Saturday, October 27, 2012

দ্বিশত জন্মবর্ষে স্মরণ নবজাগরণ পর্বের এক জ্যোতিষ্ক রেভারেন্ড কৃষ্ণমোহন


কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায় (রামতনু লাহিড়ী ও তত্কালীন​ বঙ্গসমাজ’ গ্রন্থে প্রকাশিত)

                  

দ্বিশত জন্মবর্ষে স্মরণ
নবজাগরণ পর্বের এক জ্যোতিষ্ক রেভারেন্ড কৃষ্ণমোহন

সুকান্ত মুখোপাধ্যায়

রেভারেন্ড কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন ডিরোজিওর প্রিয় ছাত্র ও সেকালের ‘ইয়ং বেঙ্গল’ দলের একজন প্রধান সক্রিয় সদস্য। হিন্দু কলেজের প্রাক্তন এই ছাত্র মূলত ডিরোজিওর প্রভাবে কিশোর বয়স থেকেই প্রতিবাদী হিসাবে গড়ে উঠেছিলেন এবং আজীবন প্রতিবাদী চরিত্রেরই মানুষ ছিলেন ও হিন্দু ধর্মের যাবতীয় কৃসংস্কার ও গোঁড়ামির বিরুদ্ধে তাঁর ক্ষুরধার লেখনী ও বাগ্মীতা তাঁকে সে যুগে এক বিশিষ্ট মানুষরূপে চিহ্নিত করেছিল। এছাড়াও ডিরোজিওর সান্নিধ্যে এসে তাঁর জীবনের আর একটি দিক উন্মুক্ত হয় যেটি হলো জানবার ইচ্ছা বা জ্ঞানতৃষ্ণা। ‘‘দ্য রোজিও কদাচ বলেননি, তুমি নাস্তিক হও, উচ্ছৃঙ্খল হও। বরং বলেছেন তুমি জিজ্ঞাসু হও। উচ্চ নৈতিক আদর্শের উপর জীবনের প্রয়োজনবোধকে স্থাপন কর...।’’ ডিরোজিওর এই কথাগুলি তিনি তাঁর লেখায় লিখেছিলেন এবং সারা জীবন এই আদর্শকেই জীবনের পাথেয় করেছিলেন। তিনি একদিকে যেমন পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে উঠেছিলেন তেমনি নিজের চেষ্টায় ইংরেজি ছাড়াও হিন্দি, সংস্কৃত, ওড়িয়া, ফারসি, উর্দু, ল্যাটিন, গ্রিক ও হিব্রু প্রভৃতি দশটি ভাষা আয়ত্ত করেছিলেন, যদিও মাতৃভাষা বাংলাকে কখনও অবজ্ঞা করেননি এবং তিনিই প্রথম বাঙালি খ্রিস্টান ধর্মযাজক যিনি আজীবন বাংলা ভাষায় ধর্মোপদেশ দিতেন। গোঁড়া ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মে তাঁর খ্রিস্টান হওয়া নিয়ে সে যুগে তুমুল আলোড়ন উঠেছিল।

