেকর্ড থেকে বাবার একটা গান গেয়েছিলেন জ্ঞানপ্রিয়া বৈষ্ণবী, গানটি ছিল ‘ঝুলন খেলায় বাঁশি ফুকারে গো’। উলটো পিঠে ছিল নিকুঞ্জ চক্রবর্তীর লেখা বাবার সুর দেওয়া ‘কানে গুঁজে ধুতুরার ফুল গো’, পুজোর দিনগুলিতে দুপুরে মা-পিসিমা শুনতেন পালা রেকর্ড। সেনোলা রেকর্ডে ‘উমার তপস্যা’ আর রিগ্যাল রেকর্ডে’ দস্যু রত্নাকর’ নামে আমাদের দুটো পালা ছিল। ‘উমার তপস্যা’ ছিল চারটি রেকর্ডে আর ‘দস্যু রত্নাকর’ ছিল তিনটি রেকর্ডে। সেনোলার লেবেল ছিল হালকা সবুজ রঙের কাগজের উপর ময়ূরের ছবি। এতে নবদ্বীপ হালদার বেশ কিছু কমিক গানের রেকর্ড করেছিলেন। আমাদের বাড়িতে ছিল ‘ফ্যান্তা ফ্যাচাং তরকারি’ আর ‘শরীরটা আজ বেজায় খারাপ’ গান দুটির একটি রেকর্ড। রিগ্যাল রেকর্ডের লেবেলের রঙ ছিল হিজ মাস্টার্স ভয়েসের মতোই আগুন রঙের বা ম্যাজেন্টা রঙের। তবে কোনো ছাপ থাকতো না। বাদলকাকুর বাড়িতে ছিল হিজ মাস্টার্স ভয়েসের ‘লক্ষণ ঊর্মিলা’ পালা। এই পালার ‘ভুলি নাই, ভুলি নাই, আজো মনে পড়ে নাম ধরে ডাকা’। গানটি আমাদের বন্ধু নব গলায় তুলে নিতে পেরেছিল। আর সে গাইতো কলম্বিয়া রেকর্ডে কানন দেবীর গাওয়া ‘মেজদিদি’ ফিল্মের গান ‘প্রণাম তোমায় ঘনশ্যাম’। গানটি আমাকেও ডুয়েটে তার সাথে গাইতে হতো। আমরা তখন ক্লাস সিক্স সেভেন-এর ছাত্র। রিগ্যাল রেকর্ড থেকেও বাবার দু’খানি গান ‘খেলা খেলিব রে’ আর ‘কাল কেউটে সাপালি’ প্রকাশিত হয়েছিল।
‘উদয়ের পথে’ ছবিতে রবীন্দ্রনাথের ‘চাঁদের হাসির বাঁধ ভেঙেছে’ গানটি ব্যবহৃত হয়েছিল। গানটি পাইওনিয়ার রেকর্ড থেকেও প্রকাশিত হয়েছিল। বড় সুন্দর ছিল পাইওনিয়ার রেকর্ডের লেবেলটি। একটি বহুবর্ণে চিত্রিত লেবেলে একটি উড্ডীয়মান মরালের ছবি আঁকা থাকতো। আমাদের বাড়িতে পাইওনিয়ার কোম্পানির দু’খানা রেকর্ড ছিল। আমি নয়ন ভরে এর লেবেলটি দেখতাম, আর দেখতাম! ‘উদয়ের পথে’ ফিল্ম এবং ‘চাঁদের হাসির বাঁধ ভেঙেছে’ গান এতই জনপ্রিয় হয়েছিল যে চুরুলিয়ার সাধুরা তাঁদের গৌরাংডি-বরাকর রুটের বাসের নাম রাখলেন ‘উদয়ের পথে’। আর রাস্তাঘাটে লোকের মুখে মুখে ফিরতে লাগলো রবীন্দ্রনাথের গান। মেগাফোন থেকে জে এন জি নম্বর সংবলিত হালকা সবুজ রঙের কাগজে হরিণের ছবি আঁকা লেবেল দেওয়া রেকর্ডে নজরুলের নিজের গলায় গাওয়া ‘পাষাণের ভাঙালে ঘুম’ রেকর্ডটিও আমাদের — বাড়িতে ছিল। তুলসী লাহিড়ীর লেখা কিছু গান মেগাফোনে রেকর্ড হয়েছিল। কমলা ঝরিয়া মেগাফোনেই গাইতেন। তাঁর গাওয়া কীর্তন গানের কিছু রেকর্ড আমাদের বাড়িতে ছিল। মেগাফোনে বাবার লেখা ‘আমি তার মূল্য দিব ধরে’ এবং ‘ব্রজপুরে কত সহি জালাতন’ গান দুটি রেকর্ড হয়েছিল।
শচীন দেববর্মণ গাইতেন হিন্দুস্থান রেকর্ডে। তাঁর নামের আগে কুমার লেখা থাকতো, কারণ তিনি ছিলেন ত্রিপুরার রাজকুমার। ‘প্রেমের সমাধি তীরে নেমে এলো শুভ্র মেঘের দল’ এবং ‘আমি ছিনু একা বাসর জাগায়ে’ গান দুটির রেকর্ডও ছিল আমাদের বাড়িতে। হিন্দুস্থান রেকর্ডের লেবেলে বরাবর বংশীবাদন-রত একটি বালকের ছবি থাকতো। পরবর্তীকালে পূর্ণদাস বাউল এবং অংশুমান রায় হিন্দুস্থানেই রেকর্ড করতেন। শচীন দেববর্মণ হিজ মাস্টার্স ভয়েসে প্রথম রেকর্ড করেন ১৯৫৬সালে পুজো সংখ্যা। গান দুটি ছিল ‘মন দিল না বধূ’ আর ‘তুমি আর নেই সে তুমি’। বাদলকাকু ছিলেন হেমন্ত মুখার্জির ফ্যান। তিনি কলম্বিয়া রেকর্ডে হেমন্ত মুখার্জি আর সন্ধ্যা মুখার্জির গান বেশি কিনতেন। তিনি তাঁর দোতলার রুমে গ্রামোফোন বাজাতেন আর আমাদের ডেকে ডেকে শোনাতেন হেমন্ত মুখার্জির ‘আকাশ মাটি ওই ঘুমালো’, শোনাতেন ‘গাঁয়ের বধূ’। তাঁর কাছে শুনলাম সুপ্রীতি ঘোষের গাওয়া ‘আকাশে লক্ষ তারার দেয়ালী/পলাশের মনে রঙের হেঁয়ালী/বলতো, বলতো দোষ কি এমন/ওগো বলতো/বলতো দোষ কি এমন হয় যদি মন হঠাৎ কিছু খেয়ালী।’ শুনলাম সত্য চৌধুরীর গাওয়া মোহিনী চৌধুরীর গান ‘পৃথিবী আমারে চায়’। নব শিখে নিলো জগন্ময় মিত্রের গান ‘তুমি আজ কত দূরে’ গানটি। নবমীর রাত। ফুটবল মাঠের আমরা চার বন্ধু। জ্যোৎস্না নেমেছে পাহাড়ীর জঙ্গলে, নব গেয়ে চলেছে জগন্ময় মিত্রের ‘চিঠি’ আর ‘সাতটি বছর আগে’ ‘সাতটি বছর পরে’ গানগুলি! সে স্মৃতি ভোলার নয়। গান দুটির প্রথম লাইন ছিল ‘এমনি শারদ রাতে’ পুজোয় কলকাতা থেকে এসেছেন ছকুকাকু—সাদা ধুতি, সাদা পাঞ্জাবি, সাদা নিউকাট, সাদা ঘড়ির বেল্ট, রিমলেশ চশমা পরে। বাবার সাথে বৈঠকখানায় গাইছেন ‘ওগো নদী আপন বেগে পাগল পারা’ আর গাইছেন সুধীরলাল চক্রবর্তীর বিখ্যাত গান ‘মধুর আমার মায়ের হাসি চাঁদের মুখে ঝরে —’ বোধহয় ‘দাগ’ কথাচিত্রের গান। ছকুকাকু বাদলকাকুদের পিসতুতো ভাই নলিনীকাকুর সাথে এসেছেন তাঁর শ্যালিকা, আমাদের বুজু মাসি। তখন ফ্রক পরে বেনি দুলোয় বাবার কাছে গানটি তুলে নিচ্ছেন। বুজুমাসি সুধীরলালের ফ্যান শুনে বাদলকাকু কিনে আনলেন ‘স্বপ্ন সুরভি মাখা দুর্লভ রাত্রি’ আর ‘খেলাঘর মোর ভেসে গেছে হায় নয়নের যমুনায় —’ গান দুটি। পানুড়িয়ার সোনেলাল শিখে নিয়ে এই গান দুটির সাথে ‘গরমিল’ ছবিতে রবীন মজুমদারের গাওয়া ‘এই কি গো শেষ দান’ গানটি তুলেছেন। পুজোর বৈঠকী গানের আসরে তখন তাঁকে নিয়ে টানাটানি। এই গানগুলিই তিনি গাইছেন সব আসরে।
বাবা অকাল প্রয়াত হয়েছেন। বাদলকাকুও। অমন একজন দুর্দান্ত ফুটবল প্লেয়ার, খেলার জন্যই যাঁর চিত্তরঞ্জনে চাকরি, তিনি মাত্র বাইশ বছর বয়সে চলে গেলেন।
গ্রামোফোন দুটিও খারাপ হয়ে গেল।
স্কুলের উঁচু ক্লাসে পড়ছি। বার্ষিক পরীক্ষার রেজাল্ট আউটের দিন। আমরা বাইরে ঘোরাফেরা করছি। ডিসেম্বরের রোদে গা সেঁকে নিচ্ছি। স্কুল সংলগ্ন ক্লাবের বারান্দায় জমিদার বাড়ির হারুদা তাঁদের ঢাউস টেবিল গ্রামোফোনখানা নিয়ে নতুন রেকর্ড বাজাচ্ছেন, নতুন ধরনের গান— ‘ধিতাং ধিতাং বোলে/ কে মাদলে তান তোলে/ কার আনন্দ উচ্ছলে/ আকাশ ভরে জোছনায়।’ সলিল চৌধুরীর কথা ও সুরে — হেমন্ত মুখোপাধ্যায় গাইছেন সে গান। মানিকদা বলছেন, ‘গণনাট্য দেখছি বাংলা গানেও নতুন দিক নিয়ে এলো! দেখো কথা কত সুন্দর— এদেশ তোমার আমার/ আমরা ভরি খামার/ আমরা গড়ি স্বপন দিয়ে সোনার কামনায়।’ সঙ্গে সঙ্গে গানটা গলায় তুলে নিলাম! সন্ধ্যা মুখার্জির নতুন গান বাজছে ‘আয় বৃষ্টি ঝেঁপে!’ বিমলচন্দ্র ঘোষের কবিতায় সলিল চৌধুরী সুর দিয়েছেন, সন্ধ্যা মুখার্জি গাইছেন, ‘উজ্জ্বল, এক ঝাঁক পায়রা/ সূর্যের উজ্জ্বল রৌদ্রে/ চঞ্চল পাখনায় উড়ছে।’ নকুলকে বলছেন, ‘এ ধরনের কথায় সুর দিয়ে যে গান হতে পারে একথা ভাবিনি তো!’ পানুদা চটুল গান পছন্দ করেন না। নতুন নতুন কথা ও সুরে হিজ মাস্টার্স ভয়েস আর কলম্বিয়ায় গাইছেন ধনঞ্জয়, হেমন্ত, শ্যামল, মানবেন্দ্র, তরুণ, দ্বিজেন, সতীনাথ, পান্নালাল, অখিলবন্ধু, মৃণাল চক্রবর্তী, অপরেশ লাহিড়ী, সন্ধ্যা, আলপনা, প্রতিমা, মাধুরী, উৎপলা, গীতা রায় (দত্ত), গাইছেন শচীন দেববর্মণ আর মান্না দে। যে বছর শচীন দেব বর্মণ ‘মন দিল না বঁধূ’ রেকর্ড করলেন এইচ এম ভি-তে সেই বছরই কলম্বিয়ায় পান্নালাল গাইলেন ‘আমার সাধ না মিটিল, আশা না পুরিল, সকলি ফুরায়ে যায় মা!’ মাঠে, ঘাটে, মাইকে, ফাংশনে সর্বত্র ঘুরতে লাগল সেই গান। একটা শ্যামাসঙ্গীত যে এতটা জনপ্রিয় হতে পারে ভাবা যায় না। রেকর্ড সংখ্যক রেকর্ড বিক্রি হলো। সে বছরই হেমন্ত রেকর্ড করেছিলেন’ ‘আর কতো রহিব শুধু পথ চেয়ে।’ যে ধনঞ্জয় তাঁর প্রথম রেকর্ড করেছিলেন ভারত রেকর্ডে— ‘ভুলে যাও মোরে’— অনেকটা জগন্ময়- সুবীরলাল — রবীন মজুমদারদের স্টাইলে, তিনিই আবার ‘সলিল চৌধুরীর সুরে ‘পাশের বাড়ি’ ফিল্মে গাইলেন — ‘ঝির ঝির ঝির ঝির বরষা/ আমার হয় কি গো ভরসা/ আমার ভাঙা ঘরে তুমি বিনে!’
বন্ধু দুলাল মিত্র নেমন্তন্ন করলো গান শোনার তাদের ক্লাব বাংলোর কোয়ার্টারে। আমরা তখন ফাস্ট ক্লাসের অর্থাৎ ক্লাস টেনের ছাত্র। শুনলাল— শ্যামল মিত্র’র ‘মহুল ফুলে জমেছে মউ,’ মান্না দে-র ‘তুমি আর ডেকে না!’ ‘এ জীবনে যত ব্যথা পেয়েছি।’ সতীনাথের ‘সোনার হাতে সোনার কাঁকন/ কে কার অলঙ্কার!’ উলটোপিঠে ‘এলো বরষা যে সহসা মনে তাই।’
গান গেয়ে আর গান শুনে এভাবেই কেটে যায় দিন। রেডিও তখন জনপ্রিয় হতে শুরু করেছে। বাজারে তখন অনেকেই রেডিও কিনেছেন, কিন্তু গ্রামোফোনের সে স্বাদ, রেডিওতে কোথায়? সলিল চৌধুরী গান বাঁধছেন, ‘তখন এ গান, তুলে তুফান, নবীন প্রাণের প্লাবন আনে দিকে দিকে/ কিসের বাধা, মরণ হরণ চরণ ফেলে সে যায় হেঁকে।’ চাঁদ ফুল জোছনা ছাড়াই, গুণ গুণ গুঞ্জন বাদ দিয়েও, প্রেমের ডোর খুলে ফেলেও পথে নেমে মানুষের হাতে হাত দিয়ে যে গান গাওয়া যায় সলিল চৌধুরী তা প্রমাণ করলেন, বললেন— ‘পথ হারাবো বলেই এবার পথে নেমেছি।’ তারও অনেক পরে বলেছেন, ‘আমি পথ খুঁজি না তো, পথ মোরে খোঁজে।’ কী সুন্দর অ্যালিটারেশন, সিমিলি, মেটাফরের ছড়াছড়ি বাংলা গানে! সুবীর সেন গাইছেন, ‘ছুটে আয়রে মিলন বীণ, ঐ তো তুলেছে তান/ শোনো আহ্বান।’
মনে পড়ে, তখন সেকেন্ড ইয়ার, মানে আজকের বারো ক্লাসের ছাত্র। যে বাসে কলেজ যেতাম, সেই একই বাসে যেত জয়শ্রী, ক্লাস টেনে পড়তো। শ্যামলা, ছিপছিপে শুচিস্মিতা মেয়েটিকে দেখলেই মনটা পবিত্র হয়ে যেত। সে বছর শ্যামল মিত্র পুজোতে রেকর্ড করলেন ‘কার মঞ্জির বাজে রিনিঠিনিঠিনি।’ আর ‘চোখের নজর কম হলে আর কাজল দিয়ে কী হবে।’ গান দুটো গলায় তুলতেই হলো। কলেজের কমনরুমে যখন প্রথম গানটার অন্তরা গাইতাম, ‘তুমি যে আমার চোখের আলো/ প্রথম দেখায় আমি বেসেছি ভালো’ তখন কেন জানে না, জয়শ্রীর হাসিমুখটাই চোখের সামনে ভেসে উঠতো। সে যেদিন মন খারাপ করে মুখ ভার করে থাকতো, সেদিন মনে মনে গাইতাম শচীন দেববর্মণের গান’ তোমার চোখের পাতা নাচে না/ নাচে না আমার পথ চেয়ে/ তোমার হাসিতে সাড়া জাগে না/ জাগে না আমার সাড়া পেয়ে/ হাসো না হাসো না সে হাসি মধুময়/ তুমি আর নেই সে তুমি।’ জয়শ্রী জানতো না সে কথা! জানে না এখনো।
