Thursday, October 25, 2012

র‌্যাচেল কেরি— নিষ্ঠুর বিচার



  র‌্যাচেল কেরি— নিষ্ঠুর বিচার  

     

বিক্রমজিৎ ভট্টাচার্য


র‌্যাচেল কেরি— একবিংশ শতাব্দীর প্রতিবাদের আরেক নাম। সাম্রাজ্যবাদী পেশিশক্তির বর্বরতম খুনের অন্যতম প্রতীক। ২০০৩ এর মার্চে মধ্যপ্রাচ্যের গাজা ভূখণ্ডে ইজরায়েলী সেনাবাহিনীর বুলডোজার পিষে মেরে ফেলেছি‍‌লো ২৪ বছর বয়সী মার্কিন যুবতী র‌্যাচেলকে। তার অপরাধ, প্যালেস্তা‍‌ইনের সমর্থনে গলা ফাটানো, গাজা ভূখণ্ডে ইজরায়েলী সরকারের আক্রমণে গৃহহীন অসহায় মানুষগুলোর পাশে সহমর্মিতায় দাঁড়িয়েছিলেন র‌্যাচেল। আন্দোলন করছিলেন, Inte

ation Solidarity Movement এর অন্যতম সদস্যা হিসেবে।

র‌্যাচেল এর মৃত্যুর পর তার পরিবার ইজরায়েলের আদালতে একটি মামলা দায়ের করেছিলেন, যাতে তাদের আইনজীবী পরিষ্কারভাবে র‌্যাচেলের মৃত্যুর জন্য ইজরায়েলী সেনাবাহিনীকে দায়ী করে তার বক্তব্য পেশ করেছিলেন। কিন্তু দীর্ঘ শুনানির শেষে ৯ বছর পরে আগস্ট ২০১২ তে ইজরায়েল এর ‍‌ডিস্ট্রিক্ট কোর্ট রায় দি‍লো ইজরায়েলী সেনাবাহিনীর স্বপক্ষেই। র‌্যাচেল এবং ISM -এর কর্মকাণ্ডকে বলা হলো, ‘বেআইনী, হটকারিতা’। পরিষ্কারভাবে বোঝা যায়, ইজরায়েলী সরকারের চাপে পড়ে কোর্টের এই একতরফা সিদ্ধান্ত। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলির চাপে বাধ্য হয়ে শেষপর্যন্ত তেল আভিভ-এ নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূতও বাধ্য হন বলতে ‘তদন্তে ত্রুটি ছিলো, আরও স্বচ্ছ্বতার প্রয়োজন ছিলো। অথচ র‌্যাচেল কিন্তু ছিলো মার্কিন নাগরিক। মার্কিনী রাষ্ট্রদূতের প্রতিক্রিয়াটি একেবারেই লঘু, কারণ মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ বিস্তারের অন্যতম দোসর হলো ইজরায়েল, ওবামার এক নম্বর ঘনিষ্ঠ সহযোগীও বটে।

র‌্যাচেলকে খুনের এই মামলাটি যাতে গুরুত্ব হারায়, সেটা করতে ইজরায়েল প্রশাসন চেষ্টার কোন ত্রুটি রাখেনি। প্রথমেই, যে চিকিৎসক র‌্যাচেলের মৃতদেহ পরীক্ষা করে মৃত্যুর কারণ সম্পর্কে সুনিশ্চিত রিপোর্ট দেন। সেই চিকিৎসকে আদালতে জবানবন্দী দেওয়ার ব‌্যাপারে সরকারী নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। এছাড়াও প্রত্যক্ষদর্শী কারোরই বক্তব্য কোর্টে গ্রাহ্য করা হয়নি। বিচারক ওতেত গারসন তার রায়দান প্রক্রিয়ার সময় স্পষ্ট ভাষায় বলেন, ‘এটি একটি দুর্ঘটনা, এরজন্য কোনভাবেই ইজরায়েলী প্রশাসন বা সেনাবাহিনীকে দায়ী করা যুক্তিযুক্ত নয়। র‌্যাচেল নিজে ইচ্ছে করেই বুলডোজারের সামনে এসেছিলেন, একজন দায়িত্ববান, সুস্থ মহিলা কখনই এমন কাজ করেন না’।