কৃষ্ণমোহনের জন্ম হয়েছিল ২৪শে মে ১৮১৩ সালে মামার বাড়িতে, উত্তর কলকাতার ঝামাপুকুরের বেচু চ্যাটার্জি স্ট্রিটের নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণ পরিবারে। মাতামহ রামজয় বিদ্যাভূষণ ছিলেন গোঁড়া ব্রাহ্মণ, জোড়াসাঁকোর জাঁদরেল জমিদার শান্তিরাম সিংহের সভাপণ্ডিত। কৃষ্ণমোহনের বাবা জীবনকৃষ্ণের আদিবাড়ি ছিল বর্তমান দক্ষিণ ২৪ পরগনার বারুইপুরের কাছে নবগ্রামে। রামজয় বিদ্যাভূষণের মেয়ে শ্রীমতি দেবীকে বিয়ে করে জীবনকৃষ্ণ কিছুদিন শ্বশুরবা‍‌ড়িতে থাকার পর কাছেই গুরুপ্রসাদ চৌধুরী লেনে বাড়ি করে উঠে যান। ভুবনমোহন, কৃষ্ণমোহন ও কালীচরণ তাঁর তিন ছেলে। কৃষ্ণমোহনের প্রাথমিক শিক্ষা বর্তমান ঠনঠনিয়া কালীবাড়ির কাছে ডেভিড হেয়ার সাহেবের ‘ক্যালকাটা স্কুল সোসাইটি’র এক ছোট্ট স্কুলে। এটি এখন আর নেই। ১৮২৪ সালে তিনি হিন্দু কলেজে ভর্তি হন এবং ১ নভেম্বর ১৮২৯-এ কলেজ থেকে পাশ করে হেয়ার সাহেবের স্কুলেই শিক্ষকতা শুরু করেন। হাওড়ার শিবপুরের রাধারমণ চট্টোপাধ্যায়ের কন্যা বিন্দুবাসিনীর সঙ্গে ১৮২৯-এ তাঁর বিয়ে হয়।

হিন্দু কলেজে পড়ার সময় থেকেই ডিরোজিওর সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতা জন্মায় এবং ডিরোজিওর বাড়িতে যাতায়াত শুরু হয়। স্কটিশ মিশনারী আলেকজান্ডার ডাফ ১৮৩০-এ কলকাতায় এলেন, কিছুদিন পরে এলেন ইংল্যান্ডের ওল্ড মিশন চার্চের যাজক আর্চডিকন ডিয়ালট্রি। দু’জনের সঙ্গেই কৃষ্ণমোহনের ঘনিষ্ঠতা গড়ে ওঠে এবং তিনি পাশ্চাত্য শিক্ষার সুফলের দিকটি সম্পর্কে আগ্রহী হয়ে ওঠেন।

মাত্র ১৮ বছর বয়সে ১৭ই মে ১৮৩১ সালে কৃষ্ণমোহন প্রকাশ করেন ‘নব্যদল’-এর মুখপত্র সাপ্তাহিক পত্রিকা “The Inquirer” যার লক্ষ্য ছিল তাঁর ভাষায় “Having thus launched our back under the denomination of Enquires we set sail in quest of truth and happiness.”। জে নটরাজনের লেখা ‘History of Indian Jou

