মুখোমুখি — আনা ফ্র্যাঙ্ক আর রাচেল কোরি
কৃশানু ভট্টাচার্য
‘‘আমার বাবা খুঁজে পেয়েছিলেন আমার ডায়েরিটা; তারপর ...’’
‘‘আমার মা’র কাছেই রয়েছে আমার ডায়েরি, কিন্তু ...’’
‘‘বাবা যুদ্ধশেষে আমস্টারডামে ফিরে এসে অনেক কষ্টে খুঁজে বার করেন আমার ডায়েরিটা। আমি ডায়েরিটা লিখেছিলাম ডাচ ভাষায়। আমার ১৩ বছরের জন্মদিনে এই ডায়েরিটা কেউ উপহার দিয়েছিলেন। তার দু’বছর আগে নুরেমবার্গ আইনের দৌলতে আমরা নাগরিকতা হারালাম। কিছুদিন বাবার অফিসের একটা ঘরে লুকিয়ে ছিলাম। ১৯৪২-র জুন মাসে অজ্ঞাতবাসের শুরু শেষ ১৯৪৪-এ। তারপর বার্গেন বেলসন কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে আমার আর বোন মার্গটের ঠিকানা। তারপর এসেছিল ১৯৪৫, জানুয়ারি, ফেব্রুয়ারি, মার্চ — এর পর কি হয়েছে আমি জানি না।’’
‘‘তোমার চেয়ে আমি পৃথিবীটাকে দেখেছি বেশিদিন — আট বছর। আট বছর মানে ২৯২০ দিন। তোমার চেয়ে পৃথিবীকে আমি আরেকটু বড় দেখেছি — নিজের দেশের বাইরে বেরিয়েও অন্য পৃথিবীকে দেখেছি। দেখেছি অনেক বেশি অত্যাচার অনেক বেশি কষ্ট। আমি শুনেছি তোমার কথা পড়েছি তোমার কষ্টকর জীবনের রোজনামচা। বুকের গহন কোণে ছবি এঁকেছি তোমার। তুমিও তো জানিয়েছিলে নাজিদের অত্যাচারের কথা। কেউ কেউ বলে তোমার লেখায় নগ্ন হয় হিটলারের বর্বরতা। তুমি আনা ফ্র্যাঙ্ক আমি সে অর্থে ততটা চেনাশুনা কেউ নই। কেউ কেউ বলে ‘পাগলি’ কেউ বলে বোকা। তবুও তোমার জ্বালানো মশাল থেকে আমায় একটু উত্তাপ দেবে? আমি যে মশাল জ্বালিয়েছিলাম তা তো নিভেই গেছে।’’
‘‘কে বলে তুমি পাগলি ? এখনও বাতাসে কান পাতলে তোমার নাম কেউ ফিস ফিস করে বলে যায়। জোরে বলতে পারে না তোমার দেশের সরকারের ভয়ে। ওদের জোরেই তো তোমার ঘাতকদের এতো শক্তি। ইতিহাস সাক্ষী ৬০ বছরেও বর্বরতার রোজনামচায় কোনো বদল হলো না।’’
‘‘আমি তখন ছোট ছিলাম যখন তোমার কথা পড়ি। শুনেছিলাম ১৪ বছরের মেয়ে হয়েও তুমি যা বলেছো তা অনেক প্রাপ্তবয়স্কও বলতে পারে না। শুনেছি হল্যান্ডের যেখানে তোমরা লুকিয়েছিলে সেখানে প্রতিবছর অনেক মানুষই যান দেখতে জানতে। সেই আগ্রহেই তোমায় পড়তে শুরু করি। আরও অনেক কিছু পড়ার ইচ্ছে ছিলো তা আর হলো কই? তার আগেই ডি-৯ অস্ত্রে সজ্জিত কাটারপিলার বুলডোজার আমায় পিষে মেরে ফেললো। তবে শুধু তো আমি নই ইজরায়েলের তাণ্ডবে প্রাণ হারিয়েছে অনেক মানুষ। রাফা, গাজা, রাসেল লাশের পাহাড় —রক্তের নদী— বীভৎসতার কোনো সীমা হয় না এটা জানতে গেলে একবার ইজরায়েলে যেতে হবেই।’’
‘‘তুমি কি জানো, এই সেদিন ২৮শে আগস্ট, ২০১২ নয় বছর শুনানির শেষে বিচারক ওডেড গ্যারসন দি বলেছেন?’’