বিশ্বের সকল প্রগতিশীল প্রতিবাদী মানুষের কাছে এই রায়ের কোন মূল্য নেই এবং ইজরায়েলী প্রশাসন দ্বারা সম্পূর্ণরূপে নিয়ন্ত্রিত সে দেশের বিচার ব্যবস্থা সম্পর্কেও পৃথিবীর মানুষ অবহিত হওয়ার সুযোগ পেলেন।

বিচারক গারসন তার ৬২পাতার রায়ে ইজরায়েলী সেনাবাহিনীর বিন্দুমাত্রও কোন দোষত্রুটির কথা উল্লেখ করেননি অথচ প্রত্যক্ষদর্শীদের বয়ান অনুযায়ী ঘটনাটি ছিলো : ‘গাজা ভূখণ্ডে প্যালেস্তিনীয় সমর্থক জনৈক নাসারেল্লার বাড়িটিকে গুঁড়িয়ে দেওয়ার লক্ষ্যে এগিয়ে আস‍‌ছিলো ইজরায়েলী সেনাবাহিনীর বুলডোজারটি। র‌্যাচেল বাধাদান করতে এগিয়ে আসে একটি লাউডস্পিকার হাতে নিয়ে, আসেপাশে কিছু প্যালেস্তিনীয় সমর্থকও ছিলো। কিন্তু বুলডোজারের গতি কমেনি, বিন্দুমাত্র মানবিকতাবোধটিকেও দূরে সরিয়ে রেখে র‌্যাচেলকে প্রথম ধাক্কায় মাটিতে ফেলে তার ওপর দিয়ে চালিয়ে দেওয়া হয় প্রাণহন্তা যান্ত্রিক বস্তুটি। রীতিমতো আওয়াজ হয়ে ভেঙে যায় র‌্যাচেলের শরীরের সমস্ত হাড় ও তার মাথার খুলি।’

পৃথিবীর ইতিহাসে অন্যতম নারকীয় ও বর্বর হত্যাকাণ্ড। ইজরায়েল সরকারের নিয়ন্ত্রিত ‘পুতুল’ বিচারক ও তার বিচারসভা কোন কথাই শুনতে চায়নি।

র‌্যাচেলের মা কান্তি কেরি কো‍‌র্টের বাইরে এসে সাংবাদিকদের বলেন, ‘শুধু আমাদের পরিবারের জন্যই নয়, সারা পৃথিবীর মানবাধিকার রক্ষার ক্ষেত্রে এই রায় চূড়ান্ত হতাশাজনক এবং আজকের দিনটি মানবতা-বিরোধী দিন হিসেবেও চিহ্নিত হয়ে রইল।’ র‌্যাচেলের পক্ষে দাঁড়ানো আইনজীবী হুসেন আবু হুসেনের কথায়, ‘এই রায় আগামীদিনে ইজরায়েলী সেনাবাহিনীকে আরও উদ্বুদ্ধ করলো মানবাধিকার লঙ্ঘনের ক্ষেত্রে।’

গাজা ভূখণ্ডে ২০০০ সাল থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত চার বছরের মধ্যে মার্কিন মদতপুষ্ট ইজরায়েল সম্পূর্ণ অন্যায়ভাবে প্রায় ২৫০০ প্যালেস্তিনীয় সমর্থকের বাড়ি গুঁড়িয়ে দিয়েছে বুলডোজার দিয়ে। গৃহহীন হয়েছেন প্রায় পঁচিশ হাজার নিরপরাধ মানুষ এবং সবচেয়ে দুর্ভাগ্যজনক, পূর্ববর্তী কোন ঘোষণা ছাড়াই ধ্বংস করা হয়েছে গরিব মানুষের বাসস্থানগুলো। সাম্রাজ্যবাদী শক্তির এই নিষ্ঠুর আগ্রাসনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলো র‌্যাচেল। বিগত আট বছর ধরে চলতে থাকা র‌্যাচেল হত্যার এই বিচার প্রক্রিয়াটিতে ইজরায়েল কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রচ্ছন্ন মদত পেয়ে আসছে। প‌্যালেস্তাইনের ওপর আক্রমণের ধারও ক্রমাগত বাড়িয়ে চলেছে ইজরায়েল। নিশ্চুপ সারা পৃথিবীর স্বঘোষিত গণতন্ত্র ও মানবাধিকার রক্ষার পাহারাদার আমেরিকা।
সৌজন্যেঃ- গণশক্তি (সম​য়ের সাথে)


No comments:

Post a Comment