তারপর কেটে গেছে কত কাল! এখন কালো কালো গোল গোল রেকর্ডগুলো স্থান পেয়েছে অমিত গুহ-র সংগ্রহশালায়, আমার ছেলেমেয়েরাও সেই ছোট ছোট পিনগুলো দেখেনি। চোঙাওলা বা বক্স গ্রামোফোনও তাদের কাছে জাদুঘরের সামগ্রী। এভাবেই পুরাতন বিদায় নেয়। আসে নতুনেরা, এসে গেছে নতুন নতুন ইলেকট্রনিক্স যন্ত্র। স্বাগত জানাতেই হবে— কিন্তু আর কী করে শুনবো তরুণের সেই গান— ‘কাজল নদীর জলে’/ ভরা ঢেউ ছলো ছলে/ প্রদীপ ভাসাও কারে স্মরিয়া,’ বা ‘ওগো কৃষ্ণচূড়া বলো আবার কবে তুমি চাঁদের আলোয় যাবে ভরে!’ কিংবা উৎপলা সেনের ‘ঝিকমিক জোনাকির দীপ
জ্বলে শিয়রে!’ ‘আমার এ গানে স্বপ্ন যদি আনে আঁখি পল্লব ছায়/ ছন্দভরা রাতে স্বপ্ন দেখে যাব/ তুমি আমি দু’জনায়। কোথায় পাবো, শ্যামল মিত্রের ‘সেদিনের সোনাঝরা সন্ধ্যা’ ‘চৈতালী চাঁদ যাক, যাক ডুবে যাক।’ সেসব রেকর্ড হারিয়ে গেলেও মনের রেকর্ড থেকে মুছে ফেলা যাবে না কোনোদিন।আমাদের ছোট গ্রামটিতে আমাদের ছাড়া ডাক্তারবাবুদেরও একটি চোঙাওলা গ্রামোফোন ছিল! মহিম ডাক্তারবাবুর বড় ছেলে চারুবাবু কিনেছিলেন সেটি। বাজতো, ‘কাদের কূলের বৌ গো তুমি, কাদের কূলের বৌ’ অথবা কানা কেষ্ট অর্থাৎ কৃষ্ণচ্ন্দ্র দে-র গান ‘ছুঁয়ো না ছুঁয়ো না বধূ ঐখানে থাকো’, অথবা ইন্দুবালার গাওয়া কাজীর গান ‘মোর ঘুমঘোরে এলে মনোহর।’ সে সুরের সাথে আজকের সুর মেলে না! চারুবাবুর সেজভাই ডাক্তার ছিলেন। তিনি অবশ্য গ্রামোফোন কেনেননি। পরে অনেক পরে চারুবাবুর ছোটছেলে বাদলকাকু কিনলেন বক্স গ্রামোফোন—সিঙ্গল স্প্রিং-এর। কুকুরের ছাপওয়ালা হিজ মাস্টার্স ভয়েস অথবা যমজ শিশুর ছবিওয়ালা টুইন পিনের বাক্স থেকে পিন বের করে তা সাউন্ড বক্সে ফিট করে স্প্রিং-এ দম দিয়ে রেকর্ডটি একটি প্লেটে চাপিয়ে দিয়ে ‘অন’ করলেই রেকর্ডটি ঘুরতে থাকতো এবং যত্ন করে রেকর্ডের কোণায় পিনটি লাগিয়ে দিলেই বেজে উঠতো মিউজিক, ভেসে আসতো ধনঞ্জয় ভট্টাচার্যের গলা ‘শোনা শোনো, কথাটি শোনো’ আমরা পুলকে শিউরে উঠতাম এই আজব কুদরতি দেখে।
মনে পড়ে, প্রতিমা রঙ করা হয়ে গেছে, বীরভূমের হজরতপুরের ত্রিভঙ্গ মিস্ত্রিমশাই তাঁর ছেলে গোপালকে নিয়ে প্রতিমায় বার্নিশ লাগাচ্ছেন, আমরা বলতাম ঘামতেল লাগানো হচ্ছে। ষষ্ঠীর দিন ইটাপাড়া থেকে ডাকসাজ নিয়ে আসবে থানাদার শুক্র সোনা। বাবা কলকাতা থেকে এলেন পুজোর কাপড়ের বাজার নিয়ে, সঙ্গে কয়েকটি শারদ সংখ্যার পত্রিকা, কয়েকটি গানের ক্যাটালগ এবং বেশ কয়েকটি গ্রামোফোন রেকর্ড। বাদলকাকুরা তার আগেই আসানসোল থেকে কিনে এনেছেন জগন্ময় মিত্র, ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য, সুপ্রীতি ঘোষ, সুপ্রভা সরকার, উৎপলা সেন, হেমন্ত মুখার্জির গানের রেকর্ড। বাবাও এনেছেন শচীন দেববর্মণ, সত্য চৌধুরী, সুবীরলাল চক্রবর্তী, শীলা সরকার, দীপালী তালুকদার, কাননবালা, কমলা ঝরিয়ার গানের রেকর্ড।
বাবার কাছে কেনা রেকর্ড ছাড়াও কিছু স্যাম্পল রেকর্ড ছিল। ফাইনাল রেকর্ডিং হওয়ার আগে স্যাম্পল রেকর্ড বের করা হতো। সাদা কাগজের লেবেলে ফাউন্টেন পেনে গানের প্রথম লাইন, গীতিকার ও সুরকারের নাম লেখা থাকতো। এইরকম একটা স্যাম্পল রেকর্ডে ছিল কাজী নজরুলের লেখা কে মল্লিকের গাওয়া একটি আগমনী গান। এই কে মল্লিকের নাম কাশেম মল্লিক, বাড়ি বর্ধমানে, অনেক বয়সে একথা জেনেছিলাম। আমাদের বৈঠকখানায় গ্রামোফোন বাজলেই ছোটোছোটো ছেলেরা ছাড়াও রজনী বাউড়ির ছেলে হরেন্দ্র, যুগল বাউড়ি, চমন সওদাগর, রমজান চাচা, পাড়ার যুবক ভুতুদা, মণীন্দ্রদা, তারাপদকাকু, প্রহ্লাদ ঘোষ এরাও এসে গান শুনতো। পুজোর আগে কাজী নজরুল লিখছেন আগমনী গান, গাইছেন কাশেম মল্লিক, শুনছেন রমজান চাচা। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এর চেয়ে প্রকৃষ্ট উদাহরণ আর কী হতে পারে? এছাড়াও বাজতো জ্ঞানেন্দ্রপ্রসাদ গোস্বামীর গাওয়া কাজী নজরুলের ‘আমার শ্যামা মায়ের কোলে চড়ে’ আর ‘শ্মশানে জাগিছে শ্যামা মা’ গান দুটি। ম্যাজেন্টা রঙের লেবেলে ‘চোঙাওয়ালা গ্রামোফোনে গান শুনছে একটি প্রভুভক্ত কুকুর। এই ছাপা ছিল হিজ মাস্টার্স-এর ট্রেড মার্ক। গ্রামোফোন কোম্পানি থেকে ‘হিজ মাস্টার্স ভয়েস’ ছাড়াও ‘কলম্বিয়া’ রেকর্ড প্রকাশিত হতো। কলম্বিয়াতে গাইতেন হেমন্ত মুখার্জি, ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য, সন্ধ্যা মুখার্জি, আর হিজ মাস্টার্স ভয়েস’- এ গাইতেন শ্যামল মিত্র, সতীনাথ মুখার্জি, তরুণ বন্দ্যোপাধ্যায়। প্রথমে ভায়োলেট রঙের পরে নীল রঙের লেবেলে বাঘের ছবি আঁকা থাকতো কলম্বিয়া রেকর্ডে। ১৯৩৯সালে বাবা হিজ মাস্টার্সে রেকর্ড করেছিলেন ‘ব্রজের কানাইয়া জাদুকর’ আর ‘রূপে মায়ের ত্রিভুবন আলা’ ঝুমুর গান দুটি। সেই সিরিজেই দীপালী তালুকদার রেকর্ড করেছিলেন তাঁর প্রথম গান ‘মেঘ মেদুর বরষায়’ আর ‘রুমঝুম রুমঝুম নূপুর বোলে’ জয়জয়ন্তী আর নটবেহাগ রাগে নিবদ্ধ কাজী নজরুলের লেখা বাংলা খেয়াল দুটি। বাবাকে তিনি এই রেকর্ডটি প্রেজেন্ট করেছিলেন, কভারে তাঁর সই ছিল। সেই রেকর্ডটি এবং কভারটি কালের গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। হিজ মাস্টার্সের রেকর্ডের নম্বরের আগে ‘এন’ এবং কলম্বিয়ার নম্বরের আগে জি ই লেখা থাকতো, আরেকটি জনপ্রিয় রেকর্ড কোম্পানি থেকে টুইন রেকর্ড প্রকাশিত হতো। এই রেকর্ড কোম্পানির সাথে প্রখ্যাত সুরকার গিরীন চক্রবর্তী যুক্ত ছিলেন। হলুদ রঙের লেবেলে কালো কালিতে যমজ শিশুর ছবির নিচে গানের লাইন, গীতিকার ও সুরকারের নাম লেখা থাকতো। রেকর্ডের নম্বরের আগে একটি লেখা থাকতো। টুইন কোম্পানি থেকেও নজরুলের বহু গান প্রকাশিত হয়েছিল। গিরীন চক্রবর্তী নজরুলের বেশ কিছু গানে সুর দিয়েছিলেন। টুইন রেকর্ডে নজরুলের কিছু ইসলামী গান প্রকাশিত হয়েছিল, গাইতেন চিত্ত রায়, ধীরেন দাসেরা। নজরুল চিত্ত রায়ের গানকে ইসলামী সমাজে গ্রহণযোগ্য করতে তাঁর নাম দিয়েছিলেন দেলওয়ার হোসেন। নজরুল যেমন গান লেখা ও সুর দেওয়ায় দক্ষ ছিলেন তেমনি রেকর্ডের বাণিজ্য কীভাবে হবে সেটাও ভালো বুঝতেন।
টুইন রেকর্ড থেকে বাবার একটা গান গেয়েছিলেন জ্ঞানপ্রিয়া বৈষ্ণবী, গানটি ছিল ‘ঝুলন খেলায় বাঁশি ফুকারে গো’। উলটো পিঠে ছিল নিকুঞ্জ চক্রবর্তীর লেখা বাবার সুর দেওয়া ‘কানে গুঁজে ধুতুরার ফুল গো’, পুজোর দিনগুলিতে দুপুরে মা-পিসিমা শুনতেন পালা রেকর্ড। সেনোলা রেকর্ডে ‘উমার তপস্যা’ আর রিগ্যাল রেকর্ডে’ দস্যু রত্নাকর’ নামে আমাদের দুটো পালা ছিল। ‘উমার তপস্যা’ ছিল চারটি রেকর্ডে আর ‘দস্যু রত্নাকর’ ছিল তিনটি রেকর্ডে। সেনোলার লেবেল ছিল হালকা সবুজ রঙের কাগজের উপর ময়ূরের ছবি। এতে নবদ্বীপ হালদার বেশ কিছু কমিক গানের রেকর্ড করেছিলেন। আমাদের বাড়িতে ছিল ‘ফ্যান্তা ফ্যাচাং তরকারি’ আর ‘শরীরটা আজ বেজায় খারাপ’ গান দুটির একটি রেকর্ড। রিগ্যাল রেকর্ডের লেবেলের রঙ ছিল হিজ মাস্টার্স ভয়েসের মতোই আগুন রঙের বা ম্যাজেন্টা রঙের। তবে কোনো ছাপ থাকতো