‘‘জানি ওই যে আমার মৃত্যুকে আমিই আমন্ত্রণ করেছি। আসলে কি জানো আমার মৃত্যুর দায় স্বীকার করে নিলে তো আরও হাজারো খুনের দায়ও মাথা পেতে নিতে হবে। জানো ওদের সবাই বলে উদ্বাস্তু— আমি জানি ওরা গায়ের জোরের ভয়ে পালিয়ে বাঁচা হাজারো জনতা, ওরা ভয় পায় কামান, বুলডোজার। তাই ওদের বরাতে থাকে বহিষ্কার, ভীতি প্রদর্শন কিংবা মৃত্যু। ওদের তাড়িয়ে দিয়েই তৈরি হবে ইহুদি রাষ্ট্র ইজরায়েল।
‘‘হায়! ইতিহাসের এই পুনরাবৃত্তিও সহ্য করতে হচ্ছে।’’
‘‘পুনরাবৃত্তি-তবে তা আরও ভয়ঙ্কর। আর এনিয়ে যতদিন না তারা অনুতপ্ত হচ্ছে ততদিন তাদের সৃষ্টি করা ক্ষত আরো গভীর হবে, ছড়িয়ে পড়বে মধ্য প্রাচ্যে ছড়িয়ে পড়বে দুনিয়ার চার কোণায়। তবে তারা অনুতপ্ত তো নয়— তারা জানে তাদের মাথার উপর রয়েছে মার্কিন আশীর্বাদ।’’
‘‘আমি অবাক হয়েছিলাম তোমার কথা শুনে —একটা ২৩ বছরের মেয়ে কলেজের ছাত্রী কেবলমাত্র সহমর্মিতা জানাবার জন্য তার নিজের দেশের বন্ধু দেশে গিয়ে প্রতিবাদ করছে। ইজরায়েলের বর্বরতার পাশবিক দিনলিপি লিপিবদ্ধ করছে, ভাষা হারা মানুষের মুখে ভাষা দিচ্ছে - আর তারপর খুন হচ্ছে — ভাবা যায় না।’’
‘‘মার্জনা করবেন, অ্যানা কখনও কোনো পশুকে দেখেছেন অপ্রয়োজনে কাউকে আক্রমণ করতে? পশু আক্রমণ করে আত্মরক্ষায় কিংবা খাদ্য সংগ্রহে। ইজরায়েলের পরিচালকদের সঙ্গে পশুর তুলনা করে পশুদের অসম্মান করবেন না — ওরা নিষ্ঠুর, হত্যাকারী তবে ওদের বর্বরতা দেখে পশুরাও লজ্জা পাবে।’’
‘‘ঠিক, তুমিই ঠিক। ওরা এতোটাই নীচ যে ওদের ঘৃণা করতেও কুণ্ঠা হয়। আর আরও নীচ তোমার দেশের সরকার। ইতিহাসের পাতা থেকে তোমার নাম মুখে দেবার জন্য তাদের তৎপরতা তুলনাহীন। আধুনিক যুগের রাজনৈতিক ইতিহাসে তোমার নাম নেই এটাও সত্যি।’’
‘‘থাকতে পারে না — থাকলে তো প্রমাণ হয়ে যাবে বর্বরতায় ইজরায়েলের মানিকজোড়টির নাম মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। যারা নিজেদের মানবাধিকারের পূজারী বলে ঢাক পেটায় তাদের ফানুস যে ফেটে যাবে। তাই আমার স্থান মার্কিন ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে। ওরা বিমানবন্দরে আমাকে হেনস্তা করেছিল। মেক্সিকো সীমান্তে আমাকে বিব্রত করেছিল। আমাকে হত্যা করার পরও তাই ওদের ভয় কাটেনি। ওরা আসলে ভয় পায় আমার অস্তিত্বকেই।’’