alism’ গ্রন্থে ১৮৩১ সালে সরকারী অনুমোদন প্রাপ্ত ১২টি পত্রিকার তালিকায় ‘দ্য এনকোয়ারার’-এর উল্লেখ পাওয়া যায়। সেই সময় ‘দ্য এনকোয়ারার’ পত্রিকার গ্রাহক সংখ্যা ছিল ২০০। প্রথম সংখ্যা প্রকাশের পরই তত্কালীন পত্রিকা ‘সম্বাদ কৌমুদী’ এই উদ্যোগকে সাধুবাদ জানিয়ে ‍‌লিখেছিল ‘‘গত ১৭ই মে অবধি ইনকোয়েরের নাম ইংলন্ডীয় ভাষায় সম্বাদপত্র এতদ্দেশীয়-সু-শিক্ষিত অল্প বয়স্কদের দ্বারা প্রকাশারম্ভ হইয়াছে, তন্মধ্যে শ্রীযুক্ত কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায় প্রধান সম্পাদক হন ত
ত্পত্রের ভূমিকার শেষভাগ অবলোকনে আমরা বোধ করিলাম যে পত্রের প্রথমভাগের লিখিত সম্পাদকের স্বীয় উক্তি ব্যতীত প্রায় সমুদয় তত্প​ত্রস্থিত বক্তৃতা এতদ্দেশীয় হিন্দু বালকদের দ্বারা রচিত হইয়াছে এবং রচরেকদের বয়ঃক্রমে চতুর্দ্দশ বা পঞ্চদশ বত্সরের ঊর্ধ্বে নহে ইহাতে আমরা অবশ্যই আহ্লাদিত হইলাম এবং তাহাদের এতাবত্ অল্প বয়সে যে এরূপ বিদ্যা জন্মিয়াছে ইহাতে বিশেষ অনুরাগ করিলাম’’। রক্ষণশীল হিন্দু সমাজ কিন্তু ‘দ্য এনকোয়ারার’-কে ভালো চোখে নেয়নি কারণ হিন্দুধর্মের যাবতীয় কু-প্রথার ওপর লেখা ছাপা হত এই পত্রিকায়। অন্যান্য পত্র পত্রিকায় সম্পাদক ও লেখককুলের প্রতি বিদ্বেষ ও গালিবর্ষণ শুরু হলো অচিরেই। অবশ্য পত্রিকাটি বেশিদিন চলেনি, ১৮৩৫-এর ১৮ই জুন পর্যন্ত চলেছিল কিন্তু ওই ক’বছরেই সতীদাহ নিবারণ, বহুবিবাহ, পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রচার ও প্রসার বিষয়ে অনেকগুলি গুরুত্বপূর্ণ লেখা প্রকাশিত হয়েছিল ওই পত্রিকায়। বহুবিবাহ প্রথা নিয়ে কৃষ্ণমোহন নিজে এক প্রবন্ধ লিখেছিলেন।সেখানে লেখা ছিল “That marriage is looked upon as traffic by the cool in Brahmins, is an evil, the existence of which can not denied. Many, many poor creatures have suffered keenly from this, and if we but consider the enormity of the crime, we cannot entertain any doubts about the course we, as members of society should pursue with respect to persons that recklessly marry a number of wives without fixing their affections on any.”

১৮৩১ সালের ২৩শে আগস্ট কৃষ্ণমোহনের অনুপস্থিতিতে তাঁর মামার বাড়িতে কয়েকজন বন্ধু রুটি ও গো-মাংস খেয়ে উচ্ছিষ্ট মাংসের হাড় প্রতিবেশীর বাড়িতে ফেলে দিয়ে ‘ঐ গো-হাড়, গো-হাড়’ বলে চিৎকার করতে থাকেন। সন্ধ্যেবেলা কৃষ্ণমোহন ঘরে ফিরে দেখেন বাড়িতে তুমুল গণ্ডগোল, গোটা পাড়া ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছে, দাদু রামজয় বিদ্যাভূষণও ক্ষিপ্ত। বন্ধুদের এই দুষ্কর্মের কারণে কৃষ্ণমোহন তাঁর মামার বাড়ি থেকে বিতাড়িত হন। বিতাড়িত হয়ে তিনি সাময়িক আশ্রয় নিলেন বন্ধু দক্ষিণারঞ্জনের বাড়িতে কিন্তু সেখানেও ঠাঁই না হওয়ায় শেষে চৌরঙ্গি অঞ্চলে এক ইংরেজ বন্ধুর বাড়িতে আশ্রয় পেলেন। এই ঘটনা সম্পর্কে কৃষ্ণমোহন নিজে তাঁর পত্রিকায় লিখেছিলেন “Persecution has burst upon us so vehemently, that on Wednesday last at 12 o’clock we were left without a roof to cover our head ….. If our readers conceive the difficulties we were placed in without a house to lodge in expecting nothing but the rage of bigots and foes, and suffering the greatest hardships for the sake of truth and liberation, they will undoubtedly excuse our present defects.