না। বাদলকাকুর বাড়িতে ছিল হিজ মাস্টার্স ভয়েসের ‘লক্ষণ ঊর্মিলা’ পালা। এই পালার ‘ভুলি নাই, ভুলি নাই, আজো মনে পড়ে নাম ধরে ডাকা’। গানটি আমাদের বন্ধু নব গলায় তুলে নিতে পেরেছিল। আর সে গাইতো কলম্বিয়া রেকর্ডে কানন দেবীর গাওয়া ‘মেজদিদি’ ফিল্মের গান ‘প্রণাম তোমায় ঘনশ্যাম’। গানটি আমাকেও ডুয়েটে তার সাথে গাইতে হতো। আমরা তখন ক্লাস সিক্স সেভেন-এর ছাত্র। রিগ্যাল রেকর্ড থেকেও বাবার দু’খানি গান ‘খেলা খেলিব রে’ আর ‘কাল কেউটে সাপালি’ প্রকাশিত হয়েছিল।
‘উদয়ের পথে’ ছবিতে রবীন্দ্রনাথের ‘চাঁদের হাসির বাঁধ ভেঙেছে’ গানটি ব্যবহৃত হয়েছিল। গানটি পাইওনিয়ার রেকর্ড থেকেও প্রকাশিত হয়েছিল। বড় সুন্দর ছিল পাইওনিয়ার রেকর্ডের লেবেলটি। একটি বহুবর্ণে চিত্রিত লেবেলে একটি উড্ডীয়মান মরালের ছবি আঁকা থাকতো। আমাদের বাড়িতে পাইওনিয়ার কোম্পানির দু’খানা রেকর্ড ছিল। আমি নয়ন ভরে এর লেবেলটি দেখতাম, আর দেখতাম! ‘উদয়ের পথে’ ফিল্ম এবং ‘চাঁদের হাসির বাঁধ ভেঙেছে’ গান এতই জনপ্রিয় হয়েছিল যে চুরুলিয়ার সাধুরা তাঁদের গৌরাংডি-বরাকর রুটের বাসের নাম রাখলেন ‘উদয়ের পথে’। আর রাস্তাঘাটে লোকের মুখে মুখে ফিরতে লাগলো রবীন্দ্রনাথের গান। মেগাফোন থেকে জে এন জি নম্বর সংবলিত হালকা সবুজ রঙের কাগজে হরিণের ছবি আঁকা লেবেল দেওয়া রেকর্ডে নজরুলের নিজের গলায় গাওয়া ‘পাষাণের ভাঙালে ঘুম’ রেকর্ডটিও আমাদের — বাড়িতে ছিল। তুলসী লাহিড়ীর লেখা কিছু গান মেগাফোনে রেকর্ড হয়েছিল। কমলা ঝরিয়া মেগাফোনেই গাইতেন। তাঁর গাওয়া কীর্তন গানের কিছু রেকর্ড আমাদের বাড়িতে ছিল। মেগাফোনে বাবার লেখা ‘আমি তার মূল্য দিব ধরে’ এবং ‘ব্রজপুরে কত সহি জালাতন’ গান দুটি রেকর্ড হয়েছিল।
শচীন দেববর্মণ গাইতেন হিন্দুস্থান রেকর্ডে। তাঁর নামের আগে কুমার লেখা থাকতো, কারণ তিনি ছিলেন ত্রিপুরার রাজকুমার। ‘প্রেমের সমাধি তীরে নেমে এলো শুভ্র মেঘের দল’ এবং ‘আমি ছিনু একা বাসর জাগায়ে’ গান দুটির রেকর্ডও ছিল আমাদের বাড়িতে। হিন্দুস্থান রেকর্ডের লেবেলে বরাবর বংশীবাদন-রত একটি বালকের ছবি থাকতো। পরবর্তীকালে পূর্ণদাস বাউল এবং অংশুমান রায় হিন্দুস্থানেই রেকর্ড করতেন। শচীন দেববর্মণ হিজ মাস্টার্স ভয়েসে প্রথম রেকর্ড করেন ১৯৫৬সালে পুজো সংখ্যা। গান দুটি ছিল ‘মন দিল না বধূ’ আর ‘তুমি আর নেই সে তুমি’। বাদলকাকু ছিলেন হেমন্ত মুখার্জির ফ্যান। তিনি কলম্বিয়া রেকর্ডে হেমন্ত মুখার্জি আর সন্ধ্যা মুখার্জির গান বেশি কিনতেন। তিনি তাঁর দোতলার রুমে গ্রামোফোন বাজাতেন আর আমাদের ডেকে ডেকে শোনাতেন হেমন্ত মুখার্জির ‘আকাশ মাটি ওই ঘুমালো’, শোনাতেন ‘গাঁয়ের বধূ’। তাঁর কাছে শুনলাম সুপ্রীতি ঘোষের গাওয়া ‘আকাশে লক্ষ তারার দেয়ালী/পলাশের মনে রঙের হেঁয়ালী/বলতো, বলতো দোষ কি এমন/ওগো বলতো/বলতো দোষ কি এমন হয় যদি মন হঠাৎ কিছু খেয়ালী।’ শুনলাম সত্য চৌধুরীর গাওয়া মোহিনী চৌধুরীর গান ‘পৃথিবী আমারে চায়’। নব শিখে নিলো জগন্ময় মিত্রের গান ‘তুমি আজ কত দূরে’ গানটি। নবমীর রাত। ফুটবল মাঠের আমরা চার বন্ধু। জ্যোৎস্না নেমেছে পাহাড়ীর জঙ্গলে, নব গেয়ে চলেছে জগন্ময় মিত্রের ‘চিঠি’ আর ‘সাতটি বছর আগে’ ‘সাতটি বছর পরে’ গানগুলি! সে স্মৃতি ভোলার নয়। গান দুটির প্রথম লাইন ছিল ‘এমনি শারদ রাতে’ পুজোয় কলকাতা থেকে এসেছেন ছকুকাকু—সাদা ধুতি, সাদা পাঞ্জাবি, সাদা নিউকাট, সাদা ঘড়ির বেল্ট, রিমলেশ চশমা পরে। বাবার সাথে বৈঠকখানায় গাইছেন ‘ওগো নদী আপন বেগে পাগল পারা’ আর গাইছেন সুধীরলাল চক্রবর্তীর বিখ্যাত গান ‘মধুর আমার মায়ের হাসি চাঁদের মুখে ঝরে —’ বোধহয় ‘দাগ’ কথাচিত্রের গান। ছকুকাকু বাদলকাকুদের পিসতুতো ভাই নলিনীকাকুর সাথে এসেছেন তাঁর শ্যালিকা, আমাদের বুজু মাসি। তখন ফ্রক পরে বেনি দুলোয় বাবার কাছে গানটি তুলে নিচ্ছেন। বুজুমাসি সুধীরলালের ফ্যান শুনে বাদলকাকু কিনে আনলেন ‘স্বপ্ন সুরভি মাখা দুর্লভ রাত্রি’ আর ‘খেলাঘর মোর ভেসে গেছে হায় নয়নের যমুনায় —’ গান দুটি। পানুড়িয়ার সোনেলাল শিখে নিয়ে এই গান দুটির সাথে ‘গরমিল’ ছবিতে রবীন মজুমদারের গাওয়া ‘এই কি গো শেষ দান’ গানটি তুলেছেন। পুজোর বৈঠকী গানের আসরে তখন তাঁকে নিয়ে টানাটানি। এই গানগুলিই তিনি গাইছেন সব আসরে।
বাবা অকাল প্রয়াত হয়েছেন। বাদলকাকুও। অমন একজন দুর্দান্ত ফুটবল প্লেয়ার, খেলার জন্যই যাঁর চিত্তরঞ্জনে চাকরি, তিনি মাত্র বাইশ বছর বয়সে চলে গেলেন।
গ্রামোফোন দুটিও খারাপ হয়ে গেল।
স্কুলের উঁচু ক্লাসে পড়ছি। বার্ষিক পরীক্ষার রেজাল্ট আউটের দিন। আমরা বাইরে ঘোরাফেরা করছি। ডিসেম্বরের রোদে গা সেঁকে নিচ্ছি। স্কুল সংলগ্ন ক্লাবের বারান্দায় জমিদার বাড়ির হারুদা তাঁদের ঢাউস টেবিল গ্রামোফোনখানা নিয়ে নতুন রেকর্ড বাজাচ্ছেন, নতুন ধরনের গান— ‘ধিতাং ধিতাং বোলে/ কে মাদলে তান তোলে/ কার আনন্দ উচ্ছলে/ আকাশ ভরে জোছনায়।’ সলিল চৌধুরীর কথা ও সুরে — হেমন্ত মুখোপাধ্যায় গাইছেন সে গান। মানিকদা বলছেন, ‘গণনাট্য দেখছি বাংলা গানেও নতুন দিক নিয়ে এলো! দেখো কথা কত সুন্দর— এদেশ তোমার আমার/ আমরা ভরি খামার/ আমরা গড়ি স্বপন দিয়ে সোনার কামনায়।’ সঙ্গে সঙ্গে গানটা গলায় তুলে নিলাম! সন্ধ্যা মুখার্জির নতুন গান বাজছে ‘আয় বৃষ্টি ঝেঁপে!’ বিমলচন্দ্র ঘোষের কবিতায় সলিল চৌধুরী সুর দিয়েছেন, সন্ধ্যা মুখার্জি গাইছেন, ‘উজ্জ্বল, এক ঝাঁক পায়রা/ সূর্যের উজ্জ্বল রৌদ্রে/ চঞ্চল পাখনায় উড়ছে।’ নকুলকে বলছেন, ‘এ ধরনের কথায় সুর দিয়ে যে গান হতে পারে একথা ভাবিনি তো!’ পানুদা চটুল গান পছন্দ করেন না। নতুন নতুন কথা ও সুরে হিজ মাস্টার্স ভয়েস আর কলম্বিয়ায় গাইছেন ধনঞ্জয়, হেমন্ত, শ্যামল, মানবেন্দ্র, তরুণ, দ্বিজেন, সতীনাথ, পান্নালাল, অখিলবন্ধু, মৃণাল চক্রবর্তী, অপরেশ লাহিড়ী, সন্ধ্যা, আলপনা, প্রতিমা, মাধুরী, উৎপলা, গীতা রায় (দত্ত), গাইছেন শচীন দেববর্মণ আর মান্না দে। যে বছর শচীন দেব বর্মণ ‘মন দিল না বঁধূ’ রেকর্ড করলেন এইচ এম ভি-তে সেই বছরই কলম্বিয়ায় পান্নালাল গাইলেন ‘আমার সাধ না মিটিল, আশা না পুরিল, সকলি ফুরায়ে যায় মা!’ মাঠে, ঘাটে, মাইকে, ফাংশনে সর্বত্র ঘুরতে লাগল সেই গান। একটা শ্যামাসঙ্গীত যে এতটা জনপ্রিয় হতে পারে ভাবা যায় না। রেকর্ড সংখ্যক রেকর্ড বিক্রি হলো। সে বছরই হেমন্ত রেকর্ড করেছিলেন’ ‘আর কতো রহিব শুধু পথ চেয়ে।’ যে ধনঞ্জয় তাঁর প্রথম রেকর্ড করেছিলেন ভারত রেকর্ডে— ‘ভুলে যাও মোরে’— অনেকটা জগন্ময়- সুবীরলাল — রবীন মজুমদারদের স্টাইলে, তিনিই আবার ‘সলিল চৌধুরীর সুরে ‘পাশের বাড়ি’ ফিল্মে গাইলেন — ‘ঝির ঝির ঝির ঝির বরষা/ আমার হয় কি গো ভরসা/ আমার ভাঙা ঘরে তুমি বিনে!’