‘‘তুমি তো লিখেছিলে সেই অত্যাচারের দিনলিপি যা কেউ পড়ার সুযোগ পেলো না— পেলে হয়তো তোমাকে আর আমাকে একই আসনে ওরা বসাতো। জানো আমার ছেলেবেলার বন্ধু ছিলো ফ্রিটজ্ লোয়েনস্টাইন’ সে শেষ জীবনে থাকতো উইলকিনসিনের মাডিসনে। ফ্রিটজের বাবা ছিলেন ডাক্তার— ফ্রিটজই আমার ডায়েরির পিটার। ফ্রিটজ রোজ ওর বাবার চেম্বারের দরজায় আঁকা স্বস্তিকা চিহ্ন মুছে দিতো। ওরা থাকতো ওসনাব্রুকে। তারপর আত্মগোপনের পর আত্মগোপন। শেষে ওরা চলে যায় আমেরিকায়। তাই ওরা বেঁচে গেলো। জানো ফ্রিটজকে জীবনের প্রায় শেয় সময় পর্যন্ত সবাই ডাকতো আমার কথা বলবার জন্য। তোমার কথা বলার তো কেউই রইলো না।’’
‘‘না সময় তার স্রোতেই রাচেল কোরিকে ভাসিয়ে নেবে। তবুও একটা জাতিকে মুছে দেবার চক্রান্ত যার নায়ক ইজরায়েল তার ইতিহাস মুছে দেওয়া সহজ নয়। স্থানান্তরণ, জাতি নিশ্চিহ্নকরণ, প্রতিবাদের স্বর রোধ করা, অন্যের সম্পদ দখল করা প্যালেস্তাইনের নিজস্ব ইতিহাস ও সংস্কৃতিকে ধ্বংস করা, জাতি বিদ্বেষ থেকে একটা দেশের ভৌগোলিক চেহারাকে বিকৃত করা অন্যায়ের তালিকা তো দীর্ঘ। সেই দীর্ঘ তালিকার শেষে আমাকে হত্যা। আমাকে হত্যা করে সেদিন যে রক্তের দাগ ইজরায়েলের হাতে লেগেছে তা হয়তো মার্কিন দেশের নদীর জল মুছে দেবে, কিন্তু হাজারো নিরীহ মানুষের রক্তের দাগ— তা মুছতে গিয়ে মার্কিন শাসকদের দেহেও তো রক্তের ছোঁয়া লাগলো, কেউ না কেউ তো তা দেখে শিউরে উঠবে চোখ মুখ বিকৃত করে বলবে ছিঃ। এতোটা হিংস্রও মানুষ হতে পারে।’’
‘‘তুমি তো সব জেনেই রাফায় গিয়েছিলে ?’’
ইজরায়েল চেয়েছিল নিজেদের মতো করে দুটো জনপদের সীমানা আঁকবে। ওদেত মদত দিচ্ছিল আমেরিকা, ওদের অভিযানের নাম ছিলো অপারেশন ফাস্ট লিড। ২০০৬-এ নির্বাচনে জেতে হামাস। তীব্র হয় প্রতিরোধ। আমি গিয়ে দেখেছিলাম কিভাবে রোজ অত্যাচারিত হচ্ছে মানুষ। সৈনিকের গুলি এফোঁড় ওফোঁড় করে দিচ্ছে নিরীহ মানুষের দেহ, গুঁড়িয়ে দিচ্ছে বাড়িঘর, রাস্তার দখল নিচ্ছে, দখল নিচ্ছে সম্পত্তির। মানুষ বলে নিজেকে সে সময় পরিচয় দিতেও লজ্জা হতো। আর মার্কিনী বলে পরিচয় দিতে হচ্ছিল ঘৃণা —নিজেকে ওদের একজন বলে পরিচয় দিয়েই যন্ত্রণাকে লুকোছিলাম। সে যন্ত্রণা আমার মনের। আর ওরা কাতরাচ্ছিল শরীরের যন্ত্রণায় কামানের গোলা, বোমা, বুলেট শিশু নারী বৃদ্ধ কাউকে রেয়াত করেনি। মানুষকে মেরে ওদের উল্লাস দেখে রোজ শিউরে উঠেছি। আর খবর পাচ্ছিলাম কিভাবে ইজরায়েলের হয়ে গলা ফাটাচ্ছেন মহামতি বুশ — ইজরায়েলের প্রধানমন্ত্রী শ্যারণ তখন আত্মরক্ষাকারী মানুষগুলোকে বলছেন ‘সন্ত্রাসবাদী’ আর ‘সন্ত্রাসবাদ’ নিয়ে বুশ সাহেবের চেনা কীর্তন চলছে অষ্টপ্রহর। দুনিয়া শুনছে সেই কীর্তনের কলনাদ —চাপা পড়ে যাচ্ছে মানুষের কান্না তারপর চাপা পড়ে গেলাম আমি।’’