ইংরেজ বন্ধুর বাড়িতে বসে এর মধ্যে তিনি লিখে ফেললেন পঞ্চাঙ্কের এক নাটক ‘The Persecuted’ , বাঙালির লেখা প্রথম প্রতিবাদী ইংরেজি নাটক যেটি প্রকাশিত হয়েছিল ১৮৩১ সালের নম্বের মাসে। নাটকটি প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গেই গোটা সমাজে এক অভূতপূর্ব সাড়া ফেলে দিয়েছিল। এর ঠিক এক বছর আগে ১৯৩০ সালে হিন্দু কলেজেরই আর এক কৃতী ছাত্র কাশীপ্রসাদ ঘোষ প্রথম বাঙালি হিসেবে প্রকাশ করেছিলেন বাঙালীর লেখা প্রথম ইংরাজী কাব্যগ্রন্থ ‘The Shair and other Poems’। প্রসঙ্গত ৫ই আগস্ট ২০০৯ সালে তাঁরও জন্মের দ্বি-শতবর্ষ পার হয়ে গেছে কিন্তু তিনি আজও বাঙালী সমাজে উপেক্ষিত থেকে গেছেন, অনেকে তাঁর নামই জানেন না।

হিন্দু সমাজে তুমুল আলোড়ন সৃষ্টি হলো যখন ১৬ই অক্টোবর ১৮৩২ সালে আলেকজান্ডার ডাফের কাছে কৃষ্ণমোহন খ্রিস্টধর্মে দীক্ষা নিয়ে ‘খ্রিস্টান’ হলেন। দীক্ষাগ্রহণের বিষয়ে তিনি তাঁর এক বন্ধুকে লিখেছিলেন “I intend being baptised this evening at the house of Rev.A.Duff.”

খ্রিস্টান কৃষ্ণমোহনের সঙ্গে শ্বশুরবাড়ির সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে গেল। তাঁর স্ত্রীকে শ্বশুরমশাই হাওড়ায় নিজের বাড়িতে নিয়ে চলে এলেন। প্রতিবাদী কৃষ্ণমোহন এতে দমে না গিয়ে হাওড়া কোর্টে মামলা দায়ের করলেন এবং স্ত্রী তাঁর পক্ষে থাকায় কঠিন পরিশ্রমে মামলায় জিতে আবার স্ত্রীকে নিয়ে এলেন নিজের কাছে। ১৮৩৬ সালে কৃষ্ণমোহন নিজের স্ত্রী ও ছোটভাই কালীচরণকে খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত করান। পাথুরিয়াঘাটার জমিদার প্রসন্নকুমার ঠাকুরের পুত্র জ্ঞানেন্দ্রমোহনকেও তিনি খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত করেন ও পরে ১৮৫১ সালে নিজের মেয়ে কমলমণির সঙ্গে তাঁর বিয়ে দেন। মাইকেল মধুসূদনের খ্রীস্টান হওয়ার পিছনে তাঁর প্রভাব ছিল। এখন যেখানে প্রেসিডেন্সি কলেজ সেই জায়গায় ১৮৩৮ সালে তিনি যখন এক গির্জা স্থাপনের উদ্যোগ নেন, এবং তৎকালীন বিশপকে দিয়ে তার শিলান্যাসও করান তখন আবার বিতর্ক শুরু হয়। এবার কিন্তু প্রতিবাদ এল সমাজের অন্য দিক থেকে। বহু গণ্যমান্য ইংরেজের সঙ্গে স্বয়ং ডেভিড হেয়ার এই চার্চ স্থাপনের বিরোধিতা করলেন। তাঁদের আশঙ্কা অমূলক ছিল না কারণ কাছাকাছি দু’টি কলেজ ছিল — হিন্দু কলেজ ও মেডিক্যাল কলেজ। চার্চ স্থাপিত হলে ছাত্ররা খ্রিস্টধর্মের দিকে প্রভাবিত হতে পারে এই আশঙ্কা তাঁদের ছিল। বাধ্য হয়ে কৃষ্ণমোহন সিদ্ধান্ত বদল করে হেদুয়ার কাছে ১৮৩৯ সালে নিজস্ব ‘ক্রাইস্ট চার্চ’ স্থাপন করেন এবং ১৩ বছর এখানে আচার্যের পদে অধিষ্ঠিত থেকে বাংলা ভাষায় খ্রিস্টধর্ম প্রচার করেন। চার্চ স্থাপনের সময় কবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত ব্যঙ্গ করে ছড়া লিখেছিলেন ‘‘হেদোর এঁদো জলে কেউ যেও না তায়, কৃষ্ণবন্দো জটে বুড়ি শিকলি দেবে পায়’’।