বন্ধু দুলাল মিত্র নেমন্তন্ন করলো গান শোনার তাদের ক্লাব বাংলোর কোয়ার্টারে। আমরা তখন ফাস্ট ক্লাসের অর্থাৎ ক্লাস টেনের ছাত্র। শুনলাল— শ্যামল মিত্র’র ‘মহুল ফুলে জমেছে মউ,’ মান্না দে-র ‘তুমি আর ডেকে না!’ ‘এ জীবনে যত ব্যথা পেয়েছি।’ সতীনাথের ‘সোনার হাতে সোনার কাঁকন/ কে কার অলঙ্কার!’ উলটোপিঠে ‘এলো বরষা যে সহসা মনে তাই।’
গান গেয়ে আর গান শুনে এভাবেই কেটে যায় দিন। রেডিও তখন জনপ্রিয় হতে শুরু করেছে। বাজারে তখন অনেকেই রেডিও কিনেছেন, কিন্তু গ্রামোফোনের সে স্বাদ, রেডিওতে কোথায়? সলিল চৌধুরী গান বাঁধছেন, ‘তখন এ গান, তুলে তুফান, নবীন প্রাণের প্লাবন আনে দিকে দিকে/ কিসের বাধা, মরণ হরণ চরণ ফেলে সে যায় হেঁকে।’ চাঁদ ফুল জোছনা ছাড়াই, গুণ গুণ গুঞ্জন বাদ দিয়েও, প্রেমের ডোর খুলে ফেলেও পথে নেমে মানুষের হাতে হাত দিয়ে যে গান গাওয়া যায় সলিল চৌধুরী তা প্রমাণ করলেন, বললেন— ‘পথ হারাবো বলেই এবার পথে নেমেছি।’ তারও অনেক পরে বলেছেন, ‘আমি পথ খুঁজি না তো, পথ মোরে খোঁজে।’ কী সুন্দর অ্যালিটারেশন, সিমিলি, মেটাফরের ছড়াছড়ি বাংলা গানে! সুবীর সেন গাইছেন, ‘ছুটে আয়রে মিলন বীণ, ঐ তো তুলেছে তান/ শোনো আহ্বান।’
মনে পড়ে, তখন সেকেন্ড ইয়ার, মানে আজকের বারো ক্লাসের ছাত্র। যে বাসে কলেজ যেতাম, সেই একই বাসে যেত জয়শ্রী, ক্লাস টেনে পড়তো। শ্যামলা, ছিপছিপে শুচিস্মিতা মেয়েটিকে দেখলেই মনটা পবিত্র হয়ে যেত। সে বছর শ্যামল মিত্র পুজোতে রেকর্ড করলেন ‘কার মঞ্জির বাজে রিনিঠিনিঠিনি।’ আর ‘চোখের নজর কম হলে আর কাজল দিয়ে কী হবে।’ গান দুটো গলায় তুলতেই হলো। কলেজের কমনরুমে যখন প্রথম গানটার অন্তরা গাইতাম, ‘তুমি যে আমার চোখের আলো/ প্রথম দেখায় আমি বেসেছি ভালো’ তখন কেন জানে না, জয়শ্রীর হাসিমুখটাই চোখের সামনে ভেসে উঠতো। সে যেদিন মন খারাপ করে মুখ ভার করে থাকতো, সেদিন মনে মনে গাইতাম শচীন দেববর্মণের গান’ তোমার চোখের পাতা নাচে না/ নাচে না আমার পথ চেয়ে/ তোমার হাসিতে সাড়া জাগে না/ জাগে না আমার সাড়া পেয়ে/ হাসো না হাসো না সে হাসি মধুময়/ তুমি আর নেই সে তুমি।’ জয়শ্রী জানতো না সে কথা! জানে না এখনো।
তারপর কেটে গেছে কত কাল! এখন কালো কালো গোল গোল রেকর্ডগুলো স্থান পেয়েছে অমিত গুহ-র সংগ্রহশালায়, আমার ছেলেমেয়েরাও সেই ছোট ছোট পিনগুলো দেখেনি। চোঙাওলা বা বক্স গ্রামোফোনও তাদের কাছে জাদুঘরের সামগ্রী। এভাবেই পুরাতন বিদায় নেয়। আসে নতুনেরা, এসে গেছে নতুন নতুন ইলেকট্রনিক্স যন্ত্র। স্বাগত জানাতেই হবে— কিন্তু আর কী করে শুনবো তরুণের সেই গান— ‘কাজল নদীর জলে’/ ভরা ঢেউ ছলো ছলে/ প্রদীপ ভাসাও কারে স্মরিয়া,’ বা ‘ওগো কৃষ্ণচূড়া বলো আবার কবে তুমি চাঁদের আলোয় যাবে ভরে!’ কিংবা উৎপলা সেনের ‘ঝিকমিক জোনাকির দীপ
No comments:
Post a Comment