‘‘শ্যারণ তো বলেছিলেন ওরা নাকি আল কায়েদার মতোই সন্ত্রাসবাদী। তাই তার এ লড়াই মার্কিনী ধর্মযুদ্ধেরই অংশ। আর সে কারণেই বুশ সাহেব ছিলেন ওদের পাশে।’’
‘‘সেদিন আমার সামনে ছিলো বুলডোজার, সেটা তার আগে গুঁড়িয়ে দিয়েছে বহু দেওয়াল, মাড়িয়ে এসেছে বহু মানুষের দেহ। তার আগে গরিব বসতিগুলোতে নির্বিচারে ছোঁড়া হয়েছে গ্রেনেড। মানুষগুলো রক্তাক্ত, হাতে নেই কোনো অস্ত্র। আমি সে সময় এধরনেরই হতভাগ্য এক পরিবারের বিপন্ন আশ্রয়ের সামনে হাজির। শুনেছি ওদেরকেও সন্ত্রাসবাদী তকমা পরিয়ে তৃপ্ত হয়েছেন শ্যারণ আর বুশ। আমি তখন ওদের বাড়ির দরজায় দাঁড়িয়ে আছি। তারপর এগিয়ে এলো বুলডোজার পিষে ফেললো আমায় ....’’
‘‘এটা দুর্ঘটনা। অন্তত হৃদয়হীন সরকারী ভাষ্যে এটা একান্তই অনিচ্ছাকৃত ভুল। তুমি তো পালাতেও পারতে। তা না করে তুমি দাঁড়িয়ে পড়লে বুলডোজারের সামনে। এমন জায়গায় প্রতিরোধ গড়তে চাইলে যে জায়গা তোমার রাফা পৌঁছনোর অনেক আগেই ঘোষিত হয়েছে মিলিটারি জোন হিসাবে। আর তাই তো তোমার নামই সময় মুছে দেবে। তুমি কোনো পাঠ্যপুস্তকেও ঠাঁই পাবে না এটা তোমার দেশের শাসকদেরই হাজারো বিবেচনার উপসংহার।’’
‘‘তবে তাই হোক মুছে দাও আমার নাম ইতিহাস থেকে, মুছে দাও সভ্যতার প্রতিটি ইমারত। মাথা উঁচু করে বাঁচুক লাশের স্তূপ আর তার উপর উড়িয়ে দাও বর্বরতার ধ্বজা।’’
‘‘বর্বরতা শেষ কথা বলে না রাচেল। বললে ফ্রিটজকে বারবার বলতে হতো না আমার কথা। তুমি তো আমার সন্তান আমার চেতনার সন্তান। তোমার মা তো কাঁদেন না —বলেন তিনি আর সবাই দাঁড়িয়ে আছেন আজও নিষ্ঠুর সভ্যতার শত্রুদের বুলডোজারের সামনে। তোমাকে বুকে করে আজও বাঁচে কয়েকজন— আগামীদিনে ওদের সংখ্যা বাড়বে বাড়বেই। আর তখন ওরাই ছিঁড়ে ফেলবে বুশ সাহেবের সরকারী ইতিহাস। তোমার মা সিন্ডা দেবেন তোমার ডায়েরি তাদেরই হাতে তুলে। আর ওদের কণ্ঠেই বেঁচে থাকবো তুমি আর আমি আনা ফ্র্যাঙ্ক ও রাচেল কোরি।’’
সৌজন্যেঃ- গণশক্তি (সময়ের সাথে)
‘‘আমার মা’র কাছেই রয়েছে আমার ডায়েরি, কিন্তু ...’’