১৮৫২ সালে তিনি হাওড়ার বিশপস্‌ কলেজে অধ্যাপনার কাজে নিযুক্ত হন, সেখানে তিনি এক সময় ছাত্র ছিলেন। এজন্য তিনি শিবপুরে থাকতে আরম্ভ করেন। ছাত্রদরদী কৃষ্ণমোহন গরিব ছাত্রদের সাহায্য করার জন্য কলেজে ৮০০ টাকা দান করেছিলেন। ১৮৬৮ সাল পর্যন্ত ওই কলেজে পড়িয়েছেন। ওই বছরেই তাঁর স্ত্রী বিয়োগ ঘটে।

সংস্কারমুক্ত বিদগ্ধ পণ্ডিত মানুষ কৃষ্ণমোহন সমাজে কিভাবে সাধারণ মানুষের সঙ্গে মিশতেন তার একটি খণ্ডচিত্র ধরা আছে শিবপুরের বাসিন্দা বসন্তকুমার পালের লেখা ‘স্মৃতির অর্ঘ্য (প্রকাশ কাল ১৩৪৬ বঙ্গাব্দ) বইটিতে। বসন্তকুমার লিখেছেন ‘‘নিমাইচাঁদ পাল আমার পিতামহ, তিনি বিশপস্‌ কলেজে কাজ করিতেন... শুনিয়াছি তখনকার পাদ্রীরা এ দেশের বাঙালিদের সঙ্গে বেশ মেলামেশা করিতেন। রেভাঃ কে এম ব্যানার্জি (কৃষ্ণ বন্দো) প্রভৃতি সাহেবেরা আমোদ করে প্রত্যেক বত্সর​ আমাদের বাড়িতে অরন্ধনের দিন ‘পান্তাভাত’ ও পৌষ পার্বণের দিন ‘পিঠেভাত’ খাইতে আসিতেন ও আমাদের তখনকার মেটে দাওয়ায় পিঁড়ির উপর বসে সনাতন কদলিপত্রে সেইসব খাইতে কুণ্ঠিত হইতেন না। বড়দিনের সময় আমাদের বাড়ির প্রেরিত নপো ময়রার খেজুরের গুড়ের চাঁপাতক্তির আদর কৃষ্টমাস কেকের চেয়ে বড় কম ছিল না।’’

দীর্ঘ কর্মজীবনে কৃষ্ণমোহন অনেকগুলি পত্রিকা সম্পাদনা করেছিলেন এবং কয়েকটি মূল্যবান বই লিখেছিলেন। তাঁর সম্পাদিত পত্রিকাগুলির মধ্যে ছিল ‘হিন্দু ইউথ’ (১৮৩১), ‘গভর্নমেন্ট গেজেট’ (১৮৪০), ‘সংবাদ সুধাসিন্ধু’ (১৮৫০), ‘বেঙ্গল স্পেকটেটর’ প্রভৃতি। ‘ক্যালকাটা রিভিউ’, ‘মুখার্জিস ম্যাগাজিন’, ‘ক্যালকাটা ইনটেলিজেন্সার’ প্রভৃতি পত্রিকায় লিখেছেন অসংখ্য মূল্যবান প্রবন্ধ। ১৮৪৬-৫১ সময়কালের মধ্যে তিনি লিখেছিলেন ১৩ খণ্ডের বাংলা ইংরেজি দ্বিভাষিক বিশ্বকোষ ‘বিদ্যাকল্পদ্রুম’ যেটি তাঁর সর্বশ্রেষ্ঠ রচনা বলে পরিচিত। তার আগে এই ধরনের কাজ বাংলা ভাষায় আর হয়নি।

তাঁর লেখা অন্যান্য বইগুলির মধ্যে আছে ‘উপদেশমালা’ (১৮৪০), ‘Dialogues on the Hindu Philosophy’ (১৮৬১) ‘ষড়দর্শন সংবাদ’ (১৮৬৭), ‘দ্য এরিয়ান উইটনেস’ (১৮৫৭), কালিদাসের ‘রঘুবংশম’ ও ‘কুমার-সম্ভবম’-এর ইংরেজি ব্যাখ্যা। ‘সাধারণ জ্ঞানোপার্জ্জিকা সভা’, ‘ভারত সংস্কার সভা’, ‘বঙ্গীয় সমাজ বিজ্ঞান সভা’, ‘স্কুল বুক সোসাইটি’, ‘ইন্ডিয়ান লিগ’, ‘ভারতসভা’ প্রভৃতি নানা প্রতিষ্ঠানের তিনি ছিলেন সক্রিয় সদস্য, এছাড়া কলকাতা কর্পোরেশনের নির্বাচিত প্রতিনিধিও হয়েছিলেন। প্রতিবাদী কৃষ্ণমোহন নানা সময়ে তদানীন্তন ব্রিটিশ সরকারের নানা দমনমূলক কাজের ও নীতির তীব্র প্রতিবাদ করেছেন। ১৮৭৮ সালের ১৭ই এপ্রিল কলকাতার টাউন হলে - Ve

acular Press Act. Drama Act ও Arms Act. এর বিরুদ্ধে ‘ভারতসভা’ আয়োজিত বিশাল এক জনসভায় সভাপতির ভাষণে তিনি এই আইনগুলির তীব্র প্রতিবাদ করে তাঁর ভাষণে বলেছিলেন, ‘Dare Gove

ment Prosecute us’ আবার ১৮৮১ সালের ১৯শে এপ্রিল কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের হলে বেথুন সোসাইটি আয়োজিত এক সভায় এর উল্টো চিত্রটি দেখা যায়। কিশোর রবীন্দ্রনাথ গান সম্পর্কে তাঁর জীবনের প্রথম বক্তৃতাটি দেন এই সভায়। বক্তৃতার সিংহভাগ জুড়েই ছিল কিশোর রবীন্দ্রনাথের স্ব-কণ্ঠে গাওয়া টুকরো কিছু গানের অংশ। সভার সভাপতি কৃষ্ণমোহন সে গান শুনে তাঁর উচ্ছসিত ভাষণে ‘বন্দে বাল্মীকি কোকিলং’ বলে নবীন কবিকে সেদিন সাধুবাদ জানিয়েছিলেন। দীর্ঘ কর্মজীবনে কৃষ্ণমোহন বহু সম্মান পেয়েছিলেন। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ১৮৫৫ সালে পাওয়া ‘কমান্ডার অব দ্য ইন্ডিয়ান এম্পায়ার’, ১৮৬৪ সালে একই সঙ্গে তাঁর ও ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের লন্ডনের রয়‌্যাল এশিয়াটিক সোসাইটির সদস্য পদ পাওয়া এবং ১৮৭৬ খ্রিস্টাব্দের মার্চ মাসে মনিয়র ইউলিয়ামস ও রাজা রাজেন্দ্রলাল মিত্রর সঙ্গে একই মঞ্চে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক সাম্মানিক ‘Doctor of Law’ উপাধি লাভ। উপাধি তাঁর হাতে তুলে দেবার সময় তৎকালীন উপাচার্য আর্থার হবহাউস কৃষ্ণমোহনের সম্পর্কে বলেছিলেন “He too, has laboured long, honourably and successfully at the literature of his country”।