‘‘বাবা যুদ্ধশেষে আমস্টারডামে ফিরে এসে অনেক কষ্টে খুঁজে বার করেন আমার ডায়েরিটা। আমি ডায়েরিটা লিখেছিলাম ডাচ ভাষায়। আমার ১৩ বছরের জন্মদিনে এই ডায়েরিটা কেউ উপহার দিয়েছিলেন। তার দু’বছর আগে নুরেমবার্গ আইনের দৌলতে আমরা নাগরিকতা হারালাম। কিছুদিন বাবার অফিসের একটা ঘরে লুকিয়ে ছিলাম। ১৯৪২-র জুন মাসে অজ্ঞাতবাসের শুরু শেষ ১৯৪৪-এ। তারপর বার্গেন বেলসন কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে আমার আর বোন মার্গটের ঠিকানা। তারপর এসেছিল ১৯৪৫, জানুয়ারি, ফেব্রুয়ারি, মার্চ — এর পর কি হয়েছে আমি জানি না।’’
‘‘তোমার চেয়ে আমি পৃথিবীটাকে দেখেছি বেশিদিন — আট বছর। আট বছর মানে ২৯২০ দিন। তোমার চেয়ে পৃথিবীকে আমি আরেকটু বড় দেখেছি — নিজের দেশের বাইরে বেরিয়েও অন্য পৃথিবীকে দেখেছি। দেখেছি অনেক বেশি অত্যাচার অনেক বেশি কষ্ট। আমি শুনেছি তোমার কথা পড়েছি তোমার কষ্টকর জীবনের রোজনামচা। বুকের গহন কোণে ছবি এঁকেছি তোমার। তুমিও তো জানিয়েছিলে নাজিদের অত্যাচারের কথা। কেউ কেউ বলে তোমার লেখায় নগ্ন হয় হিটলারের বর্বরতা। তুমি আনা ফ্র্যাঙ্ক আমি সে অর্থে ততটা চেনাশুনা কেউ নই। কেউ কেউ বলে ‘পাগলি’ কেউ বলে বোকা। তবুও তোমার জ্বালানো মশাল থেকে আমায় একটু উত্তাপ দেবে? আমি যে মশাল জ্বালিয়েছিলাম তা তো নিভেই গেছে।’’
‘‘কে বলে তুমি পাগলি ? এখনও বাতাসে কান পাতলে তোমার নাম কেউ ফিস ফিস করে বলে যায়। জোরে বলতে পারে না তোমার দেশের সরকারের ভয়ে। ওদের জোরেই তো তোমার ঘাতকদের এতো শক্তি। ইতিহাস সাক্ষী ৬০ বছরেও বর্বরতার রোজনামচায় কোনো বদল হলো না।’’
‘‘আমি তখন ছোট ছিলাম যখন তোমার কথা পড়ি। শুনেছিলাম ১৪ বছরের মেয়ে হয়েও তুমি যা বলেছো তা অনেক প্রাপ্তবয়স্কও বলতে পারে না। শুনেছি হল্যান্ডের যেখানে তোমরা লুকিয়েছিলে সেখানে প্রতিবছর অনেক মানুষই যান দেখতে জানতে। সেই আগ্রহেই তোমায় পড়তে শুরু করি। আরও অনেক কিছু পড়ার ইচ্ছে ছিলো তা আর হলো কই? তার আগেই ডি-৯ অস্ত্রে সজ্জিত কাটারপিলার বুলডোজার আমায় পিষে মেরে ফেললো। তবে শুধু তো আমি নই ইজরায়েলের তাণ্ডবে প্রাণ হারিয়েছে অনেক মানুষ। রাফা, গাজা, রাসেল লাশের পাহাড় —রক্তের নদী— বীভৎসতার কোনো সীমা হয় না এটা জানতে গেলে একবার ইজরায়েলে যেতে হবেই।’’
‘‘তুমি কি জানো, এই সেদিন ২৮শে আগস্ট, ২০১২ নয় বছর শুনানির শেষে বিচারক ওডেড গ্যারসন দি বলেছেন?’’
‘‘জানি ওই যে আমার মৃত্যুকে আমিই আমন্ত্রণ করেছি। আসলে কি জানো আমার মৃত্যুর দায় স্বীকার করে নিলে তো আরও হাজারো খুনের দায়ও মাথা পেতে নিতে হবে। জানো ওদের সবাই বলে উদ্বাস্তু— আমি জানি ওরা গায়ের জোরের ভয়ে পালিয়ে বাঁচা হাজারো জনতা, ওরা ভয় পায় কামান, বুলডোজার। তাই ওদের বরাতে থাকে বহিষ্কার, ভীতি প্রদর্শন কিংবা মৃত্যু। ওদের তাড়িয়ে দিয়েই তৈরি হবে ইহুদি রাষ্ট্র ইজরায়েল।
‘‘হায়! ইতিহাসের এই পুনরাবৃত্তিও সহ্য করতে হচ্ছে।’’
‘‘পুনরাবৃত্তি-তবে তা আরও ভয়ঙ্কর। আর এনিয়ে যতদিন না তারা অনুতপ্ত হচ্ছে ততদিন তাদের সৃষ্টি করা ক্ষত আরো গভীর হবে, ছড়িয়ে পড়বে মধ্য প্রাচ্যে ছড়িয়ে পড়বে দুনিয়ার চার কোণায়। তবে তারা অনুতপ্ত তো নয়— তারা জানে তাদের মাথার উপর রয়েছে মার্কিন আশীর্বাদ।’’
‘‘আমি অবাক হয়েছিলাম তোমার কথা শুনে —একটা ২৩ বছরের মেয়ে কলেজের ছাত্রী কেবলমাত্র সহমর্মিতা জানাবার জন্য তার নিজের দেশের বন্ধু দেশে গিয়ে প্রতিবাদ করছে। ইজরায়েলের বর্বরতার পাশবিক দিনলিপি লিপিবদ্ধ করছে, ভাষা হারা মানুষের মুখে ভাষা দিচ্ছে - আর তারপর খুন হচ্ছে — ভাবা যায় না।’’
‘‘মার্জনা করবেন, অ্যানা কখনও কোনো পশুকে দেখেছেন অপ্রয়োজনে কাউকে আক্রমণ করতে? পশু আক্রমণ করে আত্মরক্ষায় কিংবা খাদ্য সংগ্রহে। ইজরায়েলের পরিচালকদের সঙ্গে পশুর তুলনা করে পশুদের অসম্মান করবেন না — ওরা নিষ্ঠুর, হত্যাকারী তবে ওদের বর্বরতা দেখে পশুরাও লজ্জা পাবে।’’
‘‘ঠিক, তুমিই ঠিক। ওরা এতোটাই নীচ যে ওদের ঘৃণা করতেও কুণ্ঠা হয়। আর আরও নীচ তোমার দেশের সরকার। ইতিহাসের পাতা থেকে তোমার নাম মুখে দেবার জন্য তাদের তৎপরতা তুলনাহীন। আধুনিক যুগের রাজনৈতিক ইতিহাসে তোমার নাম নেই এটাও সত্যি।’’
‘‘থাকতে পারে না — থাকলে তো প্রমাণ হয়ে যাবে বর্বরতায় ইজরায়েলের মানিকজোড়টির নাম মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। যারা নিজেদের মানবাধিকারের পূজারী বলে ঢাক পেটায় তাদের ফানুস যে ফেটে যাবে। তাই আমার স্থান মার্কিন ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে। ওরা বিমানবন্দরে আমাকে হেনস্তা করেছিল। মেক্সিকো সীমান্তে আমাকে বিব্রত করেছিল। আমাকে হত্যা করার পরও তাই ওদের ভয় কাটেনি। ওরা আসলে ভয় পায় আমার অস্তিত্বকেই।’’