১৮৮৫ সালের ১১ই মে কলকাতার ৭নং চৌরঙ্গী লেনের বাসভবনে কৃষ্ণমোহনের মৃত্যু হয়। মরদেহ শিবপুরে এনে বিশপস্‌ কলেজের অভ্যন্তরের কবরখানায় সমাহিত করা হয়। তাঁর স্মৃতিফলকটি সেখানে আজও বিদ্যমান। কৃষ্ণমোহনের কোনো পূর্ণাঙ্গ জীবনী গ্রন্থ বা তাঁর লেখা বইগুলি আজ দুর্লভ অথচ ১৮৩০-১৮৮৪ এই সুদীর্ঘ সময়কালে তিনি শিক্ষাবিস্তার ছাড়াও বহু সমাজ সংস্কারমূলক কাজে লিপ্ত ছিলেন।

কৃষ্ণমোহনের প্রথম জীবনী সম্ভবত লেখা হয়েছিলো ১৮৪২ সালের অক্টোবর মাসে ‘ইন্ডিয়া রিভিউ’ পত্রিকায় যেখানে লেখা হয় হিন্দু ধর্মের সমুদয় রীতিনীতির বিরুদ্ধে আন্দোলন চালানো হতো বলে রক্ষণশীল হিন্দু সমাজ তাঁর কাগজের ওপর ভীষণ খাপ্পা ছিলেন। তাঁর বিস্তারিত জীবনী লিখেছিলেন রামগোপাল সান্যাল ১৮৯৩ সালে এবং ৭০ পাতার এই জীবনীতে তিনি লিখেছিলেন কৃষ্ণমোহন তাঁর সময়ের চেয়ে চিন্তা ভাবনায় অনেক এগিয়ে ছিলেন। ১৯২৯ সালে Bengal Past and Present পত্রিকায় ৩৭ ও ৩৮নং সংখ্যায় (Jan-June ও July-Dec) তাঁর একটি অসাধারণ জীবনী লিখেছিলেন হরিদাস দাস মহাশয় যিনি তরু দত্তের প্রথম জীবনীকার ছিলেন। এছাড়া ২৫শে জানুয়ারি ১৯০৪ সালে প্রকাশিত শিবনাথ শাস্ত্রী মহাশয়ের লেখা ‘‘রামতনু লাহিড়ী ও তত্কালীন​ বঙ্গসমাজ’ গ্রন্থেও কৃষ্ণমোহন সম্পর্কে আলোচনা আছে যদিও সন তারিখের কিছু গোলমাল লক্ষ্য করা যায়। কৃষ্ণমোহনের লেখা ‘পারসিকিউটেড’ নাটকটি উদ্ধার করা গেছে এবং সম্প্রতি ‘ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন’-এর উদ্যোগে এটি অভিনীতও হয়েছে। কৃষ্ণমোহনের মাত্র দু’টি ছবির সন্ধান বর্তমান লেখকের গোচরে এসেছে, একটি বই প্রবন্ধে ছাপা হলো আর একটি কোলসওয়ার্দি গ্রান্ট (১৮১৩-১৮৮০)-এর আঁকা স্কেচ যেটি প্রথম ছাপা হয় ‘অ্যাংলো ইন্ডিয়ান ডোমেস্টিক স্কেচ’ গ্রন্থে, ১৮৪৯ সালে, পরে এটি মন্মথনাথ ঘোষের লেখা কিশোরীমোহন মিত্রের জীবনী গ্রন্থ ছাপা হয়েছিল। আর পাওয়া যায় তাঁর লেখা Dialogues of the Hindu বইটি। কিন্তু তাঁর লেখা অন্যান্য গ্রন্থগুলি ও চিঠিপত্র উদ্ধার করা প্রয়োজন, তাঁকে নিয়ে আলোচনাও হওয়া প্রয়োজন, না হলে কৃষ্ণমোহন আমাদের কাছে অধরাই থেকে যাবেন।


সৌজন্যেঃ- গণশক্তি (সম​য়ের সাথে)

No comments:

Post a Comment