‘‘তুমি তো লিখেছিলে সেই অত্যাচারের দিনলিপি যা কেউ পড়ার সুযোগ পেলো না— পেলে হয়তো তোমাকে আর আমাকে একই আসনে ওরা বসাতো। জানো আমার ছেলেবেলার বন্ধু ছিলো ফ্রিটজ্ লোয়েনস্টাইন’ সে শেষ জীবনে থাকতো উইলকিনসিনের মাডিসনে। ফ্রিটজের বাবা ছিলেন ডাক্তার— ফ্রিটজই আমার ডায়েরির পিটার। ফ্রিটজ রোজ ওর বাবার চেম্বারের দরজায় আঁকা স্বস্তিকা চিহ্ন মুছে দিতো। ওরা থাকতো ওসনাব্রুকে। তারপর আত্মগোপনের পর আত্মগোপন। শেষে ওরা চলে যায় আমেরিকায়। তাই ওরা বেঁচে গেলো। জানো ফ্রিটজকে জীবনের প্রায় শেয় সময় পর্যন্ত সবাই ডাকতো আমার কথা বলবার জন্য। তোমার কথা বলার তো কেউই রইলো না।’’
‘‘না সময় তার স্রোতেই রাচেল কোরিকে ভাসিয়ে নেবে। তবুও একটা জাতিকে মুছে দেবার চক্রান্ত যার নায়ক ইজরায়েল তার ইতিহাস মুছে দেওয়া সহজ নয়। স্থানান্তরণ, জাতি নিশ্চিহ্নকরণ, প্রতিবাদের স্বর রোধ করা, অন্যের সম্পদ দখল করা প্যালেস্তাইনের নিজস্ব ইতিহাস ও সংস্কৃতিকে ধ্বংস করা, জাতি বিদ্বেষ থেকে একটা দেশের ভৌগোলিক চেহারাকে বিকৃত করা অন্যায়ের তালিকা তো দীর্ঘ। সেই দীর্ঘ তালিকার শেষে আমাকে হত্যা। আমাকে হত্যা করে সেদিন যে রক্তের দাগ ইজরায়েলের হাতে লেগেছে তা হয়তো মার্কিন দেশের নদীর জল মুছে দেবে, কিন্তু হাজারো নিরীহ মানুষের রক্তের দাগ— তা মুছতে গিয়ে মার্কিন শাসকদের দেহেও তো রক্তের ছোঁয়া লাগলো, কেউ না কেউ তো তা দেখে শিউরে উঠবে চোখ মুখ বিকৃত করে বলবে ছিঃ। এতোটা হিংস্রও মানুষ হতে পারে।’’
‘‘তুমি তো সব জেনেই রাফায় গিয়েছিলে ?’’
ইজরায়েল চেয়েছিল নিজেদের মতো করে দুটো জনপদের সীমানা আঁকবে। ওদেত মদত দিচ্ছিল আমেরিকা, ওদের অভিযানের নাম ছিলো অপারেশন ফাস্ট লিড। ২০০৬-এ নির্বাচনে জেতে হামাস। তীব্র হয় প্রতিরোধ। আমি গিয়ে দেখেছিলাম কিভাবে রোজ অত্যাচারিত হচ্ছে মানুষ। সৈনিকের গুলি এফোঁড় ওফোঁড় করে দিচ্ছে নিরীহ মানুষের দেহ, গুঁড়িয়ে দিচ্ছে বাড়িঘর, রাস্তার দখল নিচ্ছে, দখল নিচ্ছে সম্পত্তির। মানুষ বলে নিজেকে সে সময় পরিচয় দিতেও লজ্জা হতো। আর মার্কিনী বলে পরিচয় দিতে হচ্ছিল ঘৃণা —নিজেকে ওদের একজন বলে পরিচয় দিয়েই যন্ত্রণাকে লুকোছিলাম। সে যন্ত্রণা আমার মনের। আর ওরা কাতরাচ্ছিল শরীরের যন্ত্রণায় কামানের গোলা, বোমা, বুলেট শিশু নারী বৃদ্ধ কাউকে রেয়াত করেনি। মানুষকে মেরে ওদের উল্লাস দেখে রোজ শিউরে উঠেছি। আর খবর পাচ্ছিলাম কিভাবে ইজরায়েলের হয়ে গলা ফাটাচ্ছেন মহামতি বুশ — ইজরায়েলের প্রধানমন্ত্রী শ্যারণ তখন আত্মরক্ষাকারী মানুষগুলোকে বলছেন ‘সন্ত্রাসবাদী’ আর ‘সন্ত্রাসবাদ’ নিয়ে বুশ সাহেবের চেনা কীর্তন চলছে অষ্টপ্রহর। দুনিয়া শুনছে সেই কীর্তনের কলনাদ —চাপা পড়ে যাচ্ছে মানুষের কান্না তারপর চাপা পড়ে গেলাম আমি।’’
‘‘শ্যারণ তো বলেছিলেন ওরা নাকি আল কায়েদার মতোই সন্ত্রাসবাদী। তাই তার এ লড়াই মার্কিনী ধর্মযুদ্ধেরই অংশ। আর সে কারণেই বুশ সাহেব ছিলেন ওদের পাশে।’’
‘‘সেদিন আমার সামনে ছিলো বুলডোজার, সেটা তার আগে গুঁড়িয়ে দিয়েছে বহু দেওয়াল, মাড়িয়ে এসেছে বহু মানুষের দেহ। তার আগে গরিব বসতিগুলোতে নির্বিচারে ছোঁড়া হয়েছে গ্রেনেড। মানুষগুলো রক্তাক্ত, হাতে নেই কোনো অস্ত্র। আমি সে সময় এধরনেরই হতভাগ্য এক পরিবারের বিপন্ন আশ্রয়ের সামনে হাজির। শুনেছি ওদেরকেও সন্ত্রাসবাদী তকমা পরিয়ে তৃপ্ত হয়েছেন শ্যারণ আর বুশ। আমি তখন ওদের বাড়ির দরজায় দাঁড়িয়ে আছি। তারপর এগিয়ে এলো বুলডোজার পিষে ফেললো আমায় ....’’
‘‘এটা দুর্ঘটনা। অন্তত হৃদয়হীন সরকারী ভাষ্যে এটা একান্তই অনিচ্ছাকৃত ভুল। তুমি তো পালাতেও পারতে। তা না করে তুমি দাঁড়িয়ে পড়লে বুলডোজারের সামনে। এমন জায়গায় প্রতিরোধ গড়তে চাইলে যে জায়গা তোমার রাফা পৌঁছনোর অনেক আগেই ঘোষিত হয়েছে মিলিটারি জোন হিসাবে। আর তাই তো তোমার নামই সময় মুছে দেবে। তুমি কোনো পাঠ্যপুস্তকেও ঠাঁই পাবে না এটা তোমার দেশের শাসকদেরই হাজারো বিবেচনার উপসংহার।’’
‘‘তবে তাই হোক মুছে দাও আমার নাম ইতিহাস থেকে, মুছে দাও সভ্যতার প্রতিটি ইমারত। মাথা উঁচু করে বাঁচুক লাশের স্তূপ আর তার উপর উড়িয়ে দাও বর্বরতার ধ্বজা।’’
‘‘বর্বরতা শেষ কথা বলে না রাচেল। বললে ফ্রিটজকে বারবার বলতে হতো না আমার কথা। তুমি তো আমার সন্তান আমার চেতনার সন্তান। তোমার মা তো কাঁদেন না —বলেন তিনি আর সবাই দাঁড়িয়ে আছেন আজও নিষ্ঠুর সভ্যতার শত্রুদের বুলডোজারের সামনে। তোমাকে বুকে করে আজও বাঁচে কয়েকজন— আগামীদিনে ওদের সংখ্যা বাড়বে বাড়বেই। আর তখন ওরাই ছিঁড়ে ফেলবে বুশ সাহেবের সরকারী ইতিহাস। তোমার মা সিন্ডা দেবেন তোমার ডায়েরি তাদেরই হাতে তুলে। আর ওদের কণ্ঠেই বেঁচে থাকবো তুমি আর আমি আনা ফ্র্যাঙ্ক ও রাচেল কোরি।’’
সৌজন্যেঃ- গণশক্তি (সময়ের সাথে)
No comments:
Post a Comment